ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: রাকা ও সুমনের মেয়ে পিয়া জানতে চায়, তার বাবা-মা একসঙ্গে থাকে না কেন? নিরুত্তর রাকা। চিকিৎসা করাতে মালদা থেকে বনানী তার স্বামী বিলাসকে নিয়ে আসে শুশ্রূষা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। বনানীর সঙ্গে আসে তার পরিচিত অমলদা। শহরের ঝাঁ চকচকে হাসপাতাল দেখে মুগ্ধ বিলাস ও বনানী।
ওদিকে কোতায় যাচ্চ?’’ বনানী বলে, “বসো এখেনে...”
“আমি হাঁটতে পাইরব।”
“না পাল্লিও বা হাইটবে কেন? এতখানা টাকা দিলাম...” বনানী জোর করেই বিলাসকে বসিয়ে দেয় হুইলচেয়ারে। খয়েরি জামা পরা মহিলা মুখে প্লাস্টিক হাসি টাঙিয়ে বিলাসকে নিয়ে যায় লিফটের দিকে। পিছনে পিছনেই আসছিল বনানী। লিফটের মুখে আসতেই তাকে আটকায় গেটে দাঁড়ানো কালো প্যান্ট সাদা জামা পরা সিকিয়োরিটি মেয়েটা, “এটা পেশেন্টস লিফট ম্যাডাম... আপনি ও দিকেরটা দিয়ে যান।”
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
পেশেন্টস-লিফট ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না বনানী। মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝতে যাবে, ঠিক তখনই ওর সামনে দিয়ে বিলাসকে নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় লোহার তৈরি বিশাল চলমান বাক্স। বনানী হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। লিফট ব্যাপারটা ও জানে, সিনেমায় দেখেছে, এক বার বিলাসের সঙ্গে মালদার ব্যাঙ্কে গিয়ে চেপেওছে। কিন্তু পেশেন্টস লিফটটা ঠিক কী রকম হতে পারে, কেন সেখানে ওর যাওয়া চলবে না, কী ভাবেই বা যাবে বিলাসের কাছে, এই সব কথা ভাবতে ভাবতে আসছিল, এমন সময় অমলকে দেখতে পেয়ে একটু মনে জোর পায়। অমল ফর্ম জমা দিয়ে আবার একগুচ্ছ কাগজ হাতে করে দাঁড়িয়ে ওকেই খুঁজছিল।
“এগুনো কী গো তোমার হাতে? ওনাকে নে গেল তো ওপরে, তুমি সেই থেকে এ দিক পানে এলেনি।”
“শোন বনো, এগুলোয় তোর সই লাগবে। আর... আরও কিছু টাকা লাগবে বলল...সেটা অবিশ্যি পরে জমা দিলেও চলবে।”
“আবার টাকা ? কিসের জন্য?’’
“সমস্ত টেস্ট হবে তো। হার্ট লাংস কিডনি...’’
“হ্যাটের টেস তো হল দু’দফা। মালদায় করালাম। অই গিয়ে ইকো ইসিজি হটার মন্টার...”
“কী! ওওও... হল্টার মনিটরিং? তা ও সব পুরনো টেস্ট কি নেবে না কি এরা? এখানে সব আবার নতুন করে করতে হবে।’’
“অমলদা... ওনার তো হ্যাট নাকি ভালই আছে, পেটেই যত বেদনা। মালদায় বলেছেল লেভার নাকি ভাল লয় কো। তা সেইটাই তো দেখবে না কি? ও সব কিডনি মিডনি হ্যাট ম্যাট টেস করে কী হবে?’’
অমল আরও গম্ভীর হয়ে যায়। “এ সব ডাক্তারি ব্যাপার তো তুই আমি বুঝব না রে। আমি তো আগেই বলেছিলাম, অনেক খরচের ব্যাপার। তুইই জেদ করলি আসার জন্য।’’
“হয়েচে... হয়েচে! এখন আর কাসুন্দি ঘাত্তে বসনি বাপু। জ্যা লাগবে সে তো দিতি হবে। একন চল দেকি মানুষটাকে কোতায় নে গেল তার খবরটা নে আসি,” বলে হনহন করে আবার সেই আগের লিফটের দিকে এগিয়ে যায় বনানী।
“উহু... উহু... ম্যাডাম, এ দিকে না, এটা পেশেন্টস লিফট।’’
“হ্যাত্তেরি পেশেন লিফ... ও অমলদা...”
“এ দিকে আয়,” অমল সামনের করিডরের দিকে এগিয়ে যায়। পিছনে বনানী। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে আবার বাধা। গেটে দাঁড়ানো মেয়েটি হাত নেড়ে আটকে দেয় ওদের।
“এ কী, এ দিকে কোথায় যাচ্ছেন? এখনও ভিজ়িটিং আওয়ার্স শুরু হয়নি। ন’টা থেকে।’’
“অ্যাকুন সাড়ে আটটা। আমার ওনাকে নে গ্যাছে ভেদরে, এক বার দেকতে পাবো না?’’
“আপনাদের কাছে কি অলটাইম কার্ড আছে?’’
“কী কাড? এই অ্যাত্তোগুনো টাকা দে ভত্তি কল্লাম, আবার কাড কী থাকবে?’’
“আঃ! ব্যাপারটা বুঝছেন না,’’ সিকিয়োরিটি গার্ড হাল ছেড়ে দেয়, “আচ্ছা আপনারা রিসেপশনে যান, ওখানেই পাশের হেল্প ডেস্কে গিয়ে বলুন, ওরা কার্ড করিয়ে দেবে।’’
বনানী লিফটে ঢুকবেই। সে জেদি গলায় বলে, “বলছি এইমাত্তর এক গাদা টাকা দে এয়লম ওকেনে, এ বার তো মানুষটার কাছে যাবার লাগে ...”
অমল ডাকে পিছন থেকে। যদিও এ রকম জায়গায় সে নিজেও আগে আসেনি, তবু সহজাত বুদ্ধি দিয়ে সে কিছুটা বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। “বনো এ দিকে আয়, কিছু ক্ষণ পরেই না হয় যাব ওপরে, ওদের টাইম হোক।”
“ওদের আবার টাইম কী? ঘরের মানুষ ভত্তি করিচি তাকে দেকতে যাব ব্যস। মালদার হস্পিতালে ইসব টাইম-ফাইম ছিল না কো।’’
“না রে সেটা ঠিক নয়। ভিজিটিং আওয়ার্স সব জায়গায় থাকে। সবাই সেটা মানে না ঠিক মতো। এখানে খুব কড়াকড়ি। চল কার্ড করিয়ে আনি।’’
ক্ষুণ্ণ মনে অমলের সঙ্গে সঙ্গে এগোয় বনানী, ‘‘কাড মাড কত্তে আবার গুচ্চ টাকা লাগবে না তো?’’
বনানীর কথা শুনে মনের মধ্যে একটা আফসোস টের পায় অমল। ভুল করে ফেলল সে। বনানীকে কোথাও বসিয়ে রেখে কার্ডটা করিয়ে আনলে হত, শ’পাচেক টাকা কামাই হয়ে যেত এই তালে। এখন আর কিছু করার নেই। তির হাত ফস্কে গিয়েছে। পিছন পিছনই আসছে বনানী। যাই হোক, এর পর থেকে মাথা খাটিয়ে চলতে হবে। একটাও দান মিস করা চলবে না। মনের ভাবনা মনে চেপে রেখে আরও দায়িত্বশীল গলা বার করে অমল, ‘‘না রে বাবা না। কথায় কথায় টাকা চাইলেই কি হল না কি? আমরা জেলায় থাকি বলে কি কিছুই বুঝি না?’’
নরম সোফায় বসে, ঠান্ডা হাওয়া খেয়ে আর এ দিক-ও দিক তাকিয়ে যখন ঘড়ির দিকে তাকায় বনানী, তখন ভিজ়িটিং আওয়ার্স দশ মিনিট পার হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ কানে আসে নিজের নাম, বিলাসের নাম। গমগম করে ওকে ডাকা হচ্ছে পেশেন্ট বিলাস পালের বাড়ির লোক হিসেবে। উপরে যেতে বলছে। কোথা থেকে ডাকটা ভেসে আসছে বোঝা যায় না। কোথাও মাইক দেখা যাচ্ছে না, শুধু পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে যে ডাকছে। অমলদা আবার এই সময়েই বাইরে কোথাও গেল। পোড়া পেটে কত বালতি বালতি চা যে খেতে পারে! বনানী নিজেই এ বার জায়গা মতো চলে আসে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে। এ বার আর সিকিয়োরিটি গার্ড বাধা দেয় না। শুধু লিফটের বাটন টেপার আগে জিজ্ঞেস করে, “কোন ফ্লোর?’’ বনানীর মনে ছিল।
“থাড ফোর। মেলোয়াড, বিছানা ফিটিটু,’’ এইটুকুতেই কাজ চলে যায়। বনানীকে নিয়ে উঠে যায় লিফট।
সেই কোন কালে স্কুলে শিখেছিল, সেই বিদ্যেটা কাজে লেগে গেল। লিফটের দরজার মাথায় পর পর ফুটে ওঠা ওয়ান টু থ্রি দেখে দেখে থার্ড ফ্লোরে নেমে পড়ল বনানী। লম্বা বারান্দার দু’পাশে সারি সারি ঘর, কালো গ্রিলের কাজ করা বসার চেয়ার, পেতলের বড় বড় কলসির মতো ফুলদানি, তাতে রকমারি বাহারি গাছ, চকচকে আয়নার মতো মেঝে দেওয়াল— সব গোল গোল চোখে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলে বনানী। ‘‘উরে বাবরে বাব... এ কি হস্পিতাল, না কি রাজার বাড়ি?’’ নিজেই বিড়বিড় করতে থাকে বনানীর। জেলা হাসপাতালের গরিবিয়ানাতে অভ্যস্ত তার চোখে প্রবল বিস্ময়! এমন সময় আবার কানে আসে নিজের নাম, বিলাসের নাম। সামনে এক জন নার্সকে দেখে জিজ্ঞেস করে ও, ‘‘এই যে ডাকতেছে, আকুন কোতায় যেতি হবে।’’ নার্সটি মেল ওয়ার্ড দেখিয়ে দিয়ে চলে যায়। ভিতরে ঢুকেই দেখতে পায় বনানী, হাত দশেক দূরে একটা বেডে বসে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে সবুজরঙা আলখাল্লা পরা বিলাস। বনানী গিয়ে কাছে দাঁড়াতেই ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে শুরু করে অত বড় মানুষটা।
“কী হইয়েচে? কানতে নেগেচো কেন?’’ বনানী অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“আমি আর বাঁচব না বনো। খুবি ভারী অসুক হইয়েচে আমার,’’ বিলাস নাক টানতে টানতে বলে।
“আ মোলো যা ... বাঁচবনি বইলেই হল না কি? অ্যাদ্দূর অ্যাত্ত খচ্চাপাতি করে কোলকেতা নে এয়লম বাঁচানোর জন্যি তো? না কি মরার জন্যি? মরার হলি তো গজাননপুরেই মত্তি পাত্তে!’’
নার্স এসে সামনে দাঁড়ায়, “ম্যাডাম, আপনাকে এক বার ডক্টরের সঙ্গে দেখা করতে হবে, সে জন্যই ডাকা হচ্ছিল।’’
“চলেন...”
“আপনি একটু ওয়েট করুন। উনি পাশের ওয়ার্ড থেকে কেবিনে ফিরবেন এখনই।’’
বনানী দাঁড়িয়ে থাকে বিলাসের বেডের পাশে। ভাবে, মানুষটা সকালেও এত ভয় পায়নি। কাল রাতে শিয়ালদহ স্টেশনে এসে একটা হোটেলে ছিল ওরা। ভোর হতে না হতেই ট্যাক্সি করে এখানে চলে এসেছে। তখনও হাসিখুশি ছিল। হাসপাতাল দেখে তো কত্ত খুশি হল। ওপরে আসার পরে যেন মুখে কে কালি মেরে দিয়েছে। বয়সে প্রায় পনেরো বছরের বড় স্বামী শরীরের সুখ কোনও দিনই দিতে পারেনি বনানীকে। তাই হয়তো পাড়ায় ছেলে-ছোকরাদের দিকে মাঝেমধ্যে নজরও চলে যায় তার। একটু
হাসি-তামাশা, ঠাট্টা-ইয়ার্কি, ছলে ছুতোয় গা ঘেঁষাঘেঁষি— এই সামান্য সামান্য পদচ্যুতিতে আনন্দ পাওয়ার বদভ্যেস তৈরি হয়েই গিয়েছে খানিক। তবে না খেতে পাওয়া ঘর থেকে এসে অঢেল খাওয়াদাওয়া আর স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে বিলাসের উপর এক ধরনের কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি হয়েছে বনানীর। আর সত্যি কথা বলতে কী, মানুষটা মন্দ নয়। শখ মেটানোর টাকাপয়সাও দেয় হাত খুলে। নির্ভর করে বনানীর উপরে। সারা ক্ষণ মুখে শুধু ‘বনো’ আর ‘বনো’। বনানীর খানিক মায়াও পড়ে গিয়েছে। তাই এত বিলিব্যবস্থা করে এই পর্যন্ত টেনে আনা। যাতে সুস্থ হয়ে ওঠে, ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরতে পারে।
ভালই ছিল বিলাস। খাচ্ছিল দাচ্ছিল। নিজের কাজকর্ম নিয়ে মেতে ছিল। হঠাৎ কী রোগে ধরল! কিচ্ছু খেতে পারে না। যা পেটে যায় উগরে দেয়। এক মাসের মধ্যে চেহারা অর্ধেক হয়ে গেল। মালদাতে যে ক’জন ডাক্তার দেখেছে, বলেছে লিভারের দোষ। লিভার যে কী বস্তু তা মাথায় ঢোকে না বনানীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy