Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৬

পরিক্রমণ

চুমকি এ রকম একটা পরামর্শ সম্পূর্ণ অযাচিত ভাবেই দিয়েছিল। এ রকম সে সারা জীবন ধরে দিয়েই চলেছে অভিরূপকে।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু অধিকারী
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: অঞ্জলিকে একটা খাম দেয় হাসপাতালের নার্স ক্যাথি। খামে আছে অভিরূেপর ব্যক্তিগত কিছু কাগজ। খাম দেওয়ার পাশাপাশি ক্যাথি অঞ্জলিকে সাবধান করে, অভিরূপ যেন বিকেল চারটের পরে হাসপাতালে আর না থাকে। সে আভাস দেয়, ডাক্তার কুলকার্নির মদতে বাইরে থেকে লোক এসে অভিরূপকে হেনস্তা করতে পারে। অঞ্জলি সাবধান করার আগেই অভিরূপ নিজেই জানায়, সে হাসপাতালে যাচ্ছে না।

লাস্ট উইকে তিয়াষার সঙ্গে মিটিংটা বাতিল হওয়ার পরে অরুণকে একটা টেক্সট করে দিয়েছিল অভিরূপ। তার পর তো তাইল্যান্ড চলে গেল ক’দিনের জন্য। আজ দেখা হবে তিয়াষার সঙ্গে। তা হলে কি অরুণকেও বলা উচিত চেন্নাই হোটেলে আসতে, নাকি ওর জন্য অন্য দিন? ঠিক করে উঠতে পারে না অভিরূপ। ঘুম আসতে চায় না তার। সব সময়েই মাথার ভিতর অজস্র প্রশ্ন যদি কিলবিল করতে থাকে, ঘুম আসবে কোন পথ দিয়ে! অভিরূপ বালিশসুদ্ধ এপাশ-ওপাশ করে। সত্যি কথা বলতে কি, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আজ আর ওর মন চায় না তিয়াষা এবং অরুণকে একই সঙ্গে মিট করতে। কিন্তু অরুণের গলায় সে দিন এমন ব্যাকুলতা ছিল যেটা ছুঁয়ে গিয়েছে ওর মন। তাড়াতাড়ি ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার। কলেজ জীবনের বন্ধু বলে কথা। কিন্তু কখন? এক বার হাসপাতালে ঢুকলে চব্বিশ ঘণ্টা যে কোথা দিয়ে উড়ে যায়, অভিরূপ বুঝতেই পারে না। আর ওকে ওখানে আসতে বলা ভালও দেখায় না। আজই ঠিক হত। কিন্তু আজ কেন যে মন চাইছে না! মানুষের প্রাণ ভগবানের হাত থেকে ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ে নামার আগে এত চিন্তা করে না কোনও দিন অভিরূপ। অথচ এই সামান্য একটা সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেয়ে কেবলই বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেই চলেছে। সেই সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন ওকে ভাবিয়ে তোলে, কেনই বা আজ ওর মন চাইছে না অরুণকে ডাকতে!

কিন্তু খুব বেশি ক্ষণ শুয়ে গড়িয়ে ভাবার অবকাশ জোটে না ওর। অস্থির পায়ে উত্তেজিত হয়ে ঘরে ঢোকে চুমকি।

“এখানে ডাক্তারবাবু শুয়েবসে আরাম করছেন আর ও দিকে তো ঢি ঢি পড়ে গেল বাজারে ...”

অভিরূপ ভিতরে ভিতরে চিন্তিত হলেও মুখে কিছু বলে না। সে জানে, চুমকি যা বলতে এসেছে ঝড়ের মতো বলে আবার কোনও শপিং মল বা কিটি পার্টিতে চলে যাবে। জগতে আর কোনও কিছুকে এ সবের চেয়ে বেশি দরকারি মনে করে না ও। এমনকি এই অসময়ে অভিরূপ যে ঘরে শুয়ে আছে, এতেও চুমকির মনে কোনও প্রশ্ন জাগছে না। মাঝে মাঝে অভিরূপ চিন্তায় পড়ে যায়, এই যে সংসারের মধ্যে থেকেও এক রকম সন্ন্যাসী জীবন ওর, এতে সে খুশি না অখুশি। আগে আগে খারাপ লাগত, এখন আর নতুন করে কিছু মনে হয় না। তবুও দমকা খারাপ লাগা জেগে ওঠে কেন?

বোধহয় আজ স্পেশ্যাল শপিং আছে। চুমকি ভল্ট খুলে মোটা মোটা দুটো বান্ডিল ব্যাগে পুরে চাবি ঝুলিয়েই সামনে এসে দাঁড়ায়।

“কী বললাম শুনতে পেলে না? এ বার তো হয়ে গেল তোমার!”

উত্তর না দিয়ে শান্ত চোখে তাকায় অভিরূপ, ‘‘কার্ড ইউজ় করতে পারো তো ... আজকাল কেউ এত টাকা নিয়ে ঘোরে না।”

“ছাড়ো তো কার্ড-ফার্ড। ও দিকে তো যা তা বলছে খবরে।”

অভিরূপ বেশ অবাক হয়। অবাক এই জন্য যে চুমকি নিউজ় শুনছে আজকাল! দু’মাস অন্তর বিদেশে না গেলে ওর মান থাকে না সোসাইটিতে। তার মধ্যে দু’চার বার অন্তত বরের সঙ্গে যাওয়া চাই। নইলে নাকি প্রমাণ করা যায় না সে এক জন হ্যাপিলি ম্যারেড উওম্যান। সেই ফরমুলা অনুযায়ী তাইল্যান্ডের টুর। আর সেখান থেকে ফিরে এসে আবার সেই পার্টি, শপিং... এর মধ্যে কখন টিভি নিউজ় দেখল? ওকে কখনও বই বা খবরের কাগজ পড়তে দেখে না অভিরূপ।

“এখন আর ভেবে কী করবে? তোমার নামে যা খুশি তাই বলেছে ডক্টর কুলকার্নি। তুমি নাকি বিলাস পালের বাইপাস অ্যাডভাইস করেছিলে! উনি নাকি প্রোটেস্ট করেছেন কিন্তু তুমি ওর কথা শোনোনি।”

“কী? ডক্টর কুলকার্নি এ সব বলেছেন? কাকে? কোথায়?” কিছুটা উত্তেজিতই হয়ে পড়ে অভিরূপ। বালিশ ছেড়ে উঠে বসেছে বিছানায়। সে দিকে চুমকির লক্ষ নেই। সে নতুন কেনা পোশাকের সঙ্গে রং মিলিয়ে লিপস্টিক মাখতে ব্যস্ত। হাঁ করা মুখেই বলে, “কাকে আবার? টিভি রিপোর্টারকে। মিতাদি তো আমায় ফোন করে বলল, কাল রাত থেকেই নাকি বারবার টিভিতে কুলকার্নির বাইট দেখাচ্ছে কোন বাংলা চ্যানেল।’’

এতটা অশান্তিদায়ক খবর পাওয়ার পরেও একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয় অভিরূপ। যাক চুমকি চুমকিতেই আছে। খবরটা ওর দেখা নয়, শোনা। ওর মিতাদি নামক গাইডের কাছ থেকে পেয়েছে। আবার বুকের তলায় সেই দমকা খারাপ লাগা ছুঁয়ে যায়। এ রকম বাজে একটা খবর শুনেও কী অবলীলায় এই মহিলা সাজছে। স্বামীর টাকা ধ্বংস করতে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘরের লোকটার জন্য এক ফোঁটা উদ্বেগ নেই, দুশ্চিন্তা নেই। ও কি মানুষ! ভিতর থেকে উঠে আসা একটা ধিক্কারে ভুরু কুঁচকে থাকে অভিরূপের। চুমকি খুব সহজেই সেই মুখভঙ্গির নিজস্ব ব্যাখ্যা তৈরি করে নেয়। এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে সালোয়ারের ওড়না ঠিক করতে করতে বলে, “এখন আর হাঁড়িমুখ করে বসে থেকে কী করবে! যখন বলেছিলাম কার্ডিয়োলজির সব ডাক্তারকে তাড়াও, নতুন পুচকে ডাক্তারদের নিয়ে এস, তখন তো শোনোনি আমার কথা। শুনলে তোমারই ভাল হত। এখন ওরাই তোমায় তাড়িয়ে ছাড়বে।”

চুমকি এ রকম একটা পরামর্শ সম্পূর্ণ অযাচিত ভাবেই দিয়েছিল। এ রকম সে সারা জীবন ধরে দিয়েই চলেছে অভিরূপকে। যেখানে যেখানে সে নিজের স্বার্থ বুঝবে, সেখানেই স্বামীকে তার ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করার জন্য চাপ দেবে। অভিরূপ সারা জীবনে একবার মাত্র শুনেছিল চুমকির কথা। মাকে বৃদ্ধাবাসে পাঠানোর সময়। চুমকি শাশুড়ির সঙ্গে থাকবে না, তাকে বৃদ্ধাবাসে পাঠানোর জেদ ধরেছিল। অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষে অভিরূপ সোনারপুরে ফ্ল্যাট কিনে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মাকে রেখে এসেছে সেখানে। চুমকি জানে, তার শাশুড়ি রয়েছে কোনও এক বৃদ্ধাবাসে। কোনও দিনও সে জানতে চায়নি কোথায় সেই হোম। দু-তিন মাস অন্তর চুমকি ফরেন টুরে গেলে মা-ভাইয়ের কাছে গিয়ে মনের মতো করে থাকতে পারে অভিরূপ। দেশের বাইরে চলে গেলে চুমকি ফিরেও তাকায় না স্বামীর দিকে। এটা বড় সুবিধা অভিরূপের।

তবুও আজ খারাপ লাগে তার। কেন জানে না সঙ্গে সঙ্গেই চোখের ওপর ভেসে যায় তিয়াষার মুখ। যে দিন বিলাস পালের ঘটনাটা ঘটল, আরও পাঁচজনের সঙ্গে সেও এসেছিল অন স্পট রিপোর্টিং করতে। এসে প্রথমটায় তিরের মতোই প্রশ্নের পরে প্রশ্ন ছুড়ছিল অভিরূপের দিকে। অভিরূপ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। খারাপ ব্যবহারও করে ফেলে সে সাংবাদিকদের সঙ্গে। কিন্তু সেই সময়েই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায় ওই মেয়েটি। সব কিছু ভুলে গিয়ে দ্রুত ওর চিকিৎসার ভার নিয়েছিল অভিরূপ। তিন দিন ওকে রেখে দিয়েছিল হাসপাতালে নিজের সুপারভিশনে।

তার পর যে দিন তিয়াষা আবার এল চেম্বারে, সে দিন ওর মধ্যে সত্যিকে খুঁজে বার করার একটা জেদ দেখেছে অভিরূপ, দেখেছে অদৃশ্য এক সহমর্মিতার স্পর্শ। অভিরূপ ভাল কি মন্দ, অভিরূপ চরম অন্যায় কাজটা করেছে কি করেনি তা তো ওর জানার কথা নয়। তবুও যেন মেয়েটির চোখে ছিল এক আলোয় ফেরার আশ্বাস। যা হাজার ব্যস্ত কাজপাগল ডাক্তারকেও মাঝে মাঝে আনমনা করে তোলে, আর পাশাপাশি মৃদু নিঃশ্বাস ভারী হয় সামনের মানুষটাকে দেখলে। এই যে একটা আচমকা ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে গিয়েছে অভিরূপ, এতে সবচেয়ে যার চিন্তায় পড়ার কথা, সেই চুমকির কোনও হেলদোল নেই। বুকের ভেতর ছাপিয়ে আসা দমকা খারাপ লাগাটা কেটে গিয়ে সেখানে জেগে ওঠে বিতৃষ্ণার ঢেউ। চুমকির কোনও কথায় উত্তর না দিয়ে পিছন ফিরে শোয় অভিরূপ।

১০

গালে হাত দিয়ে বসেছিল বনানী। বিলাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চোখে ঘুম আসে তার। নয় নয় করে ন’দিন কেটে গিয়েছে। সমস্ত রকম পরীক্ষা করার পরে ডাক্তাররা জানাল, বিলাসের শরীরে বাসা বেঁধে আছে অজস্র অসুখ। দেশি বিলিতি কত তাদের নাম। বনানীর তা মনে রাখার ক্ষমতা নেই। দু’দিন আগে জানা গেল লিভার পাল্টাপাল্টি করতে হবে। মানুষের শরীরের ভিতরের অঙ্গ কী করে পাল্টানো যাবে, বনানী শত চিন্তাতেও মাথায় আনতে পারে না। এই দু’দিন ধরে তার যত প্রশ্ন সব নিয়ে ছেঁকে ধরেছিল অমলকে। বিরাম ছিল না কোনও। আজও সেই এক প্রসঙ্গ। ভীষণ চিন্তা-চিন্তা মুখ করে সে প্রশ্ন করেছিল অমলকে।

“তা লেভার পাল্টানোর ব্যাপারটা ঠিক কী বলো দেখি? কাটের হাত-পা হয় শুনিছি, এও কি কাটের লেভার পেটের মধ্যি সেধে দেবে না কি?”

বনানীর অজ্ঞতায় হেসেছিল অমল। তার পর গম্ভীর মুখে বলেছিল, “আরে না রে বাবা না। এ হল গিয়ে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন... খুব ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার। তা ছাড়া এই হাসপাতালে হয় না। সেই যেতে হবে গিয়ে সাউথ ইন্ডিয়া বা দিল্লি...’’

“টানেসপালেনটেশেন! সিটো আবার কী গো?’’

“ও...ও তুই বুঝবি না... প্রচুর টাকা লাগবে এইটুকু শুধু জেনে রাখ।’’ বনানীর চিন্তিত মুখটায় আরও খানিকটা চিন্তার ছাপ মাখিয়ে দিয়ে উঠে চা খেতে চলে গিয়েছিল অমল। দিনে অন্তত বারো- চোদ্দো বার চা না হলে ইদানীং চলছে না তার। লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন ব্যাপারটা ঠিক কী সে সম্বন্ধে অমলেরও ভাল আইডিয়া নেই। ও শুধু এটুকুই জানে যে জীবিত বা মৃত কারও লিভার কেটে বসানো হয় অসুস্থ লোকের শরীরে। কিন্তু যে সে চাইলেই দিতে পারবে না। তার অনেক নিয়মকানুন আছে। তার উপর শরীরে ম্যাচ করাকরির ব্যাপারও আছে।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy