অভিনেত্রী বনানী চৌধুরী।
১৯৪০-এর দশকের মতো সময়ে শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কোনও মেয়ের সিনেমায় অভিনয় ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। আর এটাই ঘটিয়েছিলেন অভিনেত্রী বনানী চৌধুরী, যাঁর আসল নাম আনোয়ারা। পারিবারিক দিক থেকে এ ব্যাপারে অনুকূল পরিবেশ থাকলেও, বাইরের রক্ষণশীল দুনিয়া থেকে বাধা এসেছিল। কিন্তু সে সব গ্রাহ্য না করে, নিজের ইচ্ছেকে চরিতার্থ করেছিলেন তিনি। অনেকের মতে, তিনিই বাংলা ছবির দুনিয়ায় প্রথম বাঙালি মুসলিম নায়িকা।
আনোয়ারাদের আদি বাসস্থান বর্তমান বাংলাদেশের যশোরের শ্রীপুর থানার অধীনস্থ সোনাতুনদি গ্রামে। পরে এই গ্রাম মাগুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। বাবা আফসারউদ্দিন আহমেদ পুলিশের কর্তা ছিলেন, কর্মস্থল ছিল বনগাঁয়। নানা সূত্রে জানা যায়, ১৯২৪ সালের মে মাসে জন্ম আনোয়ারার। বাবার বদলির সুবাদে তিনি ভর্তি হন মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘির একটি ইস্কুলে।
১৯৩৬ সালে যখন তাঁর ক্লাস এইট, তখনই বিয়ে হয়ে যায় কলকাতা ওয়াকফ-এর কমিশনার, এ রাজ্জাক চৌধুরীর সঙ্গে। রাজ্জাক ছিলেন শিক্ষিত ও মুক্তমনের মানুষ। প্রথম থেকেই আনোয়ারার শিক্ষা ও শিল্পীজীবনে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। ছাত্রী থাকাকালীনই গান, নাচ, মঞ্চাভিনয়ে নজর কেড়েছিলেন আনোয়ারা। চলচ্চিত্রের প্রতি আকর্ষণও ছোট থেকেই। পড়াশোনায়ও অবহেলা করেননি কখনও। বিয়ের পরে স্বামীর সহযোগিতায় দু’টি ক্ষেত্রেই তিনি বিকশিত হলেন। এক দিকে যেমন বি এ পাশ করলেন, অন্য দিকে পা রাখলেন ছবির জগতে।
আনোয়ারার স্বামীর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আনোয়ারার অভিনয়ে আসার ব্যাপারে তাঁর সহযোগিতাও ছিল অনেকটাই। এঁদের সাহায্যে ও নিজের শিক্ষিত মানসিকতার জোরে, রক্ষণশীল সমাজের বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করেছিলেন বেগম আনোয়ারা নাহার চৌধুরী লিলি। যোগাযোগ হল চিত্রপরিচালক গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর ‘বিশ বছর আগে’ ছবিতে অন্যতম নায়িকা হিসেবে নির্বাচিত হলেন তিনি। ছবির দুনিয়ায় নাম হল বনানী চৌধুরী। সময়টা ১৯৪৬। কলকাতা তখন উত্তাল। স্বাধীনতার প্রাক্কালে চল্লিশ দশকের চরম ঘটনাবহুল সময়।
বনানী চৌধুরী অভিনীত প্রথম ছবি ‘তপোভঙ্গ’ মুক্তি পায় ১৯৪৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। পরিচালকের নাম বিভূতি দাশ। এর পর, ওই একই বছরে অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় ও সুশীল মজুমদার পরিচালিত যথাক্রমে ‘পূর্বরাগ’ এবং ‘অভিযোগ’। ‘বিশ বছর আগে’ ছবিতে প্রথম কাজ করলেও, এটি ১৯৪৮-এ মুক্তি পেয়েছিল। প্রত্যেকটিতেই তিনি অন্যতম নায়িকা। পাঁচ দশক ধরে প্রায় পঞ্চাশটির কাছাকাছি বাংলা ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ (১৯৪৯), ‘শেষের কবিতা’ (১৯৫৩), ‘শাপমোচন’ (১৯৫৫), ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ (১৯৬১), ‘রাজা রামমোহন’ (১৯৬৫), ‘পিতাপুত্র’ (১৯৬৯), ‘বনপলাশীর পদাবলী’ (১৯৭৩), ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ (১৯৭৪), ‘আমি সে ও সখা’ (১৯৭৫) ইত্যাদি আরও উল্লেখযোগ্য ছবি। প্রথম দিকে নায়িকা হয়েছেন। পরে বয়সের হাত ধরে পার্শ্বচরিত্র। প্রসঙ্গত, ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ (১৯৭৩) মোড়লের গিন্নির চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন। বনানী চৌধুরীর অভিনয়ে মেধা ও ভাবনার ছাপ থেকেছে বরাবর, যা তাঁর উপস্থিতিকে বিশেষ মার্জিত রূপ দিত। যে চরিত্রই করুন, অভিনয়ে একটি নির্দিষ্ট মাপ বজায় রেখে যেতেন তিনি, যা তাঁর নিজস্ব বিশিষ্টতার দিক।
বাংলার পাশাপাশি ‘কুছ নয়া’ (১৯৪৮), ‘মণিকা’ (১৯৪৯), ‘দীপক’ (১৯৫১), ‘সবজ্ বাগ’ (১৯৫১) ইত্যাদি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেন এই অভিনেত্রী। শুধু এ পারেই নয়, ও পার বাংলার বেশ কয়েকটি ছবিতেও দেখা গেছে বনানী চৌধুরীকে। যার মধ্যে আছে ১৯৭০ সালে, বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ও সাহিত্যিক জহির রায়হান পরিচালিত ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছবিটিও। কিন্তু ছবিটি শেষ হওয়ার আগেই ঘটে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। দুষ্কৃতীদের হাতে নৃশংস ভাবে নিহত হন পরিচালক। ফলে অসমাপ্ত থেকে যায় ছবির কাজ।
১৯৪৭-এর শেষের দিক। সবে স্বাধীন হয়েছে দেশ। তখন মাত্র তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে বনানী চৌধুরীর। একেবারেই নতুন তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে। প্রতিষ্ঠাও পাননি সে ভাবে। সে সময় ‘রূপমঞ্চ’-এর মতো একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকার শারদীয়া (১৩৫৪) সংখ্যায় ‘বাংলার ছায়াচিত্রশিল্পে নতুনদের বাধাবিপত্তি’ নামে তাঁর একটি লেখা প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি ধরে ধরে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর মতো ছবির জগতে নতুন-আসা অধিকাংশ শিল্পীর অভিনয়ের মান কী কী কারণে তেমন ভাল জায়গায় পৌঁছতে পারছে না। এর অসুবিধেগুলো কোথায়। গোটা রচনাটি অকপটে বলা এক গভীর অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ। তিনি লিখছেন, “এ নিয়ে আমি গভীরভাবে অনুশীলন করেছি। এই অক্ষমতার গ্লানি আমি অনুভব করেছি এবং বারে বারে এই প্রশ্নই আমার মনে ধ্বনিত হয়েছে— আমার এই অক্ষমতার জন্যে কি একমাত্র আমিই দায়ী— এর দায়িত্ব কি অন্য কোথাও এতটুকু নেই?... পারিপার্শ্বিক অবস্থাগুলি যদি আরো অনুকূল হত, তাহলে আমার চরিত্রাভিনয় কী সাফল্যমণ্ডিত হতে পারতো না?” এর পর তিনি বিস্তারিত ভাবে এনেছেন এ ব্যাপারে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একের পর এক খামতির দিক। যার মধ্যে আছে নতুনদের চলচ্চিত্র অভিনয় সম্পর্কে উপযুক্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না করা, দুর্বল চিত্রনাট্য, স্টুডিয়োর দুরবস্থা, চিত্রপরিচালনায় উৎকর্ষের অভাব ইত্যাদি আরও অনেক কিছু, যার প্রত্যেকটিই অকাট্য যুক্তিতে উজ্জ্বল। তিনি বলছেন, এক জন নতুন অভিনেত্রীকে নির্বাচনের ক্ষেত্রে, শুধুমাত্র তাঁর কণ্ঠস্বর শুনে আর ক্যামেরায় ছবি দেখেই “শিল্পীরূপে বহাল করা হল।” তার পর কাজের দিন, “তাঁকে দু’চারবার সংলাপটি পড়িয়ে ‘সেটে’ দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। দু’একবার রিহার্সেল হল— একবার মনিটর হল— তারপরেই ‘টেক’।” এভাবে যে এক জন নবাগতর পক্ষে কখনওই ভাল অভিনয় করা সম্ভব নয়, সেটাই তাঁর অভিমত। এ প্রসঙ্গে তিনি বিদেশের তুলনা টেনে বলেছেন, সেখানে আছে অভিনয় শেখানোর বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র। অভিনয়ে আগ্রহী সেখানকার ছেলেমেয়েরা “একটি শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে অভিনয় এবং তৎসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন।” ওই সময়ে দাঁড়িয়ে, চলচ্চিত্রে সদ্য আসা এক জন আনকোরা অভিনেত্রীর পক্ষে এ রকম শাণিত এবং ঋজু প্রকাশভঙ্গির রচনা, অবশ্যই পর্যাপ্ত শিক্ষা, মেধা ও দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের পরিচায়ক।
মঞ্চনাটকেও অভিনয় করেছেন বনানী চৌধুরী। সেখানে যেমন মহেন্দ্র গুপ্ত নির্দেশিত ‘পিতাপুত্র’ (১৯৫৫), ‘মহানায়ক শশাঙ্ক’ (১৯৫৫), ‘এরাও মানুষ’ (১৯৫৫)-এর মতো পেশাদারি থিয়েটার আছে, তেমনই আছে ১৯৬০ সালে জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘মাস থিয়েটার্স’ প্রযোজিত ‘কাঁচঘর’, একই বছরে তরুণ রায়ের পরিচালনায় ‘আর হবে না দেরী’ (‘মুখোশ’-এর নামান্তর) বা ১৯৬২-তে সুশীল মজুমদার নির্দেশিত ‘জনান্তিক’-এর মতো অন্যধারার নাটক। বনানী চৌধুরীর নির্দেশনায় ১৯৬২ সালের ১২ অগস্ট রবীন্দ্রনাথের ‘মালঞ্চ’ অভিনীত হয় নিউ এম্পায়ারে। অভিনয়ে স্বয়ং নির্দেশক ছাড়াও ছিলেন নবকুমার, দীপক মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো নামী শিল্পীরা।
গানেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন বনানী। দু’টি রেকর্ডে ধরা আছে তাঁর শাস্ত্রীয় রীতির হিন্দি গান। তবে একক কণ্ঠে নয়। প্রথমটি ১৯৪৮ সালে। যাতে রামপ্রসাদ বিসমিলের কথায় আর পণ্ডিত রতন পিয়ার সুরে বনানী চৌধুরী ও নার্গিস জামাল মিলে গেয়েছিলেন ‘ঘিরো শাওন কো বদরইয়া...’ (রেকর্ড নং: FT 12496)। এর পর ১৯৫৩-য় আর একটি রেকর্ডে অণিমা দাশগুপ্ত ও সমবেত শিল্পীদের সঙ্গে প্রচলিত কথায় ও জ্ঞান দত্তের সুরে গাইলেন, ‘সবরি কহে রাম আয়েঙ্গে...’ (রেকর্ড নং: N 80037)। এ ছাড়াও অনেক বেতার-নাটকেও অংশ নিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
অভিনয় তো বটেই, অন্য সব রকম শিল্পপ্রকাশের মধ্য দিয়েই শিক্ষিত সত্তার প্রকাশ ঘটেছে বনানী চৌধুরীর। এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছে তাঁর কলমও। ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘বাংলার ছায়াচিত্র ও শিক্ষিতা নারী’-র এক জায়গায় যে আবেদন রেখেছেন তিনি, তার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনই এর সঙ্গে শিল্পী বনানী চৌধুরীর জীবনযাপন পুরোপুরি মেলে— “এখন আমাদের কর্তব্য অভিনয়শিল্প তথা চিত্রশিল্পের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ নয় বরং অন্যান্য সুকুমার শিল্পের ন্যায় একে আশীর্বাদ করে আমাদের জীবনে গ্রহণ করা।... একাজ করতে হলে প্রয়োজন সম্ভ্রান্ত অভিজাত ঘর থেকে শিল্পীরূপে শিক্ষিত নরনারীর আগমন। বিশেষ করে শিক্ষিতা নারীর আগমন। শিক্ষিতা বলতে আমি সেই নারীকেই বুঝি— যিনি শক্তিশালী চরিত্রের অধিকারিণী, সম্ভ্রান্ত ভদ্র মনের অধিকারিণী— যাঁর উপস্থিতি একটা সুন্দর পবিত্র আবহাওয়া সৃষ্টি করে। সুন্দরকে সৃষ্টি করতে হলে শিল্পীদেরও দেহ-মনে সুন্দর হওয়া চাই— আবিলতার আবহাওয়ার মধ্যে সুন্দরের সৃষ্টি হতে পারে না।... আমাদের এখন কুসংস্কারকে বা গতানুগতিক বদ্ধ ধারণাকে ছাড়িয়ে যাবার সময় এসেছে।”
১৯৮৫ সালে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অজান্তে’ ছবিতেই সম্ভবত বনানী চৌধুরীর শেষ অভিনয়। এর পর সরে যান অভিনয় জগৎ থেকে। ১৯৯৫ সালের ৫ জানুয়ারি ঢাকাতে তিনি প্রয়াত হন। এ বছর নিঃশব্দে অতিবাহিত হল এই শিল্পীর জন্মশতবর্ষ।
কৃতজ্ঞতা: সঞ্জয় সেনগুপ্ত, ‘অভিনেত্রী কথা’— সংকলন ও সম্পাদনা: দেবীপ্রসাদ ঘোষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy