Advertisement
০৯ জানুয়ারি ২০২৫
ছোটগল্প

উপলব্ধি

না, এই ঐশীকে নিয়ে সত্যিই আর পারা যায় না। আজ বাজারে বড় মাছ থাকলেও সেগুলো খুব একটা টাটকা ছিল না।

ছবি: পিয়ালী বালা

ছবি: পিয়ালী বালা

আনন্দদীপ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

উফ! আজ আবার মাথা গরম করে চিৎকার শুরু করেছে ঐশী। বাজারটা করে এনে দিয়ে, খবরের কাগজটা নিয়ে সবে সোফায় একটু গা এলিয়েছিল দীপ্তম। ইচ্ছে ছিল, চা বিস্কুট সহযোগে রবিবারের খবরের কাগজের গল্পটা তারিয়ে তারিয়ে পড়বে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! ঐশীর গলার চড়া আওয়াজ শুনে চায়ের প্রত্যাশা ছেড়ে এখন মুখ ব্যাজার করে বসে আছে দীপ্তম।

না, এই ঐশীকে নিয়ে সত্যিই আর পারা যায় না। আজ বাজারে বড় মাছ থাকলেও সেগুলো খুব একটা টাটকা ছিল না। আসলে বয়সটা পঞ্চান্নের কোঠায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বাজার করার অভিজ্ঞতাটাও প্রায় পঁচিশ বছরে ছুঁয়েছে দীপ্তমের। এখন এক নিমেষে মাছ দেখে বলে দিতে পারে সেটা টাটকা কি না! বাজারে আজ ছোট মাছগুলো বেশ ভাল ছিল। মাছবিক্রেতা বাচ্চুও তো সে কথাই বলল।

বাচ্চুকে বেশ বিশ্বাস করে দীপ্তম। ওকে তো আজ প্রথম দেখছে না। সেই কিশোর অবস্থায় বাবার সঙ্গে হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে মাছ বিক্রি করতে আসত ও। এক্কেবারে বাচ্চা ছেলে তখন। আর এখন? হাফমাথা চুল, দাড়ি পেকে আধবুড়ো একটি লোক। তো সেই বাচ্চুই যখন নিজে থেকে বলল, ‘‘দাদা, বড় মাছ আজ টাটকা নয় অতটা। ছোট চারাপোনা আর মৌরলা নাও। দুপুরের মেনুতে ডাল, মৌরলার ঝাল আর কালোজিরে দিয়ে চারাপোনার ঝোল খাবে দাদা। জমে যাবে পুরো।’’ বাচ্চুর কথা ফেলতে পারেনি দীপ্তম।

আর এতেই বাধল গোল। মাছ দেখেই ঐশীর মেজাজ চড়েছে সপ্তমে, থেকে থেকেই বলছে, ‘‘ছুটির দিনে এই ছোট ছোট মাছগুলো কিনতে ইচ্ছে করল তোমার! ছেলেটার আজ অফিস ছুটি। ও কি বড় মাছের পিস ছেড়ে এই কুচো মাছের ঝোল খাবে? তোমার আর বোধবুদ্ধি হবে না কোনও দিন!” এই রকম সময়ে নিজেকে বধির ভেবে চুপ করে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করে দীপ্তম। এটা তো আর অফিস নয়, যে সহকর্মীর সামনে যুক্তির ঢাল খাড়া করে তাকে বোঝাবে।

ঐশীকে কিছু বোঝাতে যাওয়ার অর্থ অযথা সময় নষ্ট বা অকারণে কিছু কথা কাটাকাটির সৃষ্টি। আর কথা কাটাকাটি হওয়ার অর্থ পড়শিদের কাছে নিজেদের সমালোচিত হওয়ার রসদ তুলে দেওয়া।

ঐশীর অভিযোগ তখনও চলতে থাকায় মনে মনে দীপ্তম ঠিকই করে নেয়, আজ সে ঐশীর কোনও কথাই কানে নেবে না। এরই মাঝে ছেলে সোহন উপর থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘‘মা, এ বার একটু থামো প্লিজ়। আমি ওই কুচো মাছই খাব।” সোহনের অনুরোধে ঐশী থামল বটে, তবে ভূমিকম্পের আফটারশকের মতো মাঝে মাঝেই কুচো মাছের প্রসঙ্গ তুলে খোঁচা দিচ্ছিল।

এ দিকে চায়ের দেখা না পেয়ে শুকনো গলায় কাগজের গল্প পড়ায় মন দিল দীপ্তম। আর কেন জানি, গল্প পড়ার ফাঁকে আজ অনেক পুরনো স্মৃতি হঠাৎই ভিড় করতে থাকল দীপ্তমের মনের মণিকোঠায়।

নয় নয় করে এ বছর ওদের বিবাহিত জীবনেরও পঁচিশ বছর পূর্ণ হল। টুকটাক রাগারাগি করলেও এই পঁচিশ বছরে ঐশী কিন্তু কম সাহায্য করেনি দীপ্তমকে। বিয়ের সময় কতই বা স্যালারি পেত সে? মেরেকেটে হাজার চার। তার মধ্যে বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জন্ম হল সোহনের। এল ওর অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান। এ দিকে দীপ্তমের তখন ভীষণ টাকাপয়সার টানাটানি, ভেবেছিল চড়া সুদে টাকা ধার করবে কাবুলিওয়ালার থেকে। চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময় পাশে দাঁড়িয়েছিল ঐশী, দ্বিতীয়বার না ভেবে বিয়েতে দাদার দেওয়া পছন্দের আড়াই ভরির হারটা তুলে দিয়েছিল দীপ্তমের হাতে। চিন্তামুক্ত হয়েছিল দীপ্তম।

এখানেই শেষ নয়। এর বছর কয়েক পরে দীপ্তমের পাশে দাঁড়াতে বিউটিশিয়ান কোর্স শিখে নিয়েছিল ঐশী। তার পর সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে বাড়ির নীচে শুরু করেছিল একটা পার্লার। সংসার চালাতে এই পঁচিশ বছরে যখন যা দরকার হয়েছে, ঐশী ওর সম্বল উজাড় করে সাহায্য করেছে দীপ্তমকে।

শুধু আর্থিক সাহায্য না। দীপ্তমের মা বা সোহনের যত্ন নেওয়াতেও ঐশীর সামান্য ত্রুটিও কোনও দিন লক্ষ করেনি দীপ্তম। সে বার তো মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল। শ্বাসকষ্ট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে দীপ্তমও আশা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু নাছোড়বান্দা ঐশী ওর নিখাদ পরিচর্যায় মাকে আবার সুস্থ করে তুলেছিল। সোহনকেও নিজের হাতে ধরে লেখাপড়া করিয়েছে ঐশী। আজ সে নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে নামী সংস্থায় যে চাকরি পেয়েছে তাতে দীপ্তমের চেয়ে ঐশীর অবদান অনেক গুণ বেশি। এ কথা স্বীকার করতে সত্যিই এতটুকু দ্বিধা নেই দীপ্তমের।

আজকের ছোট মাছটা তো একটা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়, ঐশী বরাবরই এ রকম। বিয়ের পর দিন থেকেই বলতে শুরু করেছিল, ‘‘বাড়ির ঘরগুলো বড় ছোট। একটু বড় ঘর হলে ভাল হত বেশ!’’ তার পর থেকে মাঝে মাঝেই শোনাত, বিভিন্ন আত্মীয়ের বড় সুন্দর বাড়ির গল্প। দীপ্তম আবার অল্পেতেই খুশি থাকতে ভালবাসে। কেন যে ঐশী বড় ঘর চাইত বুঝে উঠতে পারত না সে। এর পর এল সোহনের স্কুলে ভর্তির পালা। বাড়ির সামনের স্কুলটাতে ভর্তি করাবে বলে মনস্থির করেছিল দীপ্তম। এতে পড়ার খরচও কম হত আর বাড়ির সামনে থাকায় বাসভাড়াও বেঁচে যেত। কিন্তু ঐশী বুঝলে তো! ওর যুক্তি ছিল, ‘‘নামী স্কুলে না পড়লে বাচ্চার ভিত যেমন পোক্ত হয় না, তেমন বাচ্চা স্মার্টও হয় না।”

পাল্টা যুক্তি ছিল দীপ্তমের, ‘‘আমি তো বাড়ির সামনের ওই স্কুলে পড়েছিলাম। তাতে কি আনস্মার্ট হয়েছি? নাকি আমার জ্ঞানের ভিত নড়বড়ে হয়েছে?”

একবগ্গা ঐশী বলেছিল, ‘‘সব বন্ধুদের থেকে শুনেছি দক্ষিণ কলকাতার ওই স্কুলটা খুবই ভাল, তাই আমার স্বপ্ন ছেলেকে ওই স্কুলে পড়ানো। আজ সোহন যদি সুযোগ পায়, ও ওখানেই পড়বে। আর তোমার স্মার্টনেস মাঝে মাঝে কনফিডেন্সের অভাবে বেশ ল্যাক করে। অতএব ওটা নিয়ে বেশি আত্মগরিমা দেখানো শোভা পায় না তোমার।” এর পর আর বেশি কথা বলেনি দীপ্তম। চুপ করে গিয়েছিল সে যাত্রায়।

সোহনের প্রাইভেট টিউটর ঠিক করার সময়ও ঐশী ভরসা রাখত ওই নামী স্কুলের টিচারদের উপরেই। ভাগ্যক্রমে সোহন পড়াশোনায় ভাল হওয়ায় মেধার জোরে ওই নামী স্কুলেই সুযোগ পায়। না হলে বড় স্কুলে ছেলেকে পড়ানোর স্বপ্নটা হয়তো তখনই দারুণ ভাবে আঘাত পেত ঐশীর।

পুজোয় জামাকাপড় কেনা থেকে বাড়ির ফ্রিজ, টিভি কিংবা এসি মেশিন, সবেরই আয়তন বড় হতে হবে, ব্র্যান্ড হতে হবে নামী। বছর দুয়েক আগে তো একটা মোবাইল কেনা নিয়েও ঝামেলা হয়েছিল। মোবাইল মানে দীপ্তমের কাছে ফোনে কথা বলা আর রেডিয়োতে অবসর সময়ে গান শোনা। ক্ষেত্রবিশেষে মোবাইলের অ্যালার্ম ক্লকটাও অবশ্য কাজে দেয় দীপ্তমের। এগুলো মাথায় রেখেই সে কেনে একটা ছোট আর কম দামি মোবাইল। বাড়ি আসতেই সম্মুখীন হতে হয় ঐশীর অসন্তোষ মেশানো বাক্যবাণের। ‘‘এত ছোট স্ক্রিনের মোবাইল আজকাল কেউ ব্যবহার করে না কি?” দীপ্তম যথারীতি ওর মোবাইল কেনার সহজ সরল প্রয়োজনীয়তাগুলো জানিয়েছিল স্ত্রীকে।

রেগে গিয়ে ঐশী বলেছিল, ‘‘আজকাল লেটেস্ট ট্রেন্ড ছয়-সাত ইঞ্চি স্ক্রিন সাইজের মোবাইল। এই মোবাইল অচল। তুমি এটা পাল্টে ওই বড় স্ক্রিনের মোবাইল কেনো। ব্র্যান্ডটাও কী কিনেছে? ওটা আরও ভাল হওয়া চাই। আমিও ব্যবহার করতে পারব। আজকাল মোবাইল লোকে কেনে সেলফি ক্যামেরার কোয়ালিটির বিচারে, শুধু কথা বলার জন্য নয়, বুঝলে?” ওই যে কথায় কথা বাড়ে, আর তা শুনে পড়শি নিন্দা করার রসদ পায়। তাই নীরবতাই শান্তি স্থাপনের শ্রেষ্ঠ পন্থা। বিয়ের পর থেকে এই কথাটাকেই মন্ত্রের মতো অনুসরণ করে দীপ্তম। এতে সংসারে সত্যিই অপার শান্তি বিরাজ করে।

দর্শনে মাতৃমুখী হলেও চারিত্রিক দিক দিয়ে দীপ্তমের দিকটাই পেয়েছে সোহন। বড় আর নামী জিনিসের প্রতি ওর ছোট থেকেই সে রকম কোনও অনুরাগ নেই। তাই ঐশী যখন পরীক্ষায় বড় বড় স্কোর করার জন্য বকুনি দিত ছেলেকে, জমিয়ে মায়ের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিত সোহন।

দীপ্তমের এত ক্ষণ ধরে ভাবা ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো স্মৃতি রোমন্থনে আচমকাই তাল কাটে ঐশী, ‘‘চা-টা নিয়ে যাও তো একটু।” এই তো ঐশীর গুণ। স্বামী সন্তান শাশুড়ির প্রতি কর্তব্য পূরণে কখনও কোন খামতি নেই ওর। তাই এই নামী জিনিসের প্রতি ওর এই বাঁধনছাড়া অনুরক্তিকে দোষ হিসেবে গ্রাহ্য করলেও নিমেষেই তা ঢাকা পড়ে যায় ওর শত শত ভাল গুণের সমারোহে।

চা আনতে যাবে বলে উঠে দাঁড়াল দীপ্তম। যাওয়ার সময় সোহনের ঘরে ঢুঁ মারল একটু। দেখল কম্পিউটারের দিকে একদৃষ্টিতে কী যেন দেখছে ছেলে। এ আর নতুন কী! চাকরিতে যে দিন থেকে সোহন যোগ দিয়েছে, সে দিন থেকেই সদা কম্পিউটারমুখী থাকে ও। দীপ্তম জানে, ছুটি থাকলেও কখনও কখনও ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে হয় ছেলেকে। এখনও তাই হয়তো করছে সে। ডাকা ঠিক হবে না। কিন্তু ও তো চা খায়নি। এত বেলা হয়ে গেল! ডেকেই ফেলল ছেলেকে, ‘‘সোহন, চা খাবি না?”

‘‘খাব বাবা, তবে...” ছেলের অসমাপ্ত বাক্যে একটা বেদনার সুর।

‘‘কী রে, গলাটা এমন শোনাল কেন? আপসেট না কি?” ছেলে চুপ। ‘‘কী হয়েছে?” বন্ধুর মতো কাঁধে হাত রেখে বলল দীপ্তম।

‘‘বাবা, সামনের সপ্তাহে একটা প্রজেক্টের কাজে আমাকে অস্ট্রেলিয়া যেতে হবে। যা মনে হচ্ছে, তাতে এক বছর তো থাকতেই হবে। আরও বেশি সময়ও লাগতে পারে। আগেই অফিস থেকে বলেছিল, আজ কনর্ফামড মেল পেলাম।” একরাশ বিষণ্ণতার আঁধার মুখে লেপে কথাগুলো বলল সোহন।

ছেলেকে বরাবরই সব কাজে উৎসাহ দিয়ে এসেছে দীপ্তম। এ বারও উৎসাহ দিল। তবে প্রতিবারের মতো স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে নয়। সোহন কি সেটা বুঝতে পারল? কে জানে! আসলে চাইলেই তো সব সময় অন্তর থেকে উৎসাহবাক্য বেরোয় না।

একটু পরেই নীচে নেমে এল বাবা-ছেলে। এক সঙ্গেই। ঐশী কিছু বলার আগেই দীপ্তম ছেলের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ঘটনাটা জানাল ঐশীকে। মুহূর্তে মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হল। চোখটা কেমন জানি ছলছল করে উঠল ওর।

ঐশীর কেন জানি হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল সোহনের জন্মের দিনটা। সমস্ত ব্যথা যন্ত্রণা ভুলে কী দারুণ খুশি হয়েছিল সে দিন! একমাত্র ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে ও আর দীপ্তম। কত যত্নে আদরে বড় করেছে। সেই আদরের ছেলে ওদের ছেড়ে চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া! একশো-দুশো নয়, কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে! এত দূরে চলে যাবে ছেলে! ঐশীর মন বলছিল, সোহন একবার বাইরে গেলে আর কি দেশে ফিরে আসতে চাইবে? অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধে ওখানে।

ভাবতে ভাবতেই ঐশীর চোখে জলরাশি বিনা বাধায় নেমে আসে ওর দুই চিবুক বেয়ে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানতে চাইল, ‘‘অস্ট্রেলিয়া তো অনেক দূর! কম দূরত্বের কোথাও পোস্টিং দিল না রে সোহন? আমাদের দেশেরই অন্য কোনও শহরে!”

মনমরা সোহন শ্লেষের হাসি হেসে বলে উঠল, ‘‘মা, বড় নামী সংস্থা, বড় সংখ্যার স্যালারি, তাই পাঠাচ্ছেও বড় বেশি দূরে।” এই প্রথম, হ্যাঁ এই প্রথম বড়, নামী শব্দগুলো কেমন যেন বিস্বাদ ঠেকল ঐশীর কাছে। দুই চিবুকের বয়ে চলা অশ্রুধারার গতি হঠাৎ করেই ত্বরান্বিত হল ঐশীর।

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story Literature Book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy