Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৬

নুড়ি পাথরের দিনগুলি

পূর্বানুবৃত্তি: সেমিনার থেকে ফেরার সময় আহিরীর গাড়ির টায়ার ফেটে যায়। রাস্তার পাশে ঝুপড়ি চায়ের দোকানে সাহায্য চাইতে গেলে দোকানি খারাপ ব্যবহার করেছিল খুব। ক্যামেরার ব্যাগ-কাঁধে একটি ছেলে তাকে সে দিন সাহায্য করেছিল, চাকা মেরামত করে এনে দিয়েছিল। সে-ই বিতান। আহিরী ফেরার লিফ্‌ট দিতে চাইলেও সে নেয়নি।রাস্তার পাশে ঝুপড়ি চায়ের দোকানে সাহায্য চাইতে গেলে দোকানি খারাপ ব্যবহার করেছিল খুব। ক্যামেরার ব্যাগ-কাঁধে একটি ছেলে তাকে সে দিন সাহায্য করেছিল, চাকা মেরামত করে এনে দিয়েছিল।

প্রচেত গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৩৭
Share: Save:

দু’মাস পরে বিতান তাকে সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে চারটি তথ্য দেয়। এক, সেই চায়ের দোকানের দোকানদারটির মাথায় সমস্যা আছে। সে নাকি প্রায়ই ঝামেলা করে এবং মার-টারও খায়। রাস্তায় কেতরে থাকা গাড়ি নিয়ে ঝামেলা করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে আঁচ করে সে দিন আহিরীকে দোকান থেকে বের করে নিয়েছিল বিতান। নইলে এর মধ্যে সে ঢুকত না। তার মনে হয়েছিল, খানিক ক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি আরও রেগে যাবে এবং লোকটাকে একটা চড় মারবে। দ্বিতীয় তথ্যটি হল, সে দিন স্থানীয় মোটরবাইক চালককে সে জানিয়েছিল, ওই ম্যাডামের সঙ্গে পুলিশের চেনাজানা রয়েছে। খানিক আগেই সে পুলিশ ডাকার কথাও বলেছে, তাই ওর কাজটা করে দেওয়াই বুদ্ধিমানের হবে। তিন নম্বর তথ্য, পছন্দের মানুষ ছাড়া সত্যিই বিতানের কথা বলতে ভাল লাগে না। সুন্দরী হলেও না। সে দিন আহিরীকে সে যতটা দেখেছিল তার মধ্যে পছন্দ হওয়ার মতো অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু সেই পছন্দ গাড়িতে উঠে গল্প করতে করতে দীর্ঘ পথ যাওয়ার মতো নয়। চার নম্বর তথ্যটি বলবার আগে একটু থমকেছিল বিতান।

‘‘আমি খুঁজে খুঁজে তোমার কলেজে কেন গিয়েছিলাম জানো?’’

আহিরী মোবাইল কানে চেপে ধরে বলেছিল, ‘‘আর যাই হোক, আমার টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য যে নয় সেটা বলতে পারি।’’

বিতান বলল, ‘‘দেশলাইয়ের আলোয় অতক্ষণ দেখার পর মনে হয়েছিল, এক বার ফটফটে দিনের আলোয় তোমাকে দেখা দরকার। কারণ তার পর যখনই তোমার মুখটা মনে পড়ছিল, সেই মুখের এক পাশ ছিল অন্ধকার।’’

আহিরী মোবাইল ফোন কানে আরও জোরে চেপে বিছানায় উপুড় হয়ে বলেছিল, ‘‘দিনের আলোয় ‌কী দেখলে?’’

‘‘বলব না।’’

এই ছিল আলাপের প্রথম ভাগ। কম কথা বলা যে যুবকটিকে আহিরী তখন চিনেছিল, সে এখন তার সঙ্গে বকবক করতে খুবই পছন্দ করে। আহিরীও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিতান চুপ করে গেলে তার চিন্তা হয়। তার থেকেও বড় কথা, এই ছেলে জীবনকে নিয়ে যে এ রকম রসিকতা করতে পারে, সে দিন গম্ভীর মুখ দেখে একেবারেই বুঝতে পারেনি আহিরী।

রাত বারোটার অল্প আগে ছেলেমেয়েরা ঘেরাও তুলে নিল।

বিতানকে ডোরবেল টিপতে হল দু’বার। তার পরেও কিছু ক্ষণ দঁাড়াতে হল। কেউ দরজা খুলছে না। আবার বেল-এ হাত রাখল বিতান। ফ্ল্যাটে কি কেউ নেই?

তৃতীয় বার বেল বাজানোর আগেই এক তরুণী দরজা খুলল। চেহারা কিঞ্চিৎ ভারীর দিকে। শর্ট প্যান্টের ওপর কালো রঙের একটা স্লিভলেস জামা পরেছে। তার ফর্সা শরীর অনেকটাই উন্মুক্ত। টলটলে মুখে বিরক্তি। মেয়েটির হাতে বই। পড়তে পড়তে তাকে উঠে আসতে হয়েছে।

এই তরুণীর নাম ঊর্বী। বিতানকে দেখে সে মুখের বিরক্তি মুছে এক গাল হাসল।

‘‘ও আপনি? পড়ছিলাম বলে বেল-এর আওয়াজ শুনতে পাইনি। সরি। আসুন, ভিতরে আসুন।’’

দরজা ছেড়ে সরে দঁাড়াল ঊর্বী। বিতান ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘‘না না, ঠিক আছে।’’

বিতানের প্রতি উর্বীর আচরণ অদ্ভুত। কোনও দিন মুখ ঘুরিয়ে নেয়, কোনও দিন এমন ভাবে উচ্ছ্বাস দেখায় যে মনে হয়, বিতানকে সে খুবই পছন্দ করে। যে দিন পছন্দের ‘ফেজ’ চলে, হড়বড় করে অনেকটা কথা বলে ফেলে। এই ছোট ফ্ল্যাটে এক চিলতে একটা বসবার জায়গা রয়েছে। ড্রয়িংরুমের মতো। বেতের সোফা, বইয়ের র‌্যাক, লম্বা ফুলদানি। তবে সাজানো-গোছানো কিছু নয়। দেখে মনে হয়, অনেক দিন থেকে আছে, তাই নড়াচড়া কিছু করা হয়নি। বিতান এলে এখানে বসে। যে দিন তার মুড ভাল থাকে, ঊর্বীও বসে পড়ে। আবার কখনও সে নিজের ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। যাবার আগে তেতো গলায় বলে যায়, ‘‘আপনার বাবা এখন বাথরুমে ঢুকেছেন, অপেক্ষা করতে হবে। আজকাল বাথরুমে ওঁর মিনিমাম দু’ঘণ্টা সময় লাগে। বেশিও লাগতে পারে।’’

বিতান হলে, ‘‘তা হলে বরং পরে আসি।’’

ঊর্বী কাঁধ ঝাকিয়ে বলে, ‘‘সে ‌আপনি বুঝবেন। ইচ্ছে করলে বাথরুমের বাইরে টুল নিয়ে বসে কথা চালাতে পারেন। আর তা না চাইলে দরজা টেনে দিয়ে চলে যেতে পারেন।’’

ঊর্বীর মায়ের নাম মালবিকা। মহিলা বাড়ি থাকলে ঊর্বী বিতানের সঙ্গে কথা বলে না। ওই মহিলা বাড়িতে থাকলে বিতান আসেও না। যে কয়েক বার এসেছে, মালবিকা হয় সামনেই আসেননি, নয়তো ‘‘চা খাবে? খাবে না? আচ্ছা বোসো, তোমার বাবা আসছে।’’ বলে‌ নিজের কাজে বেরিয়ে গিয়েছেন। উনি বিতানকে যে পছন্দ করেন না, সেটা হাবেভাবে স্পষ্ট করে রেখেছেন। সরাসরি কিছু বলেন না এই যা। এর মধ্যে বিতান কোনও অস্বাভাবিকতা দেখতে পায় না। স্বামীর প্রথম পক্ষের সন্তানকে পছন্দ করবার কোনও দায় এই মহিলার নেই।

মায়ের আড়ালে ঊর্বী মিটিমিটি হেসে বলে, ‘‘মা আপনাকে কেন পছন্দ করে না বলতে পারবেন?’’

প্রশ্ন অস্বস্তিকর, উত্তর দেওয়া আরও অস্বস্তিকর। ঊর্বীর মতো তরল মনের মেয়ের পক্ষেই এই ধরনের প্রশ্ন করা সম্ভব। আর কেউ পারত না।

বিতান বলে, ‘‘ঠিক জানি না। মনে হয় পছন্দ করার কোনও কারণ নেই।’’

ঊর্বী বলল, ‘‘আসলে আপনাকে দেখলে মা’র মনে পড়ে যায়, তার স্বামীর অনেক বয়স। আপনি যদি ছোট ছেলে হতেন, মা’র এতটা সমস্যা হত না। আপনার ওপর ছড়িও ঘোরাতে পারত। আমার মা ছড়ি ঘোরাতে পছন্দ করে। কিন্তু আমার ওপর পারে না। আপনার বাবার ওপর ঘোরায়।’’ কথা শেষ করে ঊর্বী হিহি আওয়াজ করে হাসে।‌ ‌

বিতান জানে, এই যুক্তি ভুল। ঊর্বীর মা বিয়ের সময়েই জানতেন, তিনি যাঁকে বিয়ে করতে চলেছেন, তাঁর একটি ছেলে আছে এবং সে বয়সে যথেষ্ট বড়।

ঊর্বী হাই তুলে বলে, ‘‘তবে আমিও ঠিক করেছি আমার থেকে বয়সে অনেকটা বড় কাউকে বিয়ে করব। বয়সে বড় হলে বরেরা কেয়ারিং হয়। বউদের বেশি ভালবাসে। বউয়ের কথা শোনে।’’

বিতান চুপ করে থাকে। সামাজিকতার নিয়ম অনুযায়ী এই ফাজিল চরিত্রের মেয়েটি তার বোন। কিন্তু কখনও সে ‘দাদা’ ডাকে না, ‘আপনি’ সম্বোধন‌ থেকেও সরে না। বিতান মেয়েটির এই আচরণ পছন্দ করে। কোনও ভনিতা নেই। এত কম বয়সেও তার মতামত স্পষ্ট।

ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যুর পর বিতান কলকাতার বাইরে হস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছে। কলেজে পড়ার সময় সে আবার কলকাতায় ফেরে। এই ফ্ল্যাটে ক’দিন থাকার পরপরই বাবা ছোটখাটো একটা লেকচার দিলেন।

‘‘পড়াশোনার জন্য বাড়ি নয়, বোর্ডিং, হস্টেলই প্রপার জায়গা। সেখানে সবাই লেখাপড়ার মধ্যে থাকে, বন্ধুদের সাহায্য পাওয়া যায়। বাড়িতে থাকা মানে অনেক পিছুটান। এই জন্যই গুরুগৃহে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণের প্রথা চালু ছিল। সেই সময়ের মানুষ তো আর বোকা ছিল না। তুমি কী বলো, ছিল?’’

বিতান অস্ফুট স্বরে বলেছিল, ‘‘না, ছিল না।’’

‘‘তা হলে তুমিও হস্টেলে গিয়ে থাকো। খরচাপাতি যা লাগে খানিকটা আমার কাছ থেকে নেবে, খানিকটা টিউশন, পার্টটাইম কাজ করে উপার্জন করবে। এতে সাবলম্বী হবে। মনে রাখবে, নিজের পায়ে দঁাড়ানোটাই জীবনে আসল কথা। মানুষ ছাড়া জীবজগতের কেউ নিজের পায়ে দঁাড়াতে পারে না। কি, তাই তো?’’

বিতান মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘‘হ্যঁা, তাই।’’

‘‘তা হলে ব্যবস্থা করে ফেলো। ‌কলেজে পড়া শেষ হলে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে আসবে।’’

বাবার উপদেশ মতো বিডন স্ট্রিটের হস্টেলে সিট নিল বিতান। তবে কলেজ শেষ করেও আর বাড়িতে ফেরা হয়নি। তত দিনে বাবা আবার বিয়ে করে ফেলেছেন। তার পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল, ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। হয়তো মালবিকাই বলেছিলেন। এত বড় ছেলেকে নিয়ে তিনি নতুন সংসার বানাতে চাননি। কেনই বা চাইবেন?

সেই থেকে বিতান কখনও ভাড়া বাড়ি, কখনও মেসে থেকেছে। কিছু দিনের জন্য একটা প্রেসে সুপারভাইজারের কাজ করেছিল। তখন প্রেসেই রাত কাটিয়েছে। সকালে সেখানে স্নান-টান সেরে বেরিয়ে পড়ত। সারা দিন কলকাতা শহরে চক্কর দিয়ে আবার সন্ধের পর ঢুকে পড়ত। চক্কর কাটার জন্য কলকাতার মতো শহর ভূভারতে নেই। যে কোনও পথেই কত ঘটনা, কত গল্প!‌

বিতান এখন আছে বাইপাসের ধারে, বন্ধুর ফ্ল্যাটে। আট‌ তলার ওপর দুর্দান্ত ফ্ল্যাট। জানলা খুললেই চকচকে বাইপাস দু’দিকে হাত বাড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে। হুহু করে গাড়ি, বাস ছুটছে। রাতে দূরের ফ্লাইওভারে মালার মতো জ্বলে ওঠে আলো। মনে হয়, শহরটা ভাসছে। বিতানের বুঝতে পারে, এখানে না এলে কলকাতা শহরের একটা রূপ দেখা বাকি থেকে যেত। চকচকে, ব্যস্ত একটা নতুন কলকাতা। সে মনে মনে অনুভবকে ধন্যবাদ দেয়। মুখে দিতে গেলে যে গালাগালি শুনতে হবে! দু’এক বার বলতে গিয়ে শুনতে হয়েছে।

বিতানের এই ফ্ল্যাট পাওয়ার ঘটনাটাও একটা গল্পের মতো।

আসানসোলের ছেলে অনুভব বিতানের বন্ধু। স্কুল ‌কলেজ দু’জায়গাতেই একসঙ্গে পড়েছে। একসঙ্গে স্কুল বোর্ডিংয়ে থেকেছে। কলেজে পড়ার সময় অনুভব কলকাতায় থাকতে গিয়ে সমস্যায় পড়ল। টালিগঞ্জে যে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে থাকত, তারা এক দিন দু্ম করে প্রোমোটারের কাছে বাড়িটা বেচে দিল। নিজেরা মাথা গোঁজার ঠঁাই করলেও, সেখানে তো বাইরের লোককে নিয়ে যাওয়া যায় না। ফলে রাতারাতি জলে পড়ল অনুভব। এ দিকে কলেজে সেশন শুরু হয়ে গিয়েছে। কোনও হস্টেলে আর সিট ফাঁকা নেই। কলকাতা শহর দেখতেই এমন, বাড়ি আর বাড়ি। বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের থাকার জায়গা পাওয়া খুব সহজ নয়। পিজি থাকতে হলে অনেক খরচ। ছাত্রদের পক্ষে সেই টাকাপয়সা জোগাড় করা কঠিন। অনুভব হন্যে হয়ে কম পয়সায় থাকার জায়গা খুঁজতে লাগল। বিতানের হস্টেলেও গেল। সিট নেই। বিতান বলল, ‘‘দঁাড়া, সুপারের পায়ে পড়ে যাই।’’ সত্যি সত্যি সুপারের প্রায় হাতে পায়ে ধরে অনুভবকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে রাখল বিতান। তবে আর একটা খাট ঢোকাতে পারল না। সুপার বললেন, ‘‘নিয়ম ভেঙে মানুষ পর্যন্ত অ্যালাও করেছি। খাট অ্যালাও করতে পারব না। মানবিকতা দেখাতে পারব, খাটবিকতা দেখাতে পারব না। প্রিসিডেন্স হয়ে যাবে। এর পর যে পারবে সে-ই বন্ধুর জন্য ঘরে খাট ঢোকাবে।’’

কী আর করা যাবে? তিন মাস খাটে আর মেঝেতে ভাগ করে শুয়েছে দু’জনে। সেই সময় অনুভব বিতানের বাড়ির কথা কিছু কিছু জেনেছিল। তিন মাস পর অনুভবের বাবা ছেলের এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ছেলের জন্য কসবার কাছে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে ফেললেন। অনুভব সেখানে উঠে গেল। বিতানকেও টানাহেঁচড়া করেছিল। হস্টেল ছেড়ে ওর সঙ্গে গিয়ে থাকতে হবে। বিতান হেসে বলেছিল, ‘‘এখন নয়। এখন তো থাকার একটা জায়গা আছে। ভবিষ্যতে মনে হচ্ছে থাকবে না, সেই সময়ের জন্য তুলে রাখ। মনে থাকবে?’’

অনুভব বলেছিল, ‘‘না। ভুলে যাব।’’

ক্রমশ...

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

অন্য বিষয়গুলি:

novel series
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy