Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ১১

পরিক্রমণ

অভিরূপ সোজা তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ওর কথা শুনে হেসে ওঠে না বা ধমকে থামিয়ে দেয় না। পকেট থেকে সোনালি সিগার কেস বার করে তার উপর আঙুল ঠোকে।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু অধিকারী
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: উদ্দালক শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে সকলেই বলে পাগল। কিন্তু সে নিজেকে পাগল মনে করে না। তার মতে পাগলের সংজ্ঞা আলাদা। শপিং মলে ঢুকে সে মানুষ দেখে। তার ভাষায় এটা তার রিসার্চের বিষয়। এই ভাবেই মলে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখার ফাঁকে সে দেখে ফেলে তার পরিচিত মানুষ, ডাক্তার অভিরূপকে।

উদ্দালক মাথা নাড়ে, “ঠিকই...রিসার্চের পথে অনেক বাধা।’’

“আপনার ভায়োলিন কোথায়?’’

“ওটা দিনের বেলা সুরতিয়ার চায়ের দোকানে রাখা থাকে, স্যর।”

“কে সুরতিয়া?’’

“আমার ভায়োলিন টিচার ছিল।”

“ছিল মানে? এখন নেই?’’

উদ্দালক হাসে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসে, ‘‘নেইও ... আবার আছেও।”

অভিরূপ সোজা তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ওর কথা শুনে হেসে ওঠে না বা ধমকে থামিয়ে দেয় না। পকেট থেকে সোনালি সিগার কেস বার করে তার উপর আঙুল ঠোকে। ‘নো স্মোকিং জ়োন’ মনে পড়ে যাওয়ায় আবার পকেটে ফেরত পাঠায় সোনালি কৌটো। “এই আছেও আবার নেইও অবস্থাটা দু’দিন আগেও আমি বুঝতে পারতাম না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, একটু একটু বুঝতে পারছি। কিছু খাবেন?”

“না স্যর। পেট ভরা আমার।”

“কী খেয়েছেন?’’

“বাইপাসের ওপর একটা চাঁপা ফুল গাছ আছে স্যর, আজ আসার আগে অনেকখানি চাঁপাফুলের গন্ধ খেয়েছি। পেট বুক মাথা সব ভরে আছে!”

এবারেও হাসে না অভিরূপ। গম্ভীর হয়ে চিন্তা করে কিছু। তার পর বলে, “হাসপাতালে বাজাবেন? পেশেন্টদের জন্য মিউজ়িক্যাল হিলিং... রাজি?”

“হাসপাতালেই তো বাজাই, গেটের কাছে।”

“না। আমি হাসপাতালের ভিতরে বাজানোর কথা বলছি। দিনের বেলায়।’’

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কথা শেষ হয় না। রেস্তরাঁর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে অভিরূপের স্ত্রী চুমকি। “আমাকে অপেক্ষা করতে বলে তুমি এখানে সময় নষ্ট করছ? কখন এসেছি আমি, জানো? টাইম দিতে না পারলে প্রোগ্রাম করো কেন? সবাই কি তোমার পেশেন্ট যে সারাদিন হাঁ করে বসে থাকবে? ডিজ়গাস্টিং...” বিরক্তি নিয়ে বলে চুমকি।

“চুমকি বিহেভ ইয়োরসেলফ,’’ চাপা গলায় বলে অভিরূপ। কিন্তু তাতেও চুমকি থামে না, “তখন থেকে এই ভ্যাগাবন্ডটার সঙ্গে কী কথা বলছ? কে ও? কীসের এত কথা?’’

আপনজনের কষ্ট চোখে দেখা বড় কষ্টের। উদ্দালক ফেরার জন্য পিছন দিকে পা বাড়ায়।

“কী হল, আপনি কিছু বললেন না যে!’’ অভিরূপ তার প্রশ্নে অটল। চুমকির কটু ব্যবহার তাকে নিজের উদ্দেশ্য থেকে থেকে সরাতে পারেনি। এক মাথা চুল ঝাঁকিয়ে মুখের হাসিটা প্রকট করে উদ্দালক বলে, ‘‘সুরতিয়ার অনুমতি নিয়ে কাল আপনাকে জানাব স্যর, সে যদি কোনও আপত্তি না করে, তা হলে বাজাব।’’

রাকার বিশ্বাস হচ্ছে না নিজের কানকে। ভুল শব্দ সংগ্রহ করে করে ওকে বোকা বানানোর খেলায় নেমেছে নাকি কান দুটো? এ পর্যন্ত অনেক অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। জীবনে যত ঝড় আসুক, কেউ আর ওকে খুব সহজে বোকা বানাতে পারবে না। যাকে বলে সিচুয়েশন হ্যান্ডলিং সেটা শিখে গিয়েছে রাকা। কিন্তু এখানে বারো তলার উপর এসি ঘরে বসে দূরের ছোট হয়ে যাওয়া পৃথিবীটা দেখতে দেখতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে কেন কপালে? এ কি ওর সযত্ন চর্চিত আত্মবিশ্বাসের গায়ে কোন অদৃশ্য ফাটল?

সুমন কম কথা বলার মানুষ। অন্তত রাকা তাই জানত। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ একনাগাড়ে কথা বলে গেল ও। যার বিষয়বস্তু একটাই। যে কথাগুলো শুনেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না রাকা।

সুমন কখন উঠে গিয়ে ভিতর থেকে একটা ফাইল নিয়ে ফিরে এল, রাকা খেয়াল করেনি।

“তুমি কিন্তু আমার একটা কথারও উত্তর দিলে না। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।”

রাকা বাইরে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে। সুমন হাতের ফাইলটা টেবিলের উপর রাখে। একটু তাকিয়ে থাকে রাকার দিকে উত্তরের আশায়। তার পর উঠে বারান্দায় যায়। আবার ঘরে আসে। একটু বসে। আবার ভিতরের ঘরে যায়। আবার ও ফিরে আসে। এবারে বেশ উত্তেজিত দেখায় ওকে। বোঝা যায় রাকার এই পাথরের মূর্তির মতো চুপ করে বসে থাকা আর বরদাস্ত হচ্ছে না ওর। সুমন এতক্ষণে যা একবারও করেনি তাই করে বসে। ঝপ করে রাকাকে দুই শক্ত হাতে টেনে জাপটে ধরে। “কেন চুপ করে আছ? এত কী ভাবনার আছে তোমার? বললাম তো ভুলে যাও যা হয়েছে। একটা অন্তত সুযোগ দাও আমাকে। দেখো এবার আর কোনও সুযোগ দেব না তোমাকে। একটুও মন খারাপ করতে দেব না। আমি আর তুমি মিলে পিয়ার জীবনটাও সাজিয়ে তুলব।’’

আরও অনেক কথা বলে যাচ্ছিল ডাক্তার সুমন সেন। সে জার্মানির এক বিখ্যাত হাসপাতালে কাজের সুযোগ পেয়েছে। সেখানে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চায় ডিভোর্সি বৌ আর মেয়েকে নিয়ে। আবার রেজিস্ট্রি করবে সে রাকাকে বিয়ে করতে চায়। পিছনের পৃষ্ঠার যত কালির ছোপ কাটাকুটি দাগ, সে এক টানে মুছে দেবে, দরকারে পৃষ্ঠাটাই ছিঁড়ে ফেলে দেবে। এমন আরও আরও অনেক স্বপ্ন দেখে সুমন। রাকা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় সুমনের হাত থেকে। একটু সরে বসে। ঠান্ডা চোখ মেলে তাকায়।

“আর... জয়িতা?’’

প্রশ্ন শুনে থমকে যায় সুমন। তার পর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে , “ওটা একটা সাডেন ইন্সিডেন্ট... ওটা ভুলে যাওয়াই ভাল। আমি ভুলেই গিয়েছি। এক একটা পরিস্থিতি এমন আসে জীবনে। তা ছাড়া জয়িতার দিকে তুমিই আমাকে ঠেলে দিয়েছিলে!”

রাকা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। ওর চোখ কিছুই দেখছে না। কান কিছুই শুনছে না। শুধু মন ভেসে বেড়াচ্ছে পাঁচ সাত বছর আগের দিনগুলোয়।

বিয়ের পরে পরে সুমন ছিল আর পাঁচজন আদর্শবাদী ডাক্তারের মতো। খুব বেশি রোজগারের নেশা তখনও ওকে ছুঁতে পারেনি। হাসপাতালের চাকরিতে খুশি ছিল। নিজের ডিউটি আওয়ারটুকু মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করে ফিরে আসত বাড়িতে। কথায় কথায় বলত, পরিবারকে যাঁরা নেগলেক্ট করে তাঁদের আমি ঘৃণা করি। সপ্তাহে এক দিন দূর দূর গ্রামে চলে যেত বিনাপয়সার রুগি দেখতে। কখনও বা জোর করেই সঙ্গে নিয়ে যেত রাকাকে। রাকা দেখেছে ওর ধ্যানমগ্ন রূপ। দেখেছে নিঃসহায় মানুষগুলো ওকে কীভাবে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করছে। সেই সময়টা এত দিন পরেও স্বপ্নের মতো মনে হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু রাকার ভাগ্যে সইল না। ওর অজান্তে ওরই চোখের উপর সুমন কীভাবে একটু একটু করে পালটে গেল। সব কিছু কত তাড়াতাড়ি ঘটল, রাকা ভাল করে বোঝার আগেই দেখল ওর সুন্দর স্বপ্নের মতো দিনগুলো আর নেই।

হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দিল সুমন ওকে কিছু না বলে। এক ব্যবসায়ী বন্ধুর সাহায্যে নার্সিংহোম খুলল মেদিনীপুর শহরের পশ এলাকায়। ক্রমে সুমনের কাছে পরিবার সেকেন্ডারি হয়ে গেল। রাকার প্রয়োজন হয় না আর। প্রায় ষোলো-সতেরো ঘণ্টা বাইরে কাটিয়ে যখন বাড়ি ফেরে সুমন, মেয়েকে নিয়েই থাকে বেশিরভাগ। আর নয়তো ঘুম। তখন ওর একটাই লক্ষ্য, টাকা...আরও টাকা। ওই সময়েই প্রথম ওষুধ কোম্পানির পয়সায় বিদেশ যাওয়া শুরু সুমনের। যা ও মনেপ্রাণে ঘৃণা করত এক সময়। রাকা ওকে পাল্টাতে দেখেও কিছু করতে পারেনি। সুমন লন্ডন ট্রিপে যাওয়ার সময় রাকা জানতে পারে, ওর সঙ্গে লন্ডন যাচ্ছে জয়িতা। সুমনের প্রাইভেট সেক্রেটারি। এবার প্রথম নয়, আগেও বিভিন্ন জায়গায় ও গিয়েছে সুমনের সঙ্গে। এক ঘরে নাইট স্টে করেছে। সুমন ও জয়িতার ব্যাপারটা জানার পরে রাকা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আলাদা হওয়ার। কোনও জবাবদিহি না চেয়ে, কোনও অভিযোগ না করে, একটা কথাও না বলে রাকা ফিরে গিয়েছিল তার বাপের বাড়ি।

পরে অনেকবার রাকার মনে হয়েছে, সে দিন অমন করে সব ছেড়ে চলে এসে হয়তো ঠিক করেনি সে। সুমন জয়িতার সঙ্গে সম্পর্কটা অস্বীকার করেনি যেমন, খোলাখুলি স্বীকারও তো করেনি। কিন্তু একটা মহিলাকে নিয়ে একাধিকবার বাইরে যাওয়া, এক সঙ্গে থাকা, এগুলো কি একটা বিশেষ সম্পর্কেরই ইঙ্গিত দেয় না? ক্রমে রাকার সংশয় স্থির বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। আর সেই বিশ্বাসের গায়ে সিলমোহর পড়েছে যখন সুমন ওকে বিচ্ছেদের নোটিস পাঠায়।

আজ এই আকস্মিক প্রস্তাব কী করে অন্তরে গ্রহণ করবে রাকা? এই এত গুলো বছর সুমন কি আর আগের জায়গায় আছে? প্রফেশনালি ও এখন সফল। কিন্তু আবার সে পরিবার জুড়তে চাইছে। সেটা কি আর কোনওদিন সম্ভব? জয়িতার কথা ভুলে এগিয়ে যাওয়ার মতো উদারতা কেন রাকা পাচ্ছে না নিজের মধ্যে? এত এত জটিলতার মধ্যে একটাই লোভ শুধু ওকে পিছনে টেনে ধরতে চাইছে। সেটা পিয়া। সুমন মানে পিয়া। সুমনের প্রস্তাব মানে অনন্তকাল ধরে এই লড়াইয়ের অবসান। কী কঠিন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। আজ যখন সুমন ফোনে ওকে ডাকল নিউটাউনের এই ফ্ল্যাটে, রাকা একবারও ভাবেনি এমন পরীক্ষার সামনে পড়তে হবে। বহুক্ষণ চিন্তা করেও কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে টেবিলে রাখা জলের গ্লাস শেষ করে এক চুমুকে। তার পর তাকায় সামনে বসা, ঘন ঘন ঘড়ি দেখা মানুষটার দিকে।

“তুমি জয়িতাকে বিয়ে করলে না কেন? আমি কিন্তু ভেবেছিলাম তোমরা...”

ভ্রু কুঁচকে ফেলে সুমন, “ডোন্ট বি ফুলিশ... তোমার জায়গায় কখনও জয়িতাকে বসানোর কথা ভাবিনি।”

“আর আমার জায়গায় বিছানায় পাশে নিয়ে শোয়ার কথা ভাবতে পেরেছিলে?’’ নিজের তিক্ত প্রশ্নের ঝাঁজ রাকাকেই বিব্রত করল।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Rajashree Basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy