ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: অরুণের মুখে তিয়াষার কথা শুনে মনে মনে ভেঙে পড়ে অভিরূপ। নিজের এই ঈর্ষায় নিজে চমকে যায় সে। ভাবতে থাকে, স্ত্রী চুমকির প্রতি সে তো এই অনুভূতি প্রকাশ করে না! এ দিকে কোনও এক অজানা কারণে তিয়াষা পিয়াসের উপর ভীষণ রেগে যায়। সে পিয়াসের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। পিয়াস তার কাছে ক্ষমা চায় বারবার। অনুরোধ করে তাকে ছেড়ে না যাওয়ার জন্য।
প্লিজ় ও রকম করে বোলো না, আমি তো বলছি আর হবে না,’’ তিয়াষার হাত ধরে কাতর হয়ে বলে পিয়াস।
“শোন, শান্ত হয়ে শোন... ছটফট করিস না। আমি কাউকে আনি না বা এত দিন আনিনি সেটা আলাদা কথা। আমি প্রাপ্তবয়স্ক। আমার গেস্ট এলেই যদি তোর এই রিঅ্যাকশন হয় তবে তো আমার সম্মানহানি হবে। তিনি অপমানিত হবেন। তাই না? তাই আমার মনে হয়, আমার এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দেওয়াই উচিত। এটাই সব দিক দিয়ে ঠিক হবে। এটা কোনও রাগারাগির ব্যাপারই নয়,’’ একটা একটা করে সুচিন্তিত শব্দ প্রয়োগ করে তিয়াষা। একটুও খেয়াল করে না যে ওর বলা প্রতিটি কথার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে সাদা হয়ে যাচ্ছে পিয়াসের মুখ।
“এই প্রথম আমার গেস্ট এল। তুই দেখলি, সে আমার ঘরে বসে আছে। কিন্তু সে কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা তোর অজানা নয়, আমার পার্সোনাল স্পেসে আমি আমার অতিথির সঙ্গে কী ভাবে মিশব বা বসব তা নিয়ে নিশ্চয়ই তোর ইন্টারফিয়ারেন্স আমি সহ্য করব না,’’ এক নাগাড়ে বলে যায় তিয়াষা। পিয়াস স্কুলের ছেলের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়েও থামতে পারে না তিয়াষা।
আজ বিকেলে অফিসের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় চোখ পড়েছিল উল্টো ফুটে দাঁড়ানো বিশাল গাড়িটার দিকে। অভিরূপ গেটের দিকেই তাকিয়ে ছিল চাতক পাখির মতো। বেড়ে যাওয়া হার্টবিট সামলে এগিয়ে এসেছিল তিয়াষা।
“এ কী? এখানে? কোন কাজ ছিল?’’
ধরা পড়ে যাওয়া ছাত্রের মতো হেসেছিল অভিরূপ।
“আপনি হাসপাতালে যাননি? এখন তো ওখানে থাকার কথা! আর, এখানে সময় নষ্ট না করে আমাকে একটা কল দিলেই তো হত।’’ তিয়াষা তীব্র হয়।
“আমি অরুণ সাহার কাছ থেকে আসছি। তুমি সে দিন বললে ওর সঙ্গে এক বার আলোচনা করতে। সে সব কথাগুলো তোমাকে তো জানানো দরকার। তা ছাড়া এ দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম...’’
“ওহ... গিয়েছিলেন অরুণদার কাছে? তা হলে তো আর কোনও অসুবিধে নেই। উনি আপনার যা ভক্ত, জান লড়িয়ে দেবে। পুরো ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন এ বার আপনার পাশে দাঁড়িয়ে পড়বে। কুলকার্নিরা পালানোর পথ পাবে না দেখবেন,” খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে খুশি খুশি মুখে কথাগুলো বলতে বলতে নিজেই গাড়ির সামনের দরজা খুলে এসে বসেছিল তিয়াষা। কথাগুলো যার ভাল চিন্তা করে বলা হচ্ছে, এক বারও খেয়াল করেনি তার মুখের ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া চকিত কালো ছায়া। গাড়ি স্টার্ট করে কিছুটা এলোমেলো পথ এগোয় অভিরূপ। তিয়াষা কলকল করে সমানে কথা বলেই চলেছে, কোনও দিকে তার মন নেই। আসলে অপ্রত্যাশিত এই সঙ্গলাভ তাকে অনেক বেশি মুখর করে তুলেছে। সেটা বোঝার মতো মনের অবস্থা নেই অভিরূপের। তিক্ত হেসে অভিরূপ তিয়াষার নানান কথার উত্তরে একটা সামঞ্জস্যহীন কথা বলে বসে, ‘‘অরুণ সাহার সঙ্গে এত দিনের পরিচয়, সেটা আগে বলতে পারতে।’’
“কী!” তিয়াষা থমকে গিয়ে বড় বড় চোখ মেলে তাকায় এত ক্ষণে। পাশে বসা মানুষটির বুকের ভিতরের পাতাটা যেন হঠাৎই কিছু সন্ধে হাওয়ায় খুলে মেলে যায় ওর চোখের সামনে। হাসি চেপে ও তাকিয়ে দেখছিল অভিরূপের থমথমে মুখটা। তার পরই গাড়ির গতিপথ পাল্টে গিয়েছিল মনের গতির সঙ্গে সঙ্গে। তিয়াষা অভিরূপকে নিয়ে এসেছিল ফ্ল্যাটে। অভিরূপকে দেখে বোঝা যায়নি কিছু। খুব স্বাভাবিক সাধারণ ভাবে এসে বসেছিল ও। কিন্তু তিয়াষা তখন আর নিজের মধ্যে ছিল না। সেই ইন্টারভিউয়ের দিন থেকে যে চোখদু’টো দিনে রাতে, সময়-অসময়ে তাড়িয়ে বেড়ায় ওকে, সেই দুটো স্বপ্নের চোখকে চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে নিজের খুব কাছে পেয়ে মুহূর্তেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল।
গরম কফির কাপের থেকে ওঠা বাষ্পে মিশে মিশে যাচ্ছিল ওর বেপথু শরীরের ভেঙে পড়তে চাওয়া ইচ্ছের ঢেউগুলো। সেই ঢেউগুলো অবশেষে আলতো আঙুলে ছুঁয়েছিল অভিরূপ। দুপুর থেকে মনের ভিতর গুমরে থাকা অব্যক্ত অভিমানের মেঘ একটু একটু করে পাল্টে গিয়েছিল অকালবর্ষণে। সে বৃষ্টি দুটো শরীরকে ভিজিয়ে ছাপ ফেলেছিল বিছানার চাদরে জানালার পর্দায় টেবিলের ঢাকনায়। চোখের পাতা ছুঁয়ে নেমে আসা প্লাবন আর এ যাবৎ বয়ে ফেরা যত ইচ্ছেপাখির ডানা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তার পর এক সময় সাঙ্গ হয়েছিল দেওয়া-নেওয়ার পালা। থেমে গিয়েছিল ঝড়। শুধু বিধ্বস্ত পাখির মত ক্লান্ত শরীর দু’টো বিস্রস্ত ভাবে নিজেদের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছিল কান পেতে।
আর ঠিক তখনই সেই কানের পাতায় আছড়ে পড়ল বাজ পড়ার শব্দ। ছিন্ন হয়ে গেল কিছু আগের নৈঃশব্দ্য জুড়ে থাকা মোহময় অন্ধকার। ছিঁড়ে গেল সমস্ত সুর তাল লয়।
পিয়াস কখন এসেছে জানতে পারেনি ওরা। কত ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছে দরজার পাশে একটুও বোঝা যায়নি। কী দেখেছে কতটা দেখেছে সে প্রশ্ন অবান্তর। শুধু দড়াম করে পাল্লা দুটো বন্ধ করে জানিয়ে দিয়েছে ওর অসময়ের উপস্থিতি। কাঠ হয়ে আধশোয়া তিয়াষা টের পেয়েছে, বাইরে চলে গেল পিয়াস।
সত্যি যদি সেই মুহূর্তে চলে যেত তো সেটাই উচিত কাজ হত পিয়াসের। কিন্তু অভিরূপ তিয়াষা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার ঝড়ের মতোই এসে ঢুকেছিল ঘরে। আঙুল তুলে মুখ বিকৃত করে অভিরূপের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “ডক্টর অভিরূপ মুখার্জি, দিস ইজ ইয়োর কালচার? দিস ইজ ইয়োর হিউম্যানিটি? এক জন মহিলাকে একা পেয়ে...’’ কথা শেষ করতে না দিয়ে, তিয়াষা আগেই পাগলের মতোই ছুটে এসে পিয়াসকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছিল, “কী বলছিস? চুপ কর। উনি... উনি আমার গেস্ট...”
পিয়াস থামেনি। চোখ লাল করে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিয়েছিল তিয়াষাকে, “গেস্ট কারও বাড়ি গিয়েই হোস্টকে নিয়ে শুয়ে পড়ে এমন শুনেছ কোথাও? উনি একটা নোংরা লোক...’’
আর দাঁড়ায়নি অভিরূপ। শুধু চলে আসার আগে তিয়াষাকে বলেছিল, “এই ফ্ল্যাটে আমায় আনার আগে তোমার চিন্তা করা উচিত ছিল। তোমার এমন এক জন অভিভাবক আছে এখানে, এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। কিন্তু... যা ঘটেছে সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর তার জন্য আমি একটুও স্যরি নই। তুমি যদি এখানে থাকতে না চাও বা শিফট করতে চাও, আমাকে ফোন কোরো।’’
তার পরেও অনেক ক্ষণ স্থাণুর মতো বসে ছিল তিয়াষা। বসে বসেই ঠিক নিয়েছে, আর এখানে থাকবে না ও। কয়েকটা মুহূর্ত, কয়েকটা ছুড়ে দেওয়া শব্দ, কিছু অসতর্ক আচরণ কী ভাবে পাল্টে দেয় মনের আর জীবনেরও গতিপথ। মাত্র দু’ঘণ্টা আগেও যে মনটা ভরে ছিল খরাদীর্ণ মাটিতে প্রথম বারিবর্ষণের নিবিড় সিঞ্চনে, সেখানে অপ্রত্যাশিত তিক্ততায় জিভের ডগা পর্যন্ত কুঁচকে গিয়েছে, যেন ফুলের বনে মত্ত হাতির মদমত্ত তাড়নার প্রকাশ ঘটেছে তিয়াষার মনের ভিতরে। যতই বাইরে শান্ত থাকার চেষ্টা করুক, যতই ওকে দেখে বোঝা না যাক, সবটা মিলিয়ে খুব বিচ্ছিরি লাগছে ওর। নিজের ওপরে রাগ হচ্ছে এত দিন এখানেই থেকে যাওয়ার জন্য। আরও আগেই চলে যাওয়া উচিত ছিল। এটা ওর নিজের লাইফ। নিজের শরীর ও কাকে দেবে না দেবে, কাকে ভাল বাসবে না বাসবে সেটা সম্পূর্ণ ওর নিজের সিদ্ধান্ত। সে ব্যাপারে কেন কারও হস্তক্ষেপ করার মতো সুযোগ রাখল তিয়াষা? তা হলে আজ অভিরূপের যে অপমানটা হল, এবং ওর নিজেরও, তার জন্য একা পিয়াসকে কেন দায়ী করবে ও? নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করার জায়গা আছে?
নিজের ওপর ব্যাখ্যাহীন রাগে অবশ শরীর নিয়ে বসে থাকে তিয়াষা। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে যে ও পিয়াসের ওপর দুর্বল হয়ে পড়তে বসেছে। এমন কান্নাকাটি করছে ছেলেটা যে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাওয়া মনটা যেন হঠাৎ করেই অনেক কাজের ভিড়ে দুম করে রেস্ট নিতে বাইরে কোথায় চলে গেল। এ এক অসহ্য অবস্থা। তিয়াষা খুব অস্থির হাতে নিজের জিনিসপত্র প্যাক করছিল। সে সব ছেড়ে দিয়ে, বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে চেষ্টা করে। ঠিক কী করা উচিত! এমন সময়ে মোবাইলে বেজে ওঠে প্রিয় কলার টিউন। তিয়াষা এক লাফে ফোনটা মুঠোয় চেপে কানে ধরে।
“নীচে আমি অপেক্ষা করছি গাড়িতে।
দশ মিনিটের মধ্যে লাগেজ নিয়ে নেমে এস,” কুণ্ঠিত প্রেমিকের কণ্ঠস্বর নয়। অভিজ্ঞ অভিভাবকের প্রাজ্ঞ স্থিতবুদ্ধি নির্দেশ। তিয়াষা এই ক’দিনের পরিচয়ে এক বারও অভিরূপের এই আওয়াজ শোনেনি। থতিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মানে? কোথায় যাব?”
“আঃ... সে চিন্তা তোমার নয়, যা বলছি তাড়াতাড়ি করো।’’ রীতিমতো অধৈর্য শোনায় অভিরূপের গলা। এমন ভাবে ফোন কেটে দেয়
যে তিয়াষা আর একটা কথাও বলার সুযোগ পায় না। পায়ে পায়ে ভিতরের ঘরে আসে ও। পিয়াস নেই। কখন আবার বেরিয়ে গিয়েছে। নিজের ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিল যে কখন আবার বেরিয়ে গেল পিয়াস সেটা খেয়াল করেনি। ভালই হয়েছে।
ও থাকলে চলে যাওয়াটা এত সহজে হত না। আর এমন অমোঘ ডাক অস্বীকারই বা করবে কী করে তিয়াষা? মেয়েরা বোধহয় অনেক অনেক সফলতার শীর্ষে বসেও সারা জীবন এমনই কোনও ডাকের আকাঙ্ক্ষায় উজানস্রোতে নৌকা বেয়ে ঢেউয়ের আঘাত বুকে বাঁধে, যে ডাকের জলছাপ ধরে ভেসে যায় সমস্ত ন্যায়-অন্যায় বোধ, চিন্তিত সুচিন্তিত যত উচিত আর অনুচিতের বেড়াজাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy