Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৪

পরিক্রমণ

অনেকটা সময় বাজে খরচ হয়ে গেছে, খেয়াল হয় বরেনবাবুর। হাতের ফাইলে মাথা গুঁজে দিয়ে সমাপ্তিসূচক সুর টানে সে।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু অধিকারী
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: অরুণ অনন্তকে জানিয়ে দেয়, সে পারবে না বিনা কারণে কোনও রোগীকে অপারেশন করতে। অরুণের কথা শুনে অনন্ত তাকে মনে করিয়ে দেয় হাসপাতাল তৈরির সময় অনন্তর কাছ থেকে অরুণ আঠেরো লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিল। অরুণ জানিয়ে দেয় যে করে হোক সে টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই অনন্তর কাছ থেকে অরুণ জানতে পারে, তার ক্লাসমেট অভিরূপ বিনা কারণে অপারেশনের কেসে জড়িয়ে পড়েছে।

কী বলছ পাগলের মতো? যাও তোমার চেম্বারে যাও।’’

“হ্যাঁ, তা তো যাবই। কিন্তু তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে, হাসছিলে সেটা আগে শুনি... তার পর তাকে না ঝেড়ে কাপড় পরাচ্ছি তো আমার নাম বিপাশা সাহা নয়।’’ এ বারে গলার স্বর আরও একটু উঁচু স্কেলে। অরুণ এক পা এগিয়ে আসে বিপাশার দিকে। কানের কাছে মুখ এনে বলে, “তুমি কেবলই ভুলে যাও কেন

যে তোমার নামের আগেও ইনসিডেন্টালি একটা ‘ডক্টর’ আছে?’’

কিছুই মাথায় ঢোকেনি বিপাশার। সে নাক চোখ কুঁচকে তাকায়, “মানে?’’

অরুণ হাসে, “মানে? না... মানেটা আর তুমি এ জীবনে বুঝবে না।’’ বিপাশার উত্তরের অপেক্ষা না করে পায়ে পায়ে ওয়ার্ডে ঢুকে যায় অরুণ।

কাল থেকে আমার নতুন জামাপ্যান্ট হয়েছে। কালো জামা সাদা প্যান্ট। ওরা উল্টোটাই দিতে চেয়েছিল। বলল এখানকার ড্রেস নাকি কালো প্যান্ট সাদা জামা। কিন্তু আমার মনে হল ওই একই রং থাকুক, কিন্তু পাল্টে যাক উপর-নীচের ছন্দ। দেখাই যাক না কী হয়। মাথার ওপর ছাদটাই ভেঙে পড়ে না কি বাইপাস থেকে সমস্ত গাড়িগুলো রাস্তা ভুলে গিয়ে একসঙ্গে এসে এই কাচের দেওয়ালে মোড়ানো বিশাল লাউঞ্জে গুঁতোগুঁতি করে ঢুকে পড়ে। আমি যখন আমার এই এক্সপেরিমেন্টের বাসনা ওদের কাছে মুখ ফুটে বললাম, তখন প্রথমটা ওরা খুব একচোট হাসাহাসি করল আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ওদের মধ্যে একটা খুব সুন্দর মেয়ে ছিল, যাকে একদম সুরতিয়ার মতো দেখতে, যার নাম সুছন্দা। সে সব্বাইকে ধমকে থামিয়ে দিল। তার পর আমাকে নিয়ে গেল এক জন ভদ্রলোকের কাছে, যিনি শুনলাম এখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দেখাশোনা করেন, বরেনবাবু না কী যেন নাম। সেই বরেনবাবু কিন্তু একটুও হাসলেন না আমার কথা শুনে। গম্ভীর মুখে সুছন্দার সঙ্গে কিছু ক্ষণ কথা বলে, হাতের ফাইলে কী যেন নোট লিখে, কাকে যেন ফোন করে অনুমতিটা দিয়ে দিলেন। তার পর আমার মাপ নিল আর একটা দাড়িওলা লোক। আর কী মজার কাণ্ড, তার দু’ঘণ্টার মধ্যেই সেই সুছন্দা মেয়েটি আমার হাতে ধরিয়ে দিল কালো জামা সাদা প্যান্ট।

তো, আমি এখন সেই ড্রেস পরে আছি। আমার জায়গা হয়েছে দুটো দেওয়ালের কোনায়, একটু মঞ্চ মতো উঁচু জায়গায় একটা বেশ গদি আঁটা চেয়ারে। সেই ছোট্ট মঞ্চের সামনেটা কয়েকটা ফুলের বাহারি টব দিয়ে হাফ সার্কল করে ঘেরা। মাঝে একটা ছোট্ট স্ট্যান্ডে পেতলের ফলকে লেখা, মিউজ়িকাল হিলিং কর্নার। বাংলায় লেখা, সুরের ঝরনাধারা। আহা, ভারী সুন্দর আমার এই বসবার জায়গাটুকু। এখানে বসে আমিও সবটা দেখতে পাচ্ছি, আবার আমাকেও সবাই দেখছে। আর এখানে বসে আমার কেবলই গান পাচ্ছে, কেবলই গান পাচ্ছে।

আমার তো গলায় সুর নেই। যখন গানের স্রোত আমার মনকে দোলায় তখন কেমন যেন আঙুলগুলো সুড়সুড় করে। কেমন অস্থির অস্থির লাগে। দৌড়ে অনেকটা দূর ঘুরে আসতে ইচ্ছে করে। সুরতিয়া বুঝত এই অবস্থাটা। এ রকম হলেই সে আমার হাতে বেহালাটা ধরিয়ে দিত। আমি আপন মনে ছড় টানতাম আর আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে যেত সব অস্থিরতা। আজ তো আমি এখানে চাকরি করতে এসেছি। তাই চাকরির শর্ত অনুযায়ী নিজেই বেহালা নিয়ে এসেছি। চারপাশের মানুষজন প্রথমে আমাকে তেমন খেয়াল না করলেও ধীরে ধীরে আমায় ঘিরে ভিড় জমছে।

আমি ওদের দিকে হাসি-হাসি মুখ করে অনেক ক্ষণ বাজালাম। সব চেয়ে ভাল লাগছে মাঝে মাঝে ব্যস্ত পায়ে সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া ওই সুছন্দা মেয়েটিকে দেখতে। এখানে অনেক মেয়ে কাজ করছে দেখছি। কিন্তু তারা সব আলাদা। গটগট করে হাঁটছে, ফটফট করে ইংরেজি বলছে। কিন্তু এই মেয়েটার কাজলটানা শান্ত চোখে আর ধীরে ধীরে হেঁটে যাওয়ায় একটা স্নিগ্ধ ভাব আছে। কথা বললে কত মায়া ঝরে, ঠিক সুরতিয়ার মতো। আমি যদি এখানে বাজাই তো এই মেয়েটির জন্যই বাজাব। সে চাকরি বললে চাকরি, আর ইচ্ছে বললে ইচ্ছে। এত দিন এই অঞ্চলে আছি, কখনও তো দেখিনি ওকে। আজই সকালে প্রথম দেখলাম, অথচ মনে হচ্ছে যেন কত কালের চেনা। ওকে দেখতে দেখতে আমার সামনে থেকে সব মুছে যাচ্ছে। আর কেউ সামনে নেই, শুধু ও একাই যেন এই বিশাল হলঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু সেই হাসি উদ্দালক শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে, কোনও শঙ্কা পাগলার দিকে নয়। ঠিক সুরতিয়া যেমন হাসত।

“কী মনে হচ্ছে সুরেশ? মিউজ়িকাল হিলিং কর্নারের আইডিয়াটা জমবে? এরই মধ্যে কত লোক বসে গেছে দেখেছ?’’ সিসি টিভির পর্দায় চোখ রেখে বরেনবাবু বলে। সুরেশ বরেনের আন্ডারেই কাজ করে। এখানে ব্যাক অফিস, অ্যাডমিশন, অ্যাকাউন্টস, হাউসকিপিং, ক্যান্টিন সব মিলিয়ে তিয়াত্তর জন কাজ করে। হাসপাতালের বয়স মাত্র তেরো বছর। সেই তুলনায় স্টাফ সংখ্যা বেশি। কিন্তু এই মুহূর্তে কাজের যা প্রেশার, তাতে আরও পনেরো-কুড়ি জন লোক দরকার সব বিভাগে। নার্সিং বা মেডিকেল স্টাফ আলাদা। এই তিয়াত্তর জনের মাথার ওপর আছে বরেনবাবু। সুরেশ ছেলেটি নতুন। হাবড়া থেকে আসে। চালাকচতুর ছেলে, কাজ শেখার আগ্রহ আছে। তাই ওকে নিজের কাছে রেখেছে বরেন। হাতে-কলমে শেখাচ্ছে সব। সুরেশ মন দিয়ে শুনছিল বাজনাটা। এ বার রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালে তালে মাথা দোলায়। তার পর বরেনবাবুর আচমকা প্রশ্নে থেমে গিয়ে তাকায় তার দিকে।

“এটা একেবারে ইউনিক ব্যাপার। বাইপাসের কোনও হাসপাতালে নেই।’’

“বাইপাস কী বলছ, কলকাতার কোথাও নেই। গোটা বেঙ্গলেই নেই। আইডিয়াটা কার বল তো?’’

দু’দিকে মাথা নাড়ে সুরেশ।

“ডক্টর মুখার্জির। উনি ইউরোপে কোনও একটা হাসপাতালে দেখে এসেছেন। লাস্ট উইকে আমাকে ডেকে বললেন। তার পরেই সোমবারের বোর্ড মিটিংয়ে পাশ হয়ে গেল মিউজ়িশিয়ানের পোস্ট।’’

সুরেশ বলব না-বলব না করেও জিজ্ঞেস করেই ফেলে পেটের মধ্যে গুড়গুড় করতে থাকা কথাটা।

“পাশ হয়ে গেল? তবে যে শুনছিলাম এখন একটু সমস্যা চলছে ওঁর?”

“আরে ও সব সমস্যা আর কতটুকু? এখনও তো এফআইআর-এ নাম যায়নি, এখনও উনিই চেয়ারম্যান। ওঁর কথাই শেষ কথা।”

কিছু বলতে যাচ্ছিল সুরেশ। কিন্তু বরেন মুখ এগিয়ে আনে সুরেশের কানের কাছে। ফিসফিস করে বলে, “তবে হ্যাঁ, যদি এফআইআর-এ নাম ঢুকে যায়, তখন কী হবে কেউ বলতে পারে না।’’

“সেই চান্স আছে না কি?’’

অনেকটা সময় বাজে খরচ হয়ে গেছে, খেয়াল হয় বরেনবাবুর। হাতের ফাইলে মাথা গুঁজে দিয়ে সমাপ্তিসূচক সুর টানে সে। “কী করে বলি বল তো... বড় বড় বাঁদরের বড় বড় ল্যাজ... আমরা আদার ব্যাপারি, জাহাজের খবরে আমাদের কাজ কী? তা ছাড়া এক চেয়ারম্যান গেলে আর এক চেয়ারম্যান আসবে। চেয়ার তো আর ফাঁকা থাকবে না। নাও নাও, ওই বাঁ দিক থেকে লাল ফাইলটা নামাও দেখি...’’

সুরেশ আদেশ পালনে পটু। সে সঙ্গে সঙ্গেই ফাইল এনে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু নিষিদ্ধ আলোচনার চরিত্রই হল, তা চট করে থামাতে মন চায় না। সেও ফিসফিস করে বলে, “আমি কিন্তু শুনলাম এই যে শঙ্কা পাগলাকে গেট থেকে ধরে এনে চাকরি দেওয়া হল, এটা ডক্টর বেরা এবং ডক্টর কুলকার্নির খুব একটা পছন্দ হয়নি।’’

বরেন হাতের ফাইলে মনোনিবেশ করতে পারে না আর। “তাই নাকি? তুমি কী করে জানলে?”

সুরেশ একটু লজ্জা লজ্জা হাসে, “ক্যান্টিনের ছায়া বলছিল। লাঞ্চ দিতে গিয়েছিল ডক্টর বেরার চেম্বারে, তখনই শুনে এসেছে। ডাক্তারবাবুরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন।’’

“হুম... তা এত লোক থাকতে ছায়া তোমাকেই বা গোপন কথা বলে কেন হে?’’

হেসে ঘাড় চুলকায় সুরেশ, “না... মানে আমাকে একটু স্নেহ করে কিনা।”

“হা হা হা হা... স্নেহ করে? তোমার হাঁটুর বয়সি মেয়ে কিনা তোমাকে স্নেহ করে। বুঝেশুনে পা ফেলো হে ছোকরা!’’

“আমি যাই? একটু চা খেয়ে আসি?’’ লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে বলে সুরেশ।

“যাও। তাড়াতাড়ি ফিরবে। ফিরে লাস্ট মান্থের প্যাথলজির অ্যাকাউন্টস নিয়ে বসবে।’’ গম্ভীর গলায় বলে বরেন।

অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে পরচর্চায়। এ বার হাতের ফাইলে মন দিতেই হবে। এখানে কাজের পাহাড়। এক দিন ফাঁকি দিলেই পরের দিন আর দম ফেলতে পারা মুশকিল। তার ওপর নিত্যনতুন সমস্যা লেগেই আছে। যাই ঘটুক, যত কিছু তোলপাড় হয়ে যাক, নিজের চেয়ারটা আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে, নিজের আখেরটুকু গুছিয়ে যেতে হবে— এই সার সত্যটুকু বুঝেছে বরেন। কিন্তু এত কিছু বুঝেছে বরেন আর এটা তার পাকাপোক্ত মাথায় ঢোকে না যে শেকড় বাঁচলে তবেই গাছ বাঁচে। তাই নিশ্চিন্ত মনে ফাইলে চোখ রাখতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy