ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
আহিরীর মাথা গরম। যত সময় যাচ্ছে সেই গরম ভাব বাড়ছে। এখন দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। সকাল থেকে এই নিয়ে মোট তিন দফায় আহিরীকে মাথা গরম করতে হল। আহিরীর মনে হচ্ছে, এই ভাবে চলতে থাকলে বিকেলের দিকে তার মাথা থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। সুতরাং যা করবার বিকেলের আগেই করতে হবে। শর্মিষ্ঠা দত্তর ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতে হবে। তিনি যদি বলেন, ‘‘আহিরী, একটু পরে এস। আমি একটা জরুরি কাজের মধ্যে রয়েছি। তুমি বরং বিকেলের দিকে এস,’’ তখন বলতে হবে, ‘‘সরি ম্যাডাম। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব না। আমার কথা আপনাকে এখনই শুনতে হবে।’’
কটকটে রোদের মধ্যেই গাড়ি পার্ক করল আহিরী। পার্ক করতে বেশ অসুবিধে হল। বার কয়েক আগুপিছু না করে জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। গাড়ি থেকে বেরিয়ে সানগ্লাস খুলে গাড়ির দিকে তাকাল আহিরী। গাড়ির আদ্ধেকটা রোদে রয়ে গেছে। লাল টুকটুকে এই গাড়ি তার অতি পছন্দের। কলেজে চাকরি পাওয়ার পর কিনেছে। ব্যাঙ্ক লোন নিয়েছে। কমলেশ রায় মেয়েকে বলেছিলেন, দরকার হলে তিনি ডাউন পেমেন্টের সাপোর্ট দিতে পারেন। আহিরীর দরকার হয়নি। সে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকেই দিয়েছে। কমলেশ রায় বললেন, ‘‘ভেরি গুড। নিজের উপার্জনে কেনা গাড়ি কনফিডেন্সে থাকে। যা বলবি শুনবে।’’
আহিরী মিটিমিটি হেসে বলেছিল, ‘‘কী রকম কনফিডেন্স?’’
কমলেশ রায় সিরিয়াস মুখ করে বললেন, ‘‘এই ধর, মাঝপথে তেল ফুরিয়ে গেল, সে কিন্তু থামবে না। ঠিক কাছাকাছি কোনও পেট্রল পাম্পে তোকে নিয়ে যাবে। অন্য কারও গাড়ি হলে এই সুবিধেটা পেতিস না, তেল ফিনিশ, তার ছোটাছুটিও ফিনিশ।’’
আহিরী হেসে বলে, ‘‘উফ বাবা, তুমি না একটা যা–তা। আমি ভাবলাম কী না কী বলবে। তেল ফুরোলে গাড়ি চলে?’’
কমলেশ রায় বলেন, ‘‘আলবাত চলে, ভালবাসা থাকলেই চলে। গাড়ি তো কোন ছাড়, দুনিয়ায় কত কিছু ভালবাসা দিয়ে চালিয়ে দেওয়া যায় তার ঠিক আছে?’’
গাড়িটা সত্যি আহিরীর খুব প্রিয়। সেই গাড়িকে রোদ খেতে দেখে আহিরীর মেজাজ আরও বিগড়োল। গাড়ি লক করে ইট-বাঁধানো পথ ধরে হঁাটতে লাগল সে। এই সুন্দর দেখতে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালে এখন মনে হবে, কঁাচা আমের শরবত ভেবে ভুল করে সে খানিকটা নিমপাতার রস খেয়ে ফেলেছে। সেই কারণে চোখ মুখ কুঁচকে আছে।
চোখমুখ কঁুচকে থাকলেও আহিরী রায়কে সুন্দর দেখাচ্ছে। কে বলবে, বয়স তিরিশ শেষ হতে চলল? হঠাৎ দেখে এখনও ইউনিভার্সিটির ছাত্রী বলে ভুল হতে পারে। সে স্লিম এবং লম্বা। গড়পড়তা বাঙালি মেয়ের থেকে একটু বেশিই লম্বা। গায়ের রঙ ক্যাটক্যাটে ফরসা নয়, আবার কালোও নয়। তামাটে ভাব রয়েছে। তার মায়ের মতো। এ সবের থেকে বড় কথা, চোখ বু্দ্ধিদীপ্ত, ঝকঝকে। লম্বা গলা, তীক্ষ্ণ মুখে জেদ আর তেজ দু’টোই রয়েছে। এ ধরনের রূপে কমনীয়তা কম থাকবার কথা। আহিরীর বেলায় ঘটনা উলটো। তার উপস্থিতির মধ্যে এক ধরনের স্নিগ্ধতা রয়েছে। হালকা কিছু যোগব্যায়াম ছাড়া আহিরী এক্সারসাইজ বিশেষ কিছু করে না। এক বার জিমে ভর্তি হয়েছিল, বেশি দিন টানতে পারেনি। নিয়ম করে যাওয়া খুব কঠিন। প্রথমে সকালে ক’দিন গেল। ক’দিন পরে ঘুমই ভাঙত না। তার পর বিকেলের শিফট নিল। তাও হল না। কোনও না কোনও কাজে আটকে যায়। আহিরী রূপচর্চাতেও নেই। রাতে শোওয়ার সময় নাইট ক্রিম আর বিয়েবাড়িটাড়ি থাকলে এক বার পার্লারে ঢু মেরে আসা। ব্যস, তার ‘রূপ-লাবণ্যের রহস্য’ এখানেই শেষ। তার পরেও অনেকে মনে করে, এই মেয়ে মুখে যাই বলুক, শরীরের জন্য অনেকটা সময় খরচ করে। এ সব কথায় আহিরী মাথা ঘামায় না।
এ দিক থেকে কলেজের মেন বিল্ডিং-এ ঢুকতে হলে একটা হাফ সার্কল পাক দিতে হয়। তার পর কলেজে ওঠার চওড়া সিঁড়ি। কলেজ কম্পাউন্ডের ভিতরে জায়গা অনেকটা। বেশিটাই নেড়া। লন একটা আছে বটে, কিন্তু সেখানে ঘাসের থেকে আগাছা বেশি। ইট–পাথর, ছোটখাটো গর্ত-টর্তও রয়েছে। একটা সময়ে বাগান করা হত। এখন সে পাট চুকেছে। কলকাতায় এতটা জায়গা নিয়ে কলেজ খুব বেশি নেই। বাউন্ডারির বাইরে খেলার মাঠটাও বড়। পুরনো কলেজ বলেই এত বড় কম্পাউন্ড।
মুখে রোদ পড়ছে। আহিরী কপালের কাছে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করল। কলেজ কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়লে সে আর সানগ্লাস পরে না। ছেলেমেয়েরা থাকে। হয়তো ভাববে, ম্যাডাম ফ্যাশন করছে। শাড়ি আর সালোয়ারেও এক ধরনের পার্সোনালিটি মেনটেন করতে হয়। আহিরীর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, প্যান্ট-শার্ট পরে আসতে। অনেক সুবিধে, কমর্ফটেবলও। চটপট তৈরি হওয়া যায়। কত পেশাতেই তো মেয়েরা শার্ট, প্যান্ট পরছে। টিচাররা পারবে না কেন? আহিরী ঠিক করেছে, এক দিন প্যান্ট-শার্ট পরে দেখবে রিঅ্যাকশন কী হয়। সবে একটা বছর হয়েছে। আরও ক’টা দিন যাক।
এই এক বছরে আহিরী ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুবই পছন্দের হয়ে উঠেছে। তার বেশ কয়েকটা কারণও আছে। সব থেকে বড় কারণ হল, সে পড়াচ্ছে খুবই ভাল। আহিরীর নিজেরও ধারণা ছিল না, এতটা ভাল পারবে। বরং একটু ভয়ে ভয়েই ছিল। বড় কলেজ, অনেক ছেলেমেয়ে। এর আগে পার্ট টাইম যেখানে পড়িয়েছে, সেই কলেজ এর তুলনায় কিছুই নয়। কলকাতা শহরের মধ্যেও ছিল না। ট্রেনে করে যেতে হত। সেখানে ছোট ক্লাস। ম্যানেজ করাও সহজ ছিল। মেয়েরাও পরীক্ষা পাশ করার মতো নোটস পেলেই সন্তুষ্ট থাকত। এখানে গোড়ার দিকে ফঁাকিবাজ ছেলেমেয়েরা তার ক্লাসে ঢুকত না, এখন তারাও ক্লাস করতে চাইছে। কেউ চাইলে ক্লাসের পরেও পড়া বুঝিয়ে দেয় আহিরী। অনেকে স্পেশাল নোটস চায়, নতুন নতুন রেফারেন্স বইয়ের নাম চায়। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আহিরী মেশেও সহজ ভাবে। কলেজের বড় অকেশনে তো বটেই, ছেলেমেয়েরা ছোটখাটো কিছুতে ডাকলেও গিয়ে বসে থাকে। এই তো ক’দিন আগে ডিপার্টমেন্টে ডিবেট হল। আহিরী জাজ হয়েছিল। ডিবেটের মোশনও ঠিক করে দিয়েছিল। বুক নয়, ফেসবুক। খুব হইহই হল। ‘আহিরী ম্যাডাম’-এর বয়স তুলনামূলক ভাবে অন্য টিচারদের থেকে কম বলে ছেলেমেয়েরা তার কাছে হয়তো বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। সব মিলিয়ে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।
স্বাভাবিক ভাবে উলটো ফলও হয়েছে। কিছু কলিগ আহিরীকে হিংসে করে। আড়ালে বলছে, ‘‘নতুন তো, তাই বেশি ফরফরানি। গোত্তা খেয়ে পড়লে বুঝবে। এ রকম কত দেখলাম!’’ নানা রকম বাঁকা কথা। সামনেও এটাসেটা মন্তব্য। এরা বেশির ভাগই সিনিয়র। কেউ কেউ আবার কলেজের মাতব্বর। আহিরী না শোনার ভান করত। এত অল্প দিনে কিছু বলা ঠিক নয়। তবে গত মাসে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। সে দিন টিচার্স রুমে দুম করে কেমিস্ট্রির প্রফেসর অর্কপ্রভ সেন বলে বসলেন, ‘‘আহিরী, তুমি না কি কাল স্টুডেন্টস ক্যান্টিনে গিয়েছিলে?’’
দু–এক জন পার্ট-টাইমার বাদ দিলে আহিরী অধ্যাপকদের মধ্যে সবার থেকে ছোট। অধিকাংশই তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে। অর্কপ্রভ সেনের ষাট বছর হতে দেরি নেই। টিচার্স কাউন্সিলের মাথা। সব ব্যাপারে ওস্তাদি। শোনা যায়, টিচার ইন চার্জের সঙ্গে সঁাট আছে। আড়াল থেকে অনেকটাই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কন্ট্রোল করেন। সে দিন ভদ্রলোকের প্রশ্নের মধ্যে এক ধরনের শাসনের ভঙ্গি ছিল। এর আগেও উনি গার্জেনগিরি করেছেন। অনেকের ওপরেই করেন। তারা ভয়ে চুপ করে থাকে। আহিরীর কোনও দিনই পছন্দ হয়নি। তার পরেও কিছু বলেনি। সহ্য করেছে। সে দিন আর পারল না। উত্তর দিয়ে বসল।
‘‘স্যর, শুধু কাল তো নয়, আমি এর আগেও ওখানে গিয়েছি। মাঝেই মাঝেই যাই।’’
অর্কপ্রভ সেন ভুরু কঁুচকে বললেন, ‘‘তাই না কি! কেন যাও জানতে পারি?’’
আহিরী হেসে বলল, ‘‘স্টুডেন্টস ক্যান্টিনে চা–টা খুব ভাল। ছেলেমেয়েদের হুজ্জুতির ভয়ে বোধহয় ভাল করে বানায়।’’
অর্কপ্রভ ভুরু তুলে বললেন, ‘‘টিচার্স রুমের চায়ের থেকেও ভাল? স্ট্রেঞ্জ! যাই হোক, হতে পারে, তা বলে তুমি চা খেতে ছাত্রদের ক্যান্টিনে গিয়ে বসবে? মাধবকে বললেই তো সে এনে দিত। আমরা সকলেই নাহয় খেয়ে দেখতাম। নো নো, ওদের ক্যান্টিনে যাওয়াটা তোমার ঠিক হয়নি আহিরী। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে টিচারকে একটা ডিসটেন্স মেনটেন করতে হয়। নইলে ওরা মাথায় চেপে বসে। তা ছাড়া... তা ছাড়া এখনকার ছেলেমেয়েরা অ্যাগ্রেসিভ ইন নেচার, বিশেষ করে কলকাতা শহরের ছেলেমেয়েরা। কথায় কথায় স্ল্যাং ইউজ করাটা এদের কাছে কোনও ব্যাপার না। শিক্ষকদের সম্মান কী ভাবে দিতে হয় জানে না, জানতে চায়ও না। ছেলেমেয়েরা কী ভাবে মেলামেশা করে দেখো না? কম্পাউন্ডের ভিতর ঘাড়ে হাত দিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! ছি ছি! আমরা ভাবতেও পারতাম না। ওদের মাঝখানে গিয়ে বসাটা তোমার একেবারেই ঠিক হয়নি। কখন কী অপমান করে দেবে তার ঠিক আছে?’’
কথা শুনতে শুনতেই আহিরীর মনে হল, মানুষটাকে হালকা শিক্ষা দেওয়া দরকার। সে কোথায় যাবে না যাবে, এই লোক তা বলবার কে? চাকরিতে ঢোকার সময় কোথাও তো বলা ছিল না, শিক্ষকরা স্টুডেন্টস ক্যান্টিনে যেতে পারবে না! সে যখন কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, কত বার স্যর-ম্যাডামরা তাদের ক্যান্টিনে গিয়েছে। একসঙ্গে আড্ডা হয়েছে। সেই আড্ডায় টপিক হিসেবে সাহিত্য, থিয়েটার, সিনেমা এমনকী সেক্সও থাকত। ইনি কোন আমলে পড়ে আছেন?
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy