Advertisement
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪
Smaranjit Chakraborty

চুয়ান্ন

ওর হাসিটা শুনলে যে কোনও লোক চমকে উঠবে। কিন্তু লামা লেবুকে চেনে। তাই চমকাল না।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২০ ০০:০৮
Share: Save:

শুরুর কথা

অমিতাভ বচ্চনকে আমি পুরো মনের ভিতরে নিয়ে নিয়েছি। গুরুর হাঁটা, তাকানো, মাল না খেয়েও মাল খাওয়ার অভিনয়... পুরো, পুরো ভিতরে নিয়ে নিয়েছি আমি। আমরা যারা বচ্চনকে পুরোপুরি ভিতরে নিয়ে নিয়েছি, তারা কোনও দিন মেয়েদের দিকে সরাসরি তাকাই না। তবু আমাদের চোখের ক্যামেরায় সব ধরা পড়ে যায়। কোন বারান্দায় কোন মামণি এসে দাঁড়াল। কোন বৌদি কাপড় মেলতে এল। কোন কাকিমা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পাশের বাড়ির মাসিমার সঙ্গে পিএনপিসি করছে বা পাড়ার কোন উঠতি নায়িকা ঠোঁট ছুঁচোর মতো করে সারা ক্ষণ সেলফি তুলে যাচ্ছে, সব কিছু আমাদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায়! এই যে তোমার বাড়িতে চুরি হল। পাইপ বেয়ে উঠে পাখি বসার জায়গাগুলো ভেঙে, ছাদের ঘর থেকে টিভি আর জামাকাপড় নিয়ে পালাল, সেটাও ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। বুঝলে?’’ লেবু কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে অদ্ভুত শব্দ করে হাসল।

ওর হাসিটা শুনলে যে কোনও লোক চমকে উঠবে। কিন্তু লামা লেবুকে চেনে। তাই চমকাল না। শুধু নরম ভাবে হেসে, জিজ্ঞেস করল, ‘‘তুই দেখেছিস আমার বাড়িতে কে চুরি করেছে?’’

লেবু সেই হেঁচকি তোলার শব্দ করে হাসল আবার। বলল, ‘‘না না, আমি দেখিনি! আমার ক্যামেরা দেখেছে।’’

লামা বলল, ‘‘তা পুলিশ এল যখন, তখন বললি না কেন?’’

লেবু মাথাটা উপরে তুলে কোমরে দু’হাত রেখে অমিতাভ বচ্চনের গলা নকল করে বলল, ‘‘ঠাকুরসাব, ক্যামেরা মে রিল নেহি থা! সমঝে?’’

লামা নিজের মনে মাথা নাড়ল। কী আর বলবে? লেবুকে সেই ছোট থেকে দেখছে। চার ভাই ওরা। বাবার কত বড় কাপড়ের ব্যবসা! পাড়ায় কী বিরাট বাড়ি! সেখানে লেবুটা ছোট থেকেই এমন। মাথাটা কাজ করে না। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হল, কিন্তু কথা বললে মনে হয় বয়স সাত-আট বছরের বেশি নয়। আর হয় কি নয়, অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে নানা কথা বলে যায়! বছর দশেক আগে তো নিজের মায়ের বেশ কিছু গয়না নিয়ে পাড়ার সোনার দোকানে গিয়েছিল বিক্রি করবে বলে! কেন, না, কোথায় পড়েছে অমিতাভের শরীর খারাপ। তাঁর চিকিৎসার খরচ নাকি ও দেবে!

পাড়ার দোকানিটি নেহাত চেনাশুনো। ছোট থেকেই জানে লেবুর অবস্থা। তাই ওকে কিছু না বলে বাড়িতে ফোন করে দিয়েছিল।

দাদারা এসে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওকে। চড়-চাপড়ও মেরেছিল।

পরে লামা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘তুই এমন করলি কেন? নিজের বাড়ির সোনা কেউ ওই ভাবে বিক্রি করতে নিয়ে যায়?’’

লেবু দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলেছিল, ‘‘বচ্চনের শরীর খারাপ। ওঁর তো চিকিৎসার খরচ আছে, না কি? ছেলেটা তো কিছু রোজগার করে না। তাই ভাবলাম। দেখো না সিনেমায় সবার জন্য কত করে লোকটা। বুড়ো বয়সে আমরা না দেখলে ওঁকে কে দেখবে বলো!’’

পাশ দিয়ে পাড়ার মুকুলদা যাচ্ছিল। ওর কথা শুনে খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলেছিল, ‘‘পাগল কি গাছে ফলে?’’

লেবুকে পাড়ার মোড়ে রেখে নিজের বাড়ির দিকে এগোল লামা। মনটা ভাল নেই। কাল রাতে এমন একটা চুরি হয়ে গিয়েছে বাড়িতে!

নরেন্দ্রপুরে ওর বাড়িটা বেশ বড়। গাছপালা ঢাকা। বাগান আছে। সঙ্গে ছোট একটা মাঠ মতোও রয়েছে এক পাশে। পুকুরও আছে বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে। অনেক পাখি আসে বাড়িতে। ছাদে পাখিদের জন্য বসার জায়গা, খাবারের বাটি, জল সব থাকে।

চোরটা অন্ধকারের মধ্যে পাইপ বেয়ে উঠে সব তছনছ করে দরজার খিল খুলে ছাদের ঘর থেকে কিছু জিনিস নিয়ে গিয়েছে। এখনকার দিনে টিভি পাতলা বলে ছাদের ঘর থেকে সেটাও নিতে পেরেছে।

না, জিনিস গিয়েছে বলে আফসোস নেই লামার। পাখিদের বসার জায়গাগুলো ভেঙেছে বলেই কষ্ট হচ্ছে। ও বুঝতে পারছে এ সব আসলে রাগ থেকে করা। কিছু দিন আগে কয়েকটা ছেলেকে চাঁদা তোলা নিয়ে বকুনি দিয়েছিল বলে এ সব হল।

লামার বাড়িতে জগন্নাথ আর মিনতি থাকে। ওরা স্বামী-স্ত্রী। সারা ক্ষণের কাজের লোক। কিন্তু দু’জনেই ঘুমোলে মড়া। আর লামাও আজকাল কানে কম শুনছে। ফলে কেউ কিছু বুঝতে পারেনি।

বাড়ির গেট খুলে বাগানে পা দিয়েই লাল স্কুটিটা দেখতে পেল লামা। বুঝল পাগলিটা এসে গিয়েছে। না, চুরির খবর পেয়ে নয়। মাঝে মাঝে যেমন আসে, তেমনই এসেছে মেয়েটা। কিন্তু এও জানে, এসে চুরির খবর শুনলেই চেঁচাবে। বলবে, ‘‘বলেছিলাম সিসিটিভি লাগাতে। গার্ড রাখতে। শোনো না তো! এত পয়সা নিয়ে কী করবে? দাঁড়াও তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করছি। বৌ এলে কান ধরে সব করাবে!’’

লামা হাসল। গেটটা বন্ধ করে এগোতে লাগল বাড়ির দিকে। সাবুর কাছে বকুনি খেতে হবে আজ। মনটা ভাল হয়ে গেল ওর। সাবু ওর নিজের নাতনির মতো। খুব ভালবাসে ওকে। মুখটা দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। ‘নাতনির মতো’ কথাটার মধ্যে এই ‘মতো’ শব্দটা ভাল লাগে না ওর। লামা ভাবে, সেই সময়ে প্রভা যদি একটু সাহস করত, তবে এই ‘মতো’ শব্দটা এসে বসত না নাতনির আগে! তবে আর ভেবে কী হবে! প্রভা এই পৃথিবী ছেড়ে কবেই চলে গিয়েছে!

মনখারাপের একটা ছোট্ট টুনটুনি বুকের মধ্যে ফুড়ুক করে উড়ে নিল একটু। পাঁজরের মধ্যে থেকে মুখ বার করে পিকপিক করে ডাকল দু’বার। না, এ সব ভাববে না লামা। যে কষ্টের নিরসন নেই তাকে প্রশ্রয় দিয়ে কী হবে?

গাছের ফাঁক দিয়ে আলো এসে তেরছা ভাবে পড়ছে সামনের মোরামের রাস্তার উপর। হাওয়া দিচ্ছে অল্প। জুন মাসের উনিশ তারিখ আজ। তবু বৃষ্টি এল না এখনও! কবে আসবে বর্ষা?

দীর্ঘশ্বাস চেপে মূল বাড়ির দিকে এগোল লামা।

পুঁটি (দিন: এক)

এনাকে ছাড়া আজ আমার জীবনের প্রথম দিন। আকাশ ফাটিয়ে রোদ উঠেছে শহরে। জুনের উনিশ তারিখ আজ। তাও বৃষ্টির দেখা নেই! মনে হচ্ছে এক কড়া ডাল কেউ উপুড় করে দিয়েছে শহরের মাথায়! রাসবিহারী মোড়টা যেন গিঁট লেগে যাওয়া পাজামার দড়ি! সিগনাল থাকলেও চার জন পুলিশ, রেফারি আর লাইন্সম্যানের মতো এ দিক-ও দিক দৌড়চ্ছে ঊর্ধ্বশ্বাসে! যেন কেউ এক্ষুনি ফাউল করে দেবে! হ্যান্ড বল করে দেবে! কর্নারে ঠিক মতো বল বসাবে না! পেনাল্টি বক্সে ঢুকে আসা প্লেয়ারকে পিছন থেকে ট্রিক করে ফেলে দেবে!

আমি ট্রামের জানলা দিয়ে দেখলাম, সামনে চারটে অটো নিজেদের মধ্যে রোঁয়া ফোলানো বিড়ালের মতো গরগর করে ঝগড়া বাধানোর তাল করছে। বেশ কয়েকটা নীল হলুদ পাবলিক বাস, পাবলিকের সেফটি তুচ্ছ করে জেব্রা ক্রসিংয়ের উপর উঠে রিলে রেসে ব্যাটন পাওয়ার আগের দৌড়বীরের মতো ছটফট করছে। আর ইয়া মোটা একটা লোক, বিশাল বড়, এ পাড়া থেকে ও পাড়া অবধি লম্বা একটা গাড়ির পিছনের সিটে বসে প্রায় মোবাইলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এমন যুদ্ধ লাগবে লাগবে রাসবিহারী মোড়ে লোকটার নিশ্চিন্তি ভাব দেখে আমি বুঝলাম, লোকটার নিশ্চিত বোধি লাভ হয়ে গিয়েছে। সত্যি আজকাল মানুষ অন্য কোথাও মন দিতে না পারলেও মোবাইলের দিকে এমন করে মন দেয়, যেন ব্রহ্মলাভ ওখানেই হবে!

আমার ব্রহ্মলাভ আর হবে না। কারণ আজ থেকে আমি মোবাইল ছেড়ে দিয়েছি। হ্যাঁ, আপনারা ঠিক পড়ছেন। আমার আর মোবাইলের পথ আলাদা হয়ে গিয়েছে।

কার জন্য মোবাইল রাখব আমি? কার ফোনের আশায় বসে থাকব? কার মেসেজের পিং শব্দে আবার বুকের মধ্যে কাঠবিড়ালি লাফাবে? কে রাতে শুতে যাওয়ার আগে ভিডিয়ো কল করে আমায় দেখাবে, আজ কোন কবিতার বই নিয়ে শুতে গেল? কেউ না, কেউই না। কারণ এনা আমার সঙ্গে সব যোগাযোগ শেষ করে দিয়েছে।

তাতে কী হল? আপনাদের মনে হতেই পারে, একটা মেয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে বলে তুমি ভাই মোবাইল ছেড়ে দেবে? এটা কোনও কথা হল? তোমার চরিত্রের দৃঢ়তা নেই? তুমি বিবেকানন্দ পড়োনি? প্রেমটাই কি সব? এ সব ন্যাকামো না করলেই নয়!

জানি এ সবই ভাবছেন হয়তো। স্বাভাবিক। মানুষ অন্যের জীবন নিয়ে পোদ্দারি করতে খুব পারে। নিজের সঙ্গে এমন হোক না, তখন বুঝবেন। মানুষের ব্যাপারটাই এমন। সারা জীবন অন্যকে নিয়ে মন্তব্য করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই যেন। বিশেষ করে প্রেমের ব্যাপার হলে তো কথাই নেই! সারা রাজ্যের যত জ্ঞান নিয়ে এসে বাড়ি বয়ে

দিয়ে যাবে!

এ দিকে নিজের অমন প্রেম ঘেঁটে গেলে শুরু হবে ডিপ্রেশন, ঘ্যানঘ্যানানি, কান্নাকাটি, হোয়্যাটসঅ্যাপ থেকে ডিপি উড়িয়ে দেওয়া, মনখারাপের স্টেটাস দেওয়া, ফেসবুকে দু’কিলোমিটার লম্বা দুঃখের কোট দেওয়া থেকে শুরু করে আরও কত কিছু! যাকে বলে নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা! তখন আর মনে থাকবে না অন্যের বেলায় নিজে কতটা জ্ঞানদাতা হয়েছিলেন! শালা, ডাবল স্ট্যান্ডার্ডনেস দেখলে মনে হয় এভারেস্টে উঠে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করি!

‘‘ভাই, টিকিট।’’

পাশ থেকে আওয়াজ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম। অফিস টাইমের ট্রাম। ভিড় আছে। বেশ কিছু লোকের মাঝখান থেকে রোগা কন্ডাক্টরটি অর্ধেক শরীর বার করে, হাত বাড়িয়ে রয়েছে। লোকটার হাতে ছ’-সাতটা আংটি।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Smaranjit Chakraborty Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy