জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতাকে শুধু গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসেননি, সঙ্গে যত্ন করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন কলকাতার ঐশ্বর্য ট্রামকেও।
আসল উচ্চারণ ‘ট্রাম’? নাকি ‘ট্র্যাম’? নির্ভুল উচ্চারণ বাংলা বানানে লেখা সম্ভব নয় জেনেও বুদ্ধদেব বসু একটা য-ফলা দিয়েছিলেন। তাঁর ‘নির্জন স্বাক্ষর’ উপন্যাস কার্তিক মাসের এক শনিবারের বিকেলে শুরু হচ্ছে। এসপ্লানেডের মোড়ে ইস্ত্রিভাঙা জিনের প্যান্ট আর ঢলঢলে কোট পরে মাঝবয়সি লোকটি দাঁড়িয়ে আছে: “ওখানে রোজ ট্র্যামের জন্য হাজার-হাজার যারা দাঁড়ায়, তাদেরই একজন সে।” লোকটির নাম সোমেন। লেখক মানুষ। পত্রিকার ‘পূজা স্পেশালে’ লেখে না। তাই ভিড়ের মধ্যে হাতে দুটো পুঁটুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও সে একটু সরে দাঁড়িয়েছে, ‘যেন ট্র্যামের জন্য দাঁড়ায়নি, দৃশ্য দেখছে...।’
রবীন্দ্রনাথের ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতার ফুটবল-খেলোয়াড়টি ট্রাম থেকে যেখানে নামার কথা ছিল সেখানে নামতে পারলেন না কমলার জন্য: “দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।/ সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।/ আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।” রবীন্দ্রনাথ ‘স্বপ্ন’ দেখেছিলেন: “রাস্তা চলেচে যত অজগর সাপ,/ পিঠে তার ট্রামগাড়ি পড়ে ধুপ্ ধাপ্।” বুদ্ধদেব বসুর অগ্রজ-কবি রবীন্দ্রনাথ ‘ট্রাম’ বানানটি সোজাসাপ্টা রাখলেন যেন যানযন্ত্রটির লাইন দু’টির সহজ সারল্যের কথা মাথায় রেখে। তবে ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত ‘ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা’ গ্রন্থে লেখিকা কৃষ্ণভাবিনী দাস ‘ট্র্যাম’ বানানটি ব্যবহার করেছিলেন: “এই নগরেরর (লণ্ডন) প্রায় সকল দিকেই ট্র্যামে করিয়া যাওয়া যায়, এখানকার ট্র্যামগুলি দেখিতে এক একখানা কলের গাড়ির মত...। এক একখানা ট্র্যামগাড়ীতে চব্বিশ জন করিয়া লোক ধরে।”
জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতাকে শুধু গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসেননি, সঙ্গে যত্ন করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন কলকাতার ঐশ্বর্য ট্রামকেও। যে ট্রাম তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে, তাকে দেখেছিলেন এই ভাবে: “কয়েকটি আদিম সর্পিণীর সহোদরার মতো/ এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে/ পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে বিষাক্ত বিষাদ স্পর্শ/ অনুভব করে হাঁটছি আমি।”
রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘদিনের সচিব, পরবর্তী কালে বিশ্বভ্রামণিক অমিয় চক্রবর্তীর ‘ফিনল্যাণ্ডের চিঠি’তে আছে, “ট্রামে ক’রে শহরের বাগানে একটা কাফেতে এসে বসেছি— সাম্নে ছোট্ট ‘অরা’ নদী, ছোট্ট ছোট্ট নৌকো, মোটর-বোট ভাস্ছে...” লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। মজার তথ্য হল, সেই দেশের হেলসিঙ্কিতে এখনও ট্রাম চলে, কিন্তু তুর্কু শহরের শেষ ট্রামটি হয়ে গেছে আইসক্রিমের পার্লার! প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘শুধু কেরাণী’র ছেলেটি অফিস থেকে ট্রামের পয়সা বাঁচিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরল। সেই পয়সায় রাস্তার মোড় থেকে কেনা গোড়ের মালা জড়িয়ে দিল মেয়েটির খোঁপায়। স্বামীর উপহারে দৃশ্যত খুশি মেয়ে ছদ্ম-রাগ দেখিয়ে এই বাজে পয়সা খরচের জন্য মৃদু ভর্ৎসনা করলে ছেলেটি বলে, “ট্রামের পয়সা আজ বাঁচিয়ে তাইতে কিনেছি।” কথাটি আর ফুলের মালাটি যে অনন্য দাম্পত্য প্রেমের অভিজ্ঞান তৈরি করে, তার সুতোটি যেন জড়িয়ে থাকে ‘ট্রাম’ শব্দের পূর্ণ অস্তিত্বে।
সময়ের রাস্তা ধরে আর একটু পিছিয়ে গেলে দেখতে পাব, ‘সম্বাদ প্রভাকর’ পত্রিকা কলকাতায় ট্রাম চালিয়ে অর্থের অপচয় করছে বলে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। সরকারকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে বলে দাবি ছিল তাদের। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত জহরলাল ধর প্রণীত ‘সচিত্র কলিকাতা-রহস্য’ উপন্যাসে আছে ট্রাম-দুর্ঘটনার বিবরণ: “একখানা ট্রামকার, গড়্গড়িয়ে মোড়ের দিকে ছুটে এ’ল। প্যাসেন্জাররা “বাঁধ বাঁধ” শব্দ ক’রে চ’ল্লে; কিন্তু ড্রাইভার বাঁধ্তে না পেরে, এক ছ্যাকড়া গাড়ির পেচ্লির চাকার গায়ে সজোরে ট্রামকারের চাকা লাগিয়ে দিলে।” ঘোড়ায়-টানা ট্রামের যুগ ছিল সেটি। বছর দুয়েক পরে প্রকাশিত ‘এনকোর! নাইনটিনাইন!! অর শ্রীমতী’ প্রহসনে নারী চরিত্র ধিনির সংলাপ: “প্রিয়ে, তুমি আমার হিয়ে, এই যে পাঁচ পয়সা নিয়ে ট্রাম দিয়ে আসবো বল্লে? কৈ এখনও তো এলে না? ট্রাম কি তবে আউট রেল হ’লো?” এর লেখক ছিলেন দুর্গাদাস দে।
ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়লে কলকাতা শহর এক ‘চমৎকার আন্দোলন’ তৈরি করেছিল বলে ব্যঙ্গ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: “যখন তখন ট্রামে উঠে বলা ভাড়া দেব না!... কেউ আপত্তি করলে ঘুঁষি মারার জন্য হাতের মুষ্টি উদ্যত ছিল। কণ্ডাক্টরদের নিরুত্তাপ ব্যবহারের জন্যই বাধ্য হয়ে কলেজ ক্যাণ্টিনে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ট্রাম পোড়াবার! ট্রাম পোড়ানো এত সোজা, বাসের মত ঝামেলা নেই!” এই সুনীল-উপন্যাসের নাম ‘হে প্রবাসী’, ভাবনাগুলি কাহিনির নায়ক বিল্ব-র। সে দূর থেকে দেখেছিল দুটো ট্রাম আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে, তাতেই তার তৃপ্তি! সমরেশ মজুমদারের অর্ক ‘কালপুরুষ’ উপন্যাসে ট্রামের কন্ডাক্টরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল: “ট্রামে উঠেই মাথা গরম হয়ে গেল অর্কর। চার জন লোক বসেছিল সামনে, কণ্ডাক্টর টিকিট চাইতেই তারা চোখ মটকে হাসল। কণ্ডাক্টর দ্বিতীয়বার চাইতেই একজন বলল, পরে দেব, বুঝতে পারছেন না?” অর্থাৎ নির্দিষ্ট ভাড়ার বদলে কম টাকা নিয়ে একটা রফা। এই ‘দুর্নীতি’ সহ্য করতে না পেরে অর্কর তীব্র প্রতিবাদ; সহযাত্রীদের সমস্বরে সহযোগিতার ফলাফল ইতিবাচক হলেও ট্রাম থেকে নেমে অর্কর মনে হয়েছিল: “পাঁচটা সমাজবিরোধীকে নিয়ে এক নম্বর ট্রামটা এসপ্লানেডের দিকে চলে গেল।”
শিব্রাম চক্কোত্তির ‘স্বামী হওয়ার সুখ’ গল্পে আছে চারু আর শেফালির কথা। কথা ছিল শেফালি আসবে তার স্বামী চারুর আপিসে, যৌথ বাজারের অভিপ্রায়ে। কিন্তু চারু বিলকুল ভুলে গিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এই ভুলে যাওয়ার কৈফিয়ত হিসেবে সে বলে: “আপিস বেরোবার মুখে কী করে ট্রামে চাপব শুধু এই এক সমস্যা ছাড়া আর কোনো চিন্তা আমাদের মনে স্থান পায় না। এমনকী সেই ভাবনায় ভালো করে আমরা দুটি খেতেও পারিনে। আর তারপর আমরা যন্ত্রচালিতের মতো ট্রামের নির্দিষ্ট স্টপেজে গিয়ে অপেক্ষা করে, পর পর কয়েকটা কেরানি-ভরতি ট্রামে-বাসে পাত্তা না পেয়ে অবশেষে মরিয়া হয়ে আঙুলের ডগা দিয়ে একটাকে পাকড়াতে পারি। তারপর ঝুলতে ঝুলতে কী করে যে সশরীরে আপিসঘরে পৌঁছে নিজের টেবিলটিতে গিয়ে বসি সে-একটা মন্ত্রমুগ্ধ ব্যাপার!” গল্পের শেষে জানা যায়, ‘ভুলে যাবার দোষ’ চারুর নয়। কার তবে? সে প্রসঙ্গ এখানে থাক। আমরা বরং পটলডাঙায় যাই। টেনিদার শাগরেদ প্যালারামকে জুতো-চোর ভেবে রাস্তায় লোকজন জমে গেছে। তাদের মধ্য থেকে এক জনের মন্তব্য: “আজকাল চারিদিকে জুতো-চোরের মরশুম। ট্রাম থেকে পর্যন্ত সরাচ্ছে মশাই। সেদিন দুপুরবেলা শ্যামবাজার যেতে যেতে যেই চোখে একটু ঢুলুনি এসেছে, অমনি আর কথা নেই— আমার নতুন জুতো-জোড়া একেবারে ভোঁ-ভাঁ।” গল্পটির নাম ‘চরণামৃত’।
শম্ভু মিত্রের ‘বিভাব’ নাটকটিতে স্বনাম-চরিত্র শম্ভু ও অমর হাসির নাটকের উপাদান খুঁজতে কলকাতার রাস্তায় হেঁটে চলেন। বিভিন্ন চরিত্র বাস, হাতে-টানা রিকশা, ট্রামের ছবি নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে বুঝিয়ে দেয় পথের যানজমাট অবস্থা: “একটা লোক ট্রামের ছবি নিয়ে ঢোকে/ মুখে ট্রামের ঘণ্টির ‘ঠ্যাং ঠ্যাং’ আওয়াজ। সে সোজা রাস্তা ধরে/ মঞ্চের একদিক থেকে অন্যদিকে চলে যায়।” শম্ভু মিত্র বলেন, “দেখেছ, ইংরেজ কোম্পানি কিনা— ঠিক লাইন ধরে চলেছে।” সংলাপটিতে স্বদেশীয়দের প্রতি ব্যঙ্গ আর ব্রিটিশ শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধার মিশেল আছে। ঠিক এ রকমই সুরের আবেশ রয়ে গেছে শ্রীপান্থের ‘পালকী থেকে ট্রাম’ প্রবন্ধে। সেই রচনায় আছে কলকাতা শহরে ব্রিটিশের ট্রাম-পত্তনের কথাও। ১৮৭৩ সনে বঙ্গ-সরকার দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে বসিয়েছিল ট্রামের মিটারগেজ লাইন। শিয়ালদা থেকে শুরু করে বৌবাজার, ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত তার সীমা। দেড়শো বছর আগে, ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর, এইটুকুই ছিল কলকাতার প্রথম ট্রামের পরমায়ু। এই দীর্ঘ পথ-চলায় ট্রামের গতিতে বাধা এসেছে বার বার। তেমনই এক অকালমৃত্যুর সম্ভাবনার কথা শ্রীপান্থের কলমে ধরা আছে অনবদ্য মায়াগদ্যে: “ট্রাম না চললেও কলকাতা শহর চলে। কলকাতা শহর একা ট্রামের পায়ে চলে না। বাস আছে, ট্যাক্সি আছে, রিক্সা আছে— তার উপর আছে আমাদের এই সনাতন পদযুগল। সুতরাং ট্রামের সাধ্য কী আমাদের থামায়!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy