পূর্বানুবৃত্তি: প্যারালিসিসে শয্যাশায়ী হওয়ার পর বাবাকে দেখতে বিতানকে মাঝে মাঝে এ বাড়ি আসতে হয়। আজও এসেছে, তবে আজ ডেকে পাঠিয়েছেন বাবার দ্বিতায় স্ত্রী, ঊর্বীর মা মালবিকা। সোফায় বসে ঊর্বী তাকে পরীক্ষায় টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার গল্প বলল। আহিরী ম্যাডামের কথা বলতে চমকে উঠল বিতান।
বিতান স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, ‘‘উনি কী করলেন?’’ ঊর্বী কৌতুকের হাসি হেসে বলল, ‘‘ম্যাডাম সে সব কিছু করলেন না। শুধু আমার মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললেন, দু’দিন পরে পাবে। বুঝুন কাণ্ড। মোবাইল নেই মানে আমার ফেসবুক চ্যাট, গান শোনা, মুভি দেখা— সব ভোগে।’’ কথা থামিয়ে হাসতে লাগল ঊর্বী।
এই বাড়িতে বসে কোনও কিছুতে মজা পাওয়া অসম্ভব। তার পরেও বিতান মজা পাচ্ছে। আহিরীর গল্প শুনছে বলেই পাচ্ছে।
‘‘তোমাদের ম্যাডাম ফোন নিয়ে নিল?’’
ঊর্বী চোখ বড় করে বলল, ‘‘অবশ্যই নিয়ে নিল। কিন্তু এগেন থ্যাঙ্কস টু ঘেরাও। ঘেরাও চলতে চলতে রাত হয়ে গেল। আমিও গিয়ে ম্যাডামকে পাকড়াও করলাম। বললাম, রাত হয়ে গেছে, বাড়িতে খবর দিতে পারছি না। মোবাইলটা ফেরত দিন প্লিজ। উনি দিয়ে দিলেন। ম্যাডাম খুব সুইট না? ফোন কেড়ে নেওয়ার জন্য ম্যাডামের ওপর যতটা ফায়ার হয়ে গিয়েছিলাম, সব ওয়াটার হয়ে গেল।’’
কথা শেষ করে ঊর্বী ঠোঁট সরু করে কৌতুকভরা মুখে বিতানের দিকে তাকিয়ে রইল। বিতান অস্বস্তিতে মুখ সরিয়ে বলল, ‘‘তোমার মা’কে একটা ফোন করে দেখো তো কত দেরি হবে। আমার তাড়া আছে।’’
ঊর্বী এই কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘‘ও, আর একটা কথা। আপনাকে বলব ভেবে রেখেছিলাম। কয়েক দিন আগে, গড়িয়াহাটে আপনার সঙ্গে মুখোমুখি হয়েও না চেনার ভান করেছিলাম। এর জন্য স্যরি। বাট আমার কিছু করার ছিল না।’’
ঊর্বী কোন দিনের কথা বলছে বিতান মনে করতে পারল না। বলল, ‘‘আমার খেয়াল নেই।’’
ঊর্বী বলল, ‘‘আপনার খেয়াল না থাকতে পারে, আমার খেয়াল আছে। সে দিন কেন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম জানেন?’’
বিতানের আর ভাল লাগছে না। সে বলল, ‘‘আমি এ সব জানতে চাই না। তুমি মা’কে ফোন করো, নইলে আমি চলে যাব।’’
ঊর্বী বলল, ‘‘সে আপনার ব্যাপার। ইচ্ছে হলে চলে যাবেন। কথাটা শুনে যান। সে দিন সঙ্গে বন্ধুরা ছিল। আপনার সঙ্গে কথা বললে আপনার পরিচয় বলতে হত। কী বলতাম? দাদা? ওরা বলত, কেমন দাদা? মাসতুতো না মামাতো? তখন পড়তাম বিপদে। নিজের দাদা বললে তো আকাশ থেকে পড়ত। বিশ্বাসই করত না। বলত, হাউ ফানি! তোর যে দাদা আছে বলিসনি তো কখনও! তোর থেকে এত বড়! এ সব কথার মধ্যে যাওয়ার থেকে না চেনাই ভাল। তাই না?’’
বিতান ঠিক করে ফেলল এ বার সে উঠে পড়বে। এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটল।
ঊর্বী দ্রুত হাতে মোবাইল ঘঁাটতে ঘঁাটতে বলল, ‘‘এই যে, এই যে দেখুন আহিরী ম্যাডামের ছবি। দেখুন কী স্মার্ট দেখতে! আমি অবশ্য দূর থেকে তুলেছি। মাস তিনেক আগের ফোটো।’’
ঊর্বী ঘুরে এসে এক রকম জোর করে বিতানের সোফার পিছনে এসে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা বিতানের চোখের সামনে ধরল। তার পর স্ক্রিনে আঙুল দিয়ে দ্রুত ফোটোটাকে বড় করে ফেলল। বিতান স্তম্ভিত হয়ে ছবিটা দেখল।
কলেজের গেটের সামনে বিতান আহিরীর গাড়ি থেকে নামছে। জানলা থেকে ঝুঁকে আহিরী হাসিমুখে হাত নাড়ছে। গাড়ির মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে এ বার কলেজে ঢুকবে।
মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল বিতানের। ঊর্বী তত ক্ষণে উল্টো দিকে চলে গেছে। হাসতে হাসতে বলল, ‘‘এই ছবি সে দিন ম্যাডাম যদি মোবাইল ঘেঁটে দেখে ফেলত? বিরাট কেলো হত।’’
বিতান একটু চুপ করে রইল। গম্ভীর গলায় বলল, ‘‘ঊর্বী, তোমার ওই ম্যাডামের সঙ্গে আমার খানিকটা আলাপ আছে। উনি সে দিন আমাকে তার গাড়িতে লিফ্ট দিয়েছিলেন। এই ভাবে লুকিয়ে ওর ছবি তোলাটা তোমার উচিত হয়নি। এটা অন্যায়।’’
ঊর্বী চোখ বড় করে বলল, ‘‘আমি তো ওর ফোটো তুলিনি! সম্পর্কে আমার আত্মীয় হয় এমন এক জনের ফোটো তুলেছি। যেই দেখতে পেয়েছি, মোবাইল তুলে খচ।’’ হাত তুলে ফোটো তোলার ভঙ্গি দেখাল ঊর্বী। তার পর বলল, ‘‘ভেবেছিলাম এক দিন ওঁকে ফোটোটা দেখিয়ে চমকে দেব। এটা অন্যায় হবে কেন?’’
বিতান কী বলবে বুঝতে পারছে না। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। প্রথম দিন বাদ দিলে গত এক বছরে সব মিলিয়ে সে দু’দিন আহিরীর কলেজে গিয়েছে। তাও কলেজের ভিতরে নয়, গেটের কাছে। এখন মনে হচ্ছে, সেটাও ঠিক হয়নি।
বিতান বলল, ‘‘তুমি তো শুধু আমার ফোটো তোলোনি, তোমার টিচারের ফোটোও তুলেছ।’’
ঊর্বী গালের ভিতর ঠোঁট ঘুরিয়ে বলল, ‘‘আর এক দিনের ফোটোও আছে। সেটা গড়িয়াহাটে... এই যে... আপনি আর ম্যাডাম রেস্টুরেন্টে ঢুকছেন।’’
এ বার দূর থেকেই মোবাইল দেখাল ঊর্বী। হাতটা শুধু বাড়িয়ে দিল। বিতান ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পেল না। ঊর্বী বলল, ‘‘ওই দিনের কথাই তো বলছিলাম। আপনাকে দেখেও না দেখার ভান করে আড়ালে সরে গিয়েছিলাম। তার আগে কিন্তু ফোটো তোলা হয়ে গেছে। আমার মোবাইলে পিেক্সল হেভি। ছবি তুলতে যে আমার কী ভাল লাগে!’’
কথা শেষ করে ঊর্বী আবার হেসে উঠল। বিতানের মনে হল, তার মাথা কাজ করছে না। এই মেয়ে কি আহিরীকে কোনও ভাবে ব্ল্যাকমেল করার কথা ভাবছে? বিতানের মতো এক জন ‘কিছু নয়’ ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে পড়লে সেটা আহিরীর জন্য যথেষ্ট লজ্জার হবে।
ডোরবেল বেজে উঠল।
৯
চা তো এসেছেই, সঙ্গে বিস্কুটও এসেছে। তার পরেও মালবিকা বললেন, ‘‘কিছু খাবে? একটা ওমলেট করে দিই?’’
বিতান বলল, ‘‘না। আমি খেয়ে এসেছি।’’
বিতান শুধু চা নিল। প্রথম যখন এসেছিল, তখন প্রতিজ্ঞা করেছিল, এ বাড়িতে জলস্পর্শ করবে না। পরে মনে হয়েছিল, এ সব ছেলেমানুষি। কার উপর রাগ-অভিমান? বাবার উপর? উনি তো অন্যায় কিছু করেননি। ঠিক করেছেন। বিয়ে না করলে বাকি জীবনটা একা থাকতে হত। তা হলে অভিমান কিসের? জীবন তৈরির টালমাটাল সময়ে তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল বলে? হয়তো তাই। যে সময়ে বাবা-মা ছেলেমেয়ের পাশে থাকে, সেই সময় পরিমল মুখোপাধ্যায় তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এক বারও তার কথা ভাবেননি। এ নিয়ে অভিমান তো তার ছিলই। কিন্তু অভিমানও একটা বয়স পর্যন্ত বহন করা যায়, তার পর ভুলে যেতে হয়। বিতান এ বাড়ি সম্পর্কে এখন নিস্পৃহ। ঊর্বীর মোবাইলের ছবিগুলো তাকে নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে শুধু।
মালবিকার গলা আজ নরম। বললেন, ‘‘তোমার বাবার অবস্থা তো দেখছ, একেবারে শুয়ে পড়েছে।’’
বিতান বলল, ‘‘শরীর কি আরও খারাপ হয়েছে?’’
মালবিকা বললেন, ‘‘সে আর নতুন কী? রোজই একটু একটু করে বেশি খারাপ হচ্ছে। আজকাল তো বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়েই থাকেন। তবে সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা অন্য। সে জন্যই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। আমি বুঝতে পারছি, তোমার বাবা আর আমাদের সঙ্গে থাকতে চাইছেন না। চোখের সামনে আমাদের দেখলে বিরক্ত হচ্ছেন।’’
বিতান অবাক হয়ে বলল, ‘‘মানে!’’
মালবিকার বয়স পঞ্চাশ হতে এখনও বছর চার দেরি আছে। আগে বলা হত মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি। সেই ধারণা বহু দিন খারিজ হয়ে গিয়েছে। এখন পঞ্চাশেও মহিলারা নিজেদের শরীর এবং মনে ফিটফাট থাকতে পারেন। মেয়েরা যত কাজের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, বয়সের ভার তত হালকা করতে পারছে। মালবিকাকে কিন্তু বেশ বুড়োটে লাগছে। চাকরি আর সংসারের ক্লান্তি চোখেমুখে।
মালবিকা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘‘মানে আমি কী করে বলব বিতান? তোমার বাবা বলতে পারবে। হয়তো বড় অসুখে তার বোধোদয় হয়েছে। এখন ওঁর মনে হচ্ছে, যা করেছিলেন সেটা ঠিক হয়নি।’’
বিতান চুপ করে রইল। এ রকম একটা কথা বলার জন্য মহিলা তাকে ডেকে পাঠাবেন, সে ভাবতে পারেনি। এর জবাবই বা সে কী দেবে?
মালবিকা বললেন, ‘‘আমার মেয়েকে গোড়া থেকেই উনি সহ্য করতে পারেন না। শুধু আমার জন্য মেনে নিয়েছিলেন। এখন দেখলেই তেড়ে উঠছেন। খারাপ কথা বলছেন। আমার মেয়ে কেন এ সব টলারেট করবে? আমারও কোনও কিছু এখন তাঁর পছন্দ হয় না। আমিও মেজাজ হারাচ্ছি। সারা দিন অফিস, ঘরের কাজ করতে হয়। আমি কেন ওঁর গালমন্দ শুনব? এমন তো নয় যে আমি তাঁর খাই-পরি, তাঁর বাড়িতে থাকি। এই ফ্ল্যাটটাও তো এখন ওঁর নয়। আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নাম ট্রান্সফার করেছি। সরকারি খাতায় এই ফ্ল্যাট এখন আমার নামে দেখানো আছে।’’
বিতান মহিলাকে মনে মনে তারিফ করল। খুব উদ্যোগী তো!
মালবিকা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘‘তোমার বাবা বোধহয় ভুলে গিয়েছিল আমি ঘা-খাওয়া মানু্ষ। আগের বার মেয়ের হাত ধরে পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। এ বার আমি গুছিয়ে নিয়েছি।’’ একটু থেমে দম নিয়ে ফের বলতে শুরু করলেন, ‘‘আমি তার সেবাও করব, আবার গালও শুনব, কেন? কথায় কথায় তিনি তোমার মায়ের সঙ্গে আমার তুলনা করছেন। তুমি কত ভাল ছেলে, আমার মেয়ে কত বজ্জাত তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। এত দিন পরে এটা বুঝতে পারলেন!’’
বিতান নিচু গলায় বলল, ‘‘আমাকে এ সব বলছেন কেন?’’
মালবিকা বিতানের মুখের দিকে এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘‘তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে যাও বিতান।’’
বিতান অবাক হয়ে বলল, ‘‘আমি নিয়ে যাব? কী বলছেন!’’
মালবিকা চোখ কুঁচকে বললেন, ‘‘ঠিকই বলছি। আমি অনেক দিন দেখলাম, এ বার তুমি দেখো।’’
বিতানের মনে হল, মহিলা তার সঙ্গে রসিকতা করছেন। সে জোর করে হাসার চেষ্টা করল। বলল, ‘‘আমি কে?’’
মালবিকা থমথমে গলায় বললেন, ‘‘তুমি ওর ছেলে। ছেলে নও? তোমার কোনও দায়িত্ব নেই?’’
বিতানের মনে হল এখনই উঠে দঁাড়ায়। দরজা খুলে ছুটে পালায়। সে বলল, ‘‘এত বছর পরে হঠাৎ ছেলের দায়িত্ব পালন করার প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে? উনি তো আমাকে বলে কখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেননি!’’
মালবিকা বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন, ‘‘এত দিন পরে কোথায়? তুমি তো অনেক দিন থেকেই দায়িত্ব পালন করছ। বাবা ডাকলেই ছুটে আসছ, আমাকে লুকিয়ে টাকা দিয়ে যাচ্ছ, বাকি কথা আমি ঠিক জানি না। নিশ্চয়ই আরও কিছু আছে।’’
বিতান চুপ করে রইল। বাকি কিছু না থাকলেও, মাঝে মাঝে আসা, টাকা দেওয়া, এগুলো সত্যি।
মালবিকা আবার স্বর বদল করলেন। নরম ভাবে বললেন, ‘‘দেখো বিতান, তুমি বড়, তোমাকে বলতে এখন কোনও অসুবিধে নেই। মানুষটাকে আমি ভালবেসেই বিয়ে করেছিলাম। এমন কোনও বড় পদে তিনি চাকরি করতেন না, এই দু’কামরার ফ্ল্যাটটাও আহামরি কিছু নয়। সেই সময়ে আমার একটা আশ্রয়ের দরকার ছিল ঠিকই, কিন্তু চাইলে ওঁর থেকে সফল কোনও পুরুষমানুষকেও... তোমার বাবাকে আমি সত্যিই ভালবেসেছিলাম। এখনও বাসি। বাসি বলেই জীবনের শেষ পর্যায়ে তাঁকে কষ্ট দিতে চাইছি না। আমার বিশ্বাস, তিনি এই বিয়ের জন্য এখন অনুশোচনা করেন। তাঁকে মুক্তি দেওয়া উচিত।’
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy