ছবি: সুমন চৌধুরী।
না হ্, কুড়ি টাকার শোকটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না কিরু। মস্ত আহম্মকি হয়েছে সে দিন। কিছু না হোক, কুড়ি টাকায় হরিদার ‘রোল কর্নার’ থেকে আস্ত একটা এগরোল তো খাওয়া যেত! কিন্তু মাটন বিরিয়ানি, চিকেন চাপ, মুগমোহন, রাজভোগ, নলেনগুড়ের সন্দেশের কথা ভেবে সে দিন এগরোলটা স্যাক্রিফাইস করেছিল কিরু। পেটে খিদে ছিল খুব; বিশেষ করে গাড়ি ঠেলে খিদেটা পেটের মধ্যে যেন জগঝম্প লাফ দিচ্ছিল। তবু মুনি-ঋষিদের মতো আত্মসংযম দেখিয়ে কিরু বলেছিল— ছিঃ ছিঃ জ্যাঠামশাই, এই সামান্য কাজ করে আপনার কাছ থেকে পয়সা নেব; আমি কি আপনার পর!
হরিমোহনবাবু বিগলিত হেসে বলেছিলেন, সে তো বটেই সে তো বটেই! তা ইয়ে বাবা, তোমার নামটা যেন কী? কিরু ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে বলেছিল, আজ্ঞে কিঙ্কর; কিরু বললেই সবাই চিনবে।
ও আচ্ছা আচ্ছা! বলেছিলেন হরিমোহনবাবু।
আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে, ওই রাস্তা দিয়ে উত্তর দিকে একটু গেলেই আমাদের বাড়ি; হলুদ রঙের একতলা বাড়ি। আমরা এক রকম আপনার প্রতিবেশীই বলতে পারেন।
বাহ্, বেশ বেশ!
কোনও দরকার হলেই বলবেন জ্যাঠামশাই; নিজের লোক মনে করে বলবেন; কোনও সংকোচ করবেন না।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!
বলে, গাড়িতে উঠে পড়েছিলেন হরিমোহনবাবু।
হরিমোহনবাবু কিছু দিন হল বাড়ি করে এসেছেন কিরুদের পাড়ায়। বিশাল বাড়ি। পেল্লায় বড়লোক নাকি! কিছু দিন পরেই শোনা গেল হরিবাবুর মেয়ের বিয়ে। সেই বিয়েতে এলাহি আয়োজন। তা বিয়েতে পাড়ার অনেকেরই নেমন্তন্ন হচ্ছে। যাদের সঙ্গে কোনও না কোনও সূত্রে আলাপ পরিচয় হয়েছে হরিবাবুর। এই যেমন হাবুলকাকা। হাবুলকাকার সঙ্গে সেলুনে আলাপ। চুল কাটানোর পর খুচরো নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। হরিবাবুর পার্সে সব পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট। হাবুলকাকা বড় নোট ভাঙিয়ে দিয়ে সমস্যার সমাধান করলেন। তার পর বল্টু ঘোষ। হরিবাবুর বাজারের শখ। নিজের হাতে দেখেশুনে বাজার করতে ভালবাসেন। তা এক দিন বাজারের মোড়ে খ্যাপা ষাঁড় তাড়া করেছিল হরিমোহনবাবুকে। ব্যায়ামবীর বল্টু ঘোষ রুখে দিয়েছিল ষাঁড়টাকে। বল্টু ঘোষ তাই সপরিবারে নিমন্ত্রিত।
কিরু তক্কে তক্কে থেকেছে। হরিমোহনবাবু যখন বাজারে গেছেন দূর থেকে লক্ষ রেখেছে। কিন্তু পাগলা ষাঁড় দূর অস্ত্ একটা ছাগলছানাও গুঁতোতে আসেনি তাঁকে। এমনকী এক দিন হরিমোহনবাবুকে পাড়ার ‘কেশশ্রী’ সেলুনে ঢুকতে দেখে ঝোঁকের মাথায় ঢুকে পড়েছিল সেলুনে। সেলুনওলা কিরুকে দেখে বলল, কী হে ছোকরা, এই তো পরশুই চুল কেটে গেলে, আজ আবার কী করতে?
কিরু একটু আমতা আমতা করে বলল, না মানে ঠিক চুল নয়...!
তা হলে কি দাড়ি?
পাশ থেকে বলে উঠল একটা খদ্দের। বাকিরা হেসে উঠল হো হো করে। কিরু পালিয়ে এল তাড়াতাড়ি।
শেষ কালে এক দিন মুখ তুলে তাকালেন ভগবান। জোড়া বটতলার মোড়ে গাড়ি খারাপ হয়ে গেল হরিমোহনবাবুর। এমনই শুভযোগ, কিরু সেই সময় একেবারে অকুস্থলে। গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভার আর হরিমোহনবাবু অসহায় চোখে এ দিক ও দিক তাকাচ্ছেন। কিরু এগিয়ে গিয়ে বলল, কী হয়েছে?
ড্রাইভার বলল, গাড়ি খারাপ হো গয়ি হ্যায়; ইসকো ধাক্কা দেনা হুগা।
কিরু বলল, ঠিক হ্যায়, আমি ধাক্কা দিতা হ্যায়।
হরিমোহনবাবু বললেন, বাবা তুমি বাচ্চা ছেলে; পারবে?
কিরু উত্তেজিত ভাবে বলল, নিশ্চয়ই জ্যাঠামশাই, আমি অ্যায়সা ঠ্যালেগা যে...!
তা ঠেলল বটে কিরু। ‘হেঁইয়ো’ বলে কোমর বেঁধে এমন ঠেলল যে গাড়ি গড়গড় করে গড়িয়ে গিয়ে স্টার্ট নিয়ে নিল। মুখে হাসি ফুটল হরিমোহনবাবুর। পার্স থেকে কুড়ি টাকার একটা নোট বের করে দিতে গেলেন কিরুকে। কিরু তৎক্ষণাৎ জিভ কেটে বলল, ছিঃ ছিঃ জ্যাঠামশাই; এই সামান্য কাজ করে পয়সা নেব আপনার কাছ থেকে! আমি কি আপনার পর?
তার পর থেকে বড় আশায় দিন গুনেছে কিরু। এই বুঝি বাড়িতে এলেন হরিমোহনবাবু; হাতে নিমন্ত্রণপত্র; কিরুকে দিয়ে বলছেন, বাবা কিঙ্কর, তুমি কিন্তু ওই দিন মনে করে অবশ্যই...। কিরু বলছে, নিশ্চয়ই জ্যাঠামশাই, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, আমি ঠিক...।
কিন্তু একটা একটা করে দিন চলে গেছে; হরিমোহনবাবু আসেননি। দেখতে দেখতে বিয়ের দিনও এসে গেল। কিরুর মনে হয়েছে, হরিবাবুর হয়তো কিরুর নামটাই মনে নেই। সেটাই স্বাভাবিক, এক বার মাত্র শুনেছিলেন; আর পাড়ার একতলা হলদে বাড়ি তো একটা নেই; তাই ইচ্ছা থাকলেও নেমন্তন্ন করতে পারেননি কিরুকে।
কিরু তাই সন্ধেবেলা নতুন জামাপ্যান্ট পরে চুলটুল আঁচড়ে চলে এসেছে ‘আশীর্বাদ’ ম্যারেজ হলে। এখানেই তো হচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠান। কিরু নিশ্চিত, তাকে ঠিক চিনতে পারবেন হরিমোহনবাবু এবং খাইয়ে তবে ছাড়বেন।
সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গেটের মুখেই দাঁড়িয়ে আছেন হরিমোহনবাবু। যারা আসছে প্রত্যেককে জোড় হাত করে আপ্যায়ন করছেন। কিরুকে দেখেই বেশ ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বললেন, বাবা তুমি এসেছ; খুব খুশি হয়েছি আমি; ভাবিনি তুমি আসতে পারবে! তোমার বাবা গণেশ আমার ছোটভাইয়ের মতো ছিল; আহা, সে যে এমন অসময়ে চলে যাবে...! খবরটা শুনে বড় দুঃখ পেয়েছিলাম আমি। আহা, বড় ভাল ছেলে ছিল গণেশ।
কিরু বুঝল, তাকে চিনতে পারেননি হরিমোহনবাবু। না চিনুক; নাহয় সে আজ গণেশের ছেলে হয়েই পেট পুরে খেল। গন্ধ তো ছাড়ছে জব্বর। উহ্, সাঁটিয়ে খাবে বলে, বিকেল থেকে কিচ্ছুটি খায়নি কিরু।
হরিমোহনবাবু বললেন, এসো, তোমার জ্যাঠাইমার সঙ্গে দেখা করবে চলো; সে-ও বড় আনন্দ পাবে তোমাকে দেখে।
হরিমোহনবাবু কিরুকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ভেতরে; এক মহিলাকে ডেকে বললেন, এই দেখো, কে এসেছে; আমাদের গণেশের ছেলে।
মহিলা বললেন, ওমা তাই! আহা, এতটুকু ছেলে, এই বয়েসে বাবা চলে যাওয়া... আহা রে! তা তোমার মা মিনু কেমন আছে?
কিরু দেখল গণেশের ছেলে যখন সে আজ হয়েই গেছে, মিনুকে না হয় মায়ের আসন দিল। তার খাওয়া নিয়ে কথা! সে বলল, আছে এক রকম; বাবার শোকে একটু রোগা হয়ে গেছে।
যাবেই তো; যাবেই তো! আহা, বড় ভাল মেয়ে আমাদের মিনু! তুমি কিন্তু মায়ের দিকে নজর দিয়ো; একমাত্র ছেলে তুমি, তোমার দায়িত্ব অনেক।
বটেই তো জ্যাঠাইমা! কিরু বলে, সব সময় নজর দিই মায়ের দিকে।
হরিমোহনবাবু বললেন, তা বাবা, মুখাগ্নি তো শুনলাম তুমিই করেছ; আর এক বছর তো এখনও হয়নি; তা তোমার তো বিয়ে বাড়ির খাওয়াদাওয়া চলবে না। তুমি বরং এক কাজ করো— শরবত খাও, শরবতে দোষ নেই।
কিরু বলতে গেল, না, মানে, ইয়ে জ্যাঠামশাই...।
হরিমোহনবাবু বললেন, তুমি যে এসেছ তাতেই আমার প্রাণটা ভরে গেছে বাবা। আহা, গণেশের কথা মনে পড়লে এখন...! তুমি বাবা শরবতটা খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো; মা তোমার চিন্তা করবে না হলে।
কিছু বলতে পারল না কিরু। সুখাদ্যের নানা রকম মাতামাতি গন্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে শুনল, হরিমোহনবাবু কাকে যেন বলছেন, এই, একে এক গ্লাস শরবত দে তো!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy