ছবি: শুভম দে সরকার
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে প্রেমটা হয়ে বিহানের সর্বনাশ হয়ে গেল। পড়াশুনো ডকে উঠল। দরিয়াকে রোজ একবার দেখার জন্যে সাইকেল চালিয়ে হাওড়া ময়দান থেকে লিলুয়া চলে যেত। রোজ রাতে মোবাইলে গুজুরগুজুর। ফোনে টক টাইম ভরার জন্য মায়ের কাছে হাত পাততে হচ্ছিল ঘনঘন। শ্রীরূপা কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন। তিনি ছেলেকে জিজ্ঞেস না করে তার বেস্টফ্রেন্ড সনৎকে জিজ্ঞেস করলেন।
সনৎও পড়াশুনো আর টিউশনি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। শ্রীরূপার কথা শুনে সে বন্ধুর সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো মিলিয়ে নিল। তার পরে এক দিন বিহানের পিছু নিয়ে চলে গেল লিলুয়ায়। দরিয়া তখন স্কুল কেটে বিহানের সঙ্গে লিলুয়া রেল কলোনির মাঠে বসে গল্প করছে।
বিহানের হাত নিজের হাতে নিয়ে দরিয়া বলল, “পরীক্ষা এসে গেছে। এখন রোজ দেখা করা উচিত নয়। পড়াশুনো আগে। পড়াশুনোর ব্যাপারে আমি খারাপের দলে। টেস্ট পেপার আর স্যরের দেওয়া সাজেশন গাঁতিয়ে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিলে কোনও মতে পাশ করে যাব। আমার বাবা গ্র্যাজুয়েশন করতে পারেনি। আমাকে ওটা করতেই হবে।”
বিহান অন্যমনস্ক গলায় বলল, “আমার মা ইংরিজিতে এমএ। বাবাও তাই। বাবা প্রাইভেট কোম্পানির উঁচু পদে কাজ করত। পাশাপাশি নাটক করত, কবিতা লিখত। মা মনে করত ওসব করা মানে সময় নষ্ট। বাবাকে জোর করে মুম্বইতে ট্রান্সফার নেওয়াল। বাবার কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু একবার মায়ের আঁচলের তলার থেকে বেরনোর পরে স্বাধীনতা কাকে বলে বুঝে গিয়েছিল। আর ফেরেনি।”
“মানে?” দরিয়া অবাক।
“বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাবা মুম্বইতে আবার বিয়ে করেছে। ওদের একটা ইংরেজি নাটকের গ্রুপ আছে। সেটা সারা ভারত ঘুরে শো করে। তা ছাড়া বাবা হিন্দি সিরিয়ালের সংলাপ লেখে। মায়ের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।”
“তোমার সঙ্গেও নেই?”
“না। আমার বয়স যখন পাঁচ, তখন এই সব ঘটে গেছে। কাজেই বাবাকে আমার মনেও নেই। আমার জীবন জুড়ে শুধু মা। বাবার ছাঁচে মা আমাকে গড়ে তুলতে চাইছে। আমি উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করব। ভাল কলেজে ভর্তি হয়ে আবার ভাল রেজাল্ট করব। তার পরে ভাল চাকরি করব। এক বারও ভাবছে না যে আমি পড়াশুনোয় অ্যাভারেজ।”
দরিয়া ভুরু কুঁচকে কিছু ক্ষণ ভেবে বলল, “এই ক’দিন ভাল করে পড়াশুনো করো। বাকিটা পরে ভাবা যাবে।”
বিহান আর দরিয়ার প্রেমের এই গপ্পোটা এইখানে এসে নতুন বাঁক নিল। ওরা যদি যে যার মতো বাড়ি চলে যেত, মন দিয়ে পড়াশুনো করে মোটামুটি একটা রেজাল্ট করত, তা হলে প্রেমটা টিকতেও পারত, না টিকতেও পারত। কম বয়সে এই সব প্রেম কত হয়! আবার কেটেও যায়! কিন্তু দরিয়া আর বিহানের প্রেমটা কাটল না। তার কারণ গল্পে এক জন ভিলেন ঢুকে গেল। তার নাম সনৎ।
সে দুটো কাজ করল। লিলুয়া রেল কলোনির মাঠে বসে বিহান আর দরিয়াকে প্রেম করতে দেখে চলে গেল ‘বসবাস’। সাম্যব্রত আর সীমাকে জানিয়ে দিল, তাঁদের মেয়ে কী করছে। তার পর হাওড়া ময়দানে ফিরে শ্রীরূপাকে সবটা খুলে বলল।
‘বসবাস’-এ এই নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। সাম্যব্রত দরিয়াকে বলেছিলেন, “উচ্চ মাধ্যমিকটা ভাল করে দে। দরকার হলে বিহানকে বাড়িতে ডেকে একসঙ্গে পড়াশুনো কর। সারা জীবনে এই দেড় মাস আর কখনও ফেরত আসবে না।”
আর বিহান? বাড়ি ফিরে শ্রীরূপার হাতে সে বেদম মার খেয়েছিল। শ্রীরূপা মোবাইল কেড়ে নিয়েছিলেন। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিহান স্কুলে বা টিউশনিতে গেলে সঙ্গ দিতেন। সবার উপরে ছিল সনতের শকুনের চোখ।
‘রেবেলিয়ন’ বা পুরনো নিয়ম তছনছ করে দেওয়ার প্রবণতা কৈশোরের স্বাভাবিক ধর্ম। এটা অনেকভাবে আসে। বিহানের ক্ষেত্রে এল আত্মধ্বংসের পথ ধরে। শ্রীরূপার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বিহান সিদ্ধান্ত নিল, পরীক্ষায় খারাপ ফল করে মাকে শাস্তি দেবে।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এল। চলেও গেল। রেজাল্ট বেরোতে দেখা গেল বিহান টেনেটুনে পাশ করেছে। সনৎ সেকেন্ড ডিভিশন। দরিয়া আর মণিদীপা ফার্স্ট ডিভিশন।
শ্রীরূপা তখন থেকেই ছেলের প্রতি বিরূপ। সনৎ আর বিহান যখন শিবপুরের দীনবন্ধু ইনস্টিটিউশনে কমার্স পড়তে ভর্তি হল, বিহানের অ্যাডমিশন ফি-এর টাকা বাঁ হাতে ছুড়ে দিয়েছিলেন।
দরিয়া আর মণিদীপা আর্টস নিয়ে ভর্তি হল হাওড়া গার্লস কলেজে। চার জন ছেলেমেয়ে এক ধাক্কায় বড় হয়ে গেল।
দরিয়ার মাথায় এই সব দৃশ্য এত ক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল। দৃশ্যাবলি ছিঁড়ে গেল। গা গুলিয়ে উঠল হঠাৎ তার। কিছু বোঝার আগেই বমি করল।
কেউ এক জন পাশ থেকে বলল, “পেশেন্ট অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির লোককে খবর দাও। তাড়াতাড়ি। কন্ডিশন ভাল নয়।”
একটা কালো পর্দা নেমে আসছে দরিয়ার চোখের সামনে। সে শুনতে পাচ্ছে, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা করা হচ্ছে, “মেটারনিটি ওয়ার্ডের পেশেন্ট দরিয়া চ্যাটার্জির বাবা সাম্যব্রত চক্রবর্তী। আপনি অবিলম্বে লেবার রুমের সামনে চলে আসুন।”
দরিয়ার জ্ঞান ফিরে আসছে। চোখের সামনে থেকে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। সে চোখ খুলে দেখল, সাম্যব্রত সামনে দাঁড়িয়ে।
দরিয়া অসহায়ের মতো বলল, “বাবা, বিহান কোথায়?”
দরিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সাম্যব্রত মোবাইল বার করে বিহানকে ফোন করলেন। হঠাৎই দরিয়া আর এক বার বমি করল এবং অজ্ঞান হয়ে গেল।
৮
ট্রেনের হাতল ফসকে যাওয়ার ফলে গতিজাড্যের কারণে বিহান ছিটকে গিয়েছে। প্ল্যাটফর্ম শেষ হয়ে আসছে। চলন্ত ট্রেন তাকে টানছে, যেভাবে লোহাকে কাছে টানে চুম্বক। বিহান এই বার খোয়ায় মাথা ঠুকে জ্ঞান হারাবে। অথবা ধাতব চাকার তলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এলোমেলো পা ফেলে সে ছুটছে...
হঠাৎ সবল দু’টো হাত তাকে ধরে এক ঝটকায় ট্রেনে তুলে নিল।
ট্রেনের মেঝেতে বসে হাঁপাচ্ছে বিহান। চোখ বুজে রয়েছে বলে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। অতটা দৌড়নোর ফলে ফুসফুসে একফোঁটা বাতাস নেই। বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। কবাডি খেলোয়াড়রা যে ভাবে বিপক্ষ দলের এলাকায় ঢুকে একে তাকে ছুঁয়ে আবার নিজের কোর্টে ফিরে আসে, সেই ভাবেই মৃত্যুর কোর্টে গিয়ে যমরাজকে ছুঁয়ে আবার জীবনের কোর্টে ফিরে এসেছে বিহান। তার ফুসফুস এখন বাতাস চাইছে, বাতাস।
এক যাত্রী বললেন, “সুদাম না থাকলে তুমি এত ক্ষণে পটলডাঙার টিকিট কেটে ফেলতে।”
অন্য যাত্রী বললেন, “শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হলে সুদামকে একটা পেন্নাম কোরো। ওর জন্যই তুমি আজ বেঁচে গেলে।”
বিহান এ বার চোখ খুলল। ট্রেন যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। কামরায় অনেক যাত্রী। বিহান আন্দাজ করল, এঁরা কলকাতার বাসিন্দা। চাকরির কারণে পোর্ট এলাকায় থাকেন। গন্ডগোলের আঁচ পেয়ে বাড়ি ফিরছেন।
প্রথম যাত্রী স্মার্টফোনে নিউজ চ্যানেল দেখতে দেখতে বললেন, “শিলিগুড়ি আর উত্তর দিনাজপুরে গন্ডগোল শুরু হয়েছে। সরকারি বাস জ্বালিয়ে দিয়েছে। সুবীরদা, এ বার আপনার দলের ছেলেরা মার খাবে।”
দ্বিতীয় যাত্রী, যাঁরা নাম সুবীর, বললেন, “আমিও মোবাইলে নিউজ চ্যানেল দেখছি কিশোর। চ্যানেল বলছে, পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ডে মাইন বিস্ফোরণ। ওখানে তো গণতান্ত্রিক মোর্চার দাদাগিরি।”
প্রথম যাত্রী কিশোর বললেন, “ও রকম বলবেন না সুবীরদা। মানসী বসুকে আপনার দল খরাজ পার্টির লোক মেরে দিল। সেটা অন্যায় নয়?”
সুবীর বললেন, “শোনো কিশোর। আমরা সবাই জানি যে তুমি পোর্টে কিশলয় পার্টি করো আর পাড়ায় গণতান্ত্রিক মোর্চা। গিরগিটিও তোমার কাছে লজ্জা পাবে।”
সুবীর আর কিশোরের মধ্যে জোর তরজা শুরু হয়ে গেছে। কামরার বাকি যাত্রীরা দুই পক্ষে ভাগ হয়ে ভার্বাল ডুয়েল চালাচ্ছে। সে সবে কান না দিয়ে, মাথা তুলে বিহান বলল, “সুদামদা, একটু জল খাওয়াবে?”
সুদাম মেঝেতে বসে ট্রেনের দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। নিজের নাম শুনে বিহানের দিকে তাকাল। জলের বোতল এগিয়ে বলল, “আমাকে চেনো?”
সুদামের পরনে ঢোলা সাদা পায়জামা আর গেরুয়া পাঞ্জাবি। গলায় উড়নি জড়ানো। মাথার চুল কাঁধ ছাপিয়েছে। গলায় আর হাতে নানা রকমের মালা আর হার। এক পায়ে ঘুঙুর পরা। হাতে আর একতারা। অজস্র কাপড়ের টুকরো সেলাই করে বানানো ঝোলা কাঁধে। সুদামকে দেখে ট্রেনে-গান-গাওয়া-ভিখারি বলে বলে মনে হচ্ছে না।
ঢকঢক করে আধ বোতল জল খেয়ে তেষ্টা মিটেছে বিহানের। সুদামকে বোতল ফেরত দিয়ে, হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বলল, “মিনুদির রিকশা চেপে স্টেশন পর্যন্ত এলাম। মিনুদিই বলল, তুমি এই ট্রেনের প্রথম কামরায় থাকো।”
ঘাড় ঘুরিয়ে একমাত্র ভাল চোখটি দিয়ে বিহানকে দেখল সুদাম। বলল, “তোমাকে চিনতে পারলাম না।”
“না চেনারই কথা,” মৃদু হাসল বিহান, “তুমি এক বার একটা দরকারে আমার বাড়ি এসেছিলে। আমি তোমার আধার কার্ডের গন্ডগোল ঠিক করে দিয়েছিলাম।”
এক চোখে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল। মুখময় ফুটে উঠল হাসি। সুদাম বলল, “হ্যাঁ। এবার মনে পড়েছে। তুমি পোর্টে চাকরি করো। নামটা ভুলে গেছি।”
“আমার নাম বিহান। তুমি এই গন্ডগোলের দিনে হাওড়া যাচ্ছ কেন? যদি ফিরতে না পারো?”
“আমি যখন বাড়ি থেকে বার হয়েছিলাম, তখন সব শান্ত ছিল। বেরোনোর পরে গন্ডগোল শুরু হয়েছে। ওই নিয়ে চিন্তা কোরো না। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি গন্ডগোল চলতে থাকে, তা হলে রাতটা হাওড়া স্টেশনে কাটিয়ে দেব।”
“দেখা যাক।” চিন্তিত মুখে বলল বিহান।
বিহানের কথা শেষ হতে না হতেই সুবীর বললেন, “এই যে! লেনিন সরণির ভিডিয়ো দেখো। রাজপথে প্রকাশ্যে মারামারি এবং লুঠতরাজ শুরু হয়েছে। গণতান্ত্রিক মোর্চার মারমুখী কর্মীদের সামলাতে পারছে না পুলিশ।”
কিশোরও কম যান না। নিজের স্মার্টফোন বাড়িয়ে বললেন, “শ্যামবাজারে বাস পুড়িয়ে দিয়েছে খরাজ পার্টির ক্যাডাররা। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা শহরে অঘোষিত বন্ধ।”
সুবীর মোবাইল উঁচিয়ে বললেন, “খরাজ পার্টির একাধিক কর্মী খুন হয়েছেন।”
কিশোরও মোবাইল উঁচিয়ে বললেন, “আমাদের পার্টির ছেলেদের কারা মারছে? আপনারা! সরকার মিলিটারি নামানোর কথা চিন্তা করছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy