ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
আজ ২৯ ফেব্রুয়ারি, রবিবার, ২০৩৬ সাল। ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ অনুষ্ঠানবাড়িতে সকলে নিমন্ত্রিত। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটেছে। প্রার্থনাকক্ষে সকলে অধোমুখে হাতে মোমবাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে। বেলা পৌনে বারোটা। এখনও মিনিট পনেরো বাকি। আমার রাজুমামা তাঁর জায়গায় শুয়ে পড়েছে। খাটটা ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। খাওয়া-দাওয়া থেকে খাট সাজানো, সব কিছুই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট টিম দেখাশোনা করছে। ডাক্তারবাবু ক্ষণে-ক্ষণে ঘড়ি দেখছেন। ঠিক এগারোটা উনষাট মিনিটে মুখে ওষুধটা দিয়ে দেবেন। রাজুমামা ঠিক বারোটায় মারা যাবে।
প্রার্থনাকক্ষে রবিঠাকুরের ‘আগুনের পরশমণি’ মৃদু সুরে বাজছে। ওয়াশিংটনে থাকা রাজুমামার ছেলে সিঞ্চনদা মাথার সামনে দাঁড়িয়ে, মামিমা পাশে। সে বার আমাদের পাশের বাড়ির সিন্টুদাদুর মৃত্যুদিনে ডুবিয়েছিল একটা ম্যানেজমেন্ট টিম, এরা দেখছি অনেক বেশি প্রফেশনাল। এখনও পর্যন্ত আয়োজনে কোনও ত্রুটি নেই। মোমবাতি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, সব ঠিকঠাক। ‘আগুনের পরশমণি’ গানটা শুধু রাজুমামুর ঠিক করে দেওয়া।
পনেরো মিনিট যেন কাটতে চাইছে না। মামু এক বার উঠে সিঞ্চনদাকে জিজ্ঞেস করল টিংটিং কোথায়। টিংটিং সিঞ্চনদার মেয়ে। সে তার একটা বন্ধুর সঙ্গে লাইভ চ্যাট করছিল। দাদুনের কাছে গেল। শেষ হামি খেল দাদুন। ‘‘তোর বয়ফেন্ড কোথায়?’’ মামু জানতে চাইল। ডিং কাছে গেল। ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান। ভাবী দাদাশ্বশুরের মৃত্যু দেখতে উড়ে এসেছে। পল্টুমামু ডাক্তারের কাছে কাছে গিয়ে কী সব বলাবলি করল। রাজুমামু আবার উঠে পড়ল। আঙুলের ইঙ্গিত দেখে বুঝলাম ওয়াশরুমে যাবে। শেষ বারের মতো কাজটা মিটিয়ে এসে আবার শুয়ে পড়ল মামু। আমার খুব বোরিং লাগছে। এত আগে হাতে মোমবাতি ধরে দাঁড়িয়ে না পড়লেই হত। মায়ের জন্যই, মায়ের সবেতেই খুব তাড়া। রিংয়ের মেসেজ ঢুকছে। মোবাইলটা ভাইব্রেট মোডে রাখা। মাঝে-মাঝে সেটা ভ্রমরার মতো ভোঁ-ভোঁ করে উঠছে। রিং লাইভ দেখতে চায়। আমার ইচ্ছে নেই। এখন রিং দিল্লিতে। পরীক্ষার জন্য আসতে পারেনি। আমার জুনিয়ার রিসার্চ ফেলো। আমরা একই রুমে থাকি। এতে অনেক খরচ বাঁচছে। আমিও আসতে চাইছিলাম না। মা বারবার বলল, ‘‘তোর মামা তোকে শেষ দেখা দেখতে চেয়েছে। রিচুয়ালের ব্যাপারও আছে। তোর মামিকে তো জানিস, এখনও আদ্যিকালে পড়ে আছে। খুব ধর্ম মানে।’’
কাল সকালেই আসতে হয়েছে। সিঞ্চনদাকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে আমাকে দিয়ে মামিমা অনেক ধর্মীয় কাজ করিছেন। মামি নেড়া হতে বলছিলেন, আমার তাতে খুব একটা আপত্তি ছিল না। মাঝে-মাঝে সব চুল ফেলে দেওয়াটা ফ্যাশনের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু মা তীব্র প্রতিবাদ করে মামিমার সঙ্গে একচোট ঝগড়া করল। মামির শিক্ষাদীক্ষাবংশ ধরে টান দিতে আমি প্রতিবাদ করলাম। মা শান্ত হল, মামির কথা রাখতে আমি বাধ্য ছেলের মতো, ব্রাহ্মণের নির্দেশ মতো সব করে গেলাম। মামি খুশি হলেন। বামুনঠাকুরের আমাকে খুব ভাল লেগেছে। মামিকে বলেছেন, এমন ধর্মপ্রাণ ছেলে এই সময়ে পাওয়া যায় না। কিন্তু মামিমা এই ইচ্ছামৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। বছরপাঁচেক হল দেশে আইন পাশ হয়েছে। বিদেশে তো সেই কবেই হয়েছে। আমাদের এখানে পলিটিক্যাল দলগুলো বাধা দিচ্ছিল। তিরিশ সালে আইনটা পাশ হল। কবে থেকে শুনে আসছি আইন পাশ হবে। যে যার ইচ্ছেমতো মরবে, এটা তো ফান্ডামেন্টাল রাইটের মধ্যেই পড়ে। রাজনীতি এত সব শুনবে কেন, তাদের পিছিয়ে থাকাতেই আনন্দ। অন্য দেশ কত এগিয়ে গেল, আমাদের দেশ এখনও পড়ে আছে আদ্যিকালের ধ্যান-ধারণা নিয়ে। মঙ্গলে-চাঁদে জমি কিনছে মানুষ, সেখানে বাংলো বানাচ্ছে, মঙ্গলে প্যাকেজ ট্যুরে যাচ্ছে। নকল সূর্যও তৈরি করে ফেলল আমেরিকা। মহাকাশে কলোনি করেছে জাপান। আমার একটা বন্ধু সেখানে আছে। খাওয়া-দাওয়ার বালাই নেই। সপ্তাহে একটা ইনজেকশন নিলেই হল। আর আমাদের দেশে একটা ইচ্ছামৃত্যুর বিল আনতে সরকারের কয়েক বছর চলে গেল! মানুষের স্বাধীনতায় এখানে এখনও ক্ষণে-ক্ষণে হস্তক্ষেপ। এই তো সে দিন দিল্লির একটা স্পার্ম-ব্যাঙ্কে হামলা হল। এ সব নাকি কলোনিয়াল কালচার। বাইরে পড়াশোনা করতে যাওযা ছেলেদের এখন হাতখরচের একটা বড় সোর্স স্পার্ম বিক্রি। কলেজছাত্রদের ওটার দাম সবচেয়ে বেশি। স্কলার হলে তো কথাই নেই। আমি সপ্তাহে এক দিন বিক্রি করি। অনেক খরচই তা থেকে উঠে আসে। অন্য সিটিগুলো তো এখনও স্পার্ম ব্যাঙ্ক চালু করার সাহস পেল না। এই শহরেই তো চালু হল এই সে দিন।
মামিমা কাঁদতে শুরু করলেন। ‘আগুনের পরশমণি’কে তা ছাপিয়ে গেল। সিঞ্চনদা বিরক্ত। থাকতে না পেরে বলে উঠল, ‘‘মা, তোমার সব সময় কান্না আমার ভাল লাগে না। জানো, এখানে কত জন লাইভ করছে! ফরেনে কত জন ব্যাপারটা এনজয় করছে! টিংটংয়ের মাম আসতে পারেনি বলে অফিস কামাই করে দেখছে! তুমি আমার মান-সম্মান রাখলে না। এত সুন্দর একটা পরিবেশ তুমি নষ্ট করে দিয়ো না প্লিজ়।’’
মামিমা এ বার আওয়াজ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। এ দিকে আমার মোবাইলটা ভোঁ-ভোঁ করে চলেছে। মেয়েটা খুব বিরক্ত করছে! মামার মৃত্যুদৃশ্য রিংকে না দেখিয়ে উপায় নেই দেখছি। বললাম, ‘‘এক জন মানুষ মরছে, সেটা দেখার কী আছে! মানুষের প্রাইভেসি বলে কিছু থাকল না। জন্ম থেকে মৃত্যু সব দেখতে চায় মানুষ। রাজুমামারা কোনও দিন কল্পনা করেছে, এখনকার ছেলেমেয়েরা চাইলেই দেখতে পারে সে মায়ের পেটে থাকার সময় কী করছিল! কী ভাবে ডাক্তাররা মায়ের পেট কেটে তাকে বাইরে আনছে, সেটাও ছেলেমেয়ের মোবাইলে থাকতেই হবে। যদিও এটা এখন খুব জরুরিও, কোনও ক্রিটিক্যাল রোগ হলে ডাক্তারবাবুরা তা দেখতে চান। আগে মানুষ বলত, জন্ম-মৃত্যু ইশ্বরের লেখা। এখন কোনওটাই ইশ্বরকর্ম নয়, সবই মানুষের খেলা। সেখানেও ঈশ্বর তার এখতিয়ার হারিয়েছেন।
এক দিকে ভালই হয়েছে। অনেক ঝামেলা কেটেছে। মায়ের মুখে শুনেছি, আগে কেউ মারা গেলে তার আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিতে হত। তারা কখন কবে আসত, তার পর বার্নিংঘাটে নিয়ে যাওয়া হত। ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকলে তাদের জন্য মৃতদেহ বরফে ঢাকা দিয়ে রাখা হত, যাদের ক্ষমতা থাকত তারা পিস হাভেনে রাখত। সেখানেও রাখার খরচ আছে। তার চেয়ে বাবা একটা ছুটির দিন দেখে সবাইকে নিমন্ত্রণ করেই মরা ভাল। কারও খুব অসুবিধে থাকলে দু’দিন পিছোনো যেতে পারে। এতে সবাই শেষ দেখা দেখতে পেল, কারও কাজ ফেলে তড়িঘড়ি দৌড়ে আসার ব্যাপার থাকল না। রাজুমামা তো আমার জন্যই দু’বার মৃত্যুদিন পিছোল। বলেছিলাম, দিল্লিতে বসে মায়ের মোবাইল থেকে লাইভ দেখে নেব, কিন্তু মামা শুনবে কেন! একমাত্র ভাগনেকে কাছে নিয়ে মরবে। মৃত্যুর পরে পালনের জন্য আর কোনও রিচুয়াল বাকি রেখে যাচ্ছে না মামা। সবই নিজের চোখে দেখে যাচ্ছে। কোনও আইটেম খারাপ হলে কারও উপর দোষ দেওয়ার ব্যাপার রইল না।
‘‘রিং, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিস?’’
‘‘জিঙ্ক, আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবি?’’
‘‘কী, বল?’’
‘‘তোর মামার কাছে এক বার যাবি? একটা কোয়্যারি আছে।’’
‘‘মানুষটা মরতে যাচ্ছে, এই সময় আবার কী জানতে চাইবি?’’
‘‘প্লিজ়, একবারটি যা।’’
বাধ্য হয়ে মামার কাছে গেলাম। মামা উঠে বসল। ডাক্তারবাবু বিরক্ত। মামা খুব টেনশন করছে। হাজার হোক আর কিছু ক্ষণ পর মারা যাবে। ডাক্তারবাবু পটাশিয়াম সায়নাইডের ক্যাপসুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। মাথার সামনে মৃত্যুদূত। মামুর কৌতূহলী মুখ, ‘‘কিছু বলবি জিঙ্ক?’’
‘‘মামু, রিং কিছু একটা জানতে চায় তোমার কাছে।’’
মামু আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল, ‘‘হাই রিং, বলো কী জানতে চাও?’’
‘‘আচ্ছা মামু, এই সময় আপনার কেমন ফিলিংস হচ্ছে?’’
মামু এই সময় এমন প্রশ্ন আশা করেনি। তবু রিংকে ভাগনেবউ বলে জানেন। অন্য কেউ হলে শেষ বেলাতেও খেপে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিত। আমার মুখের দিকে আলতো করে তাকিয়ে বলল, ‘‘টেনশন একটু যে হচ্ছে না, তা নয়। তবে একটা ভাল লাগার ব্যাপারও আছে। এই যে সব কিছু ঠিকঠাক দেখে মরতে পাচ্ছি, সকলে আমার মৃত্যু দেখতে হাজির হয়েছে, বেশ এনজয় করছি।’’
‘‘ওকে, এটাই আমার কোয়্যারি ছিল। আর বিরক্ত করব না মামু। বেস্ট অব লাক।’’
মামু আবার খাটে শুয়ে পড়ল। ডাক্তারবাবু সিঞ্চনদার অনুমতি নিয়ে ক্যাপসুলের প্যাকেট খুললেন। সারা প্রার্থনাঘরে একটা ঠান্ডা নীরবতা। মোমবাতি যাঁদের নিভে গিয়েছিল, তাঁরা আবার জ্বালিয়ে নিলেন। ডাক্তারবাবু এগিয়ে এলেন মামুর দিকে। শেষ মুহূর্তটা ধরে রাখতে সকলে মামুর কাছাকাছি এগিয়ে যাচ্ছেন। এমন একটা পরিস্থিতিতে ঘরের মাঝে দুম করে শব্দ হল। মামিমা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। সকলে ধরে তুললেন। ডাক্তারবাবু পটাশিয়াম সায়নাইডের ক্যাপসুল রেখে মামিমার কাছে গেলেন। পাল্স দেখে বললেন, ‘‘সিরিয়াস কন্ডিশন, এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’’ মামুও মৃত্যুশয্যা থেকে
উঠে এসে মামিমার হাতের ধাত দেখছে। রাগে বিড়বিড় করতে করতে বলছে, ‘‘মহিলাকে বিয়ে করে
নিয়ে আসা পর্যন্ত একটা কাজও শান্তিতে করতে দিল না! কত টাকা খরচ করে মরতে গেলাম, তাতেও শেষে বাগড়া দিল।’’
তার পর মামু চিৎকার করে বলল, ‘‘দয়া করে আপনারা মোবাইলের লাইভটা বন্ধ করুন। আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় করে আপনারা এসেছিলেন। এ বারও আমার মরা হল না। এই নিয়ে তিন বার ভেস্তে গেল আমার মৃত্যুদিন। আর স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে যাব না। ভারটা ঈশ্বরের উপরেই ছেড়ে দিলাম।’’ সিঞ্চনদা ‘‘ডিসগাস্টিং’’ বলে প্রার্থনাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মামিমার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স এল। মামিমাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলেন মামু। প্রার্থনাকক্ষের বাইরে বসে থাকা পুরুতঠাকুর আমাকে ডেকে বললেন, ‘‘এটাই হল ঈশ্বরকর্ম, বাবা। পটাশিয়াম সায়নাইডের মৃত্যুটাও উনিই লেখেন। তাঁর ইচ্ছে না হলে কিচ্ছুটি হয় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy