ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: ঊর্বী তার মোবাইলে বিতানকে দুটো ছবি দেখাল। দুটো ছবিতেই আহিরী আর বিতান একসঙ্গে। দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল বিতান। মালবিকা বিতানকে বললেন, বিতানের বাবা মালবিকা ও ঊর্বীকে সহ্য করতে পারছেন না, খারাপ ব্যবহার করছেন। বিতান তার বাবাকে তার কাছে নিয়ে যাক, ছেলে হিসেবে দায়িত্ব নিক।
বিতান অস্ফুটে বলল, ‘‘উনি আমার কাছে গেলে শান্তি পাবেন এমন আপনি ভাবছেন কেন?’’ মালবিকা হাসলেন, ‘‘তুমিও জানো পাবেন।’’
বিতান বলল, ‘‘এ সব আপনি জোর করে বলছেন। বাবা-ই বা আমার সঙ্গে থাকতে কেন রাজি হবেন?’’
মালবিকা বললেন, ‘‘সে তুমি ওঁর সঙ্গে কথা বললেই জানতে পারবে। আমাকে বারবার বলছেন। কিছু হলেই বলেন, ছেলের কাছে গিয়ে থাকব। আমি ওঁর মন বুঝেই বলছি। দেখো বিতান, তোমার টাকাপয়সার সমস্যা হবে না। তোমার বাবার পেনশনের টাকাপয়সায় আমার কোনও দাবি থাকবে না। ওই টাকায় ওঁর খরচ চলে যাবে। কিছু টাকা বেঁচেও যেতে পারে।’’
বিতান প্রায় আর্তনাদ করে বলল, ‘‘এ সব আপনি কী বলছেন? বাবাকে আমি কোথায় রাখব? আমার নিজেরই তো থাকার ঠিক নেই।’’
মালবিকা চোখ সরু করে বললেন, ‘‘গড়িয়ায় যে দারুণ ফ্ল্যাটে তুমি থাকো, সেখানে রাখবে! বাবাকে তো তুমিই ফ্ল্যাটের কথা বলেছ। বলোনি?’’
বিতান বলল, ‘‘ওই ফ্ল্যাট তো আমার নয়, আমার বন্ধুর। ও আমাকে থাকতে দিয়েছে।’’
মালবিকা বললেন, ‘‘তোমাকে যখন দিয়েছে, তোমার বাবাকেও নিশ্চয়ই দেবে। যে দিন দেবে না, সে দিন কোনও অল্টারনেটিভ ব্যবস্থা করে নেওয়ার মতো বয়স তোমার হয়েছে।’’
কথা শেষ করে উঠে পড়লেন মালবিকা। বিতানও উঠে দাঁড়াল। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি বাবা তার কাছে চলে যেতে চায়?
মালবিকা বললেন, ‘‘আর কথা বাড়াব না। তোমার বাবা এ বার ঘুম থেকে উঠবেন। আজ শনিবার, অফিস ছুটি বলেই তোমাকে আসতে বলেছিলাম। দেখো বিতান, তুমি আমার কথা না-ও শুনতে পারো। কিন্তু মনে রেখো, আমি ওঁকে আর এখানে রাখব না। দোষটা আমার নয়, দোষটা ওঁর। উনি আমাকে এক সময় সহ্য করতে পারতেন, এখন আর পারছেন না। কেন পারছেন না? তুমি সন্তান, বলা উচিত নয়, তাই বলছি না। আমি অন্য কোনও ব্যবস্থা নেব। দ্যাট উইল বি হার্ড। অনেক দূরে, অসুস্থ অক্ষমদের কোনও আশ্রমে রেখে আসব ওঁকে। হাজার বললেও সে জায়গার ঠিকানা তুমি পাবে না। সময় নাও, সময় নিয়ে ভাবো। এক দিন আমি না থাকলে এসে ওঁর সঙ্গে কথা বলো। একটা ইনফর্মেশন দিই। মেবি সেন্টিমেন্টাল অ্যান্ড ফুলিশ, তাও তোমার জানা দরকার। তোমার বাবার মাথার বালিশের নীচ থেকে আই গট ইওর মাদার্স ফোটোগ্রাফ। বিয়ের ছবি। এটা আমার জন্য যথেষ্ট অপমানের নয় কি? আমি ওঁর রোগশয্যার পাশে বসে থাকব, আর উনি অন্য এক জনের ফোটো মাথায় করে রাখবেন, এটা কি মানা উচিত? তোমার মা পারতেন? যাক, এ বার তুমি ভেবে দেখো। আমাকে জানিয়ো।’’
আবাসন থেকে বেরিয়ে বিতান দেখল, আকাশে মেঘ জমেছে। ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে অল্প অল্প। এখন বৃষ্টির সময় নয়, তার পরেও বৃষ্টি আসছে। দুম করে বৃষ্টি পড়লে কলকাতার চেহারাটা নিমেষে বদলে যায়। মজার হয়ে যায়। প্রথম দফায় এক চোট হুড়োহুড়ি লাগে। বৃষ্টি থেকে বঁাচতে পথের মানুষ ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। কলকাতা শহরে এখন মাথা বাঁচানোর অনেক জায়গা। শহরে এ দিক ও দিক কত ফ্লাইওভার। নীচে দঁাড়িয়ে পড়লেই হল। কোথাও কোথাও সাজানো-গোছানো বাস স্টপও হয়েছে। বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে সেখানে দিব্যি থাকা যায়। দু’পা অন্তর ছোটবড় শপিং মল। ঢুকে পড়লে নিশ্চিন্ত। তবে বিতানের এতটা নিশ্চিন্তি পছন্দ হয় না। মাথার ওপর ঝমঝম বৃষ্টি, জমা জল, ট্রাফিক জ্যাম তার ভাল লাগে। প্রকৃতি কিছু ক্ষণের জন্য যাবতীয় শহুরে আদবকায়দা, নিয়মশৃঙ্খলা, অনেক ভেবে তৈরি করা রুটিনকে এলোমেলো করে দেয়।
অন্য দিন হলে এ রকম আচমকা মেঘ দেখে খুশি হত বিতান। আজ ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে এখানে না এলেই হত। মালবিকা নামের মহিলাটির চাপের সামনে পড়তে হত না। ঊর্বীর মোবাইল ফোনে ছবি দেখতে হত না। শুধু এরা দু’জনই বা কেন? আড়ালে থেকে পরিমল মুখোপাধ্যায় কি কম চাপ দিচ্ছে? পালিয়ে কি থাকা যেত? আজ না হোক কাল ওই মহিলা ঠিক যোগাযোগ করত।
বিতান কাঁকুড়গাছির মোড়ে পৌঁছে একটা সিগারেট কিনে ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে মুখ তুলল। মেঘের আকাশ আরও কালো হয়ে এসেছে। উল্টোডাঙার দিক থেকে টংটং করতে একটা অলস উদাসীন ট্রাম মেঘের ছায়ায় ভাসতে ভাসতে আসছে। ছুটন্ত ঝলমলে শহরের বুকে তাকে লাগছে বেমানান। মনে হচ্ছে, ‘অনেক হয়েছে, আর চলব না’ বলে যে কোনও সময় থমকে দাঁড়াবে।
বিতান ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগল। মানুষ যথারীতি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির আগেই যদি কোথাও পৌঁছে যাওয়া যায়। বিতানের কোনও তাড়া নেই। না কাজে যাওয়ার, না বাড়ি ফেরার। এই মুহূর্তে সে সেক্টর ফাইভে ছোটখাটো একটা কাজ করছে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অফিসে দুপুর তিনটের পর বসতে হয়। পার্ট-টাইম কাজ। সকালবেলাটা একটি মেয়ে সামলায়। আগে পুরোটাই থাকত, রাত আটটা পর্যন্ত। বিয়ের পর সে আর অতটা দেরি করতে পারে না। তাই বিতানকে নেওয়া হয়েছে। বিতানের বেরোতে বেরোতে অনেক সময় রাত দশটাও হয়ে যায়। সম্ভাব্য কাস্টমার কেউ এলে বা ফোন করলে, প্রজেক্ট কত ভাল তা বোঝাতে হয়। শনি–রবিবার করে সাইট ভিজিট করাতে হয়। কলকাতার চারপাশে এখন অজস্র বাড়ি হচ্ছে। শহর ঠেলেঠুলে, জোর করে বড় হতে চাইছে। সকলেই চাইছে, যেখানেই থাকি শহরের সব সুবিধে যেন মেলে। কেউ আর বাড়ির ইট, বালি, চুনের কোয়ালিটি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না। ভাবটা এমন, ঘর তাসের হলেও আপত্তি নেই। প্রোজেক্ট থেকে বাইপাস, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স যেন দূরে না হয়। যতই ডেস্কে ‘ডিসট্যান্স লিস্ট’ সাঁটা থাকুক, দূরত্বের সব প্রশ্নে সন্তুষ্ট করার মতো উত্তর সব সময় দেওয়া যায় না। তখন সুইমিং পুল, জিম, ফ্রি পার্কিং-এর কথা তুলে কথা ঘোরাতে হয়। সকালে যে মেয়েটি বসে সে এই বিষয়ে দক্ষ। দুটো কথার ফঁাকে ফঁাকে সে নানা কথা বানাতে পারে।
‘‘ম্যাডাম, আপনি বেডরুম থেকে পাখির ডাক শুনতে পাবেন। ইন ফ্যাক্ট আমরা কিছু ফ্ল্যাট রাখছি যেখানে সকালে আপনার পাখির ডাকে ঘুম ভাঙবে। প্রাইসটা অবশ্য একটু বেশির দিকে। বুঝতেই তো পারছেন ম্যাডাম, শহরের সব ফেসিলিটির মধ্যে পাখির ডাক অ্যারেঞ্জ করা তো কস্টলি ব্যাপার।’’
বিতান এ সব পারে না। তার ভালও লাগে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাজটা ছেড়ে দেবে। কাজ ছাড়ায় সে অভ্যস্ত। অনেক বার প্রতিজ্ঞা করেছে, হুট করে কাজ ছাড়বে না। কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না। আসলে চাকরি ভাল না মন্দ বড় কথা নয়, বাঁধাধরা কাজে মন বসে না তার। মনে হয়, কেরিয়ার তৈরি তার কম্ম নয়। সরকারি বেসরকারি কোনও চাকরির পরীক্ষা বা ইন্টারভিউই সে খুব জোরের সঙ্গে দিতে পারে না। অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন মারাত্মক ভাল কিছু নয় যে পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে কিছু এসে-যাবে না। তাকে বেশি পরিশ্রম করেই পরীক্ষায় বসতে হবে। সে জীবনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। কী হবে কেরিয়ার করে? পরিশ্রম থেকে সরে যায় বিতান। এই মনোভাবের জন্য মাঝে মাঝেই টাকাপয়সার সমস্যা হয়। ভাগ্যিস বাড়িটা পেয়েছিল, নইলে বিপদ হত। এই বিষয়টা নিয়ে আহিরী প্রায়ই তাকে বোঝায়। রাগ করে। ক’দিন আগেও বলেছে।
‘‘ভাল লাগে না বললে চলবে? কাজ তো করতে হবে। নইলে খাবে কী?’’
বিতান হেসে বলে, ‘‘আমার খাওয়ার বেশি খরচ নেই, ও ঠিক জুটে যাবে।’’
আহিরী বিরক্ত হয়ে বলে, ‘‘এ কেমন কথা! জুটে যাবে আবার কী? চিরকাল বন্ধুর বাড়িতে থাকবে?’’
বিতান বলল, ‘‘ছোটখাটো একটা কিছু করলেই চলবে। খুব বড় কোনও কাজ করার মধ্যে আমি নেই। বসেদের চোখরাঙানিই বলো, কাজের টার্গেটই বলো আর দশটা–পঁাচটা চেয়ার টেবিলে বন্দি থাকাই বলো, আমার ভাল লাগে না। আমার কেরিয়ার ব্যাপারটাতেই কোনও ইন্টারেস্ট নেই। মনে হয়, কেরিয়ারের পিছনে ছুটলে জীবনকে প্রপারলি উপভোগ করা যায় না।’’
আহিরী ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘‘এ সব অলস অকর্মণ্য লোকের কথা। তোমার কথা সত্যি হলে বেকার, হাত গুটিয়ে বসে থাকা লোকেরাই জীবনকে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করত। হুইচ ইজ নট কারেক্ট। কেরিয়ার মানে শুধু উপার্জন করা নয়, লেখাপড়া করে যা শিখেছি তাকে কাজে লাগানো।’’
বিতান বলল, ‘‘ঠিকই বলছ, কিন্তু আমার ভাল লাগে না। আমি তো তেমন লেখাপড়া শিখিওনি। ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ হয়নি। কলেজের সময় থেকেই নিজের ব্যবস্থা নিজেকে করতে হয়েছে।’’
‘‘ভাল না লাগলেও তো মানুষকে অনেক কিছু করতে হয় বিতান।’’
বিতান হেসে বলল, ‘‘সে তো নানা রকম রেস্পনসিবিলিটি থাকে। বাবা–মা, স্ত্রী–পুত্র, ফ্যামিলি। আমার সে ঝামেলা নেই। যাকে বলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে থাকা একটা জীবনের অধিকার পেয়েছি।’’
আহিরী নিচু গলায় বলেছিল, ‘‘আজ নেই, কাল যে হবে না তা ভাবছ কেন?’’
বিতান বলে, ‘‘আমি কিছুই ভাবছি না।’’
আহিরী রাতে ফোন করে থমথমে গলায় বলেছিল, ‘‘বিতান, তুমি কি সত্যি কিছু ভাবছ না?’’
বিতান হেসে বিষয়টা সহজ করার চেষ্টা করে। ‘‘তুমি এত সিরিয়াসলি নিলে আহিরী!’’
আহিরী থমথমে গলায় বলে, ‘‘কিছু কিছু জিনিস সিরিয়াসলি নিতে হয়।’’
বিতান বলে, ‘‘আমি তো রসিকতাই করি।’’
আহিরী আরও থমথমে গলায় বলে, ‘‘নিজের জীবন নিয়ে রসিকতা করা যায়, কিন্তু যেখানে অন্যের জীবন জড়িয়ে, সেখানে রসিকতা চলে না।’’
বিতান থতমত খেয়ে বলে, ‘‘আহিরী, তুমি কী বলতে চাইছ ঠিক বুঝতে পারছি না।’’
আহিরী একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘‘থাক। আমার থেকে শুনতে হবে না। যে দিন নিজে বুঝতে পারবে সে দিনের জন্য অপেক্ষা করা ভাল।’’
দু’দিন আগে, ঘেরাওয়ের সময়, কলেজ থেকে ফোন করেও আহিরী একটা ‘ভদ্রস্থ’ চাকরি পাওয়ার কথা বলেছে। সে কি আসলে তার সঙ্গে একটা ‘ভদ্রস্থ’ জীবন কাটানোর কথা ভাবছে? ঊর্বীর মোবাইলের তোলা ছবিটা সেই জন্যই অস্বস্তিতে ফেলেছে। লজ্জাতেও। কলেজের গেটে মেধাবী, সুন্দরী অধ্যাপিকার ফোটো থাকবে কোনও ‘ভদ্রস্থ’ যুবকের সঙ্গে। বিতানের সঙ্গে কেন?
পকেটে রাখা মোবাইলে মেসেজ ঢোকার আওয়াজ হল। বিতান মোবাইল বের করে দেখল, ঊর্বী তাকে মেসেজ করেছে! এই প্রথম। ফুটপাতের মাঝখানেই থমকে দঁাড়িয়ে মেসেজ পড়ল বিতান। ‘স্যরি। আমি সব ফোটো ডিলিট করে দিলাম।’
পকেটে মোবাইল ঢোকাতে না ঢোকাতে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল।
১০
সবুজ ময়দানের পাশে একটা ধবধবে সাদা রঙের বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
বিকেলবেলা কলকাতা ময়দানের গা ঘেঁযে এ রকম গাড়ি সব সময়েই দু–একটা চোখে পড়ে। ময়দানের হাওয়া খেতে আসে। কেউ গাড়ি থেকে নেমে ঘাসে খানিকটা হেঁটে নেয়, কেউ গাড়িতে বসেই বাদাম চিবোয়। কখনও দুজন নারীপুরুষ চুমু খায়। কিন্তু এই গাড়ি ‘হাওয়া খেতে’ আসেনি। দঁাড়িয়ে থাকলেও গাড়ির ইঞ্জিনটা চালু। কাচ তোলা। ভিতরে এসি চলছে নিঃশব্দে।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy