Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস  পর্ব ২২

নুড়ি পাথরের দিনগুলি

বিতানের ফাইল পড়ে কমলেশ রায় চিন্তিত হলেন। খামের মধ্যে শ্রীকণার ছবি দেখে পুরনো শ্রীকণাকে চিনতে তাঁর অসুবিধে হল না। বিভূতিকে ফোনে বললেন শ্রীকণার ফাইলটা বন্ধ করে দিতে।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

প্রচেত গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: বিতানের ফাইল পড়ে কমলেশ রায় চিন্তিত হলেন। খামের মধ্যে শ্রীকণার ছবি দেখে পুরনো শ্রীকণাকে চিনতে তাঁর অসুবিধে হল না। বিভূতিকে ফোনে বললেন শ্রীকণার ফাইলটা বন্ধ করে দিতে। বিতানের হাসিমুখ দেখে আহিরীর চিন্তা হল, সে আবার চাকরি ছেড়ে দেয়নি তো?

এই ঘটনাও ভাল লাগেনি আহিরীর। তার মনে হয়েছিল, বিতানের একটা না একটা অজুহাতে কাজ ছেড়ে দেওয়া আসলে এক ধরনের অস্থিরতা। তাও সে কিছু বলেনি। বিতান তো কোনও ছোট ছেলে নয়। তিন নম্বর চাকরিটা ভাল ছিল। কর্পোরেট অফিসে জুনিয়র ম্যানেজার। সে দিনের ঘটনা মনে আছে আহিরীর।

আজকের মতোই ঠিক সে দিনও এসে দাঁড়িয়েছিল আহিরী। সবে কলেজে পড়াতে শুরু করেছে তখন। কয়েক মাস হয়েছে মোটে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল ছ’টার সময়। ঠিক ছিল, বিতান অফিস থেকে বেরোলে দুজনে কলামন্দিরে একটা প্রোগ্রাম শুনতে যাবে। আহিরী যে গাইডের কাছে গবেষণা করেছে তাঁর বউয়ের গানের অনুষ্ঠান ছিল। মহিলার গান আগেও শুনতে হয়েছে আহিরীকে। অতি খারাপ। গলা চড়ার দিকে উঠলে খ্যানখেনে হয়ে যায়। তার পরেও যেতে হবে। নইলে ভাববে কাজ ফুরিয়েছে, গাইডকেও ভুলে গিয়েছে। আহিরী ঠিক করেছিল, একটু ক্ষণ থাকবে। বিতানকেও নিয়ে যাবে। আগে থেকে তাকে কিছু বলেনি। বিতান যদি রাজি না হয়, হল থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে দুজনে ঘুরে আসবে। কোথাও খেয়ে, বাড়ি ফিরবে।

আহিরী সে দিন আগেই বিতানের অফিসের কাছে চলে যায়। জ্যামে-ট্যামে পড়েনি। রাস্তা পেরিয়ে বিতান কাছে আসতে আহিরী জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কী হয়েছে, হাসছ কেন?’’

বিতান মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে বলল, ‘‘একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। তাই হাসছি।’’

আহিরী বলেছিল, ‘‘মজার ব্যাপারটা কী, জানতে পারি?’’

বিতান বলেছিল, ‘‘অবশ্যই পারো। তবে আগে আমি কি কিছু খেতে পারি? আজ অফিসে কিছু খাওয়া হয়নি। খুব খিদে পেয়েছে। চলো কোথাও ঢুকে খাই।’’

‘‘ঠিক আছে। তার পর কিন্তু আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যেতে হবে। রাগারাগি করবে না।’’

বিতান হেসে বলেছিল, ‘‘তোমার সঙ্গে আমি সব জায়গায় যেতে রাজি।’’

ছোট একটা রেস্তরাঁর সামনে গাড়ি দঁাড় করাল আহিরী। এখন কলকাতার অলিতে-গলিতে ভাল ভাল খাওয়ার জায়গা হয়েছে। একটা ভেজিটেবল চাউমিন নিয়ে দুজনে ভাগ করে নিল।

আহিরী বলল, ‘‘এ বার বলো মজার ব্যাপারটা কী?’’

আয়েশ করে খেতে খেতে বিতান সে ‌দিন বলেছিল, ‘‘মজার ব্যাপার অতি সামান্য। এই ‌চাকরিটাও নট হয়ে গেল।’’

আহিরী খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে বলল, ‘‘সে কী!‌ চাকরি চলে গেল!‌‌‌ কেন?’’

বিতান বলল, ‘‘তা তো বলতে পারব না! লাঞ্চের পর ইন-চার্জ ডেকে বলল, ‌কাল থেকে আর আসতে হবে না। বকেয়া যা আছে, তার সঙ্গে এক মাসের এক্সট্রা স্যালারি পেয়ে যাবেন। ক্যাশে চলে যান, এখনই দিয়ে দেবে। আজ আমি এক জন ধনী মানুষ আহিরী। পকেটে দেড় মাসের মাইনে। এই কারণে হাসছি। তোমার টাকা লাগলে বলো, ধার দিতে পারব। লাগবে?’’

আহিরী হতভম্ব হয়ে বলল, ‘‘ওরা বলল আসবেন না আর ‌তুমি কিছু বললে না?’’

বিতান খানিকটা চাউমিন মুখে নিয়ে চোখ আধখানা বুঁজে ফেলল, ‘‘বিউটিফুল!’’

আহিরী রেগে গিয়ে বলল, ‘‘কী বিউটিফুল? তোমার চাকরি যাওয়াটা বিউটিফুল!‌’’

বিতান হেসে বলেছিল, ‘‘এদের খাবারটা বিউটিফুল।’’

আহিরী থমথমে গলায় বলল, ‘‘যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। তুমি কিছু বললে না?’’

বিতান খাওয়া থামিয়ে আহিরীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘‘কী বলব? এর আগের কাজগুলোও তো গিয়েছিল। তখন টাকাপয়সা কিছু পাইনি। এ বার তো তা নয়। কিছু টাকা অন্তত পেয়েছি। বেটার সিচুয়েশন। সবটা মার যায়নি।’’

‘‘এ বার তো তুমি ছাড়োনি, তা হলে কাজটা গেল কেন?’’

বিতান বলল, ‘‘কেন গেল জিজ্ঞেস করে লাভ কী? আজকাল তো সব কনট্র্যাক্ট সা‌র্ভিস। আমারটা তো মোটে ছ’মাসের ছিল। এখন বিনা নোটিসে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার নিয়ম আছে। কারণ লাগে না। শুনলাম আজ আরও দশ জনকে নোটিস দিয়েছে। পরে আরও দেবে। কোম্পানি ওভারহেড কমাচ্ছে। এ কী, তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছ কেন? খাও।’’

আহিরী নিচু গলায় বলেছিল, ‘‘কাজ চলে গেছে আর তুমি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে?’’

বিতান বলল, ‘‘কী করব? ডাক ছেড়ে কাঁদব?’’

‌আহিরী চুপ করে রইল। বিতান একটা হাত বাড়িয়ে আহিরীর হাতের উপর রাখল।

‘‘চিন্তা কোরো না। ঠিক আবার একটা কিছু হয়ে যাবে। উনিশ বছর বয়স থেকেই কিছু না কিছু করছি, সাতাশ হতে চলল। এত দিন পারলাম যখন, আবার পারব।’’

আহিরী নিচু গলায় বলল, ‘‘এই ভাবে কত দিন চলবে? সবই তো নড়বড়ে কাজ। আজ আছে কাল নেই। এ বার একটা ঠিকঠাক চাকরির খোঁজ করো।’’

বিতান হাসিমুখেই বলল, ‘‘আমি তো তোমার মতো লেখাপড়া জানি না আহিরী। তোমার মতো কলেজের মাস্টারনি হওয়ার পরীক্ষাও দিতে পারব না। আমি এক জন অর্ডিনারি ছেলে। আমি যে ধরনের চাকরির পরীক্ষাগুলো দিই তাতে শুধু পরীক্ষায় পাশ করলে হয় না, আরও কিছু লাগে। চেনাজানা লাগে, টাকা লাগে, তোষামোদি লাগে। ও সব আমার নেই। আমাকে এ ভাবেই চলতে হবে। সুতরাং বেশি ভেবে লাভ কী?’’

‘‘তোষামোদি ছাড়া কারও চাকরি হয় না?’’

বিতান গ্লাসের জলে চুমুক দিল, ‘‘হবে না কেন? অবশ্যই হয়‌। আমার মতো অ্যাভারেজে ছেলের হয় না। এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো আমি স্মার্ট নই। কাজ চলে যাওয়ার পিছনে আমার নিজের অযোগ্যতাও নিশ্চয়ই আছে। এটাও এক ধরনের শহুরে জীবনের ক্রাইসিস। হয় কমপিটিশনে টিকে থাকো, নয় কেটে পড়ো।’’

আহিরীর মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। লেখাপড়ায় বিরাট ডিগ্রি নেই, ফড়ফড় করে দুটো ইংরেজি বলতে পারে না তো কী হয়েছে? মানুষ হিসেবে বিতান তো ভাল। সে এক জন সৎ মানুষ। তার কোনও দাম নেই? তবে বিতান যখন নিজের সমস্যা নিয়ে রসিকতা করে, তখন তার রাগ হয়। সে অবশ্য বলে, ‘‘আহিরী, এটা রসিকতা নয়, রসবোধ। রসবোধ হল পদ্মপাতার মতো। দুঃখ কষ্ট সব পিছলে যায়।’

আহিরী কড়া গলায় বলে, ‘‘স্যরি, এত রসবোধ আমার নেই, দরকারও নেই। আমার সহ্যও হয় না। আমি কাঠখোট্টা ‌বাস্তবের মানুষ।’’

বিতান কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে কপালে‌ হাত ঠেকিয়ে বলে, ‘‘জো আজ্ঞা জঁাহাপনা। আপনি যা বলবেন। এ বার থেকে আমি রামগরুড়ের ছানা হয়ে যাব। তার মতো মুখ করে থাকব। নো হাসি, নো মসকরা। চিন্তা একটাই, দাড়িওলা রামগরুড় কি হয়? আমি কি দাড়ি কেটে ফেলব?’’

আহিরী সে দিন নিজেকে সামলাতে পারেনি। বিতানের হাতে জোর চিমটি কাটে। ‘‘আহ্‌!’’ বলে ওঠে বিতান। আহিরী চাপা গলায় বলে, ‘‘আবার ঠাট্টা করলে আরও জোর চিমটি কাটব।’’

সে দিন মন এতটাই খারাপ হয়েছিল যে গান শুনতে আর যেতে পারেনি আহিরী। বিতানের সঙ্গে খানিকটা এলোমেলো ঘুরে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।‌

আজও‌ একটা ইন্টারভিউ ছিল বিতানের। ওয়াক-ইন ইন্টারভিউ। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়েছিল। হায়দরাবাদের কোম্পানি, কলকাতায় নতুন অফিস খুলছে। বিজ্ঞাপনে বলেছিল, ইন্টারভিউ হল-এই জানিয়ে দেওয়া হবে। বিতানের হাসিমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে তার হয়নি। এই ইন্টারভিউয়ের জন্যই বিতানকে ভাল করে প্রিপারেশন নিতে বলছিল সে। সে দিন কলেজ থেকে ফোনে খানিকটা কড়া কথাও বলে ফেলেছিল। সেই কারণেই আরও আসা।

বিতান বলল, ‘‘কখন এলে?’’

‘‘কিছু ক্ষণ। বলেছিলাম তো আসব। খানিক আগে মেসেজ দিয়েছি, দেখোনি?’’

সিগারেটের প্যাকেট বের করল বিতান। প্যাকেট খুলে দেখল, ফঁাকা।

‘‘না, মোবাইলের মেসেজ সব সময় দেখি না।’’

‘‘আমারটাও দেখো না?’’

বিতান হেসে বলল, ‘‘ও দিকে অনেক সময়েই তাকাই না। যাক, আহিরী, টাকা ধার দাও দেখি। সিগারটে কিনব।’’

আহিরী ব্যাগ খুলে টাকা বের করে দিল।

‘‘এত লাগবে না।’’

আহিরী নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছে, ‘‘ধার তো। বেশি করেই নাও। কম ধার নিলে ভুলে যাবে।’’

এগিয়ে গিয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনে ধরাল বিতান। আহিরীর কাছে এসে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘‘চলো।’’

আহিরী বলল, ‘‘আগে সিগারেট শেষ করো। জানো তো গাড়িতে স্মোকিং নট অ্যালাওড।’’

বিতান উদাস মুখ করে বলল, ‘‘এই জন্য গাড়ি কিনি না। দঁাড়াও, সিগারেটটা আয়েশ করে শেষ করি। ধারের পয়সায় কেনা জিনিস হুটোপাটি করে খাওয়া যাবে না।’’

আহিরী মুখ ফেরাল। রাস্তায় রাস্তায় আলো জ্বলে উঠেছে। অফিস ছুটি হয়েছে। সল্টলেক সেক্টর ফাইভে কমবয়সি ছেলেমেয়েদের ভিড়। বুকে আই কার্ড ঝুলিয়ে আকাশছোঁয়া অফিসবাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে আসছে। বাস, ক্যাব ধরছে। নিজেদের বাইক, গাড়ি, পুল কারও রয়েছে। নাইট শিফট শুরু হবে এ বার। তার ভিড়ও বাড়ছে। কলকাতার পুরনো বিবাদীবাগের অফিসপাড়ার থেকে এই অফিসপাড়ার একেবারে আকাশ পাতাল তফাত। একটা ঝলমলে ব্যাপার আছে। বয়স কম বলে ছেলেমেয়েরা অনেক ক্ষণ কাজ করেও কেউ ধুঁকছে না, মুখও গোমড়া নয়। বরং রাস্তাতেই গোল হয়ে দঁাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে তারা। হাসছে, ঝগড়া করছে। কেউ কেউ খেতে যাওয়ার প্ল্যান করছে। কোনও কোনও দলের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, অফিস নয়, ইউনিভার্সিটি ছুটি হয়েছে। আহিরীর ইচ্ছে করল, গিয়ে ওদের আড্ডায় ঢুকে পড়ে।

বিতান সিগারেট শেষ করলে আহিরী বলল, ‘‘কোথায় যাবে?’’

বিতান হালকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘‘স্বর্গের দিকটায় গেলে কেমন হয়? একটু পরেই চঁাদ উঠবে। স্বর্গের কিনারায় দঁাড়িয়ে বাদাম খেতে খেতে তুমি আর আমি জ্যোৎস্না দেখব।’’

আহিরী মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‌এত গোলমালের মধ্যেও এই ছেলের রসিকতা বন্ধ হয় না। চাকরির কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছে। এমনও হতে পারে, হালকা ভাব দেখিয়ে আহিরীর কাছ থেকে সে সমস্যা আড়াল করে রাখতে চায়। ভান করছে, সব ঠিক আছে। সব যে ঠিক নেই, আহিরী ভাল করেই জানে। সমস্যা ঘন হয়ে আসছে। বিতান যদি এ বারও কোনও কিছু করে উঠতে না পারে, তার পক্ষে খুব মুশকিল হবে। বাড়ি কী ভাবে সামলাবে? বাইরেই বা কী বলবে? কারও দিকে না তাকিয়ে, কারও আপত্তি না শুনেও সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু বিতান কি তার জন্য তৈরি? এই সিদ্ধান্ত একা নেওয়া যায় না।‌

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy