ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
শীতের পড়ন্তবেলা দিয়ে কলকাতার দিকে গাড়ি ছুটিয়েছিল আহিরী। স্পিকারে গান চলছে। কান্ট্রি রোডস, টেক মি হোম, টু দ্য প্লেস আই বিলং। আহিরী মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়াল। ভাগ্যিস কাউকে লিফ্ট দেয়নি! একা চলার আনন্দটাই নষ্ট হত। মোবাইল টেনে নিয়ে বাবাকে ফোন করল।
‘‘ফিরছি।’’
‘‘একাই আছিস? নাকি কোনও বয়ফ্রেন্ডকে তুলে নিয়েছিস?’’
আহিরী বলল, ‘‘হ্যাঁ নিয়েছি। খানিক আগে জন ডেনভার হাত দেখিয়ে লিফ্ট চাইলেন। তুলে নিয়েছি। উনি এখন গান শোনাচ্ছেন। শুনতে পাচ্ছ না? কান্ট্রি রোডস, টেক মি হোম?’’
বাবা হেসে বলেছিল, ‘‘পাচ্ছি। এনজয়।’’
ফোন রাখার পঁাচ মিনিটের মধ্যে ডেনভারের ‘টেক মি হোম’ গান ছাপিয়ে টায়ার ফাটার আওয়াজ হল। নব্বই কিলোমিটার বেগে ছোটা গাড়ি সামান্য কেঁপে উঠল। সাবধানে গাড়ি পাশ করল আহিরী। সন্ধে নামছে। এক পাশে ধু-ধু ক্ষেত, অন্য পাশে মাঠ। রাস্তা পেরোলে এক কোণে ছোট্ট এক চিলতে চায়ের দোকান। শীতের বেলা ফুরিয়ে গিয়েছে। চায়ের দোকানে টিমটিমে আলো জ্বলছে। গাড়ি থেকে নেমেই ঠান্ডার কনকনানি টের পেল আহিরী। পিছনের বঁা দিকের চাকাটা গিয়েছে। ডিকি খুলল আহিরী। গাড়ির যাবতীয় মেকানিজমের মধ্যে চাকা বদল সবচেয়ে সহজ কাজ। হাতে কালি লাগে, এই যা। গুনগুন করে ‘কান্ট্রি রোড’ গাইতে গাইতে জ্যাক ঘুরিয়ে গাড়ি তুলে ফেলল আহিরী।
ঝামেলা শুরু হল এর পর। ডিকি থেকে স্টেপনি গড়িয়ে এনে গাড়িতে লাগাতে গিয়ে আহিরী বুঝতে পারল, স্টেপনি নেতিয়ে আছে। কোনও কারণে মেরামত করা স্টেপনির ফুটোফাটা গোপনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ডিকিতে বসেই হাওয়া বের করে দিয়েছেন তিনি। দীনেশকাকা খেয়াল করেনি। আহিরী নিজেকেও দোষ দিল। এতটা পথ যাবে, বেরোনোর সময় ডিকি খুলে দেখে নেওয়া উচিত ছিল। শিক্ষা হল। কিন্তু এখন কী হবে? আশেপাশে চাকা মেরামতের কোনও দোকান চোখে পড়ছে না। শীতের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। এত ক্ষণ পর একটু নার্ভাস হল আহিরী। দুটো ফেঁসে যাওয়া চাকা নিয়ে কী করবে সে? আচ্ছা বিপদে পড়া গেল তো!
রাস্তা পেরিয়ে ঝুপড়ি চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ল আহিরী। দোকান এখনও জমেনি। দু’জন চা খাচ্ছে। তার মধ্যে এক জন কমবয়সি, অন্য জন বুড়োটে ধরনের। কম বয়সের ছেলেটির গায়ে জ্যাকেট, মাথায় টুপি। কঁাধে ব্যাগ। বোঝা যাচ্ছে, ব্যাগটা ক্যামেরার। আহিরী একটু নিশ্চিন্ত হল। এতগুলো লোক যখন আছে, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু যা শুনল তাতে মাথায় হাত। টায়ার সারাতে হলে বড় রাস্তা ছেড়ে বেশ খানিকটা ভিতরে যেতে হবে। কী করে যেতে হবে? চাকা গড়িয়ে তো যাওয়া যাবে না। ভ্যানরিকশা ধরতে হবে। আঁতকে উঠল আহিরী। গাড়ি ফেলে চাকা নিয়ে সে কী ভাবে যাবে? বাবাকে কলকাতায় ফোন করবে? প্রশ্নই ওঠে না। ভীষণ অস্থির হয়ে পড়বে। এতটা পথ আসতেই তো অনেক সময় লাগবে। এ তো আর গাড়ির মেকানিক ধরে আনার মতো সহজ ব্যাপার নয়। টায়ার সারাতেই হবে। বাবা তো টায়ার মেরামতির দোকান নিয়ে আসতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা, আহিরীর হেরে যাওয়াও হবে। সমস্যা হলে সে নিজেই তার সমাধান করবে, বলে এসেছে। পিনপিনে গলায় বলেনি, জোর গলায় বলেছে। টায়ার ফেটে যাওয়ার মতো সামান্য ঘটনাতেই সেই জোর ফুড়ুৎ? একেবারে কলকাতায় এসওএস পাঠাতে হচ্ছে! যা করার নিজেকেই করতে হবে। আহিরী দোকানের ভিতরে এগিয়ে গেল।
‘‘এখানে কাউকে পাওয়া যাবে? গাড়ির চাকা সারানোর ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারেন এমন কাউকে?’’
দোকানদার বিরক্ত গলায় বললেন, ‘‘কাকে পাবেন? দেখছেন একা মানুষ, দোকান সামলাচ্ছি!’’
আহিরী একটু থমকে গিয়ে বলল, ‘‘আমি পে করব... টাকা দেব।’’
দোকানদার আরও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘‘টাকা দেবেন তো কী? দোকান ফেলে আপনার চাকা মাথায় নিয়ে দৌড়তে হবে?’’
এ কেমন কথা বলার ভঙ্গি! আহিরীর রাগ হল। তার পরেও সে নরম গলায় বলল, ‘‘আপনি যাবেন কেন? কাউকে একটা খবর দিন। ওই টায়ার মেরামতের দোকানেই খবর দিন না। ওরা এসে চাকাটা নিয়ে যাবে। আপনি যদি কষ্ট করে ওদের কারও ফোন নম্বর দিতে পারেন, আমি ফোন করে রিকোয়েস্ট করব।’’
দোকানদার বলল, ‘‘চাকা মেরামতের দোকান কি আমার শ্বশুরের, যে বললেই ছুটে আসবে?’’
আহিরীর রাগ বেড়ে গেল। এই লোক তো অতি বদ প্রকৃতির! হাইওয়ের ধারের চায়ের দোকানগুলো সব সময় খুব ভাল হয়। মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার জন্য এরা বিখ্যাত। পথচলতি মানু্ষের বিপদে-আপদে দোকানের মালিক, কর্মচারীরা সবার আগে এগিয়ে আসে। কিন্তু এই দোকান হাইওয়ের ধারের চায়ের দোকানের কলঙ্ক। এত ক্ষণ ধরে চারপাশটা কুয়াশা-মাখা ছবির মতো সুন্দর হয়ে ছিল, নিমেষে তার ওপর যেন খানিকটা কালি পড়ে গেল।
আহিরী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘‘এ ভাবে বলছেন কেন? কেউ সমস্যায় পড়ে হেল্প চাইলে আপনি এ ভাবে কথা বলেন?’’
দোকানদার এ বার বসে থাকা দু’জন খদ্দেরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘ফুর্তি করতে এসে গাড়ি বিগড়োবে, তার পর বলবে আমায় সাহায্য করুন। এই তো পরশু রাতে এক দল ছেলেমেয়ে গাড়ি ধাক্কা মেরে... সব মাল খেয়ে টাল...’’
আহিরী আর নিজেকে সামলাতে পারল না। গলা তুলে চিৎকার করে উঠল।
‘‘শাট আপ। আমি কোনও ফুর্তি করতে এখানে আসিনি। আমি এক জন প্রফেসর। কল্যাণী ইউনিভার্সিটিতে একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে এসেছিলাম। আপনি কোন সাহসে আমাকে অপমান করছেন?’’
দোকানদারও তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘‘আমার দোকানে ঢুকে আপনি কোন সাহসে হুজ্জতি পাকাচ্ছেন? এখানে কি গাড়ি সারানো হয়?’’
আহিরী বলল, ‘‘ভদ্রভাবে কথা বলুন। এক জন মহিলার সঙ্গে কী ভাবে কথা বলতে হয় জানেন না? একা পেয়ে কি অবলা ভাবছেন?’’
দোকানদার বাইরে হাত দেখিয়ে বলল, ‘‘যান যান, যাকে খুশি ডাকুন। এটা কলকাতা নয়।’’
এ বার ক্যামেরার ব্যাগ-কাঁধে যুবকটি উঠে দাঁড়াল। আহিরীর পাশে এসে গলা নামিয়ে বলল, ‘‘বাদ দিন, এদের সঙ্গে চেঁচামেচি করে সময় নষ্ট। বাইরে আসুন। আমি দেখছি কী করা যায়।’’
আহিরী বুঝল, সত্যি সময় নষ্ট। সে বাইরে চলে এল। যুবকটিও একটি কথা না বলে, রাস্তা পার হল। তার পর প্রায় ম্যাজিকের মতো একটি মোটরবাইক-চালককে পাকড়েও ফেলল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ছেলেটি স্থানীয়। মোটরবাইকের পিছনে একটা মস্ত ঝুড়ি বাঁধা। চালকের কানের কাছে যুবকটি ফিসফিস করে কিছু বলল। ছেলেটি আহিরীর দিকে ভয়ে ভয়ে এক বার তাকিয়ে ঘাড় কাত করল। রাজি হওয়ার লক্ষণ। মোটরবাইক থেকে ঝুড়ি নামিয়ে চাকা তোলা হল। যুবকটি বাইকের পিছনে বসে হুশ করে চলে গেল অচেনা চালকের কাঁধ ধরে। যাওয়ার সময় ক্যামেরার ব্যাগটা রেখে গেল গাড়িতে। মশা আর ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে আহিরী কাচ তুলে বসে রইল গাড়িতে। খুব বেশি হলে পঁচিশ মিনিট। মেরামত করা চাকা এনে যুবকটি বলল, ‘‘নিন, লাগিয়ে নিন। আমি গাড়ির চাকা লাগাতে জানি না।’’
‘‘না না, আপনি কেন লাগাবেন? আমি করে নিচ্ছি। আপনার কাছে টর্চ আছে? এত অন্ধকারে নাট-বল্টুগুলো দেখতে পাব না। গাড়ির আলো জ্বালালেও নয়। হাত ফসকে পড়ে গেলে মুশকিল। আজ পর পর যা ঘটছে...’’
যুবকটি বলল, ‘‘দেশলাই আছে।’’
‘‘দেশলাই? ওতে কি পারব?’’
একটা দেশলাইকাঠি নিভে গেলে আবার আর একটা জ্বলে উঠছে। অস্বস্তি হচ্ছে আহিরীর। যুবকটি হাতে দেশলাই নিয়ে ঝঁুকে আছে। নিশ্চয়ই তার অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু উপায় কী? আহিরী বারণও করতে পারছে না। মনে মনে নিজের গালে একটা চড়ও মারল আহিরী। ছি ছি। একটা টর্চও রাখেনি সঙ্গে! যেন গাড়ির চাকা শুধু দিনেই বদলাতে হয়। আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে, গাড়ি চালানো মানে শুধু স্টিয়ারিং ধরা নয়। তবে চায়ের দোকানের ঝগড়াটা করে ভাল হয়েছে। নইলে এই লোককে পাওয়া যেত না। সুন্দরী তরুণীর অপমান নিশ্চয়ই মেল শভিনিজমে লেগেছে। ইস, এখনও লোকটার নাম জানা হয়নি।
কাজ শেষ হলে আহিরী হাত ঝেড়ে উঠে দঁাড়াল। বলল, ‘‘আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব! আমার নাম আহিরী। আমি কলেজে পড়াই।’’ কলেজের নাম বলল আহিরী।
‘‘আমি বিতান।’’
বিতান হাত বাড়িয়ে গাড়ি থেকে ক্যামেরার ব্যাগটা নিল। আহিরী খানিকটা গদগদ ভাব দেখিয়ে বলল, ‘‘আপনি ছবি তোলেন? ফোটোগ্রাফার?’’
বিতান নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল, ‘‘না, ফোটোগ্রাফার নই। পিছনে একটা ঝিল আছে। এই সময়টায় মাইগ্রেটরি বার্ডস আসে। খবর পেয়ে বন্ধুর ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলাম।’’
আহিরী বলল, ‘‘বাহ্, চমৎকার তো! আপনি কোথায় যাবেন?’’
বিতান বলল, ‘‘আপনি আমাকে একশো বাহাত্তর টাকা দেবেন। এমারজেন্সি বলে টায়ারের দোকানে বেশি নিয়েছে। বাইকের ছেলেটাকে একশো টাকা দিয়েছি।’’
আহিরী চটপট বলল, ‘‘এ তো কোনও টাকাই নয়। আপনি না থাকলে ঝামেলা হত। আপনি কোথায় যাবেন?’’
‘‘কলকাতা।’’
আহিরী খুশি হয়ে বলল, ‘‘আসুন, গাড়িতে উঠুন। আমি নামিয়ে দেব।’’
বিতান বলল, ‘‘না, আমি বাসে যাব।’’
এ রকম সরাসরি প্রত্যাখানের জন্য আহিরী প্রস্তুত ছিল না। বোকা বোকা হেসে বলল, ‘‘কেন? বাসে যাবেন কেন? আসুন দু’জনে গল্প করতে করতে চলে যাই। ভাল লাগবে।’’
বিতান ঠান্ডা গলায় বলল, ‘‘আমার গল্প
করতে করতে যেতে ভাল লাগবে না। আপনি টাকাটা দিন।’’
এ তো ভদ্রভাবে অপমান! আহিরী থতমত খেল। আচ্ছা ঠেঁটা লোক তো! কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ খুলে দু’টো একশো টাকার নোট বের করে দিল।
বিতান বলল, ‘‘আমার কাছে ভাঙানি নেই।’’
আহিরী গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘‘থাক। আপনার কাছ থেকে আমার হিসেব বুঝে নিতে ভাল লাগবে না।’’
ঠিক এক সপ্তাহ পরে, এক দুপুরে ক্লাস করে টিচার্স রুমে ঢুকতে যাবে আহিরী, পিয়ন এসে জানাল, এক জন দেখা করতে চায়।
বিতান সাতাশ টাকা ফেরত দিতে এসেছিল। আরও এক টাকা নিয়েছে দেশলাইয়ের জন্য। আহিরী তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় গড়িয়াহাটের এক নামকরা চায়ের বুটিকে। বিতান রাজি হচ্ছিল না।
আহিরী কড়া গলায় বলল, ‘‘এসেছেন ভাল করেছেন। সে দিন আমাকে অনেক অপমান করেছিলেন। উপকার তার থেকে বেশি করেছিলেন বলে কিছু বলতে পারিনি। আজ সেই জবাবগুলো দেব। কলেজে দঁাড়িয়ে তো দেওয়া যাবে না। তাই আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। চিন্তা করবেন না, কলেজের গেটে নামিয়ে দেব।’’
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy