আবার মাথা গরম হয়ে গেল। এত আংটি পরে কেন লোকজন? কী হয় পরে? আমার মা-ও আমায় পরিয়েছিল। লাল-সবুজ-হলুদ... নানা রকম। তাতে কিছু হল? এনা থাকল? যত্তসব হাবিজাবি। মনে হল কষে ঝগড়া করি লোকটার সঙ্গে। বলি, এত আংটি পরে কী করলেন জীবনে?
কিন্তু না, অসভ্যতা হয়ে যাবে। তা ছাড়া এই যে কারণে-অকারণে আমি রেগে যাচ্ছি, সেটাও তো ঠিক নয়! এনা ছেড়ে গিয়েছে তো এই লোকটি কী করবে? ও নিজের টাকায় আংটি পরেছে, পরুক। ইচ্ছে হলে লোহার শেকল গলায় পরে নদীতে ডুবে মরে যাক। বরং এক সঙ্গে সবাই মরে যাক। আগুন লেগে যাক শহরে। গঙ্গা থেকে গডজ়িলা উঠে এসে লাথি মেরে, ঘুসি মেরে লন্ডভন্ড করে দিক শহরটা। মহাশূন্য থেকে পাঁচশো কিলোমিটার ব্যাসের গ্রহাণু টিপ করে এসে পড়ুক কলকাতায়। বা এ সব না হলে অন্তত একটা সুনামি হোক। প্লিজ় এক পিস সুনামি, ভগবান! বঙ্গোপসাগরের সমস্ত জল এসে ভাসিয়ে দিক সব কিছু। বেশ হবে। এনা সাঁতার জানে না। তখন মজা বুঝবে। আমাকেই ডাকতে হবে বাঁচাতে। তখন দেখব ও সব কথা কোথায় যায়! জানেন, গতকাল বিকেলে ফোন করে বলে কী না, ‘‘তুই আর আমায় ফোন করবি না। তোর সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক নেই। আমার এখন রণজিৎকে ভাল লাগে। ওকে আমার নিজের মনে হয়।’’
নিজের মনে হয়? আর আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি? নাকি কেউ আশ্রমের সিঁড়ির কাছে কাপড়ে জড়িয়ে রেখে গিয়েছিল হিন্দি সিনেমার মতো? কলেজে নোটস নেওয়ার সময় মনে ছিল না? আমি তোর জুতো হাতে করে সারিয়ে এনে দেওয়ার সময় মনে ছিল না? আমি সরে যেতে চাইলে রেস্তরাঁর সিঁড়িতে আঁকড়ে ধরে চুমু খাওয়ার সময় মনে ছিল না? এখন কোথাকার কে এক রণজিৎ, তাকে নিজের মনে হয়! জীবনে একটা বিচার বা নিয়ম বলে কিছু নেই! ভগবান কোনও কাজের নয়। একটা সুনামি পাঠাতে কী হয়! সব ধ্বংস হয়ে যাক না একটু! ফর্টি টু হাইরাইজ় ছাড়িয়ে উঠে যাক জল। ডুবে যাক ভিক্টোরিয়ার পরি। হাওড়া ব্রিজ ডুবোপাহাড় হয়ে যাক। তখন দেখব পাশের গাড়ির ওই মোটা কাকু আর গড়িয়ার এনাসুন্দরী কী করে!
‘‘কী ভাই? ধ্যানে বসেছ? এখানেই? ঠাকুর সশরীরে চলে আসবেন যে! তাকে এমন কষ্ট দিয়ো না। ট্রামে যা ভিড়! টিকিটটা বরং কেটে ফেলো তার চেয়ে।’’
কন্ডাক্টর লোকটার কথায় আশপাশের সবাই খ্যাকখ্যাক করে শিয়ালের ডাক দিতে লাগল। অন্যকে মুরগি হতে দেখার চেয়ে বেশি আনন্দ, পটি আর সেক্স করেও পায় না বাঙালি!
আমি চোয়াল শক্ত করে টিকিট কাটলাম। ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে নামব। ওখানেই আমাদের অফিস। দেখলাম আমার পাশে বসা লোকটা তখনও মুখ খুলে হ্যা-হ্যা করে হাসছে।
মনে হল, দিই কানের গোড়ায় একটা। দাঁত মাজে না! গায়ে গন্ধ! নখে ময়লা! এ দিকে অন্যকে অপ্রস্তুত হতে দেখে হাসি হচ্ছে!
মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। মনে পড়ল মা বলেছিল, ‘‘গাড়িটা নিয়ে যা।’’ শুনিনি। এখন ফল ভুগছি।
হ্যাঁ, আমার একটা গাড়ি আছে। ছোট। সেটাও ত্যাগ করেছি। আসলে আমি ঠিক করেছি সব রকম লাক্সারি থেকে সরে আসব। পারলে রাতে মাটিতে শোব। এসি চালাব না। এত দিন অনেক লাক্সারি হয়েছে। জীবনকে পালটে ফেলতে হবে। এখন থেকে, আই উইল লিভ লাইক আ হারমিট।
ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে ট্রমা হয়ে গেল। ট্রামে এত ভিড় হবে, ভাবতে পারিনি। কোনও মতে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু সময় নিলাম। শরীরের সব কিছু ঠিকঠাক নেমেছে তো!
ট্রাম স্টপের উলটো দিকে একটা মল। ছোট হলেও পুরনো, আর ভিড় হয় বেশ। তার পাশ দিয়েই পণ্ডিতিয়া রোড। সেখানেই আমাদের অফিস।
আমার বাবারা তিন ভাই। ওরা তিন জন মিলে তিরিশ বছর আগে শুরু করেছিল এই ব্যবসা। তাদের পরিশ্রমে সে ব্যবসা এখন ফুলেফেঁপে উঠেছে বেশ। নানা রকম প্রোজেক্টের কাজ করি আমরা। আমার বাবা মেজ। প্রোজেক্ট ডিজ়াইন, কোটেশন থেকে শুরু করে প্রকিওরমেন্ট, এ সব দেখে। জেঠু দেখে ফাইন্যান্স আর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। আর ছোটকা দেখে সেলস, মার্কেটিং আর এগজ়িকিউশন।
এই দু’হাজার উনিশ সালেও আমরা জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকি। লেক প্লেসে আমাদের চার তলা বাড়ি। ঠাকুরদা, যাকে মিষ্টিদাদু বলে ডাকি আমরা, পুরনো আমলে তেল কোম্পানির বড়বাবু ছিল। অনেক টাকা মাইনে পেত। দাদুই লেক প্লেসে জমি কিনে বাড়ি করেছিল। ছেলেদের ব্যবসার প্রাথমিক পুঁজিও দাদুই দিয়েছিল।
তো আমাদের এই কোম্পানির কনিষ্ঠ কর্মীটি হলাম আমি, মানে লোহিতাশ্ব মুখোপাধ্যায়। আমার ভাল নামটা যেমন খটোমটো, ডাকনামটা কিন্তু তেমন নয়।
আমার ঠাকুমার প্রিয় ছেলে ছিল আমার বাবা। তাই তার একমাত্র সন্তানের ডাকনামকরণ, নিজের প্রিয় জিনিসের নামেই করেছিল ঠাকুমা। পুঁটি। হ্যাঁ, পুঁটি মাছ ঠাকুমার সব চেয়ে প্রিয় ছিল।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সবার সুন্দর সুন্দর ডাকনামের পাশে নিজের এই পুঁটি নামটা শুনলে খুব খারাপ লাগত। কিন্তু কী করব! তত দিনে তো বাড়ি, পাড়া-সহ স্কুলে পর্যন্ত মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে আমার এই ডাকনাম! আমি মাঝে মাঝে শুধু একটা কথাই ভাবি, ভাগ্যিস ঠাকুমার প্রিয় মাছ শোল, বোয়াল, কাতলা কিংবা পাঙাশ হয়নি!
আমাদের অফিসটা বেশ বড়। তিনতলা। উপরতলার একদম শেষের দিকে বাথরুমের পাশের ঘরে আমার বসার জায়গা হয়েছে। সবে মাস দুয়েক হল জয়েন করেছি আমি। আমার ঘরে সুজয়দা আর রিজু বসে। রিজু আমার সঙ্গে পড়ত। কিন্তু আমার মতো ও মাস্টার্স করেনি। গ্র্যাজুয়েশনের পরেই এখানে জয়েন করেছিল। রিজুর ঠাকুরদা আমার দাদুর বন্ধু ছিল খুব। সেই সূত্রেই ওকে জেঠু এখানে চাকরি দিয়েছে। সেই দিক থেকে রিজুও আমার সিনিয়র। তবু ব্যাটা সারা ক্ষণ বলে, আমি না কি ওর বস!
আমি দশটার মধ্যেই অফিসে চলে আসি। কিন্তু আজ ট্রামের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে সাড়ে দশটা হয়ে গিয়েছে।
পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে, চেয়ারে বসে দেখলাম টেবিলে দু’টো ফাইল পড়ে আছে। কাজ! কিন্তু মাথাটা এমন ঘেঁটে আছে যে, ইচ্ছে করছে না কাজ করতে। গা গুলোচ্ছে ফাইল দেখলে। ইস, কেন যে আজ অফিসে এলাম! তার চেয়ে লেকে বসে থাকলে কাজে দিত। মোবাইলহীন মানুষ এখন আমি। মানে বকলস ছাড়া কুকুর। কেউ কন্ট্রোল করতে পারবে না। ফলে কেউ জানতে পারত না আমি কোথায়।
আমায় দেখে রিজু নিজের টেবিল থেকে উঠে এল। তার পর হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘‘কী রে, আজ লেট করলি? তোকে ফোন করছিলাম। বলল ফোন সুইচড অফ। কেসটা কী?’’
আমি পাশে রাখা বোতল থেকে জল খেলাম একটু। তার পর গম্ভীর ভাবে ফাইলটা টেনে নিলাম। বললাম, ‘‘আমি আজ থেকে মোবাইল ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছি।’’
রিজু থমকে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ভাবটা এমন, যেন এখুনি শুনল, বিড়াল বলছে আর মাছ খাবে না।
ও জিজ্ঞেস করল, ‘‘যাঃ শালা! কেন? এ কী রে? তোর তার কেটে গিয়েছে না কি?’’
আমি চোয়াল শক্ত করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাও, এখন জনে জনে কৈফিয়ত দিয়ে বেড়াও। আগে মাধ্যমিকে অঙ্কে লেটার না পেলে এ ভাবে কৈফিয়ত দিতে হত, আর এখন মোবাইল ব্যবহার না করলে দিতে হয়!
রিজু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তার পর বলল, ‘‘বুঝেছি। নিশ্চয়ই এনা। তাই না?’’
আমি কিছু না বলে আবার জল খেলাম। কেমন একটা দলা পাকানো কষ্ট খাদ্যনালি বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। জল দিয়ে সেটাকেই আবার নীচে নামাবার চেষ্টা করলাম।
রিজু বলল, ‘‘ও তো তোদের চলতেই থাকে। এই নিয়ে কত বার তোকে আউট করল? কুড়ি-পঁচিশ বার হবে, তাই না?’’
আমি পাত্তা দিলাম না রিজুকে। বললাম, ‘‘তোর কাজ নেই?’’
রিজুও আমায় পাত্তা দিল না। বলল, ‘‘তাতে মোবাইল কী দোষ করল রে?’’
‘‘আমি ইউজ় করব না ব্যস!’’ আমি গাম্ভীর্য বজায় রাখলাম, বললাম, ‘‘মোবাইল আসার আগে মানুষ কী করত?’’
রিজু মাথা নাড়ল। তার পর বলল, ‘‘মাইরি কথা বলিস না এমন! নে, কাল থেকে নিমের দাঁতন ব্যবহার করবি তা হলে। ধুতি জড়িয়ে তার তলায় ল্যাঙট পরবি। পায়ে খড়ম দিবি। কানে পইতে জড়িয়ে মাঠে যাবি। আর, আর...’’
বুঝলাম আর কিছু বলার মতো এগজ়াম্পল মনে করতে পারছে না।
আমি বললাম, ‘‘গরুর গাড়ি কলকাতায় পাব না। মা ইলেকট্রিক কানেকশন কাটতে দেবে না বাড়িতে। মাটিতে পিঁড়ে পেতেও খেতে দেবে না। এখন ভাট না বকে নিজের জায়গায় যা।’’
রিজু মাথা নাড়ল নিজের মনে। তার পর বলল, ‘‘তোর আর এনার এই নাটকটা এ বার বন্ধ কর। প্রতি দু’মাসে ব্রেক আপ! তোদের ক্লান্ত লাগে না?’’
আমি জানি রিজু এমনি চুপ করবে না। এ অফিসে এ সব কথা কেউ জানে না। সুজয়দা এসে যাবে যে কোনও সময়ে। ওর সামনে রিজু এ সব শুরু করলে বাজে ব্যাপার হবে।
আমি ফাইলটা টেনে নিয়ে বললাম, ‘‘কাজটাই জীবনে আসল। সেটাই এ বার থেকে করব মন দিয়ে। আর আমার সামনে কোনও মেয়ের কথা বলবি না কিন্তু। বললে এই পেপারওয়েট দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব বলে দিলাম!’’
রিজু থমকে গেল। তার পর নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে বলল, ‘‘ইঃ, কত্ত রোয়াব! এনার সামনে তো গুটিয়ে কেন্নো হয়ে যাস! তখন তুই শালা প্রেমিক না সেক্রেটারি না ওর নার্স বোঝা দায়! বেশ করেছে তোকে আবার লাথ মেরেছে। কর তুই কাজ। আমার সামনে কোনও দিন এ সব নিয়ে কথা বলতে আসিস, দেখ তোকে কী করি!’’
কথা শেষ করার আগেই সুজয়দা ঢুকে পড়ল। হাতে বড় একটা ট্রেসিং পেপারের রোল। কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ।
‘‘কাকে কী করবি রে রিজু?’’
রিজু চুপ করে গেল। সুজয়দা বেশ সিনিয়র। আর ঠোঁটকাটা মানুষ। রিজু সমঝে চলে।
আমি আর কোনও দিকে মন না দিয়ে ফাইল খুলে পকেট থেকে পেনটা হাতে নিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতর ছোট্ট শক লাগল। আরে, এই পেনটা আজও নিয়ে এসেছি! এটাও তো এনা দিয়েছিল আমায়।
পেনটা সরিয়ে রেখে দিলাম। ড্রয়ার থেকে অফিসের পেন বের করে নিলাম। তার পর কিছু ক্ষণ সব ভুলে থাকব বলে ফাইলের মধ্যে ঝাঁপ দিলাম।
কখন ঘণ্টাদেড়েক কেটে গিয়েছে, হুঁশ ছিল না। খেয়াল হল বিনয়কাকার ডাকে।
ক্রমশ
ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy