ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: অর্জক আহিরীকে খুব পছন্দ করেছে, আমেরিকা ফিরে গিয়ে লিখেছে, সে তার জন্য অপেক্ষা করবে। আহিরী পড়েছে সমস্যায়, বাড়িতে সে এখনও বিতানের কথা বলেনি। কলেজে ঢুকে আহিরীর মাথা গরম হয়ে গেল, তার গাড়ি রাখার জায়গায় অন্য একটা গাড়ি। সে বাবার কথা ভাবতে ভাবতে এগোল, তার পারফেক্ট জেন্টলম্যান বাবা।
আমি যদি টাকার ব্যবস্থা করে দিই, স্কুল তোমাকে আলাদা চোখে দেখবে। তোমার ভুল ত্রুটি চট করে ধরবে না। শাসন করবার প্রযোজন হলে দশবার ভাববে,’’ বাবা বলেছিল।
আহিরী বায়না করেছিল, ‘‘বাবা, এটা আমার প্রেস্টিজ। প্লিজ তুমি দাও।’’
‘‘বাবার বিজ্ঞাপন দেওয়াটা কোনও মেয়ের প্রেস্টিজ হতে পারে না। লেখাপড়া করে নিজের প্রেস্টিজ তৈরি কর, আহি।’’
আহিরী বলেছিল, ‘‘অনেকেই তো দিচ্ছে।’’
বাবা বলেছিল, ‘‘অনেকে করলেই ভুল কাজ কখনও ঠিক হয় না। স্কুলের ফান্ড রেজ করবার জন্য স্টুডেন্টদের জড়ানো ঠিক নয়। এটা ভুল। আমি সমর্থন করি না। যে মেয়েরা দিতে পারবে না তারা হীনম্মন্যতায় ভুগবে। আইসোলেটেড ফিল করবে।’’
সেই বয়সে যে প্রশ্ন করা যায় না, সে দিন আহিরী সেই প্রশ্ন করেছিল। সে ছোটবেলা থেকেই আর পঁাচ জনের থেকে পরিণত।
‘‘ভুল করেই নাহয় দাও। বাবা, তুমি কি কখনও ভুল করোনি?’’
আহিরীর মনে আছে, কমলেশ রায় সে দিন একটু চুপ করে গিয়েছিলেন। তার পর বলেছিলেন, ‘‘যদি করেও থাকি, আরও ভুল করবার জন্য সেটা কোনও লাইসেন্স নয়। এই বয়সেই সবটা বুঝতে পারবে না। বড় হলে পারবে।’’
আহিরী বাবার কথা সে দিন বিশ্বাস করেনি। অসম্ভব, বাবা কখনও ভুল করতে পারে না। আহিরী স্কুল ছাড়ার পর এই মানুষটাই নিজে থেকে প্রতি বছর স্কুলে বড় অ্যামাউন্টের ডোনেশন পাঠিয়ে দেয়। কেউ জানতেও পারে না। বছর তিন হল জানতে পেরেছে আহিরী। স্কুলের এক পুরনো টিচারের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে জিজ্ঞেস করায় কিছু বলেনি, মুচকি হেসেছে শুধু। একে খুব পছন্দ না করে উপায় আছে?
কলেজে জয়েন করবার আগে বাবা যখন পরামর্শ দিয়েছে, আগ্রহ নিয়ে শুনেছে আহিরী। কমলেশ রায় বলেছিলেন, ‘‘কাজের জায়গায় গিয়ে সব বিষয়ে মাথা ঘামাবি না। নিজের কাজে মন দিবি। আগে কাজের ব্যাপারে নিজেকে উপযুক্ত প্রমাণ করবি, তার পর অন্য কথা।’’
এখনও পর্যন্ত বাবার কথা মেনে চলার চেষ্টা করে আহিরী। ছাত্রছাত্রীদের ছাড়া কোনও কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। নতুন ভবনের গোলমাল নিয়েও কখনও কথা বলে না। তবে বাড়ি আটকে থাকার ঘটনাটা যে ধীরে ধীরে জট পাকাচ্ছে সেটা টের পায়।
আহিরী কবজি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখল। সে মিনিট পঁাচ-সাত লেটে আছে।
২
কলেজ বিল্ডিং–এ ঢোকার সিঁড়িতে গোপাল রক্ষিতের মুখোমুখি হল আহিরী। থমকে দঁাড়াল।
‘‘গোপালবাবু, গাড়িটা কার?’’
গোপাল রক্ষিত অন্য কিছু ভাবছিল। থতমত খেয়ে বলল, ‘‘কোন গাড়ি দিদি?’’
ভুরু কঁুচকে আহিরী বলল, ‘‘ওই যে পিছনে পার্ক করে রেখেছে। ছাই রঙের গাড়ি।’’
গোপাল রক্ষিত বলল, ‘‘লাইব্রেরির পিছনে? শেডের নীচে?’’
আহিরী বিরক্ত গলায় বলল, ‘‘আবার কোথায় হবে? এক বছর ধরে তো আমি ওখানে গাড়ি রাখছি। এত দিন তো কেউ ওখানে যায়নি। আজ হঠাৎ কার সাধ হল?’’
গোপাল কলেজের সিকিয়োরিটি ইন-চার্জ। নতুন বাড়ি তৈরির সময় থেকে সে টেনশনে আছে। লক্ষ লক্ষ টাকার ইট, বালি, সিমেন্ট, লোহা পাহারার দায়িত্ব তার ঘাড়ে। মোটে ছ’জনের টিম নিয়ে এই কাজ করতে হয়। কোটি টাকার মালপত্রের তুলনায় এই সংখ্যা কিছুই নয়। তবে একটা সময় প্রায় তিরিশ-চল্লিশ জন লেবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে থেকে গেছে। বাড়ি যেখানে তৈরি হচ্ছিল তার পিছনে দরমা-বেড়ার ঘর বানিয়েছিল। অত লোক থাকলে চোর-ডাকাত ঢোকার সাহস পায় না। কাজ বন্ধ হয়ে যেতে এখন তারাও কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। কলেজ ছুটি হয়ে গেলে শুনশান। পর পর ছুটির দিন থাকলে তো কথাই নেই। যতই কলকাতার মতো শহর হোক, যতই উঁচু পাঁচিলে ঘেরা কম্পাউন্ড আর বড় গেট থাকুক, কলেজ তো আর বড় রাস্তার ওপরে নয়! একটু ভেতরে ঢুকতে হয়। সামনের রাস্তাটা ফঁাকা। এ দিকে নতুন তিনটে তলায় জানলা-দরজা, গ্রিল, টাইলস বসে গেছে। সে সবও দামি জিনিস। কেউ খুলে নিয়ে গেলে ভাল দামে বিক্রি করতে পারবে। ফলে চাপ বেড়েছে। এই সময়ে সিকিয়োরিটির সংখ্যা বাড়ানো দরকার। অথচ কলেজ মানতে চাইছে না। এইমাত্র শর্মিষ্ঠা দত্তের সঙ্গে তার খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। মহিলা খালি নিজেরটুকু দেখে। সে গিয়েছিল সিকিয়োরিটি বাড়ানোর আর্জি নিয়ে।
‘‘ম্যাডাম, এই ক’জন সিকিউরিটি দিয়ে এত বড় বাড়ি পাহারা দেওয়া অসম্ভব।’’
শর্মিষ্ঠা দত্ত অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, ‘‘এত বড় বাড়ি কোথায়? আটতলার মধ্যে মাত্র তিনটে তলা হয়ে পড়ে আছে। বাকি তো দঁাত বের করা ইট আর আখাম্বা কতকগুলো লোহার রড। বাড়ি কোথায় গোপাল? চুরি করবার মতো কী আছে ওখানে?’’
গোপাল বলল, ‘‘ম্যাডাম, মালপত্র তো অনেক। মাত্র ছ’টা লোকে নজর রাখা যায়? দিনে তিন জন, রাতে তিন জন থাকি। তার ওপর ছুটিছাটা আছে। কম করে আরও চার জন লাগবে। পুরনো এই বাড়িটাও তো দেখতে হয়। এখানেও তো কম্পিউটার, ল্যাবরেটরি ইকুপমেন্ট, এসি মেশিন, ফার্নিচার— সব আছে।’’
শর্মিষ্ঠা দত্ত বললেন, ‘‘তুমি কি খেপে গেলে? আটকে থাকা বাড়ির জন্য এক ডজন পাহারাদার রাখব? সরকার আমাকে ছেড়ে কথা বলবে? সরকার কলেজে টাকা দেয় লেখাপড়া করার জন্য না পাহারাদার পোষার জন্য? এক কাজ করো, কাজ যখন আটকে গেছে, তুমিও দু’জন লোক কমিয়ে দাও। আবার কাজ শুরু হলে দেখা যাবে।’’
গোপাল আর্তনাদ করে ওঠে, ‘‘পাগল হয়েছেন ম্যাডাম? দরজা-জানলা সব খুলে নিয়ে যাবে!’’
শর্মিষ্ঠা দত্ত শান্ত ভাবে বললেন, ‘‘অডিটের লোকজন এক দিন ঠিক তোমার মতোই বলবে, আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন মিসেস দত্ত? খোদ কলকাতায় একটা আধ-তৈরি বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য মাইনে দিয়ে এতগুলো লোক রেখেছিলেন! না গোপাল, তুমি দেখো লোক কী ভাবে কমানো যায়। ডিউটি ডবল করে দাও। জানলা-দরজা চোরে খুলে নিয়ে গেলে আবার হবে। সেটা অপচয় নয়। তার দায় আমার নয়। সেটা চুরি, পুলিশ দেখবে। টাকাপয়সার অপচয় হলে সব আমার ঘাড়ে পড়বে। উফ, এই আপদের জায়গা ছেড়ে যে কবে যাব! যা লেখাপড়া করেছিলাম সব তো ভুলতে বসেছি। লোহা, সিমেন্ট নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কে জানে, এর পর হয়তো রাতে এসে তোমার সঙ্গে লাঠি হাতে বাড়ি পাহারা দিতে হবে।’’
গোপাল মনে মনে গাল দিতে দিতে আসছিল। আহিরীর কথা পুরোটা বুঝতে সময় লাগল তার।
‘‘আপনার জায়গায় কেউ গাড়ি রেখেছে দিদি?’’
এ বার একটু থমকে গেল আহিরী। ‘আপনার জায়গা’ কথাটা ঠিক নয়। কলেজে প্রথম দিকে গাড়ি এনে দেখেছিল, গেটের দিকে পার্ক করার উপায় নেই। ইতিমধ্যেই অনেকে গাড়ি রেখেছে। সকলেই চায় সিঁড়ি থেকে নেমে গাড়িতে উঠে বসতে। একটুও যেন হঁাটতে না হয়। এক দিন জায়গা খঁুজতে খুজতে আহিরী শেষ পর্যন্ত কলেজের পিছনে গিয়ে একটা শেডও খুঁজে পেল। তার ছোট গাড়িটা অনায়াসে রাখা যাবে। রোদ-জল লাগবে না। সমস্যা একটাই, গাড়ি রেখে খানিকটা হঁাটতে হবে। সে আর কী করা। যারা আগে থেকে আছে তারা তো সামনেই গাড়ি রাখবে। আহিরী সেই শেডের নিচেই গাড়ি রাখছে। এক বছর পর আজ হঠাৎ দেখছে, শেডের নিচে অন্য গাড়ি। যতই রাগ হোক, জায়গাটাকে ‘নিজের’ বলা যায় না। কলেজের জায়গা।
‘‘গোপালবাবু, আপনি কাউকে কিছু বলবেন না। শুধু কার গাড়ি খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবেন।’’
গোপাল রক্ষিত বলল, ‘‘আচ্ছা দিদি, জানাব।’’
আহিরী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মুখ ফিরিয়ে আবার বলল, ‘‘কাউকে কিছু বলবেন না যেন।’’
শর্মিষ্ঠা দত্তর কাছে যাওয়া হল না আহিরীর। পরীক্ষার সময় হয়ে গেছে। অফিস থেকে জানল, তার ডিউটি থ্রি বি-তে। মানে তিন তলায়। অফিসের কর্মচারী নির্মাল্য খাতা গুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘কী ম্যাডাম, পর পর চার দিন ডিউটি পড়ে গেল?’’
আহিরী ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘‘কী করব বলুন নির্মাল্যদা, জুনিয়র হওয়ার খেসারত দিচ্ছি।’’
নির্মাল্য গলা নামিয়ে বলল, ‘‘হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টকে বললেন না কেন? আর কারও তো পর পর ডিউটি পরেনি। মাঝখানে একটা দিন অফ পড়েছে। আপনার একার কেন পড়বে?’’
আহিরী বলল, ‘‘বলেছিলাম। উনি বললেন, এগজাম ডিউটি নাকি শর্মিষ্ঠা দত্ত নিজে দেখছেন। তিনি চেয়েছেন, আমি রোজ ডিউটি দিই।’’
নির্মাল্য বলল, ‘‘ও, তা হলে আর কী করবেন।’’
আহিরী দঁাতে দঁাত চেপে বলল, ‘‘ঠিক করেছি, আজ ওঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব। আমার কোয়ালিফিকেশনের কোন অংশটা দেখে ওঁর মনে হয়েছে, পরীক্ষা-হলে আমি ভাল গার্ড দিতে পারি? অনার্স-মাস্টার্সে ভাল রেজাল্ট করলে বুঝি এক দিনও গ্যাপ ছাড়া পরীক্ষা-হলে টহল মারতে হয়?’’
নির্মাল্য চাপা গলায় বলল, ‘‘অবশ্যই জিজ্ঞেস করুন। এ সব আর কিছুই নয়। বদমাইশি। দেখবেন এই মহিলা শিগগিরই খুব বড় ঝামেলায় ফঁাসবে।’’
পরীক্ষার মাঝখানেই গোপাল এসে খবর দিয়ে গেল, সাদা গাড়ি জিয়োগ্রাফির প্রমিত তরফদারের। এত দিন ড্রাইভার এসে ছেড়ে যেত, এ বার থেকে গাড়ি কলেজে থাকবে। আহিরীর বিরক্তি বাড়ল। সামান্য বিষয়, কিন্তু নতুন ফ্যাকড়া তো বটেই। দূর, আর গাড়িই আনবে না সে। ক্যাব ডেকে চলে আসবে। এমএ পাশ করার পর বাবাই গাড়ি চালানো শিখিয়েছিল। মায়ের আপত্তি ছিল। মা পুরনো বিশ্বাস-অবিশ্বাস থেকে বেরোতে পারে না। মেয়েদের সম্পর্কে তার মত হল, ‘‘লেখাপড়া শেখো, চাকরি করো, কিন্তু অতিরিক্ত লাফালাফি কোরো না। মনে রেখো, শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভাল একটা বিয়ে করে সংসারে থিতু হতে হবে।’’
একমাত্র সন্তান আহিরীকেও তিনি এই প্রাচীন বিশ্বাসে চালাতে চান। পারেন না। কলেজে পড়ার সময়েই সে মাকে বলে দিয়েছে, ‘‘মা, অনেক কাল বাঙালি মেয়েরা বসে বসে জীবন কাটিয়েছে, এ বার তাদের লাফাতে হবে। কত লাফ বাকি তোমার ধারণা আছে? সব সুদে-আসলে তুলতে হবে না?’’
‘‘যা গিয়ে লাফা। গোল্লায় যা।’’
আহিরী মায়ের দু-’কঁাধে হাত রেখে হাসিমুখে বলেছিল, ‘‘চিন্তা কোরো না, লাফ শুরু করে দিয়েছি। আজ কলেজে সিগারেট খেয়েছি। গোটা একটা সিগারেট। ছেলেরা বলেছিল, দু’টানেই কাশতে কাশতে মরে যাবি। একটুও কাশিনি। বাট ভেরি ব্যাড টেস্ট। আর খাব না। বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, আমার মুখের গন্ধ শুঁকে দেখো।’’
মেয়ে মুখ এগোলে নবনী ছিটকে গিয়েছিলেন। আহিরী হেসে বলেছিল, ‘‘এ বার তোমাকে আর একটা লাফানোর খবর দেব। পোল ভল্ট টাইপ। এই সামারে আমি আর কেমিস্ট্রির তপা যাচ্ছি জুলুক। তিব্বতের বর্ডার। জায়গাটা ছবির থেকেও একটু বেশি সুন্দর। গরমের সময়ে জুলুক রডোডেনড্রনে ছেয়ে যায়। আমি এবং তপা, আমরা দু’জনেই সুন্দরী এবং অ্যাট্রাকটিভ বলে কলেজের অনেক
ছেলে আমাদের সঙ্গে ভিড়তে চাইছে। তুমি শুনে খুশি হবে মা, আমরা তাদের মধ্যে দু’জনকে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে বেছে নিয়েছি। দু’জন মেয়ের সঙ্গে দু’জন ছেলে।’
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy