Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
পা ন্তা ভা তে…

ওঁকে ‘স্যর’ বলে ডাকতাম

আঁধি’র চিত্রনাট্য নিয়ে চললাম কলকাতা। আমি আর প্রযোজক জে ওমপ্রকাশ। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নো ডিসকাশন, নো কোয়েশ্চেন। আমি কোনও প্রশ্ন করব না, আপনি যা বলবেন আমি তা-ই মেনে নেব।’ আমি একটু লজ্জাই পেয়ে গেলাম। উনি মনে রেখেছেন তা হলে প্রথম সাক্ষাতের কথা।

গুলজার
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

আঁধি’র চিত্রনাট্য নিয়ে চললাম কলকাতা। আমি আর প্রযোজক জে ওমপ্রকাশ। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নো ডিসকাশন, নো কোয়েশ্চেন। আমি কোনও প্রশ্ন করব না, আপনি যা বলবেন আমি তা-ই মেনে নেব।’ আমি একটু লজ্জাই পেয়ে গেলাম। উনি মনে রেখেছেন তা হলে প্রথম সাক্ষাতের কথা।

চিত্রনাট্য শোনার পর উনি রাজি হয়ে গেলেন। এ বার আমি একটু হেসে বললাম, ‘আপনি এই সিনেমায় বিশেষ কোনও চরিত্রকে কাটছাঁট বা মডিফিকেশন করতেই পারবেন না। কারণ সিনেমাটায় একে চরিত্র কম, আর মহিলা চরিত্র মাত্র একটি, আপনার।’ মিসেস সেন একটু অবাকই হলেন, কারণ অন্য সবার মতো উনিও খেয়াল করেননি যে সিনেমায় কেবল একটি মহিলা চরিত্র। এমনকী সিনেমা দেখার পরও কেউ তেমন করে খেয়াল করেন না।

শুটিং শুরু হল। প্রথমেই বিপত্তি। উনি সবার সামনে আমাকে ‘স্যর’ বলে ডাকতে লাগলেন। বললাম, সে কী কথা! আপনি আমার চেয়ে বড়, আপনি আমায় স্যর কেন বলবেন? মিসেস সেন বললেন, ‘আপনি আমার ডিরেক্টর, তাই স্যর।’ আমি বললাম, ঠিক আছে আমিও আপনাকে তা হলে ‘স্যর’ বলেই ডাকব। দেখাদেখি গোটা ইউনিট ওঁকে স্যর বলে ডাকতে আরম্ভ করল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার আর ওঁর এই সম্বোধনই বজায় ছিল। কাশ্মীরে শুটিং-এর সময়টা বড় সুন্দর কেটেছিল। আমার মেয়ে বস্কি তখন ছোট। স্যর খুব খেলতেন ওর সঙ্গে। রাখীজিও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। দারুণ জমাটি আড্ডা হত— আমি, রাখীজি, সঞ্জীব আর স্যর। সঞ্জীবের সঙ্গে স্যরের খুব ভাল র‌্যাপো ছিল।

শুটিং শেষ হল। রাশ দেখে ইউনিটের সবার মুখ চুন। কারও ভাল লাগেনি। স্যরেরও না। কিন্তু মুখের ওপর তো সরাসরি বলতে পারেন না। তাই বললেন, ‘ঠিকই আছে এমনিতে। কিন্তু এর সঙ্গে নিশ্চয়ই আরও কিছু জুড়বে, মিউজিক জুড়বে।’ আমি বললাম, ‘দেখুন, সিনেমাটা এটাই। এর চেয়ে কিছু অন্য রকম বা নতুন হয়ে উঠবে না।’ আমার ক্যামেরাম্যান আমায় ডেকে বলল, ‘জো চিজ আদমি নিউজপেপার মে পড়তা হ্যায়, ও সিনেমা মে কিঁউ দেখেগা?’ মানে সিনেমাটা দর্শকের চোখে একটি কষাটে খবরের কাগজ ছাড়া কিছুই মনে হবে না। বসলাম এডিটিং টেবিলে এবং তার পর সবার চোখ চকচক করে উঠল। সবাই মুগ্ধ। মিসেস সেনের অনবদ্য অভিনয় দেখে মুগ্ধ, তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স-এ মুগ্ধ।

এর পর সেই ঘটনা। আমি তখন মস্কোয়, ফেস্টিভ্যালে। ভারতে তখন ‘আঁধি’ ২২-২৩ সপ্তাহ চলছে। জুবিলি হবে। হঠাৎ ফোন পেলাম, আঁধি ব্যান হয়ে গেছে। কেন? দক্ষিণ ভারতে কারা যেন প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে: স্ক্রিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিনা মদ খাচ্ছে, সিগারেট খাচ্ছে? অথচ আমি এই স্টিরিয়োটাইপটাই ভাঙতে চেয়েছিলাম। ভ্যাম্প ছাড়াও যে মেয়েরা ড্রিংক করে, সিগারেট খায়, সেটাই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম। পরে তখনকার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী আই কে গুজরাল-এর সঙ্গে কথায় কথায় জানতে পারি, কেবল ওটাই ইস্যু ছিল না, আরও নানা আপত্তি উঠেছিল। সঞ্জয় গাঁধী এই ধরনের প্রতিবাদে বিচলিত হয়ে সিনেমাটা বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এই ব্যান নিয়ে নিই ইয়র্ক টাইম্‌স-এ বিরাট রিপোর্ট হয়েছিল। স্যরও ব্যাপারটায় খুব আঘাত পেয়েছিলেন।

তবে সিনেমাটার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, আমাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। কত শুনেছি, উনি নাকি ভীষণ রিজার্ভড, কারও সঙ্গে মেশেন না, কথা বলেন না। কিন্তু আমি মানুষটাকে অন্য ভাবেই চিনেছি। হয়তো উনি পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষের সঙ্গেও মেলামেশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি তো কলকাতা গেলেই দেখা করতাম। মুনমুন আমায় বলেছিল, মা’কে জিজ্ঞেস না করে কারও ফোন দিতে পারি না, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ফোন তুলে আমায় শুধু বলতে হয়, স্যরের ফোন। এই পাওয়াটা বড় পাওয়া। আমি আসলে ওঁকে চিনি ভীষণ ইমোশনাল, ওয়র্ম এক জন মানুষ হিসেবে। আমার মনে আছে, ‘আঁধি’র গোটা শুটিং-এ যত বার ওঁকে কান্নার দৃশ্য করতে হয়েছে, এক বারও গ্লিসারিন ব্যবহার করেননি। কেবল একটাই আবদার ছিল। ক্যাসেট প্লেয়ারে আমাকে ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে’ গানটার ‘তুম জো কহে দো তো আজ কি রাত চাঁদ ডুবেগা নহি, রাত কো রোক লো...’ লাইন দুটো বাজাতে হত। উনি সেটা শুনতেন আর তার দু’মিনিট পর বলতেন, ‘শট নাও।’ আমি গোটা শুটিং-এ আমার টু-ইন ওয়ান আর ওই ক্যাসেটটা বয়ে বেড়াতাম।

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে কত সময় গিয়ে দেখেছি, উনি বারান্দায় বসে আছেন আর কাকদের আঙুর খাওয়াচ্ছেন। কী অবাক হতাম! কাকগুলো সব ওঁর হাত থেকে আঙুর নিয়ে যেত। অথচ আমি শুনেছিলাম কাক নাকি মানুষকে ছোঁয় না! সকালের দিকে গেলে, উনি কাউকে বলতেন, এক গ্লাস ঠান্ডা দুধ আনতে। প্রতি বারই অবাক হতাম। আমার ব্রেকফাস্টের মেনু ওঁর এখনও মনে আছে! কত সময় কলকাতা গিয়েছি, কিন্তু ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। ফোন করে জানিয়েছি। ও মা, সন্ধেবেলায় হঠাৎ বারীনদা এসে উপস্থিত। বারীনদা ওর সেক্রেটারি থেকে ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, ‘ম্যাডাম এসেছেন গাড়ি নিয়ে, চলুন।’ তখন আমি দেখা করতে যেতাম।

মুনমুনকে তো কত ছোট থেকে দেখেছি। ওর মেয়েদের দেখি। ফ্লাইটে কিংবা কোনও ফাংশনে দেখা হয় এখনও। রাইমা এক বার আমার কাছে এসেছিল ওর দিদিমাকে নিয়ে নানা কথা জানতে, একটা শুটও হয়েছিল। ওদের প্রতি রইল আমার অনেক শুভেচ্ছা আর ভালবাসা।

অন্য বিষয়গুলি:

Suchitra Sen Gulzar memory
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy