Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ২৭

পরিক্রমণ

সকাল থেকেই উদ্দালকের মাথার ভিতরটা কেমন যেন তোলপাড় করতে লাগল। কে যেন ঘিলুগুলো দশ আঙুলে ধরে চটকে দিতে লাগল প্রবল ভাবে।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু
শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: ডাক্তার সুমন সেন ধরে নিয়েছিল তিয়াষাই অভিরূপের স্ত্রী। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই ভুল ভেঙে দেয় অভিরূপ। এমনভাবে কথাটা বলে যে, মনে আঘাত পায় তিয়াষা, অবাক হয় অরুণও। এদিকে বাকিরা সবাই মিলে মেতে উঠে পার্কস্ট্রিটে খেতে যাওয়ার জন্য। সবাই এগিয়ে যায়। তিয়াষাকে ফেলে এগিয়ে যায় অভিরূপ। একবারও সে ফিরে তাকায় না। এই অবজ্ঞা মেনে নিতে পারে না সে। যেতে চায় না পার্কস্ট্রিটে। অরুণ তাকে চাপাচাপি করলে, অরুণকে অভিরূপ বারণ করে। এদিকে হাসপাতালের চত্বর ছাড়িয়ে গঙ্গার ধারে গাছের তলায় বসে সুছন্দার কথা ভাবে উদ্দালক।

সুছন্দা নিজের মনে কাজ করে, পেশেন্ট অ্যাটেন্ড করে, বারবার হেঁটে যায় সামনে দিয়ে। কখনও এক ঝলক হেসে যায় উদ্দালকের মুখের দিকে তাকিয়ে। তখন সেই মুহূর্তগুলোয় আর নিজেকে পাগলা বলে ভাবতে ইচ্ছে হয় না উদ্দালকের। সে কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক।

বেশ কেটে যাচ্ছিল দিন। আজ সকাল থেকেই হঠাৎ মাথার ভিতরটা কেমন যেন তোলপাড় করতে লাগল। কে যেন ঘিলুগুলো দশ আঙুলে ধরে চটকে দিতে লাগল প্রবল ভাবে। তখনই বোঝা গেল, গবেষণার কাজটা অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে। এ বার শেষ করা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ। তখন আর সামনে কোনও কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। বেহালা, মিউজ়িক কর্নার বা সুছন্দার আনাগোনার মায়া ছেড়ে নেমে পড়তেই হয় অনির্দিষ্টের পথে। সেই মতো মাথার ভিতরে গোছা গোছা ফাইলপত্তর সব সাজিয়ে নিয়ে সকলের অজান্তে সক্কালবেলা হাসপাতাল ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছিল উদ্দালকশঙ্কর। কালো জামা সাদা প্যান্টে সজ্জিত পুরোদস্তুর উদ্দালকশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না কী অসম্ভব সব কার্যকলাপ ঘটে চলেছে তার মগজের ভিতরে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে রেকর্ড হয়ে চলেছে অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি। যার সিরিয়াল ফাইলিং শুধু উদ্দালকই পারে, আর কারও দ্বারা সম্ভব নয়।

ধর্মতলা এসে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল উদ্দালক। সেখানকার এক পাঁচতারা হোটেলকে ভাল করে দেখে নেয় কপাল কুঁচকে। চোখের উপর হাত তুলে, ডাইনে বাঁয়ে হাত মেলে। সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে দু’দিকে। সাহেবরা বেশ ভেবেচিন্তেই ভবিষ্যতের হকার-রাজ অনুমান করে হোটেলটা বানিয়েছিল। এ কথা মানতেই হবে। বাজারি ভিড়ের ঠেলা গুঁতো খেতে খেতে স্রোতে ভাসা হয়ে নিউ মার্কেটের দিকে এগোতে এগোতে ভাবছিল উদ্দালক। আজ কে জানে ইদ না দুর্গাপুজো না কি দশেরা? গুড ফ্রাইডে না ক্রিসমাস? কিছু একটা হবে, সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষই তাই আজ ধর্মতলায়। তাদের মধ্যে অনেকেই এই পথের দু’পাশে অবিশ্রান্ত ভাজা হতে থাকা চাউ নামের সুতলি দড়ির মতো খাদ্যবস্তুটি দিয়েই ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতেই হচ্ছে। এই পাঁচতারা হোটেলের কাছে একটা বহু পুরনো কেকের দোকান আছে, সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল উদ্দালকের। সে দেখতে চেয়েছিল, ক্রেতারা যখন বড় বড় কেক কিনে দোকান ছেড়ে যায়, তখন দোকানের বাইরে বসে থাকা মেয়েটা কেমন ভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই নিয়ে একটা চ্যাপ্টার লেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু লোকের ধাক্কায় ধাক্কায় উদ্দালক নিজেকে আবিষ্কার করল একটা বড় জুতোর দোকানে। যেখানে ঢুকে ও প্রথম জানতে পারল, এক সঙ্গে পনেরো হাজার লোক কী ভাবে জুতো কেনে। এত মানুষের একই দিনে একই দোকান থেকে এক সঙ্গে জুতো কেনার দরকার, এটা জেনে প্রথমটা তাজ্জব বনে গিয়েছিল উদ্দালক। এদের সবারই কি এখনই জুতোর প্রয়োজন! দোকানের ভিতরের চলন্ত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সামনের লোকের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে নিজের নাকের সামনে নিজের প্রায় ফর্দাফাই হয়ে আসা জুতোসুদ্ধ ডান পা’খানা তুলে দেখছিল ও। নাহ... এইটুকু ছেঁড়া তো কোনও ব্যাপারই নয়, এখনও কয়েক যুগ চলবে এই জুতো। নিশ্চিন্ত হয়ে পা শূন্যে তুলেই মাথা নাড়ছিল উদ্দালক, আর ঠিক সেই সময়েই দু’জন গার্ড এসে ওকে দু’দিক থেকে চেপে ধরে দোকানের বাইরে বার করে দিয়েছিল। প্রথমে উদ্দালক চেঁচাতেই যাচ্ছিল। কিন্তু তার পরই ওর মনে পড়ে, এই গার্ডদের জন্য বা এই জুতোর দোকানে ভিড় করে আসা পাগলদের জন্য কোনও চ্যাপ্টার লেখার প্ল্যান তার নেই। তাই এদের নিয়ে কোনও গবেষণার দরকার নেই এই মুহূর্তে। আর কোনও দিকে না তাকিয়ে কোনও রকম চেঁচামেচি না করে সোজা হাঁটতে শুরু করেছিল উদ্দালক। কতক্ষণ হেঁটেছে সে সব খেয়াল করেনি। অনেকটা সময় হেঁটে এই এখন প্রিন্সেপ ঘাটের সেই ঝাঁকড়া গাছটার তলায় এসে বসেছে। বসেছে আর বসেই আছে। সামনে দিয়ে ভেসে যাওয়া গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ক্রমেই শান্ত ধীর হয়ে আসছিল উদ্দালকের সহস্র প্রশ্নজর্জরিত মন। কিন্তু হঠাৎ করেই এক নজর সামনে তাকিয়ে থেমে গেল এতক্ষণের থিতিয়ে আসা মনের জটিলতম সঞ্চালন।

বড় গাছটার তলায় বসে আছে উদ্দালক। সামনে দিয়ে অসংখ্য সিঁড়ি নেমে গিয়েছে জলের বুক অবধি। সময়টা মাঝদুপুর। কম লোক। এ দিক- ও দিক কিছু ছেলেমেয়ে ঘনিষ্ঠ ভাবে বসে আছে আঙুলে আঙুল জড়িয়ে। উদ্দালক খুব মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল প্রেম করার সময় ছেলেমেয়েদের মুখের ভাবখানা ঠিক কী রকম হয়। অনেক ক্ষণ থেকে দেখে দেখে উদ্দালক এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে প্রেমের সময় একটা নতুন ধরনের আলো খেলা করে চোখেমুখে, যেটা একেবারে সদ্য বিয়ে হওয়া দম্পতির মধ্যেও থাকে। কিন্তু বিয়ে একটু দরকচা মারলেই সেই আলোটায় একটা কালচে ছাপ পড়তে থাকে। একটু একটু করে মেচেতার মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে চামড়ার তলায় তলায়। তার পর এক সময় সুস্পষ্ট ফুটে ওঠে সম্পর্কের নানা ওঠাপড়ার দাগচিহ্ন হয়ে। অর্থাৎ উদ্দালকের গবেষণা অনুযায়ী ছেলেমেয়েদের মুখের দাগছোপ রঙ ইত্যাদি থেকেই তাদের প্রেমজীবন, বিবাহিত জীবন ইত্যাদি সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায়। উদ্দালক এ ব্যাপারে ওর পেপারে একটা অংশ রাখবে ভাবছে, কারণ সব সময় যে ওর থিয়োরি ঠিক হবে তার কোনও মানে নেই, ভুলও হতে পারে এক-আধ বার। আর, এই যে প্রভাইসোর কথা মাথায় এল এ রকম ছোটখাটো ব্যাপারগুলো থেকেই উদ্দালক বুঝতে পারে মানুষ কতখানি ভুল করে ওকে শঙ্কা পাগলা বলে ডাকে। নিজেকে নিয়ে ওর ভুল ধারণা নেই। বরং নিজের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার উপর আছে অসীম আস্থা।

সেই আস্থা নিয়েই তীব্র দৃষ্টিতে সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে উদ্দালক। এক ধাপ এক ধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে মেয়েটি। জলের একদম কাছে চলে গিয়েছে। কিন্তু ওর হেঁটে যাওয়াটা যেন কেমন কেমন। ও যে ক্রমশ জলের কাছে চলে গিয়েছে, তা যেন ও নিজেই জানে না। এই মেয়েটিকে তো দেখেছে উদ্দালক। এই মেয়েটা সেই মেয়েটা না? সেই সেই সেই মেয়েটা? কিন্তু কোথায় দেখেছে ওকে? দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে, মাথার চুল মুঠো করে ধরে উপরে নীচে ঝাঁকিয়ে, অনেকক্ষণ আকাশের দিকে, বয়ে যাওয়া গঙ্গার দিকে তাকিয়েও কিছুতেই মনে করতে পারে না উদ্দালক, কোথায় দেখেছে মেয়েটাকে। চোখের উপর দিয়ে এক পা এক পা করে মেয়েটা জলে নেমে যাচ্ছে। চার পাশে তাকায় উদ্দালক। তিন চার জোড়া ছেলেমেয়ে এ পাশে ও পাশে বসেছিল। তাদের মধ্যে এক জোড়াই আছে এখন। বাকিরা কখন উঠে চলে গিয়েছে সে খেয়াল করেনি। যে যুগলটা বসে আছে, তারাও একটু আড়াল খুঁজে নিয়ে নিজেদের মধ্যেই মগ্ন, কোনও দিকে তাদের নজর নেই। আর কাউকে না খুঁজে পেয়ে নিজেই নামতে থাকে উদ্দালক। মেয়েটা জলের মধ্যে তিন চার ধাপ নেমে চুপ করে ও পারে তাকিয়ে আছে। যেন কার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে দূরের দিকে, কেউ বুঝি খেয়া নৌকো চেপে এখনই আসবে ওর কাছে। এমন ধীর শান্ত সেই চেয়ে থাকা যে পিছন থেকে উদ্দালকের মনে হয় বড় চেনা এই অপেক্ষার ভঙ্গিটি। আর কোনও কিছু ভাবনার নেই, খোঁজার নেই, উদ্দালক হাত বাড়িয়ে দেয় মেয়েটার দিকে। সে বুঝি আরও এক ধাপ নামার জন্য পা বাড়িয়ে দিয়েছিল। উদ্দালকের হাতের ছোঁয়ায় থেমে যায় সেই বাড়ানো পা। থমকে পিছন ফিরে তাকায় মেয়েটা। খানিকক্ষণ মাত্র। তার পরেই ভারী আপনজনের মতো হেসে সে বলে ওঠে, “ও ... আপনি? এসেছেন? কখন এসেছেন?’’ ভারী স্বাভাবিক সেই কথা বলার ভঙ্গি, যেন উদ্দালকের এই আসাটা কোনও হঠাৎ ঘটে যাওয়া ব্যাপার নয়, যেন আসার কথাই ছিল।

ওর তাকানো, কথা বলা, হাসির দিকে চোখ মেলে থেকে উদ্দালকের মাথার ভ্রষ্ট স্মৃতি ফিরে আসে। এক ঝলক রোদ্দুরের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে ঢাকা পড়ে যাওয়া গবেষণার কাজ। এই তো সেই মেয়েটি। তিয়াষা। একে তো কত বার দেখেছে ও। উজ্জ্বল আগুনের শিখার মতো ঝলমল করতে দেখেছে এই মেয়েকে। কখনও একা, কখনও আরও কয়েক জন কাগজের অফিসের লোকের সঙ্গে। তার পর তো বেশ কিছু দিন ধরে ডাক্তারবাবুর সঙ্গেই দেখেছে কত বার। ওদের দু’জনকে পাশাপাশি বেশ মানায়। এ কথাও তো মনে মনে বেহালা বাজাতে বাজাতে ভেবেছে, যদিও সেই ভাবনার কথা কাউকে মুখ ফুটে বলেনি উদ্দালক। এমনিতেই লোকে ওকে শঙ্কা পাগলা বলে ডাকে, তার উপর এ রকম একটা কথা ওর মুখ থেকে শুনলে যে লোকে সেটাকে নিয়ে আরও বেশি হাসাহাসি করবে, সেই হাসাহাসির ফলে মানুষ দুটোর মান খাটো হবে, সেই জ্ঞানটা ওর আছে। আরও জ্ঞান আছে যে, এই রকম সব ছোটখাটো বিষয় থেকেই উদ্দালক বুঝতে পারে সে পাগল নয়। ও একজন গবেষক। বরং তাকে যারা পাগল বলে তারাই পাগল।

তিয়াষাকে চিনতে পারার মুহূর্তে সেই গবেষকের গলায় বলে উদ্দালক, “এতখানি জলে নেমে দাঁড়িয়েছ যে? জানো না জলে নামলে কী হয়?’’

তিয়াষা হাসে। জল থেকে সরে আসতে আসতে বলে, “কী হয়?’’

‘‘কী আবার হবে?’’ উদ্দালক মাথা চুলকোয়, জলে নামলে মানুষ নৌকা হয়ে যায়। হুউউউস করে ভেসে চলে যায় অনেক দূরে...’’

তিয়াষা কয়েকটা ধাপ উপরে উঠে এসে একটা সিঁড়িতে বসেছিল। খুব মন দিয়ে শুনছিল উদ্দালকের কথা। এ বার উদাস মুখে সামনে তাকিয়ে বলে, “এক দিন আমিও নৌকা হয়ে যাব। ভেসে ভেসে অনেক দূরে চলে যাব...’’

উদ্দালক লক্ষ করে, এই মেয়েটির চামড়ার তলায় তলায় ফুটে উঠেছে মনখারাপের চিহ্ন। উদ্দালক জানে, যা একমাত্র ভেসে আসে ভালবাসায় আঘাত পেলে, অসময়ে স্বপ্নভঙ্গ হলে।

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Rajashree Basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy