ছবি: কুনাল বর্মণ
ব্যাপার কি? নোংরা-টোংরা মাড়িয়ে এসেছ না কি? কেমন একটা বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে!’’ অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই রঞ্জনা কথাটা বলল।
‘‘বিশ্রী গন্ধ! কই? আমি তো পাচ্ছি না!’’ বলে দু-তিন বার জোরে জোরে নাক টেনে শোঁকার চেষ্টা করলাম।
নাক কুঁচকে রঞ্জনা বলল, ‘‘থাক, তোমাকে আর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে হবে না। সোজা বাথরুমে যাও। চান করে এসো। আমি খাবার গরম করছি। মুনুউউ... বাবা এসে গেছে। এ বার টিভি বন্ধ করে খাবে এস।’’
মেয়ে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আমাকে দেখেই বলল, ‘‘বাবাই, আমার খাতা এনেছ?’’
ধ্যাত্তেরিকা! ভুলেই মেরে দিয়েছি একদম। জিভ কেটে বললাম, ‘‘একেবারে ভুলে গিয়েছি। কালকে আনব। ঠিক।’’
মুনু তাকিয়ে আছে আমার ব্যাগের দিকে। ফুলে আছে ব্যাগটা। স্কচের বোতলটা চ্যাপ্টা হলেও মাপে বড়। তার সঙ্গে খবরের কাগজে জড়ানো, মেহতার দেওয়া বাকি ১৮ হাজার টাকা। সব একশোর নোটে। ঘুষ নেওয়ার সময় খুব সাবধান থাকি। নতুন নোট একদম নয়, বড় নোটও নয়।
‘‘তা হলে ব্যাগে কী তোমার?’’ মুনু বলল।
‘‘আহ্, বললাম তো, তোমার খাতা কাল এনে দেব!’’ একটু ঝাঁঝিয়েই উঠলাম।
মুনুর পাশ কাটিয়ে ভিতরে গিয়ে, আলমারি খুলে ব্যাগটা ওপরের তাকে রাখলাম। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে শুনতে পেলাম মুনু তার মা’কে বলছে, ‘‘ঘরে মনে হয় ইঁদুর মরেছে। কেমন একটা পচা পচা গন্ধ!’’
******
অফিসে দুপুরের দিকে রোজ পাশের ঘরের বিদ্যুৎদা আসেন। আজকেও এসেছিলেন। আমার কাছে এসে শুরু করেছিলেন, ‘‘আমার মেয়েটা এত ইন্টেলিজেন্ট, কী বলব ভাই! নিজের মেয়ে বলে বলছি না। একটু দেখো না, যদি ওর একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারো। তোমার তো অনেক সোর্স।’’
আমি মিটিমিটি হাসি। আমি জানি আমার কত সোর্স। কিন্তু টাকা ছাড়া আজকাল আঙুল নাড়াতেও ইচ্ছে করে না। মুখে বলি, ‘‘আপনার মেয়ে যখন, ইন্টেলিজেন্ট তো হবেই।’’
একগাল হেসে খুব লজ্জা-টজ্জা পেয়ে ভদ্রলোক আরও একটু চেয়ারটাকে টেনে আনলেন আমার কাছে। ‘‘এই এক তুমিই বললে। আর কেউ আমার দাম দিল না রে ভাই। অফিসে গাধার মতো খাটি, বসের কাছে কুকুরের মতো ব্যবহার পাই। আর আমার ঘরের সহকর্মীদের দেখো! শুধু নিজেদেরটা বোঝে। কখনও এক কাপ চা-ও অফার করে না। এ দিকে প্রত্যেক উইকেন্ডে মন্দারমণি নয় দিঘা গিয়ে মোচ্ছব করছে। ছ্যা ছ্যা। আরে জীবনে কী থাকবে! অ্যাঁ? বলো ভাই? সব ফেলে এক দিন চলে যেতে হবে। কি? ঠিক কি না?’’
আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিই, ‘‘সে তো বটেই। কিছুই সঙ্গে যায় না।’’
শুনেই বিদ্যুৎদা বেশ উৎসাহিত হয়ে আবার শুরু করেন, ‘‘ঠাকুর কী বলেছেন জানো? বলেছেন, নিজের যা কিছু সব অপরের জন্য বিলিয়ে দে, তা হলেই তুই মুক্ত!’’ বলে একটা দার্শনিক হাসি হাসলেন।
‘‘এ রকম বলেছেন না কি?’’
বিদ্যুৎদা বেশ জোর দিয়ে বললেন, ‘‘এ সব নিয়ে আমার বহুকালের চর্চা রে ভাই। সেই জন্যই তো জীবনটা এমন মোহমায়ামুক্ত হয়ে কাটিয়ে যাচ্ছি। সবই সেই করুণাময়ের ইচ্ছে। আমার মেয়েটাও হয়েছে ঠিক আমার মতো, বুঝলে? ওর ব্যাপারটা এক বার দেখো ভাই।’’
আমি টেবিলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, নিশ্চয়ই দেখব। সব ব্যাপার ভাল করে দেখেশুনে নিতে হবে। আমার কাছে যদি পাশ করতে পারে তবেই... এখনকার মেয়েরা ভারী সেয়ানা। কাজ ফুরোলে আর পাত্তা দেয় না। আগেই হিসেব বুঝে নিতে হবে। কিন্তু এখন ঠিক কত টাকা বিদ্যুৎদার কাছ থেকে চাওয়া যায়?
হঠাৎ দেখলাম বিদ্যুৎদা নাক কুঁচকে ফোঁস ফোঁস করছেন!
জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কী হল?’’
বিদ্যুৎদা মুখ বিকৃত করে বললেন, ‘‘একটা চিমসে, পচা গন্ধ পাচ্ছ? এখানে এসে বসার পর থেকেই পাচ্ছি। এখন বেশ জোর লাগছে গন্ধটা। টেবিলের নিচে একটু দেখো তো। যদি কিছু পচে-টচে থাকে।’’
আমি হেসে ফেলে বললাম, ‘‘কী বলছেন বিদ্যুৎদা। অফিস রোজ ঝাড়মোছ হয়। রুম ফ্রেশনার দেয়। এখানে কী করে কিছু পচবে! কই, আমি তো পাচ্ছি না গন্ধ?’’
সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্যুৎদা বললেন, ‘‘তুমি পাচ্ছ না? ঠিক বলছ?’’
আমি বারকয়েক জোরে জোরে শুঁকে বললাম, ‘‘নাহ্, পাচ্ছি না।’’
বিদ্যুৎদা আর বেশি ক্ষণ বসলেন না। ‘কাজের চাপ আছে’ বলে উঠে গেলেন।
অফিস ছুটির একটু আগে রুমেলা এল। হাতে একটা ফাইল। ফাইলটা দিয়ে বলল, ‘‘এটা আমাকে পরশু দিলেই হবে। চাপ নেই।’’
রুমেলার সঙ্গে আমার একটু মাখো-মাখো সম্পর্ক। রঙিন রঙ্গ-রসিকতা করা যায়। বললাম, ‘‘চাপ তো আমার তোকে দেখলে হয় রে। বুকের মধ্যে। দিন দিন কি মিষ্টি যে হচ্ছিস। বোস না। চা খাবি?’’
হিহি করে হেসে চেয়ার টেনে নিয়ে রুমেলা বসে বলল, ‘‘এই খেলাম। আপনি খান।’’
বলতে বলতে মোবাইলটা বাজল। বাড়ি থেকে, রঞ্জনা। ফোনটা ধরে বললাম, ‘‘ব্যস্ত আছি। পরে ফোন করছি।’’
রুমেলা সামনে বসে। বুকের আঁচল সরে গিয়েছে। ঝুঁকে এল সামনে। তার পরেই নাক সিঁটকালো, ‘‘টেবিলটাকে এমন নোংরা করে রাখেন কেন? ইস্স, কী বাজে গন্ধ। কী সব জমিয়ে রাখেন বলুন তো? এত পচা গন্ধ কিসের!’’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘‘আমি তোর গায়ের মিষ্টি গন্ধ ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছি না।’’
‘‘ধ্যাত! আপনার খালি ইয়ার্কি।’’
শরীরে হিল্লোল তুলে রুমেলা চলে যাচ্ছে। পিছন থেকে রুমেলাকে বেশি সেক্সি লাগে। শুনছি সামনের মাসে ওর বিয়ে। অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। জীবনে কত কী যে করা হল না!
ফেরার সময় একটা জুয়েলারির দোকানে ঢুকলাম। আজ একটা বড় অর্ডার পাস করিয়েছি। মোটা টাকা এসেছে। এত টাকা বাড়িতে ফেলে রাখা বোকামি। লাখের ওপরে হলেই তাই গয়না কিনে নিই। রঞ্জনা ভাবে, ওর জন্যে কিনছি! খুশি হয়। আমি জানি, সোনার চেয়ে ভাল বিনিয়োগ আর হয় না।
******
গন্ধের ব্যাপারটা কিন্তু গেল না। দু’দিন হল রঞ্জনা মেয়ের সঙ্গে পাশের ঘরে শুচ্ছে। গন্ধে নাকি ঘুমোতে পারছে না। শালা, এর নাম বউ! পরশু রাতে গয়নাটা পেয়েও রাজি হল না!
এর মধ্যেই এক দিন বিদ্যুৎদাকে লিফটের সামনে পেয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সামান্য পিছিয়ে গেলেন। হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কী ব্যাপার? আর যে এলেনই না!’’
বিদ্যুৎদা কী একটা দায়সারা উত্তর দিলেন। বুঝলাম, এড়িয়ে যাচ্ছেন। সে দিন বেশি চাইনি। পঞ্চাশ বলেছিলাম। ঠিক হ্যায়। আমিও দেখব কী করে তোর মেয়ের চাকরি হয়।
নিজের চেয়ারে গিয়ে বসার একটু পরেই রুমেলার স্লিপ নিয়ে পিয়ন এল। সেই ফাইলটা চেয়ে পাঠিয়েছে। লিখেছে, ‘জরুরি।’ এ রকম কেসে নিজেই চলে আসে। এই প্রথম পিয়নকে পাঠাল। পিয়ন ছেলেটা নতুন। স্লিপটা দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, ‘‘ম্যাডাম কি সিটে আছেন?’’
ছেলেটা একটু ইতস্তত করে বলল, ‘‘হ্যাঁ। মানে, না। ক্যান্টিনে চা খাচ্ছেন।’’
শুনে থমকে গেলাম। ফাইলটা রেডিই ছিল। বার করে দিলাম।
অফিস থেকে ফেরার সময় দেখেশুনে একটা চড়া গন্ধের ডিয়ো কিনলাম। দোকানের বাইরে এসে বেশ খানিকটা বগলে বুকে স্প্রে করে নিলাম। ভাবলাম বয়েস হচ্ছে, তাই হয়তো ঘামের গন্ধ বেড়েছে। তবু মনের ভিতর একটা খচখচানি লেগেই রইল। বাড়ি ঢুকতেই রঞ্জনা বলে উঠল, ‘‘এ আবার কী মেখেছ! এমনিতেই গায়ের গন্ধে ভূত পালায়, তার ওপর এই চড়া গন্ধ! উফফ! আর টিকতে দেবে না দেখছি!’’
মেয়েও দেখলাম নাক টিপে সরে গেল। মাথাটা গরম হয়ে গেল।
অফিসের জামাকাপড় টবে ফেলে পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরছিলাম। রঞ্জনা পাশের ঘর থেকে বলে উঠল, ‘‘এ বার থেকে তোমার কাপড়জামা লন্ড্রিতে দিও। আমার কাচতে বমি পায়। যা দুর্গন্ধ!’’
শুনে আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করল না। পাড়ার চায়ের দোকানে চলে এলাম। সেখানে স্বপনকে পেয়ে গেলাম। ছোটবেলার বন্ধু। সোজা সরল গাধা টাইপের ছেলে। এমনিতে বিশেষ পাত্তা দিই না। আজ আর থাকতে না পেরে সব বলে ফেললাম।
চুপ করে স্বপন সব শুনল। তার পর সোজাসুজি বলল, ‘‘দেখো বস, সত্যি বলতে কী, দুর্গন্ধটা আমিও পেয়েছি। আজ ডিয়ো-ফিয়ো মেরে এসেছ, কিন্তু তাও পাচ্ছি। তবে এত চাপ নেওয়ার কিছু নেই। অনেকের মুখেও খুব বাজে গন্ধ হয়। লিভার থেকে হয় শুনেছি। ডাক্তার দেখালে সেরেও যায়। এটাও মনে হয় সে রকমই কিছু। একটা ভাল ডাক্তার দেখিয়ে নাও। সেরে যাবে।’’
স্বপনের সঙ্গে কথা বলে মনটা বেশ হালকা হয়ে গেল। যতটা ক্যালানে ভাবতাম তেমন নয়। ওর কাছ থেকেই ভাল এক জন ডাক্তারের খোঁজ পেলাম। ইয়ার্কি মেরে বললাম, ‘‘এই ডাক্তারের সঙ্গে তোমার কত পার্সেন্টের হিসেব?’’
স্বপন হাহা করে হেসে উঠল।
******
ডাক্তারবাবুটি বয়স্ক। দু–এক জন রোগীর পরেই আমাকে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘‘কিচ্ছু লুকোবেন না, লজ্জা পাবেন না। সব খুলে বলুন।’’
যা যা ঘটেছে সব বলে, জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আপনিও কি কোনও গন্ধ পাচ্ছেন?’’
ডাক্তারবাবু এক বার তাকিয়ে বললেন, ‘‘আমরা ডাক্তার। সারা দিনে কত পেশেন্ট ঘাঁটতে হয়। অনেক রকমের গন্ধও সহ্য করতে করতে অভ্যেস হয়ে যায়। আপনি জামাটা খুলে ওই বেডে শুয়ে পড়ুন।’’
শুয়ে পড়ে বললাম, ‘‘আশেপাশের সবাই গন্ধ পায়, কিন্তু আমি কেন পাই না বলুন তো?’’
ডাক্তার মৃদু হেসে বললেন, ‘‘সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি। দেখি আপনার জিভটা!’’
অনেক ক্ষণ ধরে আমাকে পরীক্ষা করলেন। প্রেশার মাপলেন, বুকে, পিঠে স্টেথো বসিয়ে বসিয়ে মন দিয়ে শুনলেন। কানের ভিতর, নাকের ভিতর টর্চ জ্বেলে দেখতে লাগলেন। ক্রমশ তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠছিল। এক সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামলেন।
‘‘নিন, উঠে পড়ুন।’’
জামাটা পরতে পরতে বললাম, ‘‘কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু?’’
ভদ্রলোক বললেন, ‘‘আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন। একটা জরুরি ফোন করার আছে। হয়ে গেলেই আপনাকে ডেকে নিচ্ছি।’’
বাইরে এসে একটা চেয়ারে বসলাম। যে ঝিনচ্যাক মহিলা রিসেপশনে বসেছিলেন, তিনি দেখলাম নাকে রুমাল দিলেন। আরও দু–তিন জন রোগী বসে ছিল। তারাও নাকে কাপড় চাপা দিয়েছে!
হঠাৎ কানের কাছে গমগম করে উঠল ডাক্তারবাবুর গলা। চমকে তাকালাম। কিন্তু কই ডাক্তার? সে তো ঘরের ভিতরে! মাঝখানে কাচের দরজা। ও পারে ভারী মোটা পর্দা। এ সব ভেদ করে এত পরিষ্কার ভাবে ডাক্তারের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি কী করে!
ঘরের বাকি লোকগুলোর দিকে তাকালাম। তারা এক রকম ভাবেই বসে। ওরা কেউ বোধহয় ডাক্তারের গলা শুনতে পাচ্ছে না। শুধু আমি পাচ্ছি! সেটাও এত পরিষ্কার, এত গমগমে, যে মনে হচ্ছে হেডফোনে শুনছি! ডাক্তার কাউকে ফোনে বলছে, ‘‘তুই বিশ্বাস কর, একদম সত্যি বলছি। পেশেন্টটার কিচ্ছু নেই! পালস, প্রেশার, হার্টবিট, নাথিং! আরে ভাই, আমার চেম্বারে পেশেন্ট বসে আছে, আমি এই সময় তোর সঙ্গে ইয়ার্কি মারব? আমার কুড়ি বছরের ডাক্তারির অভিজ্ঞতায় এ রকম কখনও দেখিনি! তুই এক বার আসতে পারবি? এক্ষুনি? আমি ওকে বসিয়ে রেখেছি। লোকটা যেন জীবন্ত লাশ। মনে হচ্ছে মর্গ থেকে উঠে এসেছে। নাক, কান সব পুঁজে ভর্তি। যেন ভিতরে সব পচেগলে গিয়েছে! একটা বিকট দুর্গন্ধ ছাড়া বাইরে থেকে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই! বুঝতে পারছিস? হ্যালো? হ্যালো অনির্বাণ, শুনতে পাচ্ছিস...?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy