Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

ধূসর বিকেল আর একমুঠো চিঠি

এ বাড়িতে একাই থাকে বৈদেহী। বিয়ে-থা করেনি। না, কোনও অসম্পূর্ণতা নয়, রূপ, মেধা লোভনীয় একটা চাকরি আর সেই সুবাদে আর্থিক সচ্ছলতা— সব কিছুই তার মুঠোতে ছিল, তবু বিয়ে করেনি।

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল

রমা সিমলাই
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

মুখ আর মুখোশের গান নিয়ে

তুমি যতই সন্দিহান থাকো

আমি কিন্তু আকাশগঙ্গার পথ বদলে

অলকানন্দা করে দেবো, দেবোই!

শুরুটা লিখতে গিয়ে কম করে চার-পাঁচ বার কাটাকুটি করল বৈদেহী। লেখিকা তো নয়, আদ্যন্তই পাঠিকা। লেখার কথা পেটের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে, কিন্তু নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়, ঠিক কী লিখতে চাইছে, উপন্যাস? ছোটগল্প? নাকি নেহাতই সাদামাটা একটা চিঠি? বেশ, না হয় চিঠিই হল! কিন্তু পাঠাবে কাকে? পড়বে কে! লেখার টেবিলে সাদা পাতায় পেনটা আঙুলে নিয়ে থম মেরে বসে থাকে। আজ যে ভাবেই হোক, শুরুটা করতেই হবে! এমনই বড় বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে। রক্তে তারও খেলা করছে মারণবীজ। একটু আগেই মাকে দেখে ফিরেছে বৈদেহী। অসুস্থ জীর্ণ মা। ক্ষয়ে যেতে যেতে একদম ছোট্ট হয়ে গিয়েছে। অমন গায়ের রঙ (যা নিয়ে এক সময় গর্বিত ছিল সে বন্ধুমহলে) অমন টানা চোখ, অমন গোলাপি ঠোঁট, আজ কুঁকড়ে-মুকড়ে কী অসহায় একটা অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে! অজান্তেই টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে সাদা কাগজটাকে ভিজিয়ে দিল। বৈদেহী উপরের কাগজটা সরিয়ে নিল, কিন্তু কান্নাটা তাতে সরল না! নাহ্‌, এ ভাবে হবে না। উঠে দাঁড়ায়। মাথার ভিতরটা কেমন জ্বালা-জ্বালা করছে। মাঝে মাঝেই হয় এটা। বেসিনে গিয়ে চোখে-মুখে জল দেয়। মুখটা মোছে না। ভিজে-ভিজে ভাবটা একটু আরাম দেয়।

এ বাড়িতে একাই থাকে বৈদেহী। বিয়ে-থা করেনি। না, কোনও অসম্পূর্ণতা নয়, রূপ, মেধা লোভনীয় একটা চাকরি আর সেই সুবাদে আর্থিক সচ্ছলতা— সব কিছুই তার মুঠোতে ছিল, তবু বিয়ে করেনি। ইচ্ছেটা হয়নি আর কী! জ্বালা-জ্বালা ভাবটা একটু কমেছে, কী ভেবে এসির কুলিংটা একটু বাড়িয়ে আবার টেবিলে গিয়ে বসে। হঠাৎই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে যায়। চিঠিটা মাকেই লিখবে সে! মা এখন আর পড়তে পারেন না, পড়া তো দূর অস্ত্‌, অনেক সময় কথাও বুঝতে পারেন না ঠিক মতো। তাতে কী! মাকেই চিঠিটা লিখবে বৈদেহী। মা বুঝতে পারবেন না, এতে তো আরও নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। কোনও ভাবেই মাকে কষ্ট দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। মাকে সে অসম্ভব ভালবাসে। এই ভাল, লেখাটা তাঁকে লিখতেই হবে, অথচ যাকে লিখবে সে একটুও কষ্ট পাবে না। এত সহজ একটা বিকল্প পেয়ে অনেকটা ভারমুক্ত হয়েই কলম তুলে নেয় বৈদেহী।

কোনও সম্বোধন নয়, সোজাসাপটা শুরু করে, ‘তোমাকে খুব খুব খুউব ভালবাসি, মা! ক-ত-টা, তা তুমি আন্দাজ করতে পারবে না। সেই ছোট্টবেলায় যখন ফেরিওয়ালা কাকুর কাছে কাকিমাদের সঙ্গে তুমিও ঝুঁকে পড়ে শাড়ি দেখতে, আর তার পর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শাড়িটা দেখেও না নিয়ে ফিরিয়ে দিতে, আমি কান্নাকাটি শুরু করতাম তোমাকে শাড়িটা নিতেই হবে বলে! তখনও বাজেট ব্যাপারটা মাথায় ঢোকেনি, তোমার অনাবশ্যক কিপটেমিতে আমি আহত হতাম, কারণ আমার ছোট্ট মাথা এটুকু তো টের পেত যে শাড়িটা তোমার পছন্দ, অথচ কেন যে নিচ্ছ না! কেঁদে ভাসাতাম। ওটা ওই ছোট্ট মেয়েটার ভালবাসা ছিল, মা!

তখন বোধহয় আমি বারো। হাইস্কুল! আমার বন্ধুরা এসেছিল বাড়ি। তোমাকে দেখেই ওরা কানে কানে ফিসফিস করতে লাগল। পরে জানলাম ওরা সবাই তোমাকে দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে, “ইস, কী সুন্দর তোর মা! কত ফরসা! কত চুল! কী সুন্দর চোখ!” সত্যিই বলব মা, সেই প্রথমবার আমি জীবনে অহংকারী হয়েছিলাম, তাও তোমাকে নিয়ে! তার পর থেকেই সুযোগ পেলেই আমি ওদের বাড়িতে ডাকতাম শুধু এটা শোনার জন্য, “কী সুন্দর তোর মা!’’ অনেকে আবার বলত, “তুই কিন্তু মোটেই এত সুন্দর হোসনি।” তাতে কী! বুকটা আমার ভরে যেতো! তোমার মনে আছে, মা! আমাদের স্কুলের বড়দি এক দিন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন! তোমাকে দেখেই বলেছিলেন, ‘‘আরে, তুমি তো ভারী সুন্দর দেখতে!” উফ, আমি যেন হাওয়ায় ভাসছিলাম! আনন্দে, গর্বে, উত্তেজনায়! সেটাও আমার ভালবাসাই ছিল, মা! মা গো, কী করে ভুলি বলো, আমাকে গড়ে তোলার পিছনে তোমার প্রতি মুহূর্তের লড়াই, তোমার সমস্ত অবদমিত স্বপ্ন, যা তুমি নিজের জীবনে সাজিয়ে তুলতে পারনি, তুমি আমার জীবনে ফুলে-ফলে পল্লবিত করে তুলতে চেয়েছিলে! আর ঠিক সেই কারণেই পনেরো বছরেরই আমার প্রেমে পড়াটাকে তুমি কিছুতেই মেনে নিতে পারলে না। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল তোমার! আসলে তুমি তোমার কল্পনার পরিকে আমার মধ্যে বাস্তব রূপ দিতে চেয়েছিলে, এতে কোনও দোষ নেই, মা! শুধু তুমি যদি বুঝতে, ঈশ্বরও মানুষ গড়ে তাকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি, সে তার নিজের নিয়মেই চলেছে, এক দিন অস্বীকার করেছে তার স্রষ্টাকেও!

মা, আমি তখন পনেরো, ফ্রক ছেড়ে শাড়ি! একা নিঃসঙ্গ জীবনে (তোমার মনে আছে, মা, তোমার ভালবাসার শাসনে আমার তারুণ্য, আমার কৈশোর আক্ষরিক অর্থেই বন্ধুহীন কেটেছে) আমার কল্পনার ডানা সব সময় সুদূরে পাড়ি দিত।

তবে আমার যা কিছু দৌড় সবই ছিল মনে মনে, আর সেই মনটাই পড়ে ফেলছিলে তুমি! আজও তোমার সেই কঠিন কণ্ঠস্বরটা চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পাই, “আমি তোর পেটে হইনি, তুই আমার পেটে হয়েছিস, আমায় বোকা বানানোর চেষ্টা করিস না! না মা, কখনওই তোমায় বোকা বানানোর চেষ্টা করিনি আমি! সে স্পর্ধাই আমার ছিল না!

উফ, লোডশেডিং-এ সারা রাত ধরে বাতাস করা মা, শীতের রাতে লেপের তলায় ভাত খাইয়ে দেওয়া মা, পড়তে ইচ্ছে না-করা মেয়ের কানের কাছে বই পড়া মা, কী অসম্ভব পালটে গেলে তুমি! ভেসে গেলাম, একদম তলিয়ে গেলাম আমি। অভিমানে নয় মা, ভয়ে আর যন্ত্রণায় একটু একটু করে ক্ষয়ে গেলাম! উঠে দাঁড়ানোর জন্য, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য একটা মানসিক আশ্রয়, একটা শক্ত কাঁধ দরকার ছিল মা, তুমি বুঝতেই পারলে না, তোমার ভিতু-ভিতু মেয়েটা কী ভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল! না মা, তুমি কখনও বন্ধু হতে শেখোনি, তোমার মাতৃত্বের অহংকার, তোমার ক্ষমতার আশ্চর্য সাবলীল প্রয়োগ আমাকে তোমার থেকে অনেক, অনেক দুরে নিয়ে গিয়েছিল, অনেকখানি অন্ধকারে। অথচ দেখো, অনেক পরে আমি জেনেছিলাম, ঠিক এই একই যন্ত্রণার সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্কে তুমিও নাকি হাবুডুবু খেয়ে, শেষে পাশ করতে না পারার যন্ত্রণা বয়ে বেরিয়েছ সারাটা জীবন! আমি ঠিক জানি না মা, নিজের জীবনের অন্ধকার আমাকে দিয়ে তুমি কি মুক্তি পেতে চেয়েছিলে! না কি আলো বা আলেয়ার তিরন্দাজিতে লক্ষ্যভেদ করার নেশা তোমায় তৃপ্তি দিয়েছিল খুব! কিন্তু আমি তো তোমারই আত্মজা ছিলাম, মা!’

বৈদেহীর মাথার ভিতরটা আবার ঝাঁ-ঝাঁ করে, কিন্তু আজ তাকে লেখায় পেয়ে বসেছে। কলমের উপর তার যেন কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই! সে ইচ্ছেমতো গড়িয়ে চলেছে, সময়ের সুদকষা না মানে ঘড়ির কাঁটা, না মানে যুক্তি। তার দায় শুধু স্মৃতির সীমাবদ্ধতায়! তাই বৈদেহী থামতে চাইলেও পারছে না।

‘সময় কী জানি কী ভাবে কান্নার দাগ মুছে ফেলে, মা। রক্তক্ষরণ জমাট বেঁধে কয়লা হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তুমিও নিশ্চিন্ত হয়েছিলে মেয়েকে স্বাভাবিক দেখে। কিন্তু দেখো, কোথায় যেন কয়লাগুলোও জ্বালানি হওয়ার জন্য মনে মনে বিদ্রোহী হতে শুরু করে! শুধু বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারে না। আমার কলেজে যাওয়া, আবার আমার বন্ধুদের তোমায় দেখে মুগ্ধ হওয়া, খুশি হতাম, মা। ভীষণ খুশি হতাম, কিন্তু তোমায় কেমন যেন একটা স্ফুলিঙ্গ ভাবতাম, যাকে দূর থেকে ভাল লাগে, কাছে গেলেই পুড়িয়ে দেয়! তোমার মেমসাহেবের মতো রঙ, একঢাল কালো চুল, গোলাপি ঠোঁট, টানা-টানা দু’টো চোখ, সে এক অন্য রকমের মুগ্ধতা! আর সেই মুগ্ধতার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এক বিষণ্ণ ভয় আমি কখনও কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারতাম না।

হ্যাঁ, আমার জীবন থেকে অর্ককে মুছে দিয়েছিলে তুমি। অথচ সেই অর্কই আবার আসতে শুরু করল আমাদের বাড়িতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা! কেউ বলেনি, তবুও আমি কী ভাবে যেন বুঝে নিলাম, অর্ক আমার জন্যই ছুটে আসে, আমার জন্যই এ বাড়িতে তার ‘নিত্য যাতায়াত’! সে যে কী আনন্দ, কী প্রাপ্তি, কী উন্মাদনা! কৃতজ্ঞতায়, প্রতীক্ষায়, পূর্ণতায় আমি তখন একটু একটু করে মানবী হয়ে উঠছি।’ কলমটা হাত থেকে পড়ে যায় বৈদেহীর। না, থামলে চলবে না। শক্ত করে কলমটাকে ধরে বৈদেহী। আঙুলগুলো কি একটু বেশিই টনটন করছে! অনেক দিন একসঙ্গে এত ক্ষণ লেখার অভ্যেস নেই তো! হোক! আজ কিছুতেই থামবে না সে!

‘তোমরা নিজেদের নিয়ে বড্ড বেশি মগ্ন ছিলে মা, আমার কলেজ থেকে ফিরে আসা, জুতো খোলা (কোনওটাই নিঃশব্দে হয়নি), আমার দরজার পাশে দাঁড়ানো কিচ্ছু টের পেলে না তোমরা! অর্ক নয়, আমি শুধু তোমাকে দেখছিলাম মা, কি ভয়ঙ্কর সুন্দর দেখাচ্ছিল তোমায়! সে মুহূর্তে কী যে সুখী দেখাচ্ছিল তোমায়! খুব বমি-বমি পাচ্ছিল, মা! সরে এসেছিলাম দরজা থেকে! মা গো, তোমার লুকনো সুখের ঝাঁপি দেখে কেন যে আমার এত কান্না পেয়েছিল সে দিন!’

কাঁদছে বৈদেহী। নোনা জল ঠোঁট দাঁত ছুঁয়ে এমন লণ্ডভণ্ড ঘটিয়ে দিলো, ফোনটা বাজছে শুনেও এগোতে পারলো না কিছুতেই।

আবার ক্রিং ক্রিং! নিজেকে সামলায় বৈদেহী, এখন সে ফর্টি সেভেন প্লাস! এখনও এত কান্না!

‘‘দিদিভাই, মা আর নেই রে! গাড়ি পাঠালাম। নিজে ড্রাইভ করে আসিস না!’’ ও পাশের গলা বুজে আসে।

মোবাইলটা টেবিলে রেখে কাগজগুলো হাতে তুলে নেয় বৈদেহী। অসমাপ্ত লেখাটা নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে কাগজগুলো, তার পর উপর দিকে ছুড়ে দেয়!

আস্তে আস্তে টুকরো কাগজগুলো সমস্ত স্বরবর্ণ আর ব্যাঞ্জনবর্ণগুলোকে কাঁধে নিয়ে নেমে আসে বৈদেহীর চুলে, চোখে, চিবুকে!

হুহু করে কাঁদছে বৈদেহী। না, ফর্টি-সেভেন প্লাসের বৈদেহী নয়, এ সেই ফেরিওয়ালা কাকুর শাড়ি নিয়ে ফিরে যাওয়া দেখে ভ্যাঁ করে কেঁদে-ফেলা বৈদেহী, বহুরূপী দেখে মায়ের আঁচলের পিছনে মুখ লুকনো বৈদেহী!

অন্য বিষয়গুলি:

short story Rama Simlai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy