Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

প্যান কার্ড

কর্মী দিন দিন কমছে, কাজের পাহাড়। তার মধ্যে কাস্টমারদের অধৈর্য ও অভিযোগে প্রত্যেকটা ব্রাঞ্চ এক-একটা মেছোহাটা।

হর্ষ দত্ত
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

দাড়ি রাখার পর থেকে আজ নয় কাল, রূপম ঝামেলার সামনে পড়ে যাচ্ছে। এমনিতেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মীদের ওপর কাস্টমাররা বেজায় চটা। অ্যাকাউন্ট হোল্ডার হয়ে সবাই যেন মাথা কিনে নিয়েছেন! সামান্য দেরি, কোনও ক্ল্যারিকাল মিসটেক হলেই শুকনো লঙ্কা, ধানি লঙ্কা হয়ে যান এক-এক জন। চিৎকার চেঁচামেচির সঙ্গে ব্যঙ্গ, কুকথা, জ্ঞানদান ও পরামর্শ বিতরণের জোয়ার বইতে থাকে।

কর্মী দিন দিন কমছে, কাজের পাহাড়। তার মধ্যে কাস্টমারদের অধৈর্য ও অভিযোগে প্রত্যেকটা ব্রাঞ্চ এক-একটা মেছোহাটা। এর মধ্যে মন দিয়ে কাজ করা যায়! ওর ডান পাশের টেবিলে বসেন দস্তিদারবাবু। তাঁকে রূপম এক দিন বলেছিল, দাদা, এই পরিবেশে কাজে কনসেন্ট্রেশন দেওয়া সম্ভব! আপনিই বলুন।

দস্তিদার আর দু’বছর পরে অবসর নেবেন। মহিলা গ্রাহকদের প্রতি ওঁর সহৃদয়তা দারুণ। সামনে বসিয়ে অবান্তর কথা শুরু করেন। যুবতী থেকে মাঝবয়সিরা দস্তিদারবাবুর টার্গেটের তালিকায় একেবারে ওপরে। তার পরে পুরুষ গ্রাহক। রূপমের অসহায়তায় অদ্ভুত হেসে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘‘মনটাকে বাদ দিয়ে কাজে প্রাণ ঢেলে দাও। তা হলে আর কোনও সমস্যাকে প্রবলেম মনে হবে না।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

উত্তর সহ্য করতে না-পেরে রূপম কড়া গলায় জানতে চেয়েছিল, ‘‘তার বদলে কী মনে হবে?’’

‘‘এই যেমন ধরো গ্রাহকদের দেখে প্রাণ ভাববে, এরা গগনের তারা, কাননের ফুল, স্বপনচারিণী, বিদেশিনী কিন্তু তোমায় চিনি, সন্ধ্যার মেঘমালা— এই রকম সব আর কী!’’

গালাগালিটা অনেক কষ্টে গিলে নিয়ে রূপম অশ্রুত স্বরে বলেছিল, ‘‘আপনি দেখছি এফ ছাড়া আর কোনও জেন্ডার আছে বলে জানেন না।’’

‘‘কিছু বললে ভাই?’’ দস্তিদার আনমনা ভঙ্গিতে জানতে চেয়েছিলেন।

বিরক্তি ঝরিয়ে রূপম বলেছিল, ‘‘না। ডিল আর ড্রিবলের পার্থক্যটা আপনার কাছ থেকে শিখে নিতে হবে। আসলে ঢ্যামনা ঝোলে গাছে, বলদ খুশি ঘাসে।’’

দস্তিদার এর পর কয়েক দিন বাক্যালাপ বন্ধ রেখেছিলেন। রূপমের তাতে বয়ে গেল! এই যে আজ ওর টেবিলের সামনে রাখা দু’টি চেয়ারে যে-দু’জন বসে আছেন, তাঁদের দস্তিদারের দিকে ঠেলে দিলে বুঝতে পারতেন, প্রাণ বেরিয়ে যাওয়া কাকে বলে! শালা, এর নাম ব্যাঙ্কের চাকরি! খাটা পায়খানার ফিস্‌কল্ এডিশন। আগেরটায় ডাব্বায় মাল ভর্তি হয়, পরেরটায় রাজকোষ বাড়তে থাকে। ছ্যা, ছ্যা!

ভদ্রলোকের নাম মনোরঞ্জন রক্ষিত। ভদ্রমহিলা স্বর্ণময়ী রক্ষিত। স্বামী-স্ত্রী। বয়স যথাক্রমে ঊনআশি ও তিয়াত্তর। রূপম এখন ফিক্সড ডিপোজ়িট দেখাশোনা করে। ক্যাশ কাউন্টার থেকে সরিয়ে আট মাস আগে ম্যানেজার ওকে কত কম সুদ পাব, কত বেশি সুদ পাব দফতরের দায়িত্বে ফেলে দিয়েছেন। রূপম নাকি পাবলিক ডিলিং-এ কম্পিটেন্ট। মাথা গরম করে না। প্রশ্ন যতই বিচিত্র এবং আজগুবি, বোকা-বোকা এবং বিষয় বহির্ভূত হোক না কেন, রূপম ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে দড়। যে দড়, তার গলাতে দড়ি বেঁধে দেওয়াই দস্তুর। ওর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ফিক্সড ডিপোজ়িট যে জ্বর বা ডায়রিয়ার ওষুধ নয়, খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ দেবে— এ কথা কাস্টমারদের বোঝাতে দম বেরিয়ে যায়। প্রকল্পটা যে একটা নির্দিষ্ট সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, তা অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করেন না। যাঁরা বোঝেন তাঁদের দিক থেকে ছুটে আসে নানা গা-জ্বালানি প্রশ্ন, ম্যাচিওরের পরে রিসিটে লেখা টাকাটাই পাব তো! সরকার ইন্টারেস্ট কমিয়ে দেবে না তো? নোটবন্দির মতো কিছু ঘটলে?

উত্তর দিতে দিতে রূপম ক্লান্ত। এরই মধ্যে এক জন প্রৌঢ় ডাক্তারের উদ্ভট প্রশ্নের উত্তরে ও বলেছিল, ‘‘শুনুন, মড়া চুল্লিতে ছাই হয়ে যাওয়ার পরেও ডেথ সার্টিফিকেট যেমন আনচেঞ্জড থাকে, তেমনই এফডি-র কোনও বদল ঘটে না। যেখানে যে-অবস্থায় রেখে দেবেন, সেখানে সে ভাবেই থাকবে। শুয়ে-বসে কেবল ওর গতর বাড়বে। সুদ বা ইন্টারেস্ট নামক একটা ক্যাপসুল ওর স্বাস্থ্য ফেরায়। এ ছাড়া কিছু হয় বলে আমার জানা নেই।’’

ডাক্তারবাবু উত্তর শুনে মোটেই খুশি হননি। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বিকৃত গলায় বলেছিলেন, ব্যাঙ্কে এলেই আমার হাইপোকনড্রিয়া সিনড্রোম বেড়ে যায়।

রক্ষিতবাবু রূপমদের ব্রাঞ্চে পাঁচ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজ়িট করতে এসেছেন। এফডি উইথ জয়েন্ট নেম। হাজ়ব্যান্ড অ্যান্ড ওয়াইফ। এখানে রক্ষিতবাবুর একটা সেভিংস অ্যাকাউন্ট আছে। মনোরঞ্জন রক্ষিত একটু আগেই বলেছেন, ‘‘কবে টুক করে চলে যাব! স্ত্রীকে সারা জীবন তো কিছুই দিতে পারিনি। এই সঞ্চয়টুকু দিয়ে গেলুম। একটা ছোটখাটো ইলেকট্রিক্যাল গুডসের দোকান থেকে কতই বা আয় করেছি! সংসার টানতে ব্যয়ই বেশি হয়েছে! এই হল শেষ জীবনের সঞ্চয়।’’

স্বর্ণময়ী অমনি খোঁচা মেরেছেন, ‘‘আ মরণ, শেষ জীবন বলছ কেন? নাতনির বিয়ে দেখে তবে যাবে।’’

মনোরঞ্জন অসুখী স্বরে বলেছেন, ‘‘সুখের চেয়ে যেমন স্বস্তি ভাল, অর্থের চেয়ে তেমন মৃত্যু ভাল।’’

‘‘আবার সেই এক কতা বলছ!’’ স্বর্ণময়ী রক্ষিত রেগে গেছেন, ব্যাঙ্কটা কি তোমার বাড়ি না তার-বাটাম-পাইপ-এলইডি-সিএফএল-টিউবলাইটের দোকান? এখানে টাকা বড়, তোমার মতো গরিব-গুর্বোরা নয়। মরার হলে এত দিনে ইলেকট্রিক শক খেয়ে মরে যেতে। বুঝেছ!’’

এফডি-র ফর্মটা কেউ হয়তো লিখে দিয়েছেন। মনোরঞ্জন ইংরেজিতে আর ওঁর সহধর্মিণী বাংলায় সই করেছেন। রূপম বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলল, ‘‘তা হলে আপনাদের এফডি-টা হচ্ছে আইদার অর সারভাইভর। অর্থাৎ আপনারা উভয়েই অথবা যিনি বেঁচে থাকবেন তিনি এই টাকা ম্যাচিওরিটির পরে পাবেন। সিনিয়র সিটিজ়েন হিসেবে আপনারা পয়েন্ট ফাইভ পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট আরও বেশি পাচ্ছেন।’’

ছেলেটা বড্ড বেশি ইংরেজিতে কথা বলছে। স্বর্ণময়ীর পড়াশোনা ক্লাস ফোর পর্যন্ত। বড় মেয়ে হিসেবে কিশোরী বয়সে সংসারের কাজের চাপ মায়ের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়েছিল। অটোচালক বাবা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পরে স্বর্ণময়ীর দুটো ভাইও পড়াশোনায় বেশি দূর এগোতে পারেনি। স্বর্ণময়ী চোখ সরু করে রূপমকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি আরও এক বার বলবে বাছা? আমি বুঝতে পারলুম না। এত ইংরেজি...’’

এ বার রূপম যতটা সম্ভব বাংলা শব্দ ব্যবহার করে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু শ্রীমতী রক্ষিত আবার গুলিয়ে ফেললেন, ‘‘আমার সোয়ামিও বেঁচে, আমিও বেঁচে। তা হলে জমা টাকা যখন পাকবে তখন আমরা দু’জনেই পাব। কিন্তু আমি যদি আগে মরে যাই তা হলে ও পাবে। আর ও যদি আগে মরে যায় তা হলে কি আমি পাব?’’

‘‘নিশ্চয়ই পাবেন। ওঁর টাকা যেমন আপনার, তেমনই আপনার টাকা ওঁর।’’

ভয়ঙ্কর চিন্তিত হয়ে স্বর্ণময়ী বললেন, ‘‘এই পাঁচ লাখের একটা টাকাও তো আমার জমানো টাকা নয়। কর্তা পটল তুললে গরমেন্ট আমায় টাকা দিতে যাবে কোন দুঃখে!’’

রূপম হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ল, ‘‘আপনি ভুল করছেন মাসিমা। উনি যেহেতু এই টাকার অংশীদার করছেন আপনাকে, তাই আসল আর সুদ মিলিয়ে পাঁচ লাখের সমান ভাগিদার আপনিও। বুঝলেন?’’

বেশ দুঃখের সঙ্গে রক্ষিত-পত্নীর উত্তর, ‘‘এ কথা কেন বলছ, বাবা? আমি আগে চলে গেলে তো এই লোকটাই সুদে-আসলে সবটা পাবে। তখন আমাকে কি আর যমালয় থেকে ডেকে এনে বলবে, ‘ওগো, এই নাও আড়াই লাখ।’ শুনে রাখো, এক পয়সাও আমাকে দেবে না।’’

‘‘ব্যাঙ্ক যে ভাবে আপনাদের সঙ্গে চুক্তি করছে, সেটা আবার আপনি গুলিয়ে ফেললেন। প্রথমত, উভয়েই পাবেন। দ্বিতীয়ত, দু’জনের মধ্যে যিনি বেঁচে থাকবেন তিনিই হবেন হকদার। এসব লিখিত-পড়িত থাকছে। কোনও গন্ডগোল বা অন্যথা হবে না।’’

প্রায় ডুকরে উঠলেন স্বর্ণময়ী, ‘‘যদি দু’জনেই একসঙ্গে মরে যাই, তা হলে তো এ টাকা ব্যাঙ্কের পকেটে ঢুকে যাবে! এ রকম কত টাকা ব্যাঙ্ক নিশ্চয়ই গায়েব করে দিয়েছে!’’

মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে। ভদ্রমহিলাকে কী করে বোঝাবে, তা নিজেই রূপম বুঝে উঠতে পারছে না। মহা সমস্যা হল। এ দিকে ওর টেবিল ঘিরে এফডি অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের ভিড় জমেছে। অনেকেরই নানা প্রশ্ন, নানা অনুসন্ধান, রি-ইনভেস্টমেন্টের আবেদন, প্রি-ম্যাচিওর উইথড্রয়াল ইত্যাদি। এঁদের বিদায় করতে না-পারলে অন্যদের দিকে ধ্যান দেনা বহুত তকলিফ কি বাত! বেশ কড়া গলায় নিরুপায় রূপম বলল, ‘‘এ বার আপনারা আসুন। মিস্টার রক্ষিত, আপনি পরশু এসে রিসিটটা নিয়ে যাবেন। শুধু নিয়ে আসবেন সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ট্রান্সফারের রসিদটা।’’

‘‘আমাকে মিস্টার রক্ষিত বলবেন না, শুনলে লজ্জা হয়। আমি তো আর আপনাদের মতো শিক্ষিত নই।...আসলে আমারও ভিতরটা খচখচ করছে এই ভেবে— ঈশ্বর না করুন— দু’জনেই যদি এক সঙ্গে স্বর্গলাভ করি তা হলে এই টাকাটার কী হবে? কে পাবে? বড় কষ্টের ধন তো।’’

‘‘আমি তো প্রথমেই আপনাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কাউকে নমিনি করবেন কি না। নমিনি কী তাও বুঝিয়েছি। কিন্তু তখন আপনারা সে সব নাকচ করে দিলেন।’’

ঝাঁঝিয়ে উঠলেন স্বর্ণময়ী, ‘‘নাকচ করে দিয়েছি কি এমনি এমনি! ভাইটি, আমাদের এক মাত্র ছেলে বল্টু তেঁএটে বজ্জাত। কর্পোরেশনের বরো না বারো— কী বলে ছাই— সেই আপিসে চাকরি করে। পলিটিক পাটির দাদাদের হাতে-পায়ে ধরে কাজ পেয়েছে। তাতেই ছেলের মাটিতে পা পড়ে না। এ দিকে বিয়ে দিয়ে কালসাপ ঘরে নিয়ে এলুম। বউ আমার বল্টুকে নিয়ে আলাদা হয়ে‌ গেল। তবে যত নষ্টের গোড়া, নাটের গুরু এই ইনি।’’

মনে মনে হাসল রূপম। নাট-বল্টু শব্দ দুটো ভদ্রমহিলা অচেতনভাবেই উচ্চারণ করলেন। লোহার তৈরি নাট-বল্টু একই সঙ্গে আটকে থাকে। এঁদের ছেলের ক্ষেত্রে তা হয়নি। কী আর করা যাবে! ছাড়াছাড়ি এখন জীবনের গভীরে ছড়িয়ে যাওয়া ভাইরাস।

ওর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবতী, সুশ্রী গৃহবধূর ধৈর্যের বাঁধ এ বার ভেঙে গেল। খুব মার্জিত অথচ জ্বালা-ধরানো ভাষায় তিনি বললেন, ‘‘স্যর, এ বার আমাদের দিকে একটু দেখুন। এদের নিয়ে পড়ে থাকলে তো আমরাই শেষকালে ফিকস্‌ড ফোটো হয়ে যাব!’’

অসহায় চোখে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘দেখছেন তো, বয়স্ক মানুষ। ম্যাটারগুলো বুঝতে পারছেন না। সিনিয়র সিটিজ়েনরা যদি হেনস্তার নালিশ জানান, তা হলে শো-কজ়ের চিঠি ধরিয়ে দেবে ব্যাঙ্ক।’’

‘‘এঁদের জন্যে তো আমরাও হেনস্তা হচ্ছি। অথচ আমাদের অন্য কাজ আছে। সব ক’টা সরকারি সংস্থাই জীবন থেকে সময় চুরি করে নেয়। তাজ্জব ব্যাপার মাইরি!’’ এক জন চিমসে মতো ভদ্রলোক চিবিয়ে চিবিয়ে বাণী দিলেন।

কিচ্ছু করার নেই। অন্যদের এনকোয়ারি অথবা রিকয়্যারমেন্টে হাত দিলেই রূপমের মাথা এখন গুলিয়ে যাবে। তবে এ বার আর বুড়ো-বুড়ির কোনও প্রশ্নের জবাব দেওয়া নয়। ওঁরা যদি কাউকে নমিনি না-করতে চান, তাতে রূপমের কী? বোঝানো মানে নাক গলানো। কোনও দরকার নেই।

মনোরঞ্জনের সেভিংস অ্যাকাউন্ট নম্বরটা কম্পিউটার থেকে দেখে আর এক বার মিলিয়ে নিল রূপম। ওঁদের চলে যেতে বলার প্রাক্-মুহূর্তে রূপম হঠাৎ আবিষ্কার করল, ফার্স্ট ডিপোজ়িটরের নামের জায়গায় লেখা আছে স্বর্ণময়ী রক্ষিতের নাম। দ্বিতীয় খোপে মনোর়ঞ্জন বিরাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে প্রথম গচ্ছিতকারীর প্যান নম্বর দেওয়া জরুরি, দিতেই হবে। কেননা, টাকার পরিমাণ পাঁচ লক্ষ।

সামান্য ইতস্তত করে অপেক্ষমাণ জনতাকে করুণ স্বরে রূপম বলল, ‘‘আর দু’মিনিট হয়তো লাগবে।’’ তার পর স্বর্ণময়ীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘মাসিমা, আপনার প্যান নম্বর বলুন। প্যান কার্ড এনেছেন? দিন, আমি লিখে নিচ্ছি।’’

যেন আকাশ থেকে পড়লেন, স্বর্ণময়ী। গলায় বিস্ময়, ‘‘প্যান কার্ড? সে আবার কী বাপু?’’ তার পর স্বামীর দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কি গো, উনি কী চাইছেন? আমার তো ভোটার কার্ড, আধার কার্ড আছে। ওই কার্ড তো তুমি আমাকে করে দাওনি!’’

বেটার-হাফের প্রশ্নে জর্জরিত মনোরঞ্জন আমতা আমতা করে রূপমকে বললেন, ‘‘ওর তো কোনও ইনকাম নেই। হাউজ়ওয়াইফ। তাই প্যান কার্ড করাইনি।’’

‘‘সে কী! রোজগার থাক বা না-থাক ফিনানশিয়াল ইয়ারের শেষে রিটার্ন জমা দিতে হয়। বাধ্যতামূলক এই আইন অনেকেই মানে না, জানেও না। অথচ দেখুন, প্রতি বছর আপনাকে সেল ট্যাক্স জমা দিতেই হয়। জানেন নিশ্চয়ই, ব্যাঙ্কে জমা টাকা থেকে ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট টিডিএস অর্থাৎ উৎসমূলে কর আদায় করে নেয়। টিডিএস কেটে নেওয়া হয় ওই প্যান কার্ডের নম্বর ধরে ধরে। আচ্ছা, সেভিংস অ্যাকাউন্টটা জয়েন্ট নামে করেননি কেন?’’

মাথা নিচু করে মনোরঞ্জন বললেন, ‘‘করা উচিত ছিল। নানা ঝামেলায় পারিনি।’’

‘‘তা পারবে কেন! আমি তো বউ নই, বাড়ির ঝি,’’ স্বর্ণময়ী দাঁতে দাঁত ঘষলেন।

মৃদু হেসে রূপম বলল, ‘‘শুনুন ম্যাডাম, আপনি এফডি-র পাঁচ লাখ টাকার মালিক হচ্ছেন, তাই আপনার প্যান কার্ড নম্বর লাগবেই। ওই ওয়েটিং এরিয়ায় বসে সিদ্ধান্ত নিন কী করবেন। আমার অন্য কাজগুলো সেরে ফেলতে দিন। প্লিজ়...’’

গ্রাহকদের বসার জায়গায় অগত্যা ওঁদের চলে আসতে হল। পাশাপাশি দু’জনে বসার জায়গা পেলেন। বসেই স্বর্ণময়ী রাগে ফুঁসে উঠলেন, ‘‘আমাকে তো আগে কখনও বলোনি, পান কার্ড, চুন কার্ড, সুপুরি কার্ড, জর্দা কার্ড— এ সব হাজারো ঝকমারি আছে! বলি, এ সব করে দাওনি কেন? ব্যাঙ্কেও টাকা রেখেছ শুধু নিজের নামে!’’

অপরাধ স্বীকারের মতো গলায় মনোরঞ্জন বললেন, ‘‘কখনও ভাবিনি তোমার জন্যেও এ কার্ড লাগবে। প্যান কার্ড ইনকাম ট্যাক্স জমা দিতে লাগে। তুমি তো আর ইনকাম করো না! তবু দেখো, ফ্যাকড়া করে দিল। ভেবেছিলাম, শেষ সঞ্চয়টুকু তোমার নামে, তোমার হাতে দিয়ে মরব।’’

‘‘আহা, মরি মরি, কী প্রেম!’’ স্বর্ণময়ী খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘তোমার মতো ধিনিকেষ্টর জন্য জীবনটা শেষ হয়ে গেল। উঠোনই নেই, উনি নাচতে নেমেছেন!’’

প্রায় হাত জোড় করে মনোরঞ্জন অনুনয়ের ভঙ্গিতে ফিসফিস স্বরে বললেন, ‘‘চেঁচিও না। অন্যদের অসুবিধে হলে ব্যাঙ্ক থেকে বার করে দেবে।’’

স্বর্ণময়ী কোনও রকমে নিজেকে সামলে চুপ হয়ে গেলেন। দু’জনের মাঝখানে যেন ধীরে ধীরে হিমশৈলের দেওয়াল উঠে গেল। মনোরঞ্জনের শরীরটা অস্থির অস্থির লাগছে। এই মহিলা কাউকে রেয়াত করে না। কপালে আজ নৃমুণ্ডমালিনীর নৃত্য অবধারিত। এর ডিক্টেটরশিপের জন্যে ছেলে, বউমা, নাতনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এ বার মনোরঞ্জনের পালা। হায়, এমন নীরবতা একটু পরেই ভেঙে খানখান হয়ে যাবে।

প্রায় মিনিট পঁয়ত্রিশ পরে রূপম ওঁদের ডাকল। স্বর্ণময়ীর মুখ ক্রোধের আগুনে পুড়ছে। দু’জনকে আর বসার সুযোগ না-দিয়ে তড়িঘড়ি ও মনোরঞ্জনকে বলল, ‘‘নো প্রবলেম। আর একটা ফর্ম নিয়ে যান। সেই ফর্মে প্রথম নাম হবে আপনার, দ্বিতীয় নাম মিসেসের। কাল অথবা পরশু আসবেন। নমস্কার...’’

বোমার মতো সঙ্গে সঙ্গে ফেটে পড়লেন স্বর্ণময়ী, ‘‘না, এ টাকা প্রথমে আমার নামেই থাকবে। এ সব চালাকি আমি করতে দেব না। এই আমার ভোটার আর আধার কার্ড...’’ বলতে বলতে সস্তা হাতব্যাগে রাখা কার্ডগুলো বার করে রূপমের টেবিলে স্বর্ণময়ী ছুড়ে ফেলে দিলেন। ওর নাকের সামনে আঙুল নাচিয়ে বৃদ্ধা বললেন, ‘‘ব্যাঙ্কের লোকেরা ভাঁওতা দিয়ে টাকা সরিয়ে ফেলে, গায়েব করে দেয়। আমি সব জানি...’’

দপ করে রূপমের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু স্বর্ণময়ীর আধার কার্ডটা দেখে স্থির হয়ে গেল ওর চোখ। কার্ডে বাংলা হরফে জ্বলজ্বল করছে: স্বর্ণময়ী রক্ষিতা। এটা টেকনিক্যাল এরর। সংশোধন করিয়ে নেওয়া যায়। তার ব্যবস্থা সরকার করে রেখেছে। কিন্তু এ বার রাগের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধিটা রূপমকে চালিত করল। আধারের ভুল জায়গাটায় আঙুল রেখে রূপম বলল, ‘‘এটা দেখেছেন স্যর? এ যে আপনার মিসেসের মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি!’’

ঝুঁকে পড়ে পদবিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনোরঞ্জন কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, ‘‘আমি এই ভুল প্রথম দেখছি!’’

এ বার কার্ডটা স্বর্ণময়ী দেখলেন এবং মুহূর্তে পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘চলো বাড়ি। তোমার প্যানপ্যানানি বার করছি। আমি রক্ষিতা! নোংরা মেয়েছেলে! ছিঃ, তোমার লজ্জা করে না, বিয়ে করা বউকে এত নীচে নামালে? ঠিক আছে, বেলনা দিয়ে তোমার মাথা আগে ফাটাব, তার পর টাকার ফয়সালা। ইয়ার্কি পেয়েছ! হোক রক্তারক্তি! হোক থানা-পুলিশ...’’

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy