Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১০

পরিক্রমণ

বুড়ি মাথা নেড়ে নেড়ে, শনের মতো কাঁধ ছোঁয়া পাতলা ক’টি চুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে হেসেই যাচ্ছে।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু অধিকারী
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: তিয়াষা সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করে ডাক্তার অভিরূপের। নিমরাজি হয়ে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। হাসপাতালে ঘটে যাওয়া এক অঘটনে জড়িয়ে গিয়েছে ডাক্তারের নাম। সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ সেটাই। তিয়াষার সঙ্গে কথা বলে অভিরূপের মন কিছুটা হাল্কা হয়। কিন্তু অভিরূপের মনের মধ্যে ঘোরে একটাই প্রশ্ন, কে হতে পারে তার শত্রু?

বুড়ি মাথা নেড়ে নেড়ে, শনের মতো কাঁধ ছোঁয়া পাতলা ক’টি চুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে হেসেই যাচ্ছে। পাশে নাতি বসে আছে এক মুখ অস্বস্তি নিয়ে। দিদিমা এই ডাক্তারবাবুকে দেখতে পেলেই হল, এক দম হেসে গড়িয়ে পড়বে প্রতি কথায়। খুবই প্রিয় এই ডাক্তার। অভিরূপ মহিলাকে বিছানায় শুইয়ে স্টেথো চাপে বুকে। দিদিমার হাসি অম্লান।

“কী হল দিদিমা? এত হাসি কীসের? আছেন কেমন?”

“হ্যা বাবা, খেয়েছি। না খেলে কি নাতবউ ছাড়বে? সকালে একগেলাস হল্লিস আর সন্দেশ খাইয়ে তবে ছেড়েছে।”

“আরে... আছেন কেমন?’’ অভিরূপ কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জোরে জোরে বলে। এবার ঢুকেছে কানে। ওমনি হাসি বন্ধ। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে সরলা।

“আর বল কেন বাবা। দিনরাত বুকের এই মেশিনটা থেকে গান বাজছে।’’

“গান? সে কী! পেসমেকার কোম্পানি কি আজকাল মিউজ়িকাল মেশিন তৈরি করছে?”

নাতি এগিয়ে আসে, “না...না ডাক্তারবাবু, দিদিমার যত উদ্ভট কথা।”

“ওঁকেই বলতে দিন,” অভিরূপ আবার সরলার কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে, “কী গাআআআন?”

ডাক্তারের প্রশ্ন শুনে খুশিটা মুখে চোখে ফিরে আসে, “এই ধরো, সকালে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ আবার...’ রাত্তিরে মাঝে মাঝে ‘তিষিত এ মরূ...’”

“তা দাদু বুঝি গাইতেন এ সব গান?”

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

খুব জোরে না চেঁচালেও এবারের প্রশ্নটা কী করে যেন কানে ঢুকে যায় এক বারেই। ফোকলা হাসি হেসে সলজ্জ গর্বিত স্বরে বলেন সরলা, “সে মানুষটা ভাল গাইয়ে ছিল বাবা। এরা মা ব্যাটায় কেউ তার মতো হয়নি।’’

“ওই জন্যই আপনি গান শুনতে পাচ্ছেন। ভাল তো!” নাতির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে অভিরূপ। সরলার পেসমেকার বসেছে সাতবছর আগে। বেশ ভালই চলছে। কোথাও কোন সমস্যা নেই। আগের ওষুধই চলবে। কিন্তু সব ভাল আছে শুনে সরলা খুশি হতে পারেন না। তিনি নাতিকে দাঁড়াতে বলে ডাক্তারের কানের কাছে মুখ এনে বলেন যাবতীয় জ্বর কাশি মাথা ব্যথা আর পাতলা পায়খানার বৃত্তান্ত।

“আহ দিদিমা চল এখন। অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে।”

“তুই থাম না। ডাকদার ওষুধ দেবে তবে তো যাব।”

অভিরূপ গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে, “আচ্ছা দিদিমা, আপনি বাড়ি যান। আপনার পাতলা পায়খানার ওষুধ আমি পাঠিয়ে দেব।’’

( ৬ )

আমি উদ্দালক শঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। এত ভাল নামটা এখন আর কেউই জানে না বোধহয়। যারা জানতো তারা ভগবানের প্রিয় হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু আমি নিজেই নিজেকে এই গাল ভরা নামে ডেকে থাকি। আর সবাই অর্থাৎ যারা আমায় ডাকে বা যাদের আমাকে ডাকার প্রয়োজন হয় তারা যখন তখন হাঁক পাড়ে “অ্যাই শঙ্কা পাগলাআআ...” বলে। আমি তাদের কিচ্ছু বলি না। একবারও বলি না যে আমি পাগল নই। যারা আমায় পাগলা বলছে তাদের থেকেও বেশি আমার জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনা। আর এটাও জানি যে আমার এই জানায় কোনও ভুল নেই। কিন্তু এই ব্যাপারটা কেউ যে মানে না, সেটাও আমি জানি। সে না মানুকগে। এই পৃথিবীতে কে বা কাকে মানছে! সবাই তো চলেছে নিজের মর্জি মতো। চলতে ফিরতে ঠোকাঠুকি। তাই তো সারাক্ষণ এতো কিচিরমিচির। এসব আমার ভাল লাগে না। এসব দেখে কাটালে আমার চলবেও না। আমার অনেক কাজ!

এবারে প্রশ্ন আসবে যাকে লোকে শঙ্কা পাগলা বলে চেনে তার আবার কী কাজ? আছে...আছে, অনেক কাজ আছে।

এই তো আমি এখন বাইপাসের ধারে রাক্ষসের মতো দাঁড়িয়ে থাকা পেল্লায় শপিংমলে এসেছি। একটা বাসে উঠে চলে এলাম। এখন আর আমার কাছে কন্ডাকটররাও টিকিট চায় না। চেহারাটা এতটা পালটে গিয়েছে! বাইরে থেকেই সবাই বুঝে যায় যে আমার এই ঝোলা পকেটটাতে একটাও পয়সা নেই। এতে অবশ্য আমার ভালই হয়েছে। শরীর হাল্কা লাগে। এদিক ওদিক থেকে কী করে যেন পেট ভরানোর মতো খাবার জুটেই যায়। বাকি সময় আমার রিসার্চের কাজে খরচ করি। এখানে প্রশ্ন উঠবে আমার গবেষণার বিষয় কী। হ্যাঁ সেই টা বলব বলেই এত কথার আয়োজন। আমার গবেষণার বিষয়, মানুষ। না, এটা ডারউইন সাহেবের বিবর্তনের তত্ত্ব নয়। এটা বর্তমান মানুষের মানসিক এবং সামাজিক বিবর্তনের একটা প্রামান্য বিবরণ। এই বিবরণ কোনও খাতা কলমে ধরা নেই। লাইন বাই লাইন ধরা আছে এই উদ্দালক শঙ্করের মগজে।

মনে মনে কথা বলতে বলতে উদ্দালক এগিয়ে যায় মলের ভিতরে। কাচের দরজাটা বেশ মজার। ও গিয়ে দাঁড়াতেই নিজে নিজেই খুলে গিয়ে দু’পাশে সরে যায়। বাইরের দিকে দু’জন সিকিউরিটি নাক কুঁচকে তাকায়। কিন্তু কিছু বলে না, বাধাও দেয় না। কিছু দিন আগে ধুতি পরা একজনকে মলে ঢুকতে বাধা দেওয়ার কী ফল হয়েছিল, তা সবাই জানে। এখন সবাই মেনে নিয়েছে বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতি ধর্ম বর্ণ পোশাক বা পকেট নির্বিশেষে সকলের অধিকার আছে পাবলিক প্লেসে যাওয়ার। উদ্দালক সিকিউরিটিদের বিরক্তি পাত্তা দেয় না। মলের ভিতর ঢুকে যায় সে। উদ্দালক ঘুরতে থাকে সুসজ্জিত লোভনীয় দ্রব্যসামগ্রীর হাতছানি দেওয়া এক মায়ারাজ্যে। মুখে লেগে থাকা হাল্কা হাসিটুকু আস্তে আস্তে চওড়া হতে হতে এক সময় পুরোটাই ছড়িয়ে যায়।

এরকম একা একা হাসতে থাকা লোককে অন্যরা পাগলই বলবে। তাদের দোষ দিই না আমি। আমার হাসি, কান্না— একান্ত নিজের। আর পাগল ভাবলেই বা কী? এই জগতে কেই বা একটু আধটু পাগল নয়! হিসেব মতো দেখতে গেলে সব মানুষই পাগল। কেউ টাকার জন্য, কেউ খ্যাতির জন্য কেউ বা ভালবাসার জন্য। আরও হরেক ধরনের পাগলের সন্ধান আছে আমার কাছে। এত দিন এত বছর ধরে গবেষণা করে করে মগজের মধ্যে নানারকম পাগলামি লিপিবদ্ধ করে ফেলেছি আমি। এই যে মানুষগুলো কেবল কিনছে জামা, জুতো, ঘড়ি, বেল্ট, টাই, ব্যাগ, ছাতা, বাটি, থালা, পাপোশ, ঝাড়ন... আরও কত কত জিনিস। যা পাচ্ছে তাই কিনছে। ট্রলি ভর্তি করে ইয়া ইয়া প্যাকেট নিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে, যারা জানেও না প্যাকেটের ওই জিনিসগুলোর সত্যি কোনও দরকার আছে কিনা তাদের জীবনে, নাকি শুধু কেনার জন্যই কেনা। দু’দিন পরে আবর্জনার স্তুপের মতো পড়ে থাকবে ঘরের এক কোণে, তবু কিনেই যাচ্ছে কিনেই যাচ্ছে, এদেরও বা পাগল ছাড়া কি বলা যায়! অথচ এই লোকগুলো কোথাও গিয়েই সিকিউরিটির কোঁচকানো চোখ দেখতে পায় না। কারণ এদের জামাকাপড় চকচকে। গালগুলোও চকচকে। এদের চট করে পাগল বলে চেনাই যায় না। কিন্তু আমি এদের চিনি। কারণ আমি মানুষ নিয়ে গবেষণা করি। সেই গবেষণার জন্য আমাকে সারা দিন গোটা কলকাতা চষে বেড়াতে হয়। শুধু শপিং মলে নয়। আরও অনেক জায়গায় যেতে হয়। আর এই নানা জায়গায় যেতে যেতে আমার দেখা হয়ে যায় কত চেনা মানুষের সঙ্গে। তারা কিন্তু আমাকে দেখতে পায় না। তারা আমাকে প্রায় চেনেই না। চেনে না কারণ খুব কাছে দিয়ে হেঁটে গেলেও তারা আমাকে লক্ষ্যই করে না।

সবাই অবশ্য এক রকম নয়। কেউ কেউ চেনে আমাকে। আমাকে যখন কেউ দেখে, তখন যদি আমি তার দিকে না তাকিয়েও থাকি, তা হলেও আমার ভিতরে একটা তরঙ্গ তৈরি হয়, যা দিয়ে অনুভব করতে পারি কে আমাকে দেখেছে। আর সেই অনুভূতি থেকে তাদের সঙ্গে একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে যায়। তখন মনে মনে সেই মানুষটিকে আমি আমার আপনজনের তালিকায় ঢুকিয়ে নিই। তার অবশ্য এসব জানার কথা নয়।

এই যেমন এখন দাঁড়িয়ে একটা নামী রেস্তোরাঁর সামনে। এখানে মাঝে মাঝে এসে দাঁড়িয়ে থাকি। কারণ এই রেস্তোরাঁয় এমন অনেক মানুষ আসেন যাদের পেটে খিদে থাকে না। কেউ অবশ্য সত্যি খেতে আসে। কেউ আসে বৌ বা বান্ধবীর আবদারে। কেউ একা একা মদ খেতে। হয়তো দুঃখ ভুলতে। আমার মতে প্রথমটা বাদে বাকি দুটোই পাগলামি। কিন্তু এখন যাকে দেখতে পাচ্ছি সে তো আমার হিসেব মতো পাগলের তালিকার লোক নয়। বরং উল্টোটা। মাত্র ক’দিন আগেই একে আমি আমার আপনজনের তালিকায় তুলেছি। কিন্তু এই লোকটিও কি পাগল হয়ে গেল? নইলে রেস্তরাঁর না ঢুকে, আমার দিকে তাকাবে কেন? আমার দিকেই বা এগিয়ে আসছে কেন? কিন্তু একে তো পাগল হলে চলবে না। এর ওপরে তো ভুবনের ভার। যতটুকু জানি, এ ভিতুও নয়। ভুবনের ভার বইতে পারার সাহস ও শক্তি দুইই তার আছে। সেই জন্যই তো আমার আপনজনের তালিকায় এর নাম আছে। কিন্তু সে কেন আমার দিকেই এগিয়ে আসছে? ঠিক যেমন করে এক জন চেনা মানুষ এগিয়ে আসে তার অতি পরিচিত কারও দিকে!

অভিরূপ উদ্দালকের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকিয়ে থাকে চোখে চোখ রেখে। কোন কথা বলে না। তার পর সহজভাবে নিঃশ্বাস ছাড়ে। যেন এই দেখা হওয়াটা স্বাভাবিক।

“কী ব্যাপার? কী করছেন এখানে?’’

“রিসার্চের কাজে এসেছিলাম। আপনি?’’

উত্তর শুনে চমকায় না অভিরূপ। অন্যমনস্ক ভাবে বলে , “আমারও একটু রিসার্চের কাজই ছিল। কিন্তু সেটা আর হবে না মনে হচ্ছে আজ।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy