Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
False Research Works

বিজ্ঞানে তথ্যের কারচুপি করেছেন বহু নামীদামিই

দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এই গোলমালে আছেন বহু কিংবদন্তি এবং নোবেলজয়ী কেউ কেউও। সুবিধামতো পরিবর্তিত ডেটা কিংবা কাল্পনিক পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে তৈরি করেছেন গবেষণাপত্র।

সত্যসন্ধানী: ইমেজ ডিটেকটিভ অলিজ়াবেথ বিক বর্তমানে ইাঁস করেছেন বহু ভ্রান্তির পর্দা।

সত্যসন্ধানী: ইমেজ ডিটেকটিভ অলিজ়াবেথ বিক বর্তমানে ইাঁস করেছেন বহু ভ্রান্তির পর্দা।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৫:২৩
Share: Save:

এক দিকে প্রতারক, অন্য ধারে ডাকসাইটে গোয়েন্দা, টম-আর-জেরির এই খেলার মধ্যে উপচে পড়ে থ্রিল। প্রতারণাটা বিজ্ঞানের দুনিয়ায় হলেও তার থ্রিল কিছু কম নয়। সময়বিশেষে সাধারণ জনতাও তা উপভোগ করে চেটেপুটে।

‘ডেটা’ কিংবা তথ্যের যথার্থতা নিয়ে হইচই হয় মাঝেমধ্যেই। বিভিন্ন সমাজেই হয়। তবে সে সব তথ্যের সঙ্গে সাধারণত জনগণের দিনযাপনের রসায়ন নিবিড়। যেমন, জিডিপি, মূল্যবৃদ্ধি, কোভিডে সংক্রমণ, মৃত্যু কিংবা কাজ-হারানোর সংখ্যা। এর বিপ্রতীপে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুনিয়া। আপাত ভাবে নেহাতই নীরস, যাকে নিংড়ে জীবন-রস খুঁজে পাওয়া কঠিন। তা বলে সে দুনিয়ার খরগোশের গর্ত গলে ঢুকে পড়লে যে প্রতারণার জমজমাট গল্প মিলবে না, তেমনটা ভাবারও কোনও কারণ নেই। সেই প্রবঞ্চনাগুলোও বেশ জটিল এবং আকর্ষণীয়। এ নিয়ে গোয়েন্দাগিরিও চলে। আর প্রতারক-গোয়েন্দার চোর-পুলিশ খেলা সব সময়ই তৈরি করে গভীর আগ্রহ ও কৌতূহল।

গবেষণার তথ্য-সংক্রান্ত এমনই দু’টি জবরদস্ত প্রতারণার ঘটনা সম্প্রতি শোরগোল ফেলেছে মার্কিন সমাজেও। এর একটায় আবার জড়িত এক সাম্প্রতিক নোবেল-বিজয়ী। জনস হপকিন্সের অধ্যাপক এবং ২০১৯-এ চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেলপ্রাপক গ্রেগ সেমেঞ্জা। ইতিমধ্যেই যাঁর দশ-দশটা ছাপা-হওয়া গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট জার্নালগুলো থেকে। ভুয়ো তথ্য কিংবা ছবি দেওয়ার অভিযোগে।

প্রকাশিত হওয়ার পরও কোনও কারণে গবেষণাপত্র তুলে নেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। নোবেল-বিজয়ীদের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে আগে। ২০১৮-র রসায়নে নোবেলজয়ী ফ্রান্সেস আর্নল্ড তুলে নিলেন তাঁর ২০১৯-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র, কারণ তাতে বর্ণিত ফলাফল আবার পরীক্ষার মাধ্যমে দেখানো যায়নি। আসলে একই ধরনের পরিস্থিতিতে একই পরীক্ষা আবার করে একই রকমের ফল না পেলে তা আর বিজ্ঞান থাকে না। বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া, পুনর্নির্মাণ সম্ভব না হলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা গ্রহণযোগ্য হয় না। ঘটনা হল, ‘নেচার’-এর মতো ডাকসাইটে পত্রিকার ২০১৬-র এক অনলাইন সমীক্ষা অনুসারে ১,৫৭৬ জন গবেষকের ৭০ শতাংশই পুনর্নির্মাণ করতে পারেননি তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল। ঘটনাটা সত্যিই সাংঘাতিক। ছেলেবেলায় পড়েছি, প্রোফেসর শঙ্কুর প্রায় সর্বরোগহর ‘মিরাকিউরল’ বড়ি তৈরি করতে পারেন না শঙ্কু ছাড়া অন্য কেউই। আমি ভাবতাম, যদি পারত, তা হলে মানুষের কী উপকারটাই না হত। আজ বুঝি, এই পুনর্নির্মাণযোগ্যতার অভাবে আজকের বাস্তব বিজ্ঞানের জগৎ কোথায় কল্পবিজ্ঞানের চেয়ে আলাদা। যাই হোক, বাস্তবের নোবেলজয়ী অন্য কিছু বিজ্ঞানীও কিন্তু বাধ্য হয়েছেন তাঁদের গবেষণাপত্র তুলে নিতে। যেমন, ২০০৪-এর চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল-প্রাপক লিন্ডা বাক প্রত্যাহার করেছিলেন তাঁর ২০০৫ এবং ২০০৬-এর দু’টি গবেষণাপত্র। টুকটাক এমন হয়ই। কিন্তু এক জন নোবেল-বিজয়ীর গত পনেরো বছরে ছাপানো দশ-দশখানা গবেষণাপত্র উঠিয়ে নেওয়ার মতো বিরল ঘটনার অভিঘাতে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের দুনিয়াই নয়, কাঁপন ধরেছে মার্কিন সমাজ-জীবনেও। সার্বিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে বিজ্ঞান-সাধকদের সততা নিয়েও, যা নিয়ে জনগণ সন্দেহ করেন না সাধারণত। কিন্তু, বিস্ময়কর ভাবেই, বিজ্ঞানের দুনিয়ায় প্রতারণা চিরায়ত, এবং তা ক্ষেত্রবিশেষে হয় স্থানীয় ভাবে, যাকে বলে ‘এন্ডেমিক’।

সম্প্রতি আলোড়ন তোলা দ্বিতীয় ঘটনাটাও মার্কিন মুলুকের। হার্ভার্ড বিজ়নেস স্কুলের মতো ডাকসাইটে প্রতিষ্ঠান প্রশাসনিক ছুটিতে পাঠিয়েছে তাদের এক অধ্যাপক, ফ্রান্সেস্কা গিনো-কে। ঘটনাচক্রে যিনি আবার গবেষণা করেন ‘এথিক্স স্টাডি’, অর্থাৎ নীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে। গিনোর বিরুদ্ধে অভিযোগ কিন্তু নীতিহীনতার, তিনি নাকি সুচারু ভাবে তথ্যে কারচুপি করে ছাপিয়েছেন চারটি গবেষণাপত্র। অভিযোগ করেছেন তিন মার্কিন গবেষক। গিনোর গবেষণার ডেটা-সম্বলিত এক্সেল শিটের আগের ভার্সন পরীক্ষা করে তদন্তকারীরা নাকি বুঝেছেন ডেটা বদলানো হয়েছে তার অনেক সারণিতে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গিনোর তত্ত্ব দাঁড়িয়ে রয়েছে এই পরিবর্তিত ডেটার উপর ভিত্তি করেই, পরিবর্তনের আগেকার মূল ডেটা বিশ্লেষণ করে সেই তত্ত্বে উপনীত হওয়া সম্ভবই নয়। অধ্যাপক গিনো অবশ্য রেগে আগুন। বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেছেন অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে, এবং তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও। ঘটনাটা নিয়ে তাই সমাজ-পরিসরে হইচই হয়েছে বেশ।

প্রতারণার গল্পের আকর্ষণটা আরও জমাটি হয়, থ্রিলারের রূপ নেয়, যখন তাতে ঢুকে পড়েন কোনও ঝানু গোয়েন্দা। যেমন, প্রফেসর মরিয়ার্টিকে রুখতে যখন আসরে নামেন শার্লক হোমস। লেখাপড়ার জগতে সাধারণত গোয়েন্দার ভূমিকা থাকে সহকর্মীদের বা সমগোত্রীয় পাঠকদের। যেমনটা হয়েছে সেমেঞ্জা কিংবা গিনোর ক্ষেত্রে। জ্ঞানবিজ্ঞানের জটিল ক্ষেত্রের গন্ডগোল বুঝতে সক্ষম তো তাঁরাই।

প্রতারণা সম্ভব নানা ভাবে। পঞ্চাশ বারের পরীক্ষার মধ্যে যে পনেরো বারের ডেটা নিখুঁত, কিংবা প্রস্তাবিত তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, সেগুলো প্রকাশ করে গোপন রাখলাম বাকি তথ্য, সেটাও বড়সড় প্রতারণা। এমন ঘটনা কিন্তু ঘটে আকছার। বড় একটা উদাহরণ দিই। ঠিক একশো এক বছর আগে, ১৯২৩-এ, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান রবার্ট অ্যান্ড্রুজ় মিলিকান। মিলিকান বিখ্যাত তাঁর ১৯০৯-এর ‘অয়েল ড্রপ এক্সপেরিমেন্ট’-এর জন্য, যা দিয়ে নির্ধারিত হয়েছিল ইলেকট্রনের চার্জ। মিলিকানের মৃত্যুর পরে তাঁর নোটবই ঘেঁটে দেখা গেল তাতে রয়েছে ১৪০ বার করা এই পরীক্ষার তথ্য। কিন্তু যে ৫৮টির ডেটা তাঁর তত্ত্বের পক্ষে ‘উপযুক্ত’, সেগুলোই তিনি বেছেছিলেন তত্ত্বটাকে প্রতিষ্ঠা করতে। একেবারেই অ্যাকাডেমিক সততার নিদর্শন নয়। সত্য, তা যেমনই হোক, তাতে নিরাসক্ত ভাবে একনিষ্ঠ থাকাটাই বিজ্ঞানীর ধর্ম। তার অন্যথা হলে সত্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়।

দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সত্যের সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা হামেশাই হয়। তা খবরেও আসে না সর্বদা। বিজ্ঞান-চর্চার তো আর খেলা, গান বা অভিনয়ের মতো বিনোদনমূল্য নেই। ১৯৮০-র দশকের একটা মস্ত প্রতারণা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল দুনিয়াকে। সেটা জন ডারসি-র ঘটনা। হৃদ্‌যন্ত্র-সংক্রান্ত গবেষণায় প্রতিশ্রুতিমান এক অসাধারণ তরুণ গবেষক ছিলেন ডারসি। শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান পত্রিকাগুলিতে দ্রুতই তিনি ছাপিয়ে ফেললেন একগাদা গবেষণাপত্র, যা একেবারেই সহজসাধ্য নয়। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে ফ্যাকাল্টি হওয়ার সুযোগ পান মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে। কিন্তু যেমন হাউইয়ের গতিতে তাঁর উত্থান, তেমনই দ্রুততায় মাটিতে আছড়ে পড়ে তাঁর কেরিয়ার। ১৯৮১-র মে মাস নাগাদ তাঁর কিছু সহকর্মী অনুমান করলেন, তথ্য নিয়ে নিয়মিত এবং পদ্ধতিগত মিথ্যাচার করে চলেছেন ডারসি। অনুসন্ধান হল জোর কদমে। জানা গেল, আগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে পাওয়া ‘ভাল’ তথ্যকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নতুন তথ্য তৈরি করতেন ডারসি। এমনকি পরীক্ষা না চালিয়েও বানিয়ে-তোলা ডেটার জোগান দিয়েছেন তিনি। এ ভাবেই লেখেন প্রচুর ‘অর্থহীন’ আর্টিকল। বিজ্ঞানের দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হল ডারসির অন্তত ৮০টি গবেষণাপত্র। কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলেন ডারসি। যিনি হয়তো অবলীলায় নোবেল পেতেন এক দিন, স্বর্গচ্যুতি ঘটল তাঁর।

আসলে বিজ্ঞানের জগতে সত্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার, কিংবা প্রতারণার অভিযোগের শিকড় যে কত সুদূরবিস্তৃত তা কল্পনা করাও কঠিন। ডারসিকে নিয়ে যখন তুমুল হট্টগোল চলছে মার্কিন বিজ্ঞান-মহলে ও জনসমাজে, সে সময়ে, ১৯৮২-তে, একটা বই লেখেন উইলিয়াম ব্রড এবং নিকোলাস ওয়েড নামে ‘সায়েন্স’ পত্রিকার দুই প্রাক্তন প্রতিবেদক। নাম ‘বিট্রেয়ার্স অব দ্য ট্রুথ: ফ্রড অ্যান্ড ডিসিট ইন দ্য হল অব সায়েন্স’। বিভিন্ন ‘কেস স্টাডি’র মাধ্যমে ব্রড আর ওয়েড দেখান, বিজ্ঞানের জগতে প্রতারণা চিরায়ত। এবং ব্যাপক।

কী সব সাংঘাতিক উদাহরণ সে বইয়ে! পতনশীল বস্তু সম্পর্কিত গ্যালিলিয়োর তত্ত্ব নাকি তৈরি হয়নি পরীক্ষাভিত্তিক কোনও তথ্যের উপর নির্ভর করে। তারাদের নিয়ে টলেমির পর্যবেক্ষণ রাতের আকাশের নীচে বসে হয়নি, তা নির্মিত হয়েছে আলেকজ়ান্দ্রিয়ার সুবিশাল লাইব্রেরিতে। ১৯৮৪-তে ‘আইসিস’ জার্নালে ‘বিট্রেয়ার্স অব দ্য ট্রুথ’ বইটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাট্রিসিয়া উল্ফ হতবাক— শুধু টলেমি কিংবা গ্যালিলিয়ো নয়, সৎ গবেষণার মাপকাঠিতে বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্ত হয়েছেন বিজ্ঞানের দিকপাল মহারথীরা! গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিপারকাস থেকে শুরু করে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আইজ়্যাক নিউটন, জন ডালটন, ড্যানিয়েল বার্নুলি, চার্লস ডারউইন... কে নন!

সত্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ রয়েছে জেনেটিক্সের প্রবাদপুরুষ গ্রেগর মেন্ডেল-এর বিরুদ্ধেও। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৩-র মধ্যে প্রায় ২৯,০০০ মটরশুঁটি গাছের উপর পরীক্ষায় প্রাপ্ত ডেটা বিশ্লেষণ করে মেন্ডেল প্রকট ও প্রচ্ছন্ন ফেনোটাইপের অনুপাত পেয়েছিলেন ৩:১। কিংবদন্তি ব্রিটিশ রাশিবিজ্ঞানী রোনাল্ড ফিশার ১৯৩৬-এ মেন্ডেলের তথ্য ঘেঁটে বললেন, এই ডেটা আসলে বানিয়ে-তোলা, কারণ ডেটায় এই অনুপাতগুলো বড্ড বেশি ঠিকঠাক। যেমন, বাস্তবে কোনও শ্রেণির ছাত্রদের গড় উচ্চতা পাঁচ ফুট হলে সব্বাই তো আর পাঁচ-ফুটিয়া হবে না। কেউ কিছু কম হবে, কেউ খানিক বেশি। এই বৈচিত্রই ডেটার স্বাভাবিক চরিত্র। রাশিবিজ্ঞানের নিরিখে কিন্তু মেন্ডেলের ডেটায় বৈচিত্র বড্ড কম, তা বড্ড নিখুঁত— আর সেখানেই তা জাগিয়ে তোলে প্রবল সন্দেহ। ফিশার লিখলেন, মেন্ডেলের বেশির ভাগ পরীক্ষার তথ্যই বানানো, তাঁর প্রত্যাশিত তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি। ১৯৬৪-তে যখন ঢাকঢোল পিটিয়ে দুনিয়া জুড়ে মেন্ডেলের যুগান্তকারী আর্টিকেলের শতবর্ষ উদ্‌যাপিত হচ্ছে, ফিশারের এই সমালোচনা নজরে আসে বিশ্বের। ২০২২-এ মেন্ডেলের দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপনের পটভূমিতে আবার জেগে ওঠে মেন্ডেল-ফিশার বিতর্ক। ফিশার অবশ্য মেন্ডেলকে খানিক ছাড় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কে বলতে পারে, তথ্যগুলি হয়তো নথিবদ্ধ করেছিল মেন্ডেলের কোনও সহকারী, সে-ই হয়তো করে থাকবে গন্ডগোলটা। প্যাট্রিসিয়া উল্ফ আবার এই দিকপাল বিজ্ঞানীদের ছাড় দিয়েছেন অন্য কারণে। তিনি বলছেন, খ্রিস্টপূর্ব দু’শো সাল থেকে আজ পর্যন্ত দু’হাজার বছরের সময়কালে বিজ্ঞানের মাপকাঠি বদলে গিয়েছে অনেকটাই। যেমন, ডেটার গড় শুধু নয়, তথ্যের তারতম্যও যে স্বাভাবিক এবং সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, সেই ধারণাটাও ছিল না মেন্ডেলের সময়কালে। তাই আজকের নীতির মাপকাঠিতে এই বিজ্ঞানীদের বিচার অসমীচীন।

সত্যের অপলাপ বা বিশ্বাসঘাতকতা কিন্তু করে চলেছেন আজকের অনেক বিজ্ঞানীও, যাঁরা আজকের নীতির মানদণ্ড সম্পর্কে সম্যক অবগত। ২০০৯-তে ‘প্লস ওয়ান’ জার্নালের এক আর্টিকেলে এডিনবরার ড্যানিয়েল ফানেল্লি লিখছেন, ২ শতাংশ বিজ্ঞানী কখনও না কখনও ডেটা বানিয়ে তোলার কথা স্বীকার করেছেন, আর ৩৪ শতাংশ স্বীকার করেছেন গবেষণায় কোনও অসততার কথা। কত শতাংশ যে অসততা করেও স্বীকার করেননি, তার হিসাব অবশ্য পাওয়া যাবে না এখান থেকে।

যাই হোক, প্রতারণার এই গল্পগুলিকে আরও জমাটি বানাতে প্রয়োজন দক্ষ গোয়েন্দার। এ প্রসঙ্গে এক ব্যতিক্রমী গোয়েন্দার গল্প বলা যাক। তিনি এলিজ়াবেথ বিক। ছিলেন স্ট্যানফোর্ডের মাইক্রোবায়োলজি-বিশেষজ্ঞ। বিজ্ঞানের দুনিয়ার প্রতারণা ধরা তাঁর নেশা। ঠিক এক দশক আগে, ২০১৩-তে, এলিজ়াবেথ বিক দেখলেন, তাঁর নিজেরই একটি গবেষণাপত্র থেকে নকল করা হয়েছে। সে-ই শুরু। শুধুমাত্র চোখ ও স্মৃতি নির্ভর করে সম্ভাব্য মেডিক্যাল বৈজ্ঞানিক চিত্র সম্বলিত হাজার হাজার গবেষণাপত্র পরীক্ষা করে বিজ্ঞানের এক অন্ধকার দিক উন্মোচন করতে প্রয়াসী হলেন তিনি। এক মাইক্রোবায়োলজিস্ট হয়ে গেলেন বায়োলজির ‘ইমেজ ডিটেকটিভ’। ইতিমধ্যেই বিক পরীক্ষা করেছেন লাখ খানেকের বেশি গবেষণাপত্র। খুঁজে পেয়েছেন ৪,৮০০-র বেশি মিথ্যা ছবির ঘটনা, ১,৭০০টি অন্য জালিয়াতির সূত্র। ফলশ্রুতি— ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জার্নালে প্রত্যাহৃত হয়েছে হাজারের বেশি গবেষণাপত্র। হয়েছে আরও হাজারের বেশি সংশোধন। প্রবল আলোড়ন তুলে দেওয়া ব্যতিক্রমী এই ‘গোয়েন্দা’ কাজ করে চলেছেন ‘সায়েন্স ইন্টিগ্রিটি কনসাল্ট্যান্ট’ হিসাবে।

তথ্য, ছবি ইত্যাদি নিয়ে এমন মিথ্যাচার বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও থাকবে একই ভাবে, এটাই স্বাভাবিক। কারচুপি ধরার হরেক রাশিবিজ্ঞান-ভিত্তিক পদ্ধতি অবশ্য আছে। যেমন, বেনফোর্ড ল। অনেক ডেটা থাকলে তার প্রথম অঙ্ক হিসাবে কোন সংখ্যা কী অনুপাতে থাকবে তার একটা গণিত-নির্ভর হিসাব। নির্ধারিত অনুপাতের থেকে খুব অন্য রকম কিছু পেলেই সন্দেহ করা যাবে ডেটার উপর। মার্কিন সরকার যেমন ট্যাক্সে কারচুপি ধরতে বেনফোর্ড ল ব্যবহার করে ব্যাপক হারে। তথ্যে মিথ্যাচার ধরার রয়েছে আরও অনেক রাশিবিজ্ঞান-নির্ভর উপায়, যা নিশ্চিত ভাবে কারচুপি নির্দেশ না করলেও ডেটার উপরে সন্দেহ ধরিয়ে দিতে পারে বইকি। আসলে যে কোনও অপরাধের মতোই তথ্যেও নিখুঁত কারচুপি বলে কিছু হয় না। ডেটার দুনিয়ার শার্লক হোমস, মিস মার্পল কিংবা পেরি ম্যাসন তা ধরে ফেলবে অবাক-করা দক্ষতায়। কিন্তু এটাও ঠিক, হাতে-পাওয়া সমস্ত তত্ত্ব প্রয়োগ করে তথ্যের অগ্নিপরীক্ষা করা সর্বদা বাস্তবসম্মত নয়। সময়, পরিকাঠামো, কিংবা সদিচ্ছার অভাবে।

সেটাও কিন্তু সহজ হতে পারে ক্রমশ। আজকের দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই হয়তো হয়ে উঠতে পারে সত্যিকারের ‘ডেটা ডিটেকটিভ’ বা তথ্যের গোয়েন্দা। এআই-এর ডেটাবেসে প্রচুর পরিমাণে প্রকাশিত ডেটা, অন্য তথ্য, প্রচুর গবেষণাপত্র পুরে দিয়ে তাকে রাশিবিজ্ঞানের নিরিখে তথ্যের অগ্নিপরীক্ষার বিবিধ অ্যালগরিদম চালানো শিখিয়ে দিলে, ডেটা, তথ্য, ছবি ইত্যাদি যাচাই করে চুরি বা মিথ্যাচার ধরার ক্ষেত্রে ম্যাজিক দেখাতেই পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সামাজিক ক্ষেত্রের নানাবিধ ডেটার সত্যতা যাচাইয়ের কাজটাও সে একই ভাবে করতে পারে অক্লেশে। এলিজ়াবেথ বিক-দের মানবিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও হয়ে উঠতে পারে তথ্যের গোয়েন্দা। সত্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা তথ্যের প্রতারকদের ধরতে।

অন্য বিষয়গুলি:

america
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy