Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Short Story

ইনক্রিমেন্ট

সেকশন অফিসারকে দূর থেকে দেখেছি। লিফটে এক দিন পাশাপাশি উঠেওছিলাম। লম্বা-চওড়া ফিটফাট গম্ভীর লোক।

সৌরভ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আপনাকে সেকশন অফিসার ডেকেছেন।” “আমাকে?” একটু অবাক চোখে আমি ফিরে তাকাই। আমায় তো কেউ ডাকে না। দ্বিতীয় বার একটু যেন অবিশ্বাসের ঝোঁক লাগিয়ে জিজ্ঞেস করি, “আ-মা-কে?”

বেয়ারা সুখলাল নীরস গলায় বলে, “হ্যাঁ। আপনার এক বছর সার্ভিস কমপ্লিট হল, খেয়াল নেই? কাগজ সই করতে হবে। ইনক্রিমেন্ট...”

সেকশন অফিসারকে দূর থেকে দেখেছি। লিফটে এক দিন পাশাপাশি উঠেওছিলাম। লম্বা-চওড়া ফিটফাট গম্ভীর লোক। গম্ভীর লোকজনকে আমি একটু ভয় খাই। দামি গন্ধ মাখেন সেকশন অফিসার। আমি বরাবর দামি গন্ধের সামনে কেমন গুটিয়ে যাই। সেকশন অফিসারের কাছে যেতে হবে শুনে আমার একটু নার্ভাস লাগছে।

আমার আপিসটা দশ তলায়। মস্ত হলঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে, একটা জানলার ধারে আমার টেবিল। বাঁ দিকেই জানলাটা, একটা কাচ ভাঙা। দূরে গঙ্গা দেখা যায়। হাওড়া ব্রিজ। পিঁপড়ের মতো মানুষ, খেলনার মতো গাড়িঘোড়া। একটু ঝাপসা লাগে, সেটা নদীর বুকের ফিকে কুয়াশার কারণে, না আমার দৃষ্টির ক্ষীণতার দরুন, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আমার ডান পাশে লোয়ার ডিভিশন রণেন মাইতির টেবিল। উল্টো দিকে বিষ্ণু সরকার, ইউ ডি। মাঝে মাঝে ভাবি, ওদের জিজ্ঞেস করি— ওদেরও কি ঝাপসা লাগে আমার মতো? কিন্তু না, প্রশ্ন করতে সঙ্কোচ হয়।

আমার সঙ্গে তো কেউ মেশে না। কথাবার্তাও হয় কালেভদ্রে।

আসলে, এই আপিসে আমার নামই হচ্ছে ‘পাগলা শুভো’।

ঠিক এক বছর আগে, যে দিন একটা কোঁচকানো জামা আর ইস্ত্রিহীন ট্রাউজ়ার পরে আমি এই আপিসে ঢুকি--- সে দিন থেকেই আমাকে অভ্রান্ত ভাবে চিনে নিয়েছে ডিপার্টমেন্টের লোকজন। আমার মুখে দিন ছয়েকের বাসি দাড়ি ছিল, অর্ধেক পাকা। মাথায় অবিন্যস্ত এলোমেলো চুল, কালো আর সাদা প্রায় সমপরিমাণ, সেও প্রায় আড়াই মাসের আ-কাটা। চপ্পলে অনেক তাপ্পি-সেলাই। কাঁধের ঝোলা তেলচিটে, চেন-খোলা। ফিসফিস শুরু হয়েছিল তখনই।

চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই, এমন বুড়ো বয়সে আমি কেরানিগিরির চাকরির পরীক্ষায় উতরোলাম কী করে— বিশেষত এমন খেপাটে দশায়--- তা ছিল গোটা হলঘরের গবেষণার বিষয়। এক দল বলল, হাই লেভেলে ক্যাচ আছে। আর এক দল বলল, আসলে শুধু রিট্‌ন পরীক্ষা

তো, তাই। ইন্টারভিউ থাকলে আর এই থোবড়ায়...

বুড়ো হেড ক্লার্ক অনিল গাঙ্গুলি তিন দিনের মাথায় আমাকে ডেকে বলেছিলেন, “হলই বা সরকারি আপিস, নাই বা রইল কর্পোরেটের মতো ড্রেস-ডেকোরাম, একটু ভদ্দরলোকের মতো জামাকাপড় পরেও কি আসা যায় না শুভময়বাবু?”

আমি এক বার কুটকুটে দাড়িতে, আর এক বার মাথার উড়োখুড়ো চুলে হাত চালিয়ে বলেছিলাম, “হ্যাঁ স্যর, ঠিকই... কিন্তু আসলে... আমার সব জামাকাপড়ই এ রকম স্যর, মানে... একলা মানুষ...”

চশমাটা কপালে তুলেছিলেন অনিল গাঙ্গুলি, “বাড়িতে দেখার কেউ নেই? মা, বৌ...?”

“আজ্ঞে মা তো অনেক দিন আগেই...”

“অ, আচ্ছা। বৌ?”

“আজ্ঞে, সেও...”

“অ্যাঁ! মারা গিয়েছে!” অনিলবাবুর মুখে আধা-দুঃখ আধা-বিস্ময়ের একটা ভাব ফুটছিল।

“না স্যর। চলে গিয়েছে,” একটু থেমে, গলা নামিয়ে, প্রায় অশ্রুত স্বরে বলেছিলাম আমি, “কিন্তু আসবে, বুঝলেন। ফিরে আসবে আবার।”

আমার উত্তরটা অনিলবাবুর মুখ থেকে দুঃখের ভাবটুকু এক লহমায় সরিয়ে দিয়ে একটা বেয়াড়া কৌতূহলের রঙ ছুপিয়ে দিচ্ছিল, স্পষ্ট দেখেছিলাম আমি। বিড়িখোর দু’টো কালো ঠোঁটে এক ঝাঁক কূট জিজ্ঞাসা হুড়োহুড়ি ঠেলাঠেলি করছিল, ফুঁড়ে বেরোতে চাইছিল--- মিটসেফের জালের বাইরে ইঁদুরেরা যেমন হামলে পড়ে ফুটোফাটা খোঁজে। কিন্তু আমি আর দাঁড়াইনি। পিছন ফিরে চলে এসে নিজের সিটে বসে পড়েছিলাম। গঙ্গার হাওয়া আমার কপালের রুখু চুল নিয়ে খেলা করছিল। আমি টের পাচ্ছিলাম, হেড ক্লার্কের টেবিল থেকে একটা গুঞ্জনের ঢেউ বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ছে হলঘর জুড়ে।

যার বৌ চলে গিয়েছে, তার পাগল হওয়া কি যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত নয়? পোশাকআশাক নিয়ে আর কেউ তেমন ঘাঁটাত না আমাকে তার পর থেকে। ডিপার্টমেন্টে ‘পাগলা শুভো’ নামটার জন্ম বোধহয় সেই দিনই।

খুব যে অসুবিধের মধ্যে আমার দিন কেটেছে এই আপিসে, তা বলতে পারি না। সত্যি বলতে কী, সব আপিসেই একটা-দু’টো পাগলাটে লোক নিজের খেয়ালে বিন্দাস কাটায়, তাদের কেউ ঘাঁটায় না। জয়েন করার দেড় মাসের মাথায় আমিও যে দিন অ্যাকাউন্টসের ফাইলে কবিতা লিখে টাইপ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, একটু চেঁচামেচি জলঘোলা হয়েছিল বটে, কিন্তু চাকরি যায়নি। বরং অনিলবাবুর হস্তক্ষেপেই আমাকে একটা গুরুত্বহীন টেবিল দিয়ে এই নির্ঝঞ্ঝাট কোণে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বেশ আছি সেই থেকে। সারা দিন বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি।

রণেন মাইতি এক বার জিজ্ঞেস করেছিল, “সারা দিন কী ভাবো, ভায়া? নাগাড়ে বাইরে তাকিয়ে? এত কী ভাবার থাকতে পারে একটা লোকের, অ্যাঁ, বাপরে বাপ!”

বোঝো! বলে কি না, এত কী ভাবার! আমি উত্তর দিইনি, শুধু হেসেছিলাম। এরা সব ‘নরম্যাল’ লোকজন। এদের বোঝানো যাবে না।

ভাবার জিনিসের কি শেষ আছে?

শুধু সুজাতাকে ভেবেই তো গোটা দিন কাটিয়ে দিতে পারি আমি দিব্যি।

সুজাতা, আমার বৌ। যে ছেড়ে গিয়েছে আমাকে।

‘গিয়েছে’ শব্দটা অবিশ্যি আমি ভাবতে পছন্দ করি না। ‘আসবে’ এই কথাটাই বেশি জরুরি। কাল নয় পরশু, নয়তো তরশু--- সুজাতা ফিরে আসবে আবার আমার কাছে। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছে সে।

ফিরে এসে প্রতি মাসে চুল কাটতে পাঠাবে আমাকে সুজাতা, দু’দিনের বেশি তিন দিন হলেই দাড়ি কামানোর জন্যে ঝুলোঝুলি করবে। আমার জামাকাপড় ধবধবে করে কেচে দেবে, ইস্ত্রি করে দেবে। ফিটফাট টুটুবাবু করে আপিস পাঠাবে। স্টিলের টিফিনকৌটোয় ভরে দেবে নরম সাদা লুচি আর বেগুনভাজা। সুজাতার মতো করে নিটোল গোল লুচি আমি আর কাউকে বেলতে দেখিনি। বেগুনভাজার একটি কোণও কালো হত না, তেল গড়াত না এতটুকু, পেপার ন্যাপকিনে মুড়ে নিখুঁত করে শুষে তার পর আলতো করে শুইয়ে দিত। সঙ্গে একটা কাঁচা লঙ্কা, মাস্ট। গাঢ় সবুজ, শক্ত খোসার লম্বাটে যে লঙ্কাগুলো, খুব ঝাল, সেই রকম আমার পছন্দ। এক দিন আমি কী একটা দরকারে শহরে বেরিয়েছিলাম, সুজাতা আমার জন্যে টিফিন গুছিয়ে কৌটো ভরে দিয়েছিল কাঁধের ঝোলায়। গঙ্গার ঘাটে বসে খেয়েছিলাম। সেই এক বারই--- ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম বলেই বোধহয়, সে স্মৃতি অক্ষয় হয়ে আছে।

এখন আমি টিফিনে দু’টাকার মুড়ি-ছোলা কিনে খাই। সুজাতা ফিরে এসে আবার সব সাজিয়ে গুছিয়ে দেবে, বলে গিয়েছে। ওর মতো কেউ জানে না, আমার পছন্দ-অপছন্দ।

আমার সঙ্গে তিন দিন সংসার করেছিল সুজাতা। হ্যাঁ, মাত্র তিন দিন। সেও কত বছর আগে! তাতেই আমি টের পেয়েছি, কী লক্ষ্মীমন্ত আর গুছোনে বৌ সে।

সুজাতা ফিরলেই সব বদলে যাবে। শুধু এক বার সুজাতাকে খবরটুকু দেওয়া। যে, আমি চাকরি পেয়েছি, চাকরি! তা হলেই, ব্যস!

কিন্তু, সুজাতাকে খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই। আমাদের পুরনো পাড়া ছেড়ে ওর ফ্যামিলি তো সেই ক-বে চলে গিয়েছে। তখন আমি কাঠবেকার, ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরি, মায়ের সঙ্গে এক-কামরার ভাড়াঘরে থাকি, তিনটে টিউশনি করি। সুজাতার বাবা যখন ট্রাক ডেকে বাক্স-বিছানা তুলছিলেন, আমি মাঠের ওপাশে অশ্বত্থগাছের আড়াল থেকে দেখছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল এক বার জিজ্ঞেস করি, ‘কাকু, নতুন বাসার ঠিকানাটা অন্তত...’

না, জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়নি। কয়েক মাস আগেই তো ক্লাবের ছেলেদের দিয়ে সালিশি ডাকিয়ে পঞ্চায়েত মেম্বারের সামনে ফয়সালা হয়েছিল— ভবিষ্যতে কখনও সুজাতা বা তার পরিবারের সঙ্গে সামান্যতম যোগাযোগের চেষ্টাও করতে পারব না আমি! করলেই পাড়াছাড়া হতে হবে, বুড়ি মা সমেত! সুজাতাকে আমার বৌ বলে মানেইনি ওরা কেউ। ও সব নাকি নিছক ছেলেমানুষির ঝোঁক...

সালিশি সভার পিছনে অনেক টাকা ঢেলেছিলেন সুজাতার বাবা, জানতাম। তবু আমি সেখানে একেবারে চুপ করে থাকিনি। মরিয়া হয়ে বলেছিলাম, “কিন্তু সুজাতা তো স্বেচ্ছায় চলে এসেছিল আমার কাছে... তিন-তিনটে দিন...”

ক্লাব আর পঞ্চায়েতের লাল-চোখ মাতব্বররা হুঙ্কার দিয়ে থামিয়েছিল আমাকে। ঘোষণা করেছিল— নিছক বন্ধু হিসেবেই আমার বাসায় গিয়েছিল সুজাতা, থেকেছিল দিনকয়েক, জাস্ট সমবয়সি বন্ধু যেমন বেড়াতে যায়! তার বেশি কিচ্ছু ঘটেনি। সে নিজেই নাকি বলেছে তেমনটা। কোনও সইসাবুদ হয়নি, রিচুয়ালসও নয়। সে জানিয়েছে, তিন দিন সে ঘুমিয়েছে আমার মায়ের সঙ্গেই! এর বেশি কিছু রটালে বা দাবি করলে মাথা ভেঙে দেওয়া হবে আমার।

আমি ভয়ে চুপ করে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, সুজাতা ঘুমিয়েছিল মায়ের সঙ্গেই, তক্তপোষে, ঠিকই। আমি মেঝেয়, মাদুর পেতে। হ্যাঁ, সইসাবুদ আচার-অনুষ্ঠানের সুযোগও ওই তিন দিনে আমি করে উঠতে পারিনি। কিন্তু তাতেই কি সব? সুজাতা যে নিজের মুখে আমাকে বলেছিল, সে আমার বৌ! তার চেয়ে বড় কথা দুনিয়ায় কী থাকতে পারে! কলেজ-পড়ুয়া সুজাতা যে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে এসে ওই তিন-তিনটে দিন যেচে আমার বৌ হয়েছিল, তার ভ্যালিডেশন হবে শোয়াশুয়ির বিচারে? ছি ছি!

কিন্তু, আমি বলতে পারিনি কিচ্ছু। ওই তিনটি দিন যে আমার ভাঙা ঘরে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে গিয়েছিল সেই মেয়ে— আমার মাকে সে মা বলেছিল, আমার মা তাকে পুত্রবধূ বলে মেনেছিল। সুজাতা রীতিমতো রান্নাবাড়া করে ঝাঁটপাট দিয়ে আমার গরিব সংসারে বধূজীবন যাপন করেছিল ওই তিন দিন— এ সব যুক্তি আর পেশ করতেই পারিনি। এমনকি, চার দিনের মাথায় সুজাতার বাবা যখন গাড়ি করে তাকে আমার কাছ থেকে এক রকম জবরদস্তি উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন— তখনও সুজাতা আমাকে বলেছিল, সে ফিরে আসবে! আমি একটা চাকরি জোগাড় করলেই... যেখানেই সে থাকুক, কেউ তাকে আটকে রাখতে পারবে না।

সেই শেষ দেখা। আর তাকে বেরোতে দেয়নি তার পরিবার। সালিশি বসিয়ে আমাকে শাসিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমার অগোচরেই তাকে পাচার করে দেয় নতুন জায়গায়, তার পর নিজেরা শিফট করে। ঠিকানা মেলেনি আর।

লরিটাকে আমি সাইকেলে করে ফলোও করেছিলাম অনেক দূর পর্যন্ত। কিন্তু ওরা হাই রোডে উঠে পড়ার পর সাঁ-সাঁ করে চলে গেল, নাগাল পেলাম না।

তার পর থেকে কেবলই সুজাতাকে খুঁজে চলেছি আমি, চাকরি খোঁজার মতোই হন্যে হয়ে। উন্মাদের মতো খেটে, বছরের পর বছর রগড়ে, ব্যর্থ হতে হতে--- চাকরিটা পেয়েছি অবশেষে। সুজাতার জন্যেই তো চাকরি। সেই খবরটা তাকে পাঠানো ভীষণ দরকার। ভীষণ!

জানতে পারলেই সুজাতা ফিরবে। সুজাতা ফিরলেই আমি আবার ভাল হয়ে যাব। সুস্থ, স্বাভাবিক। নরম্যাল। রণেন মাইতির মতো, বিষ্ণু সরকারের মতো। তখন আমার টেবিলে ফাইল উপচে পড়বে। খসখস করে নোটশিটে ঝকমকে ইংরিজিতে নোট লিখব। ‘এনক্লোজ়ড প্লিজ় ফাইন্ড হিয়ারউইথ আ সামারাইজ়ড অবজ়ার্ভেশন অন...’! সুখলালকে ডেকে ঘ্যাম নিয়ে বলব, “সেকশন অফিসারের টেবিলে দিয়ে এসো, যাও।”

আহ্‌, শুধু কবে যে...

...“কী হল, এখনও যাননি! কখন বলে গেলাম!” সুখলাল ধমকাচ্ছে।

আমি চমকে কাঁচুমাচু মুখে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ি। চাকরির এক বছর হল। ইনক্রিমেন্ট। মাইনে বাড়ছে

বোধহয়। কিন্তু এখনও সুজাতার খোঁজ নেই।

আমার টেবিল থেকে কোনাকুনি, হলঘরের দূর প্রান্তে সেকশন অফিসারের ঘর। একটা থামে আড়াল পড়ে কিছুটা, তার পরে কাঠের কিউবিকলের বাকি অংশটা দেখা যায়। নেমপ্লেট ঝকঝক করে। গম্ভীর, ব্যক্তিত্ববান, শৌখিন লোক— সেকশন অফিসার।

আচ্ছা, সেকশন অফিসারও কি আমাকে পাগলা শুভো বলে জানেন? আমার সব হিস্ট্রি...?

যাওয়ার পথে একটা পুরনো আলমারি পড়ে, তার কাচে নিজের মূর্তিখানার একটা আভাস নেওয়ার চেষ্টা করলাম। ইস, সেই মুখভর্তি দাড়ি, উলুকঝুলুক চুল, খাটো-হয়ে যাওয়া প্যান্ট আর কোঁচকানো জামা! যদি খেয়াল থাকত যে আজ এক বছর পূর্তির দিন--- আর এই দিনে সেকশন অফিসারের ঘরে যেতে হয়— একটু ভদ্রস্থ হওয়ার আগাম চেষ্টা করা যেত। সুজাতা থাকলে মনে করাত ঠিক। ভাবতে হত না...

সুইং ডোরে ক্যাঁচ করে শব্দ হয়। কামরায় দামি গন্ধ। আমি সসঙ্কোচে বলি, “মে আই...”

এঃ হে। খেয়াল করিনি, এখন টিফিন আওয়ার। সেকশন অফিসার ওঁর টিফিনকৌটো খুলেছেন সবে। আপাদমস্তক এক বার দেখলেন আমাকে। একটু অপ্রস্তুত। না কি, বিরক্ত? আমি অপ্রতিভ মুখে বলি, “পরে আসব স্যর?”

“নাহ্‌, এসেই তো পড়েছেন,” গম্ভীর গলায় উত্তর এল, “আসুন, সিগনেচার ক’টা করে দিয়ে যান...”

আমি কাচ-ঢাকা টেবিলের দিকে এগোই। টিফিনকৌটোটা বন্ধ করে দেবেন কি না তা নিয়ে এক মুহূর্ত দ্বিধায় পড়লেন সেকশন অফিসার। তার পর বোধহয় ভাবলেন, পাগল-ছাগল মনিষ্যি...! শুধু বাঁ-হাতের ইশারায় আমাকে কাগজগুলো দেখিয়ে দিলেন।

অনেকগুলো কাগজে লেখা, তার পর সই। তারিখ। দীর্ঘ দিন অভ্যেস নেই এ সব। দাঁড়ানো অবস্থায় টেবিলে ঝুঁকে লিখে চলেছিলাম আমি। হাত কেঁপে যাচ্ছিল আমার। ভুল হচ্ছিল। কাটাকুটি। অনেক সময় লাগছিল।

একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন বোধহয় সেকশন অফিসার— কিংবা খুবই খিদে পেয়েছিল তাঁর— তিনি খেতে শুরু করে দিলেন। আমি তাঁর খাওয়া দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম হঠাৎ। স্থির হয়ে গেল শরীর। কলম থেমে গেল আমার।

“কী হল?” তিনি আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।

আমি যেন একটা অলৌকিক ঘোর থেকে জেগে উঠে আলতো করে জিজ্ঞেস করলাম, “সুজাতাকে একটা খবর দিয়ে দেবেন, স্যর?”

আধখানা লুচিতে মোড়া বেগুনভাজা ডান হাতে ধরা, গাঢ় সবুজ আধখাওয়া লঙ্কাটি স্টিলের কৌটোর ডালায় রাখা রয়েছে— এই অবস্থায় সেকশন অফিসার আচমকা থমকে গেলেন। আমার কথা কি তিনি আদৌ বুঝতে পারছেন? আমি সে-বিষয়ে মাথা ঘামালাম না আর। শুধু দেখলাম, হতচকিতের মতো তাকিয়ে থেকে, খুব বিমূঢ় গলায় তিনি বললেন, “অ্যাঁ!”

আমি শেষ সইটি খুব নিবিড় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করলাম। তার পর কাগজের তাড়াটা সেকশন অফিসারের দিকে যত্ন করে এগিয়ে দিয়ে, বিনীত কিন্তু খুশি-খুশি ভঙ্গিতে, চাপা গলায় বললাম, “শুধু বলবেন, শুভো চাকরি পেয়েছে। আজ ইনক্রিমেন্ট হল।”

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy