Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস 

শেষ নাহি যে

লেডিস পিন্টু ঢুকে গেল ডানদিকের গলিতে। আর তখনই ঘটল অঘটনটা। একটা ছেলে দৌড়ে এসে টোটোর দিকে লাঠি ছুড়ল। লাঠিটা উড়ে এসে লাগল দরিয়ার হাতে।  দরিয়ার হাত থেকে মোবাইল ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেল। সাম্যব্রত অবাক হয়ে দেখলেন, দরিয়া ব্যথায় কুঁকড়ে বলে উঠল, ‘‘বি...হা...ন!’’ তার পরে চোখ বুজল।   

ছবি: শুভম দে সরকার

ছবি: শুভম দে সরকার

ইন্দ্রনীল সান্যাল
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:১০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: গণতান্ত্রিক মোর্চার নেত্রী মানসী বসু আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গোটা রাজ্যে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অশান্তি, হিংসা। আর এই সময়ই প্রসব যন্ত্রণা শুরু হল দরিয়ার। দরিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে এল লেডিস পিন্টু।

পিন্টুর কথায় সায় দিয়ে পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করছেন সাম্যব্রত। ঠিক এই সময়ে টোটোর পাশে গুড়ুম করে শব্দ হল। আগুনের ঝলকানিতে সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ধোঁয়ায় ভরে গেল রাস্তা। লেডিস পিন্টু চিৎকার করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলল, ‘‘পোয়াতি মেয়ে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। এখন কেউ ঝামেলা করবি না বলে দিলাম।’’

সাম্যব্রত দরিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘‘পিন্টু, তাড়াতাড়ি চলো।’’

দরিয়া ককিয়ে উঠে বলল, ‘‘বাবা, আমার পা! কিছু একটা ঢুকেছে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।’’

‘‘আর পাঁচ মিনিট মা। আমরা এসে গিয়েছি,’’ মেয়ের মাথা নিজের কোলে নিয়ে টোটোতে গুঁড়ি মেরে বসলেন সাম্যব্রত। তখনই তাঁর চোখে পড়ল, কয়েকটা ছেলে রাস্তার উপরে মারামারি করছে। পরিস্থিতি বুঝে সাম্যব্রত বললেন, ‘‘পিন্টু, ডানদিকের গলিতে ঢুকে যাও।’’

লেডিস পিন্টু ঢুকে গেল ডানদিকের গলিতে। আর তখনই ঘটল অঘটনটা। একটা ছেলে দৌড়ে এসে টোটোর দিকে লাঠি ছুড়ল। লাঠিটা উড়ে এসে লাগল দরিয়ার হাতে। দরিয়ার হাত থেকে মোবাইল ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেল। সাম্যব্রত অবাক হয়ে দেখলেন, দরিয়া ব্যথায় কুঁকড়ে বলে উঠল, ‘‘বি...হা...ন!’’ তার পরে চোখ বুজল।

‘‘পায়ে বোমার টুকরো ঢুকেছে। ওটা বার করতে পারিনি। হাতের চোটটার জন্য চিন্তা নেই। আর বাচ্চা একদম ঠিক আছে,’’ বললেন ডাক্তার।

‘‘যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল,’’ রুমাল দিয়ে টাকের ঘাম মুছলেন সাম্যব্রত। লেডিস পিন্টু আকাশের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল।

ডক্টর মিত্র বললেন, ‘‘নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। পা থেকে বোমার টুকরোটা বার করার জন্য অপারেশন করতে হবে। আমি গাইনিকলজিস্ট। ওটা আমি পারব না।’’

‘‘অপারেশনটা তা হলে আজই করে দিন। আপনার চেনা কোনও সার্জনকে ডেকে নিন।’’

‘‘ডাকতেই পারতাম। কিন্তু অন্য সমস্যা আছে। বোম্ব ইনজুরি বা লাঠির আঘাত... এগুলো শারীরিক নির্যাতন বা ফিজ়িকাল অ্যাসল্ট। এর জন্যে পুলিশ কেস হবে।’’

ফতুয়ার পকেট থেকে ইনহেলার বার করে একটা লম্বা টান দিয়ে সাম্যব্রত বললেন, ‘‘আপনি এখানে ডেলিভারিটা করে দিন। আমরা তার পর থানায় যাব।’’

‘‘এই পেশেন্টের ডেলিভারি এখানে হবে না।’’

‘‘মানে?’’ ইনহেলার পকেটে ঢুকিয়ে সাম্যব্রত বললেন, ‘‘দরিয়ার প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টা আপনি চেক আপ করলেন। এখন বলছেন ডেলিভারি করবেন না? এটা কী ধরনের কথা?’’

ডক্টর মিত্র সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘এটা শুধুমাত্র মেটারনিটি ক্লিনিক। আমি শুধু গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে ডিল করি। আপনার মেয়ের কেসটা কমপ্লিকেটেড হয়ে গেছে।’’

সাম্যব্রত চুপ।

ডক্টর মিত্র বললেন, ‘‘ওকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ইনজুরি রিপোর্ট লেখাতে হবে। থানায় গিয়ে জিডি করতে হবে। এগুলো রুটিন কাজ। কারও বিরুদ্ধেই কেউ কোনও ব্যবস্থা নেবে না। মেয়ে ভাল থাকলে ভাল। কিন্তু ওর কিছু হয়ে গেলে আপনি হাজার ঝামেলার মধ্যে পড়বেন। আমি আপনাকে করজোড়ে অনুরোধ করছি, মেয়েকে হাওড়ার বঙ্গবাসী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’’

সাম্যব্রত কী বলবেন বুঝতে না পেরে চেয়ারে বসে পড়লেন। ডক্টর মিত্র মোবাইলে কাউকে কিছু বললেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই স্ট্রেচারে তোলা হল দরিয়াকে। সে ফিসফিস করে সাম্যব্রতকে বলল, ‘‘আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা?’’

সাম্যব্রত উত্তর দিলেন না। দেখলেন, স্ট্রেচার ঢুকে যাচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে। লেডিস পিন্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘তোমাকে কত দেব?’’

‘‘মরণ দশা আমার!’’ কপালে হাতের তালু ঠুকে লেডিস পিন্টু বলল, ‘‘ওরা তো যা দেওয়ার দিয়েছে। বোমা, লাঠি! আমি অন্য রকম। আমি আজ কিছু নেব না। যে টাকাটা বাঁচল, ওটা পরে কাজে লাগবে। এ বার যাও। সাড়ে দশটা বাজে।’’

সাম্যব্রত লেডিস পিন্টুর দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠলেন। সাম্যব্রত দেখলেন, এই শীতেও দরিয়া ঘামছে। ঘোলাটে গলায় সে বলল, ‘‘বাবা, বিহানকে ফোন করো। আমার মোবাইলটা তো রাস্তায় পড়ে গেছে।’’

আরে! জামাইকে এখনও ফোন করা হয়নি! মনেই ছিল না সাম্যব্রতর। তিনি নিজের মোবাইল থেকে বিহানের নম্বর ডায়াল করলেন।

বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্সের সেন্সরে আঙুলের ছাপ দিয়ে পোর্টের ভিতরে ঢুকে মোবাইলে সময় দেখল বিহান। সওয়া দশটা বাজে। পনেরো মিনিট দেরি করার জন্য মিস্টার দাসের কাছে আজেবাজে কথা শুনতে হবে। লোকটা খেঁকুড়ে টাইপের।

নিজের অফিসের দিকে না গিয়ে মিস্টার দাসের চেম্বারের দিকে এগোল বিহান। উনি যদি এখনও নিজের চেম্বারে থাকেন, তা হলে বিহান বেঁচে গেল। সে যে পনেরো মিনিট দেরি করেছে, এটা উনি বুঝতে পারবেন না।

আজকের দিনটা বিহানের পক্ষে শুভ নয়। মিস্টার দাসের চেম্বারে ঢোকার মুখেই ওর চামচা বলল, “স্যর তোমার কাছে গেল। পোর্টের ম্যানেজার ফোন করে স্যরকে ধাতানি দিয়ে বলেছেন, কার্গোর লোডিং আর আনলোডিং নিয়ে ডেটা এন্ট্রিতে চার মাসের ব্যাকলগ আছে। স্যর তোমার ওপরে বহুত খচে আছেন।’’

সর্বনাশ করেছে! বিহান নিজের অফিসের দিকে দৌড় দিল। লম্বা করিডর দিয়ে দৌড়ে ডান দিকে ঘুরে একটা ঘুপচি গলি দিয়ে কয়েক পা গেলেই তার বসার খুপরি।

করিডর দিয়ে দৌড়তে গিয়ে ব্রেক কষল বিহান। ডান দিকের গলি থেকে বেরিয়ে এসেছেন মিস্টার দাস। মুখে বিরক্তি আর রাগের ছাপ স্পষ্ট। বিহানকে দেখে বললেন, ‘‘দৌড়ে আসার দরকার নেই।
তুমি লেট।’’

‘‘স্যরি স্যর!’’ হাঁপাচ্ছে বিহান।

‘‘স্যরি কেন বলছ? তুমি তো প্রত্যেক দিনই লেট করো,’’ বিহানকে পেরিয়ে যাচ্ছেন মিস্টার দাস। বিহান পিছন পিছন হাঁটছে। “কোনও দিনও করি না স্যর। আজই হয়ে গেছে।’’

মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে মিস্টার দাস বললেন, ‘‘তুমি এখন যাও।’’

অন্য যে কেউ হলে চলে যেত। মিস্টার দাস এখন রেগে আছেন। একটু পরেই রাগ পড়ে যাবে। তখন বললেই হল, ‘‘আর কোনও দিনও হবে না স্যর। এ বারের মতো মাফ করে দিন।’’ মিস্টার দাস বলতেন, ‘‘ঠিক আছে, যাও।’’ সব মিটে যেত।

কিন্তু আজ বিহানের হাতে সময় নেই। আজ কনট্র্যাক্ট রিনিউয়ালের দিন। সে বলল, ‘‘স্যর, আপনার সঙ্গে একটা দরকার ছিল।’’

মিস্টার দাস বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘‘তোমাকে তো যেতে বললাম। আবার কী হল?’’

চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে বিহান বলল, ‘‘স্যর, আমার রিনিউয়ালটা...’’

মিস্টার দাস নিজের কেবিনে ঢুকলেন। চেয়ারে বসে রিমোট টিপে দেওয়ালে মাউন্ট করা টিভি চালিয়ে বললেন, ‘‘তোমার বিরুদ্ধে পোর্ট থেকে আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। কার্গোর লোডিং আর আনলোডিং-এর ডেটা এন্ট্রিতে চার মাসের ব্যাকলগ কেন?’’

কথা বাড়ালেই বিপদ। কিন্তু আজ বিহান নিরুপায়। সে বলল, ‘‘স্যর, কাজটা আমাকে একা তুলতে হচ্ছে।’’

‘‘তো?’’ বললেন মিস্টার দাস।

‘‘সনতের কাজটাও আমাকেই করতে হয় স্যর,’’ গড়গড় করে বলে দিল বিহান, ‘‘ও সপ্তাহে মাত্র দু’দিন অফিসে আসে। সেই দু’দিনও কাজ না করে সংগঠনের মিটিং করে।’’

ভুরু কুঁচকে মিউট করা টিভির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মিস্টার দাস। সামান্য ভেবে বললেন, ‘‘তুমি এক কাজ করো। তোমার এই অভিযোগটা লিখিত আকারে আমাকে দাও। পোর্টের বড়কর্তার জন্যও একটা কপি দিও।’’

এ তো মহা গেরো! বিহান সামান্য কনট্র্যাকচুয়াল স্টাফ। লিখিত অভিযোগ জানাতে গিয়ে কী বিপদে পড়বে কে জানে! হয়তো চাকরিটাই চলে যাবে। অজানা আশঙ্কায় দু’হাতের পাতায় মুখ ঢাকল বিহান। তার পর নিজেই নিজেকে সাহস জুগিয়ে বলল, ঝামেলায় গিয়ে কী দরকার? যা বলার বলা হয়ে গেছে। একটা দেঁতো হাসি দিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল শুরু করল বিহান, ‘‘আমি তো স্যর কথার কথা বললাম। এ বারের মতো মাফ করে দিন।’’

‘‘ওইভাবে কথা ঘোরানো যায় না কি?’’ মিস্টার দাসের গলায় যেন মিছরির ছুরি, “তোমার কাজের অসুবিধে হচ্ছে। সেটা তুমি লিখিত জানাবে না? মৌখিক অভিযোগের তো কোনও গুরুত্ব নেই।”

“ভুল হয়ে গেছে স্যর,” বিহানের দেঁতো হাসি বন্ধ হয়ে গেছে।

মিস্টার দাস বললেন, “সনৎ কুইলা খরাজ পার্টির রাজ্যস্তরের নেতা। এটা তুমি জানো?”

“জানি স্যর। ও আমার স্কুলের বন্ধু।”

“সনৎই তোমাকে এই চাকরিতে ঢুকিয়েছে। তাই না?” জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার দাস।

“হ্যাঁ স্যর।”

“তা হলে তোমার জানা উচিত যে, ও কোনও কাজ করবে না। তোমাকেই ওর সব কাজ তুলে দিতে হবে।”

“হ্যাঁ স্যর।” বিহান ঠিক করেছে ‘হ্যাঁ স্যর’ ছাড়া অন্য কোনও কথা সে এখন বলবে না।

“তা হলে তুমি মেনে নিচ্ছ যে তোমার কাজে গাফিলতি হয়েছে?”

“হ্যাঁ স্যর।”

“কাজে গাফিলতি হলে তোমার অ্যানুয়াল কন্ট্র্যাক্ট রিনিউয়াল কী করে করি বলো তো? কাল অন্য এক জন ফাঁকিবাজ স্টাফ এসে বলবে, ‘স্যর, কন্ট্র্যাক্ট রিনিউয়াল পেপারে সই করে দিন।’ আমাকেও তখন সেটা মেনে নিতে হবে। এই সব দু’নম্বরি প্রবণতাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা ভাল।”

বিহান বুঝতে পারছে, মিস্টার দাস তাকে নিয়ে খেলছেন। হুলো বেড়াল যেমন ভাবে থাবার মধ্যে ইঁদুরছানাকে নিয়ে খেলে, ঠিক সেই ভাবে। কিন্তু বিহানের কিছু করার নেই। তাকে এই চাকরিটা রাখতে হবে। মাসের শেষে পনেরো হাজার টাকা তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢোকে।

মিস্টার দাসের টেবিলের পাশে গিয়ে হাত দু’টো জড়িয়ে ধরে বিহান বলল, “এইবারের মতো ক্ষমা করে দিন স্যর। আমার বউয়ের বাচ্চা হবে। টাকাটা খুব দরকার।”

এক ধাক্কায় বিহানকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন মিস্টার দাস। চিৎকার করে বলছেন, “‘এই সব শস্তা মেলোড্রামা আমার সঙ্গে একদম করবে না। গেট আউট! বেরিয়ে যাও আমার
চেম্বার থেকে।”

টেবিলের পাশ থেকে সরে দাঁড়াল বিহান। টিভির দিকে এক পলক তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন মিস্টার দাস।

সামনের মাস থেকে চাকরিটা রইল কি না কে জানে! বিহান চোখের জল মুছছে। মিস্টার দাসের চেম্বারে থাকার আর কোনও মানে হয় না। বরং নিজের খুপরিতে গিয়ে সারা দিন খেটে যদি কাজটা তুলে দেওয়া যায়, তা হলে আগামীকাল আর এক বার মিস্টার দাসকে বলা যাবে। সনৎকেও বলে দেখতে হবে। ও চাকরি দিয়েছিল। চাকরি যাওয়া ও-ই আটকাতে পারবে বলে মনে হয়।

মিস্টার দাসের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে টিভির দিকে নজর গেল বিহানের।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy