ছবি: বৈশালী সরকার
ভাগো, ডক্টর জি, ভাগো, নইলে বাঁচবে না তুমি। ওরা তোমায় মেরে ফেলবে, মান-ইজ্জত সব যাবে।’’ চুপিচুপি ডাক্তার বসুকে বলল তাঁর বাড়ির মাঝবয়সি পরিচারিকা।
মাত্র ক’দিন আগেই, মানুষের প্রাণভরা ভালবাসা পেয়ে মনটা ভরে আছে। বসু তাই স্বগতোক্তি করলেন, ‘ধুস’। কিন্তু হায়! তিনি যদি জানতেন, তাঁর ভবিষ্যত!
গ্রামের ছোট সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখানে এক জনই ডাক্তার, ডাক্তার বসু। উনি ছাড়া, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আছে তাঁর দুই সহযোগী। প্রথম জন, কম্পাউন্ডার সেনগুপ্ত, আর দ্বিতীয় জন নার্স মিনতি দে। এছাড়া নিখিল, বেয়ারা কাম দারোয়ান।
সকাল সাতটা বাজতে না বাজতে, আশপাশের গ্রাম থেকে আসা রোগীদের ভিড়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র গমগম করে। ডাক্তার বসুর মুখে কোনও বিরক্তি নেই। সে যতই রোগীদের ভিড় হোক না কেন। হাসিমুখে সকলের চিকিৎসা করেন। কাউকে ফেরান না। শুধু ভিড়ের চাপ বেশি মনে হলে, দু’হাতে নিজের টাকে হাত বোলাতে বোলাতে নিখিলকে বলেন, ‘‘একটু চা কর।’’ এর পর, হাসিমুখে ফের রোগী দেখেন। রোগী দেখা শেষ হতে হতে বিকেল চারটে-সাড়ে চারটে বেজে যায়। এর পর বাড়িতে গিয়ে স্নান সেরে, দুটি ভাত খেয়ে, একটু বিশ্রাম।
ভাল মানুষ এই ডাক্তার। কলকাতায় বাড়ি। সাত থেকে সাতাত্তর, সব বয়সের মানুষ ওঁর সুন্দর ব্যবহারে বন্ধু হয়ে যায় অচিরেই। হাসপাতালের সামনে চওড়া সড়ক। সেখানে আমরা সারা বছরই ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম। রোগী কম থাকলে ডাক্তারবাবু কখনও-সখনও আমাদের খেলায় ব্যাট হাতে খেলতে শুরু করতেন।
ওঁর এক বন্ধু লন্ডনে থাকেন। বড়দিনের সময় কলকাতায় আসবেন। বন্ধুকে দিয়ে আমাদের জন্য একটা উইলো কাঠের ভাল ক্রিকেট ব্যাট আনিয়ে দেবেন, কথা দিয়েছেন।
ছেলেপিলে নেই নিখিলের। বৌকে সঙ্গে নিয়ে ও ডাক্তারবাবুর সঙ্গেই থাকে। সকালে ডাক্তারবাবু রোগী দেখা শুরু করলে, নিখিল এক সময় বাজার সেরে বৌকে দিয়ে আসে। বৌ রান্না করে রাখে। ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে। এর পর আবার ডাক্তারখানায় ফিরে ফাইফরমাস খাটতে লেগে যায় নিখিল। কম্পাউন্ডার সেনগুপ্ত অবশ্য এই দু’জনের মতো নন। বৌ আর দুই ছেলে নিয়ে সংসারী। মাস ছয়েক আগে যখন ডাক্তারবাবু এই হাসপাতালে আসেননি, তখন কম্পাউন্ডারের খুব রমরমা ছিল। ডাক্তার বসুর আগে ছিলেন ডাক্তার মাজি। তিনি প্রায়ই দেশে চলে যেতেন। আবার কখনও এখানে থেকেও হাসপাতালে আসতেন না। কম্পাউন্ডারই তখন চিকিৎসা করতেন রোগীদের। সে সময় ওষুধই থাকত না। রোগীরা পয়সা খরচ করে ডাক্তার মিত্র বা ডাক্তার ঘোষ বা ধলা ডাক্তারের কাছে যেত।
পরে বুঝেছি, ডাক্তার মাজি আর কম্পাউন্ডার মিলে হাসপাতালের সব ওষুধ ওই ডাক্তারদের কাছে বিক্রি করে দিতেন।
ডাক্তার মিত্র বাংলাদেশের লোক। ডাক্তারি পড়তে কলকাতায় আসেন। পড়তে পড়তেই বিয়ে। স্বাধীন হয় দেশ। তার পর দেশভাগ। তখন শ্বশুরবাড়ির পরামর্শে আমাদের এখানে এসে চেম্বার খুলে বসেন। এখানে তখন কোনও ভাল ডাক্তার না থাকায় পসার জমে যায়।
ডাক্তার হিসেবে ভাল হলেও, তিনি বেশ দাম্ভিক। তাই ওঁর আসার কিছু দিন পরে, এই এলাকার ঘোষবাড়ির ছেলে ডাক্তার হয়ে চেম্বার খুলে বসলেন। তখন মিত্র ডাক্তারের পসার কিছুটা হলেও কমে গেল। স্থানীয় ছেলে, ডাক্তার হয়ে এসেছেন। সবারই চেনা। তাই ডাক্তার হিসেবে একটু কমা হলেও, তাঁর পসার জমে গেল তাড়াতাড়ি।
এ ছাড়াও, এই অঞ্চলে আছেন ধবলেশ্বর ভট্টাচার্য। সবাই তাঁকে বলে ধলা ডাক্তার। তাঁর বাবা ছিলেন জমিদারের গোমস্তা। জমিদার বেশি সময় থাকতেন কলকাতায়, ফলে ধলার বাবাই জমিদারি চালাতেন। লোক হিসেবে তিনি ছিলেন অসম্ভব মামলাবাজ আর ধূ্র্ত। জমিদারি চালানোর নাম করে, কত লোকের ভিটেমাটি উচ্ছেদ করে, তাদের সর্বনাশ করেছেন, তাদের সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছেন, তার ঠিক নেই। সেই বাপেরই ছেলে এই ধলা। বাপের চেয়ে এক কাঠি উপরে। স্কুলের গণ্ডি পার হননি, কিন্তু বুক ফুলিয়ে ডাক্তারি করে চলেছেন স্রেফ বাপের জোরে।
শীত পড়তে শুরু করেছে। ডাক্তারবাবুর আগ্রহে আর আর্থিক সহযোগিতায় এ বছর ক্রিকেট টুর্নামেন্ট করব ঠিক করলাম। আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের আরও সাতটি দল মিলে হবে এই টুর্নামেন্ট। বড়দিনে শুরু হল। ফাইনাল হবে পয়লা জানুয়ারি। উদ্বোধন করলেন ডাক্তার বসু। এর মধ্যে ওঁর লন্ডনবাসী বন্ধু আমাদের জন্য ক্রিকেট ব্যাট এনেছেন। যেমন সুন্দর সেই ব্যাট, তেমনই চমৎকার তার স্ট্রোক। সবাই দারুণ খুশি।
তবে এই দারুণ ব্যাটের সুখটা আমাদের বেশি দিন সইল না। সারা দিন ধরে পেটানোর ফলে, হ্যান্ডেলটা দু’দিনেই গেল। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‘কোই বাত নেই, কলকাতা থেকে সারিয়ে এনে দেব।’’ ডাক্তারবাবু সেই ব্যাট নিয়ে গেলেন কলকাতায়। কিন্তু আর ফেরত দিয়ে যেতে পারলেন না।
******
ডাক্তার মিত্র আর ডাক্তার ঘোষ দু’জনেরই চেম্বার খুব দূরে নয়, বরং কাছাকাছিই। এমনিতে ওঁদের মধ্যে মিল নেই, বরং অমিলই বেশি। তবে মাঝেমধ্যে সন্ধের পর, ধলা ডাক্তার, মিত্র ডাক্তারের চেম্বারে চলে আসেন। ঘোষ ডাক্তারও তখন সেখানে হাজির হয়ে যান। তিন ডাক্তারের গোপন সভা বসে। বছরের প্রথম দিনেও সেই গোপন সভা বসে।
ধলা ডাক্তার বললেন, ‘‘এ বার তো আমাদের ডাক্তারি ছেড়ে মুদির দোকান দিতে হবে। আজ বিকেলে হাসপাতালের সামনে ক্রিকেট ফাইনালের ভিড়টা দেখলেন! আপনাদের দু’জনকে তো তবু ওরা ডেকেছিল। আমায় তো ডাকেওনি। আমাদের তো ওরা এ বার নক-আউট করে দেবে মশাই।’’
‘‘তা বটে! দেখলাম কিছুটা খেলা। বেশ জমিয়ে দিয়েছে। আগে কোনও দিন হয়নি,’’ বললেন মিত্র।
ঘোষ বললেন, ‘‘বোস ডাক্তার ব্যাপারটা করেছে ভালই। ’’
‘‘অ্যাঁ! ভাল করেছে বলছেন! ডাক্তার বোস তো দেখছি এ বার আমাদের ভাতে মারবে। নিজে খায় না, খাবে না, আর আমাদেরও না খাইয়ে মারবে। নিজে গাধার মতো খেটে মরছে, আর সেই সঙ্গে আমাদেরও পেটে মারছে,’’ বিরক্ত হয়ে বললেন ধলা।
একটু ভেবে ঘোষ বললেন, ‘‘ঠিক! সাপ্লাই বন্ধ। রোগী আসাও কমছে। দুশ্চিন্তারই ব্যাপার। কিন্তু
কী করা?’’
‘‘একটা উপায় বার করতেই হবে। অনামুখোটা যে ভাবে পাড়ার ছেলেদের হাত করে ফেলেছে, আর সাধারণ লোকেরা তো ওকে ভগবান ভাবছে, এর পর কেউ আর আমাদের কাছে আসবে না। আমি একটা উপায় ভেবেছি,’’ গলার স্বর নামিয়ে বললেন ধলা।
ঘোষ ডাক্তার, ‘‘কী রকম?’’
ধলা, ‘‘বোস, নিখিল আর ওর বৌকে নিয়ে থাকে। ওদের তিন কুলে কেউ নেই। ছুটিও বিশেষ নেয় না। শুধু প্রতি বছর গঙ্গাসাগর মেলার সময়, ক’দিন ছুটি নিয়ে মেলা দেখতে যায়। শ্বশুরবাড়িও ওখানে। সেই সময় ওর বাড়ি কাজ করে আমাদের বাড়ির ঠিকে বৌটা।’’
শুনে মিত্র বললেন,
‘‘তাতে কী?’’
‘‘তাতে কী! এ বার নিখিল যখন বৌকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে, সে সময় বোস আমার বাড়ির বৌটাকে নিজের ঘরে ডেকে রেপ করবে। ঠিক তখন সবাই জানতে পেরে ডাক্তারের বাড়ি ঘেরাও করবে। ডাক্তারকে হাতেনাতে ধরে ফেলবে। তার পর, ওকে বিদায় করতে আর কত ক্ষণ!’’
অবাক হয়ে ঘোষ বললেন, ‘‘রেপ করবে মানে?’’
ধলা, ‘‘বৌটার বর আমার কাছে প্রায়ই ধার নেয় চোলাই খাওয়ার জন্য। ধার দিয়ে দিয়ে নেশা ধরিয়ে দিয়েছি। ক’দিন পরেই পৌষসংক্রান্তি। তখন ধারের সব টাকা একসঙ্গে ফেরত চাইব। দিতে পারবে না। তখন, ওকে দিয়েই কাজটা হাসিল করব। সন্ধের সময় অনামুখোটা ঘরে থাকবে, আর বৌটাও ঘরে থাকবে, রান্না করবে। তখন ওর মরদটাকে দলবল দিয়ে পাঠাব ওখানে, বাইরে থেকে শেকল তুলে দিয়ে সবাই হাল্লা করবে যে, ওর বৌকে ডাক্তার বোস রেপ করছে। আশপাশের লোকজনকে ডাকবে, আমরাও যাব। সবাই মিলে হাতেনাতে ধরব।’’
ঘোষ সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘‘ডাক্তার স্বীকার করবে কেন? আর বৌটাই বা কেন বলবে ডাক্তার রেপ করেছে?’’
‘‘কাউকেই কিছু স্বীকার করতে হবে না। বেশ লোক জড়ো হলেই, মরদটা ওর বৌকে চুলের মুঠি ধরে, মারতে মারতে টেনে নিয়ে চলে যাবে। ওর সঙ্গে দু’চার জনকে দিয়ে দেব, যাতে বৌটা কোনও কথা বলতে না পারে। আর বললেও যাতে কেউ তা শুনতে না পায়। আর থানাতেও বলা থাকবে, খবর পেলেই ওরা সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে। এর পর সকাল হওয়ার আগেই, তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখান থেকে বরাবরের মতো বিদায় নেবে। এর পরে আমাদের রাস্তা ক্লিয়ার। আর, এর পরে যে ডাক্তারই হাসপাতালে আসুক, তাকে এই পরিণামটা জানিয়ে দিতে হবে,’’
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন ধলা।
******
ক্রিকেট ফাইনালের ক’দিন পর শুনলাম হাসপাতালের ডাক্তারবাবু তাঁর ঘরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
মাঝখান থেকে আমাদের লোকসান হয়ে গেল। ভাল ব্যাটটা সারাতে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেটা ফেরত পাওয়া গেল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy