ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: অসুস্থ দীপ্যদাকে দেখতে তার বাড়ি যায় সাবু। দীপ্য বলে, সাবুর দিদিকে নয়, সাবুকেই ওর পছন্দ। অন্য দিকে, মিস্টার বাগালে চন্দন সিংকে অফিস থেকে বার করে দিলেও, কোম্পানির আর-এক পদস্থ কর্মী মিস্টার লালকে হাত করেছে সে। ফলে পুঁটিদের দুশ্চিন্তা যায়নি। এক বৃষ্টির দিনে পুরনো ডায়েরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে পুঁটির হাতে আসে তার স্কুলজীবনের একটা ছবি। ২০১২ সাল। ওরা তখন ক্লাস ইলেভেনে। ঠিক হয়েছিল বন্ধুরা সবাই মিলে পার্টি করবে। সেদিন ক্লাসের বিয়াল্লিশ জনের মধ্যে পুঁটির চোখ ছিল শুধু সর্বোত্তমার উপরেই।
ইলেভেনে সাবুর সঙ্গে আলাপ আমার। এমন সহজ খোলামেলা মেয়ে আমি আগে দেখিনি। এক দিনেই কেউ এমন বন্ধু
হয়ে যেতে পারে! ইলেভেনের প্রথম দিনেই সর্বোত্তমা হয়ে গিয়েছিল সাবু। তার পর ডিসেম্বর আসতে আসতে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
কিন্তু না, শুধু যে বেস্ট ফ্রেন্ড তা নয়। আরও যেন সামান্য কিছু বেশি! আমার নোট লিখে দেওয়া থেকে, অঙ্ক সল্ভ করে দেওয়া থেকে শুরু করে আমি কোনও নেমন্তন্নে কী পরে যাব সেটাও ঠিক করে দেয় ও! নর্থ থেকে সাউথে চলে আসে। বাড়িতে সবার সঙ্গে কী ভাবে যে মিশে যায়! আমার চিলেকোঠার ঘরের কারপেন্ট্রিতে আমায় নানা সময়ে সাহায্য করে। সাবু ছাড়া মনে হয় আমি
ঠিক কিছু করতে পারব না।
এ সবের মাঝে এক দিন একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি।
আমার দাদুর বাড়ি বেলঘরিয়ায়। আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, সেই বাড়ির বড় বারান্দায় একটা সাদার ওপর সবুজ ফুলছাপ চুড়িদার পরে বসে আছে সাবু। চার দিকে হাওয়া বইছে খুব। আর কী সুন্দর একটা আলোয় ভরে আছে পৃথিবীর নরম বাটি। তার মধ্যে সাবু বসে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমি
সেই লম্বা বারান্দা পেরিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম
সাবুর দিকেই। তার পর হাঁটু গেড়ে বসে মাথা রেখেছিলাম সাবুর কোলে! সাবুও আলতো করে হাত রেখেছিল আমার মাথায়! আর সেই স্পর্শ এতটাই অদ্ভুত ছিল, সত্যি ছিল, যে আচমকা ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার!
খুব ভোর তখন। মাথার কাছে খুলে রাখা জানলা দিয়ে ভোরের ফিনফিনে হাওয়া আসছিল। সবে লাল-হলুদ রং ধরা আকাশে তখনও দপদপ করে জ্বলছিল শুকতারা! আর আমাদের বাড়ির গাছে জেগে উঠছিল পাখিদের শহর!
ভোরবেলার স্বপ্ন সত্যি হয়? ঠাকুমা বলে,
সত্যি হয়। আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করছিল। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। মাথা হাল্কা লাগছিল।
এটা কী দেখলাম আমি! সাবু তো আমার বন্ধু! তা হলে? তা হলে এমন স্বপ্নটা তৈরি হল কী করে? সামান্য অপরাধবোধ হচ্ছিল আমার। কিন্তু আবার ভালও লাগছিল।
তার পর থেকে সাবুর সামনে আমি এমনি সহজ ভাব দেখালেও মনে মনে কেমন একটা
অদ্ভুত ফিলিং হয়! আগে এমন হয়নি তো, তাই বুঝতে পারি না কী হচ্ছে! কাউকে যে বলব সেটারও উপায় নেই!
আজ সাবুকে দেখে আমি থমকে গেলাম। লম্বা চুল পনিটেল করে বাঁধা। জিন্স আর টপ পরে এসেছে। কোনও সাজ নেই। কিন্তু তাতেই মনে হচ্ছিল পৃথিবীর বাটি ভরে উঠেছে অন্য কোনও জগতের আলোয়।
আমরা সবাই কিছু ক্ষণ বসলাম বিদিশাদের বড় ঘরে। পিৎজ়া, কোল্ড ড্রিঙ্ক আছে প্রচুর পরিমাণে। সবচেয়ে বেশি কথা বলছে সাবু, বিদিশা আর ঋদ্ধি। ছবি তোলাও হল বেশ। আমি নিজে বাবার কিনে দেওয়া ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে এসেছি। আমিও ছবি তুললাম অনেকগুলো। সব মিলিয়ে আমার ভালই লাগছিল।
কিন্তু তার পরই আচমকা বিদিশা, ঋদ্ধি, শুভায়ন আর দেবাদিত্য উঠে গেল ভিতরে। আর সবাইকে অবাক করে নিয়ে এল বেশ কয়েকটা মদের বোতল আর প্লাস্টিকের গ্লাস।
এই সেরেছে! এদের দাবি কী? আমি ঘাবড়েই গেলাম! এরা মদ খাবে?
আমাদের বাড়িতে কেউ মদ খায় না। ফলে আমার একটু রিজ়ার্ভেশন আছে এই নিয়ে। সেখানে এরা মদ নিয়ে এসেছে!
আমি বললাম, ‘‘এ সব কী? একদম এ সব করবি না!’’
‘‘কেন?’’ রিজু দাঁড়িয়ে উঠল।
‘‘তুই আবার দাঁড়ালি কেন? চেপে বোস!’’ আমি ধমক দিলাম।
রিজু বলল, ‘‘না দাঁড়ালে প্রতিবাদ করা যায় না। কোনও বিপ্লবীকে দেখেছিস বসে বসে প্রতিবাদ করতে? বোমা ছুড়তে? গুলি চালাতে? না দাঁড়ালে ফোর্স আসে না।’’
বিদিশা আমাকে পাত্তা দেয়নি। বোতল খুলে সূর্যাস্ত-রঙা পানীয় প্লাস্টিকের গ্লাসে ঢেলে সবার হাতে হাতে ধরিয়ে দিল।
আশপাশের সবাই দেখলাম বিনা বাক্যব্যয়ে টুকটুক করে খেতেও শুরু করে দিল! আরে, এটা তো ইললিগ্যাল! এ সব কী হচ্ছে! আমি বোঝার আগেই কী যেন একটা হল। আর সাত-আটটা ছেলে মিলে আমার উপর রাগবির কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছু বোঝার আগেই আমি দেখলাম কার্পেটের উপর আমি লিয়োনার্দোর ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ হয়ে গিয়েছি!
আমি হাত-পা নাড়িয়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সবাই এমন করে চেপে ধরেছে যে, এক ইঞ্চিও নড়তে পারলাম না। মনে হল আমার উপর যেন প্রাচীন কালের শল্যচিকিৎসা করা হবে!
এক জন এর মধ্যে আচমকা আবার নাক চেপে ধরল। আমি শ্বাস নেওয়ার জন্য মুখ খুললাম। আর ব্যস, রিজুব্যাটা সেই সুযোগে আমার গলায় এক গ্লাস আগুন ঢেলে দিল!
হ্যাঁ, আগুনই তো! তা ছাড়া আবার কী! মনে হল পুরো খাদ্যনালিটাতেই কে যেন পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে!
এ বার ওরা ছেড়ে দিল আমায়। আর আমি বিষম খেয়ে নালে-ঝোলে একাকার হয়ে উঠে বসলাম। ওরে বাবা, এ সব কারা খায়! তাদের পেট কি লোহা দিয়ে তৈরি!
আমি কী করব বুঝতে পারলাম না। আর তখনই সাবু এগিয়ে এল।
সবাইকে ধমক দিয়ে, জোর করে উদ্ধার করল আমায়! একদম ক্লাসিক ‘ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস’-এর মেল ভার্সন!
আমার মাথা ঘুরছে। পা টলছে। এত তাড়াতাড়ি কাজ করে মদ! না কি প্ল্যাসিবো!
সাবু আমায় ধরে ধরে নিয়ে গেল ওই বাড়িরই একটা নির্জন বারান্দায়। তার পর আমাকে বসাল শ্বেত পাথরের মেঝেয়।
ডিসেম্বর মাস। ঠান্ডা মেঝে। কিন্তু আমার তেমন ঠান্ডা লাগল না। আমার কেমন যেন লাগছে। পেট থেকে একটা উত্তাপ টর্চের আলোর মতো
ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে। হাওয়া আসছে
বাইরে থেকে। ঠান্ডা হাওয়া। মাথাটা আচমকা হাল্কা লাগছে আমার। মনে হচ্ছে পিঠে কে যেন পাখনা লাগিয়ে দিয়েছে!
‘‘তুই ঠিক আছিস তো?’’ সাবু ঝুঁকে পড়ল আমার দিকে।
আমি তাকালাম। বিকেলের আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কেমন একটা কার্বন পেপারের মতো অন্ধকার নামছে। তার মধ্যে সাবুর মাখনের মতো মুখটা জেগে আছে! টর্চলাইট আলো ছড়াচ্ছে আরও! আরও! আরও! সামনে সাবুর মুখ! পারফিউমের গন্ধ! কানের দুলের ছোট্ট পাথর চকচক করছে! যেন ভোর রাতের শুকতারা! শুনলাম পাখিরা ফিরছে বাসায়। পাখিদের শহর ঘন হয়ে আসছে সন্ধের আবছায়ায়! স্বপ্ন! দে জা ভু! মাথার ভিতর কী যেন একটা হল আমার! এক পৃথিবীর সমস্ত বকুল ঝরে পড়ল মনের ফুটপাতে!
আমি সাবুকে টেনে নিয়ে ওর ঠোঁটে
ঠোঁট রাখলাম।
আবার এখন : ২০১৯
‘‘বাবু, এক জন এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে, নীচে বসে আছে। চলো...’’ বিনয়কাকার ডাকে আমার ফ্ল্যাশব্যাক শেষ হল।
আজ সুজয়দা আসেনি। রিজুও নেই। একা ঘরে বসে কী সব যে মনে পড়ছে!
আমি তাকালাম, বিনয়কাকার দিকে। লোকটা আজও এসেছে! ট্রেনে করে আসে অনেক দূর থেকে। আজ ট্রেন খুব ইররেগুলার। তাও এসেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘জেঠু, ছোটকা নেই?’’
‘‘না, ওঁরা বেরিয়ে গিয়েছেন। তা ছাড়া তোমাকেই খুঁজছে! আমি নাম জানি না। তবে
মুখ চেনা।’’
আমি জানি, বিনয়কাকাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। লোকটার মন যতটা ভাল, মেমরি ততটাই খারাপ। রিসেপশনে রিনাদি বসেন। আজ আসেননি। তাই ইন্টারকমে জানায়নি কেউ।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের ছবিটা আবার ডায়েরির মধ্যে রেখে, ডায়েরিটা ঢুকিয়ে রাখলাম ড্রয়ারে। তার পর উঠলাম। নীচে নামতে হবে।
আমাদের অফিসের একতলায় রিসেপশনের পাশেই একটা ঘষা কাচের পার্টিশন দেওয়া ঘর আছে। ভিজ়িটার্স রুম ওটা।
আমি দরজার সামনে দাঁড়ালাম। ভিতরে যে কেউ বসে আছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কে? এখন এমন ওয়েদারে কার এত জরুরি কাজ পড়ল?
আমি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই থমকে গেলাম! আরে বাবা! লোকটার সাহস আছে তো! ও তো জানে এখানে এলে ওকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া হবে! তা হলে? তাও এসেছে!
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমায় দেখে হেসে নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল চন্দন সিং।
১০
সাবু
এক-এক দিন এমনও হয়। অনেক ঘুমিয়েও মনে হয় যেন ঘুমই হয়নি। বুক আর পেটের সংযোগস্থলটা কেমন যেন ফাঁকা লাগে। মাথা কাজ করে না। আরও বহু বছর ঘুমিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, সেই তো মারা-ই যাব, তা হলে আর এত কাজকম্ম করে কী লাভ!
আমার সামনের সব কিছু কেমন যেন আলতো ঢেউ লাগা নৌকোর মতো নড়ছে! আর থেকে থেকেই কেমন একটা বাজে গন্ধ মনে আসছে। হ্যাঁ, মনে, স্মৃতিতে!
সে দিন দীপ্যদা যে কী করল না! আমার দিদির বয়ফ্রেন্ড হয়ে এটা করল কী করে! দীপ্যদার মুখ থেকে পাওয়া সিগারেটের গন্ধের সঙ্গে আর একটা কেমন পুরনো পেতলের মতো গন্ধ পেয়েছিলাম! আমার এমনিতেই গন্ধের বাতিক খুব। তাই খারাপ কিছু গন্ধ পেলেই আমার মন টুকে রাখে। আর তার সঙ্গে যদি স্মৃতিটাও খারাপ হয় তা হলে তো হয়েই গেল! সেটাই বার বার মনে পড়ে!
আচ্ছা, তা-ই কি আজ এমন স্বপ্ন দেখলাম! সেই স্বপ্ন দেখলাম বলেই কি ঘুমটা এমন ছানাকাটা আকাশের মতো হল! আর তাই কি এমন কষ্ট হচ্ছে মাথার ভিতর!
গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলাম আমি। আর সঙ্গে সঙ্গে পুঁটির মুখটা ভেসে উঠল। হলুদ পাঞ্জাবি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে পুঁটি। কেমন একটা ধাক্কা লাগল মনে। কষ্ট হল! কান্নাও পেল কি? কী জানি!
আমার মাঝে মাঝে নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করে আজকাল। আমি যে কী বোকার মতো কাজ করেছিলাম সেই স্কুললাইফে! নিজের পছন্দ আর ইচ্ছের চেয়ে যেন অন্যের কাছে ‘কুল’ হওয়াটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট ছিল আমার কাছে! না হলে বিদিশার বাড়িতে অমন একটা ঘটনার পরও আমি কেন সরিয়ে দেব পুঁটিকে! পুঁটি তো বলেছিল, ও আমাকে ভালবাসে! কিন্তু সেই বয়সটায় আমার তো পুঁটির ওপর ভালবাসা আসেনি! ওটা যেন হাল্কা একটা মজা। যেন নেশার ঘোরে সামান্য একটা দেওয়াল টপকানো। আমি পাত্তাই দিইনি!
একটা কথা আমি সার বুঝেছি। জীবনে টাইমিংটাই আসল। টাইমিং-এর গোলমাল হলে যেমন ব্যাটসম্যান ক্যাচ তুলে ব্যাট বগলদাবা করে প্যাভিলিয়নে ফিরে যায়, তেমন জীবনেও টাইমিং ঘেঁটে গেলে সব ভুল হয়ে যায়।
পুঁটির যখন আমার প্রতি ভালবাসা এসেছিল, আমার আসেনি। তার পর আমার থেকে কষ্ট পেয়ে, সরে গিয়ে পুঁটি যখন নিজেকে সামলাল, তার পর কলেজে এনাকে দেখে প্রেমে পড়ল, তার পর আমার মনে পুঁটির জন্য প্রেম এল!
এ সব গোলমেলে কাজকম্ম কেন যে হয়! আমার তো এখনও বিদিশাদের বাড়িতে সেই সন্ধে নেমে আসা সময়টার কথা মনে পড়ে। ঠোঁটে যেন এখনও স্পর্শ টের পাই! যেন গন্ধ ফিরে আসে নতুন দাড়ি কামাতে শেখা একটা ছেলের আফটার শেভের! কী যে কষ্ট হয় আমার! সেখানে পুঁটি এখন এমন ব্যবহার করে যেন আমায় চেনেই না!
“কী রে, শরীর খারাপ করছে?” জিনাদি পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল।
আমি সোজা হয়ে বসলাম আবার। বললাম, “না না, এমনি।”
“তোর কী হয়েছে রে? আগে এত বকবক করতিস, সেখানে এখন এমন চুপচাপ কেন?”
আমি জোর করে হাসলাম একটু, “কই কিছু হয়নি তো!”
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy