ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: কমলেশ ও নবনী ডুয়ার্স বেড়াতে গিয়েছিলেন। পূর্ণিমার রাতে নদীর ধারে বসে নবনী বললেন, কমলেশ যে এক কালে একটি মেয়েকে ভালবাসতেন সে খবরে নয়, তিনি যে সেই মেয়েটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, তা জেনে তিনি আহত। তবে তা না হলে নবনীরও কমলেশকে, আহিরীকে পাওয়া হত না।
নবনী থমথমে গলায় বললেন, ‘‘তুমি বললেই চিন্তা বন্ধ করে দেব এমনটা ভাবছ কেন? মাঝরাত পর্যন্ত মেয়েকে কতকগুলো গুন্ডা আটকে রাখবে আর আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখব?’’
কমলেশ বললেন, ‘‘গুন্ডা বলছ কেন? ওরা স্টুডেন্টস। আহিরই সব ছাত্রছাত্রী।’’
নবনী দাঁতে দাঁতে চেপে, চোখে ঘৃণা নিয়ে বললেন, ‘‘এরা ছাত্র! ছিঃ! আমরা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়িনি? টিচারদের রাতদুপুর পর্যন্ত আটকে রাখাটা ছাত্রদের কাজ?’’
কমলেশ বললেন, ‘‘তোমাদের সময়েও এ সব হয়েছে নবনী। তার আগেও হয়েছে। ছেলেমেয়েরা এই ধরনের আন্দোলন চিরকালই করে। কোন ইস্যুতে করে দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন। তবে এটা ঠিক, আনরেস্ট বাড়ছে। গোটা দেশেই কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলোতে গোলমাল লেগে আছে।’’
নবনী এ বার ঘরে ঢুকলেন। মোড়ায় বসলেন। মোড়াটা সাধারণ মোড়া নয়, হস্তশিল্প মেলা থেকে বেশ দাম দিয়ে কেনা। কাঠের ওপর পুতুল খোদাই করা। কমলেশ মনে মনে প্রমাদ গুনলেন, নবনী বসেছে মানে অনেকটা বলবে। শুধু বলবে না, ঠিকমত কথার উত্তর না দিলে তাকে ‘ইগনোর’ করা হচ্ছে বলে রাগারাগিও করবে।
নবনী বললেন, ‘‘আহিকে নিয়ে চিন্তা হয়। লেখাপড়া করে এ কী গোলমালে পড়ল!’’
কমলেশ বললেন, ‘‘আহি তো বড় হয়েছে। অত চিন্তার কিছু নেই।’’
নবনী বললেন, ‘‘বড় হয়েছে বলেই তো আরও চিন্তা। এর পর অন্য জায়গায় মানিয়ে নিতে অসুবিধে হবে।’’
কমলেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘‘অন্য জায়গায়! তার মানে!’’
নবনী একটু চুপ করে থাকলেন। তার পর বললেন, ‘‘আহির একটা ভাল সম্বন্ধ পাওয়া গেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। কম্পিউটার নিয়ে লেখাপড়া। বাড়িতে এসেছিল। আহির সঙ্গেও আলাপ হয়েছে।’’
কমলেশ ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘‘তুমি আমাকে বলেছিলে না?’’
‘‘বলেছিলাম। কিন্তু পুরোটা বলিনি। ওই ছেলের আহিকে পছন্দ হয়েছে। সে তাকে জানিয়েওছে এ কথা। অমন মেয়েকে তো পছন্দ হওয়ারই কথা।’’
কমলেশ একটু চুপ করে থেকে মাথা নামালেন। হাতে রাখা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে বললেন, ‘‘ভাল তো। আহির সঙ্গে কথা বলো। লেখাপড়ার জগতের ছেলেকে তো ওর ভাল লাগারই কথা।’’
নবনী এ বার ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, ‘‘অনেক বলেছি। মেয়ে বলছে এখন বিয়ে করবে না। কলেজে পড়াব পড়াব করে তো তিরিশ বছর বয়স করে ফেলল। আর কত দিন?’’
কমলেশ ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘‘এখানে সিস্টেমটাই তো এ রকম। ভাল ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া নিয়ে থাকতে চাইলে চাকরি-বাকরি পেতে পেতে বয়স হয়ে যায়। কী অদ্ভুত!’’
নবনী এ বার আরও ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, ‘‘এখানে পড়ে থাকার দরকার কী? বিদেশে গিয়ে পড়ানোর চাকরি নেবে। কত ছেলেমেয়ে তো পড়াচ্ছে। এখানে সারা রাত কলেজে আটকে থাকার থেকে তো সেটা অনেক ভাল।’’
কমলেশ মুখ তুলে বললেল, ‘‘আহি আপত্তি করছে না কি?’’
নবনী মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘‘তুমি জিজ্ঞেস করো। মেয়ের সঙ্গে এত আদিখ্যেতার সম্পর্ক আর এইটা জিজ্ঞেস করতে পারছ না!’’
কমলেশ শান্ত ভাবে বললেন, ‘‘আমি তো এতটা জানতাম না।’’
নবনী এ বার গলা তুলে বললেন, ‘‘জানতে না কেন? একমাত্র মেয়ে, তার বিয়ের ব্যাপার জানবে না? শুধু আমি জানব? কেন? তুমি চাকরি করছ আর আমি ঘরে বসে আছি বলে? মেয়েকে তো আমি মানুষ করে দিয়েছি। আমার ডিউটি শেষ। আমার যা কোয়ালিফিকেশন তাতে আমিও চাকরি করতে পারতাম। ভাল চাকরি পেয়েও করিনি। কেন করিনি? না আমি সংসার দেখব, মেয়ে মানুষ করব। মেয়ে তো আমার একার নয়, তোমারও।’’
কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন কমলেশ। হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে ছোট করে চুমুক দিলেন। নবনীকে তিনি সেই সময়ে অনেক বুঝিয়েছিলেন। চাকরির সুযোগ যখন এসেছিল বলেছিলেন, অবশ্যই করা উচিত। ওয়ার্কিং মায়ের ছেলেমেয়েরাও ভাল হয়, দারুণ কেরিয়ার করে। চারপাশে ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। আবার বাবা–মা সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখার পরেও ছেলেমেয়েদের গোল্লায় যাওয়ার ঘটনা অজস্র। এই ভাবে দুই আর দুইয়ে চার হয় না। নবনী রাজি হননি। বলেছিলেন, ‘‘পরে দেখা যাবে। মেয়েটা দুরন্ত।’’ এ কথাটা অবশ্য সত্যি। ছোটবেলায় আহি খুব ছটফটে ছিল। কমলেশ জানতেন, সেটা কোনও বিষয় নয়। সবাই যে ভাবে অ্যাটেনড্যান্ট রেখে ছেলেমেয়ে সামলায়, সে ভাবেই সামলানো যেত। এখন কলকাতায় ভাল ভাল সব ক্রেশ হয়েছে। সেখানে রাখা যেত।
মেয়ে একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর ঝামেলা অনেক কমে গিয়েছিল। লেখাপড়ার কথা বলতে হত না। সে নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে গোড়া থেকে সিরিয়াস। নবনী অবশ্য হাল ছাড়েননি। মেয়েকে ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়র বানানোর জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন আপ্রাণ। নানা ধরনের টিউশন, কোচিং, মক টেস্টের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। একটা বয়সের পর আহিরী আপত্তি করল। বলে দিল, ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়র হওয়ার মধ্যে সে নেই, সে টিচিং প্রফেশনে যাবে। সুতরাং তাকে নিয়ে মায়ের এই ছোটাছুটি বৃথা। নবনী চিরকালই মেয়ের ব্যাপারে পজেসিভ। তিনি চাইতেন, মেয়ে তার কথা মতো জীবন তৈরি করুক। মেয়ের ‘ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়র’ না হওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। তার পরেও না মেনে উপায় ছিল না।
ইউনিভার্সিটি শেষ করে আহিরী গবেষণার কাজ শুরু করল। নবনী চাইলেন, গবেষণা করতে করতে আহিরী বিয়ে করে ফেলুক। এর পরে বয়স পেরিয়ে যাবে। ছেলেও দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসে। শ্বশুরবাড়ির হেঁশেল ঠেলতে ঠেলতে সে গবেষণার কাজ চালাতে পারবে না। কমলেশও তখন মেয়েকে সমর্থন করেছিলেন। বলেছিলেন, ক’টা দিন যাক। রিসার্চের কাজটা মন দিয়ে শেষ করুক। বিয়ে তো পালিয়ে যাচ্ছে না! নবনী রেগে ছিলেন খুব, কিন্তু করার কিছু ছিল না। তার পর জল আরও গড়িয়েছে। আহিরী চাকরি পেয়েছে। বয়সও বাড়ছে।
রাগ সংযত করে, গলা নামিয়ে নবনী বললেন, ‘‘মেয়ের দিকে এ বার একটু নজর দাও।’’
কমলেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘‘এত বড় মেয়ের দিকে আমি কী নজর দেব! সে কলেজের টিচার।’’
নবনী দঁাতে দঁাত চেপে বললেন, ‘‘তাতে কী হয়েছে? কলেজে পড়াচ্ছে বলে মাথা কিনে নিয়েছে? তোমাকে কিনতে পারে, আমাকে পারবে না। যা বলছি কর। আশকারা দেওয়া বন্ধ করে, মেয়েকে সামলাও। এর পরে আপশোস করতে হবে।’’
কমলেশ স্ত্রীর কথা তেমন বুঝতে পারেন না। আহিরীর ওপর কী নজর দেবেন? সে খুবই ভাল একটা মেয়ে। বাবা হিসেবে তিনি এই মেয়ের জন্য গর্ব বোধ করেন। ও বাইরে যাক অথবা দেশে থাকুক, আরও অনেক ওপরে উঠবে। হ্যাঁ একটা কথা ঠিকই, এখানকার শিক্ষাজগতের এখন অনেক রকম অস্থিরতা। রাজনীতি, দলাদলি বাড়ছে। সত্যি যারা লেখাপড়া ভালবাসে, লেখাপড়া নিয়ে থাকতে চায়, তারা মাঝেমধ্যেই হতাশ হয়ে পড়ে। বিদেশে চলে গেলে এই সমস্যা থাকবে না। কথায় কথায় ঘেরাও, কলেজ-ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ভিতর মারপিট, হাঙ্গামা। লেখাপড়ার বদলে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে অনেক বেশি। কিন্তু সেটাও তো আহিরীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। জোর করে তো চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এর সঙ্গে তাকে সামলানোর প্রশ্ন উঠছে কেন?
‘‘তুমি কী বলছ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না নবনী।’’
নবনী একটু চুপ করে থেকে চাপা গলায় বললেন, ‘‘আহি খুব বাজে একটা ছেলের পাল্লায় পড়েছে। আমি খবর পেয়েছি, সেই ছেলে কিছু করে না। লেখাপড়াতেও ভাল না। এতটাই বাজে যে সে কোনও কাজ করতে গেলে তাকে দু’দিন পরে তাড়িয়ে দেয়। বাড়িতেও জটিলতা আছে।
কী জটিলতা এখনও জানতে পারিনি। এর খপ্পর থেকে মেয়েটাকে বের করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’’
কমলেশ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। নবনী কী বলছে এ সব! আহি এমন এক জন ছেলে ‘বন্ধু’ হিসেবে বেছেছে! হতে পারে না। নিশ্চয়ই নবনী বাড়াবাড়ি করছে। নিজের পছন্দের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় বলে এ সব বলছে। হয়তো একটু শুনেছে, বলছে অনেকটা।
‘‘এত সব খবর তুমি পাও কোথা থেকে?’’
নবনী স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে রইলেন। তার পর বললেন, ‘‘নিজের লোকদের খবর রাখব না তো কার রাখব?’’
কমলেশ একটু থমকে গেলেন। নবনী কি তাঁকেও খোঁচা দিল?
নবনী বললেন, ‘‘তুমি নিশ্চয়ই জানো এই ধরনের সম্পর্কের শেষ কোথায় হয়।’’
কমলেশ নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বললেন, ‘‘তুমি কোথাও ভুল করছ না তো নবনী? আহি এক জন বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে নিজের ভালমন্দ বোঝে।’’
নবনী একটু চুপ করে থাকলেন। তার পর স্বামীর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, ‘‘যাদের বুদ্ধি থাকে তারা ভুল করে না?’’ একটু থমকে থেকে আবার বললেন, ‘‘আহি তোমারই তো মেয়ে। এই বিষয়ে তার ভুল হওয়াটা আশ্চর্যের হবে না। আমি তাই ভয় পাচ্ছি।’’
কমলেশ বুঝতে পারলেন, নবনীর ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। সে ভুলতে পারেনি। পারবেও না।
নবনী বলল, ‘‘যাক ও সব কথা। তুমি আহির খোঁজ নাও। বারোটা বাজতে চলল। মোবাইল এখনও অফ। তোমার এক বার যাওয়া উচিত। দূর থেকে হলেও দেখে আসা দরকার ওখানে কী হচ্ছে। আর মদ খাওয়ার কারণে তুমি যদি ড্রাইভ করতে না পারও তা হলে ক্যাব ডেকে দাও, আমি যাব।’’
কথা শেষ করে নবনী চলে গেলেন। কমলেশ বুঝতে পারলেন, কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না। নবনী অশান্ত। সে অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে রয়েছে। কমলেশ হাত বাড়িয়ে মোবাইল টেনে নিলেন। নম্বর টেপার পর চাপা গলায় কথা বললেন।
‘‘বিভূতি, কী খবর?’’
‘‘স্যর, মনে হচ্ছে একটা কিছু নড়চড় হয়েছে।’’
‘‘কী করে বুঝলে? তুমি কি ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলে?’’
‘‘না স্যর, ভিতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। কলেজের গেটে পুলিশ আছে। তবে গোপাল বলল, এ বার ফয়সালা হয়ে যাবে মনে হয়। প্রিন্সিপাল না কার ঘরে যেন মিটিং চলছে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘গোপাল কে?’’
বিভূতি বলল, ‘‘কলেজের দারোয়ান। আলাপ করে নিয়েছি স্যর।’’
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy