ছবি: শুভম দে সরকার
পূর্বানুবৃত্তি: অনেক বাধা পেরিয়ে সুদামের সঙ্গে হাসপাতাল পৌঁছায় বিহান। এ দিকে দরিয়ার মনে পড়ে পুরনো দিনের কথা। যখন বাবা-মার কাছে সত্য গোপন করে বিহান, মণিদীপা ও সুদীপ্তর সঙ্গে মন্দারমণি গিয়েছিল সে।
ঝুট কেন বোলতা হ্যায়? তোমার মতলব হাম সমঝতা হ্যায়। হোটেলের রুম মে লে জাকে হিজিবিজি কাম করেগা। ইস লিয়ে হমকো মদ খাইয়ে দিয়েছ।”
“দূর শালা! এ তো মহা ঝামেলা!” বিহান রাগের অভিনয় করছে।
“ঠিক আছে। তোমাকে আমাদের হোটেলে যেতে হবে না। তুমি আমার চল।”
“শাট আপ!” আঙুল তুলে বলে দরিয়া, “এখন থেকে আমি যা বলব, সেটাই হোগা। আর দারু হ্যায়?”
“না। শেষ হয়ে গেছে।”
“হোটেলের রুমে হ্যায়?”
“হুম!”
“হুমহাম বাদ মে করেগা। পহেলে ইয়ে বাতাও, তুম হামকো বিয়ে করেগা?”
বিহান ভুরু কুঁচকে বলল, “পারলে তো আজ, এখানেই বিয়ে করে নিতাম। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশন না করলে কোনও চাকরি পাওয়ার চান্স নেই।”
“ধ্যাত্তেরিকা!” বাঁ হাতের পিছন দিয়ে মুখ মুছে উঠে দাঁড়িয়েছে দরিয়া, “এখন নয়। টাইম পে বিয়ে করেগা তো? না কি অন্য লড়কি দেখকে ভাগ যায়গা?”
দরিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে বালিতে হাঁটছে বিহান, “তুমি ছাড়া অন্য কোনও মেয়েকে আমার ভাল লাগে না দরিয়া। এই সব কথা কেন বলছ? আমাকে প্লিজ একটা কাজ জোটাতে দাও। তার আগে বিয়ে বিয়ে করে লাফিও না।”
দরিয়া এখন সিরিয়াস। সে বলল, “বাবা কিছু বলে না। কিন্তু মায়ের তরফ থেকে চাপ আছে। বাবাকে রোজ বলে খবরের কাগজের পাত্রপাত্রী কলামে বিজ্ঞাপন দিতে।”
“মাকে বলে দাও যে তুমি একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করো।”
“মা জিজ্ঞেস করবে ছেলেটা কে? কী করে? কত টাকা মাইনে পায়?”
“মাকে বলবে ছেলেটার নাম বিহান চট্টোপাধ্যায়। হাওড়া ময়দানে থাকে। বি কম সেকেন্ড ইয়ার। এখনও পর্যন্ত এক টাকাও রোজগার করে না। তবে আমাকে ফুলটাইম ভালবাসে।”
বিহানদের হোটেল এসে গিয়েছে। দরিয়ার কোমর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে বিহান। বাঙালি পরিবারটির কর্তা জড়ানো গলায় বলছেন, “বাহামা, কেম্যান আইল্যান্ড, বালি, ওয়াইকিকি— দুনিয়ার সেরা সব সি বিচ আমার ঘোরা। তারা কেউ বাংলার মন্দ-রমণীর সঙ্গে পেরে উঠবে না।”
হোটেলের রুমে ঢুকে আবার একটু মদ্যপান হল। গল্পগুজব কম হল, ভাব-ভালবাসা বেশি হল। কিন্তু আমরা সে দিকে তাকাব না। দুই যুবক-যুবতীর ব্যক্তিগত মুহূর্তকে প্রকাশ্যে আনার কী প্রয়োজন?
নির্দিষ্ট দিনেই বাড়ি ফিরে এসেছিল দরিয়া আর মণিদীপা। বিহান আর সুদীপ্তও। সনৎ জানতে পারেনি এই গোপন অ্যাডভেঞ্চারের কথা। সে তখন রাজনীতির সাপলুডো খেলায় মত্ত।
সেই বসন্তেই দুই পক্ষের বাড়ির অজান্তে বিহান আর দরিয়ার বিয়ে হল ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে। দরিয়ার তরফে সাক্ষী ছিল মণিদীপা এবং এক কলেজ বান্ধবী। বিহানের তরফে সুদীপ্ত এবং কলেজের আর এক বন্ধু। তাদের বারবার বলে দেওয়া হয়েছিল, সনৎ যেন এই সংবাদ জানতে না পারে।
ওরা বলেনি। বি কম ফাইনালের রেজ়াল্ট বেরল। শুরু হল চাকরি খোঁজার দুঃসময়। অবশেষে সনতের দাক্ষিণ্যে বকুলতলা পোর্টে ডেটা এনট্রি অপারেটারের চাকরিটা জুটিয়ে ফেলল বিহান।
তাকে না দিয়ে বিহানকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে বলে রাগের চোটে সুদীপ্ত সনৎকে বলে দিল, দরিয়া আর বিহানের রেজিস্ট্রি ম্যারেজের কথা।
সেই থেকে সনতের সঙ্গে বিহানের সম্পর্ক চিরকালের জন্য খারাপ হয়ে গিয়েছে। সনৎ বিহানের বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে বদলে হয়ে গেল শত্রুতে। প্রথমেই সে শ্রীরূপাকে বলে দিল যে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে বিহান আর দরিয়া রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছিল। সঙ্গে জুড়ে দিল, দরিয়ার জন্যই বিহানের বি কমের রেজাল্ট ভাল হয়নি।
শ্রীরূপা সব শুনে ঠান্ডা মাথায় বিহানকে বললেন, “আমি যত দিন বেঁচে থাকব তত দিন যেন ওই মেয়েটা এই বাড়িতে না ঢোকে। আমি মরে গেলে বেলেল্লাপনার হাট বসিও।”
মন্দারমণির সেই দিনগুলোকে আজকাল স্বপ্ন বলে মনে হয় বিহানের। ঝাড়া হাতপা দুটো ছেলেমেয়ে, একে অপরকে ভালবেসে কাছে আসার চেষ্টা করছে, একটু নিরালা খুঁজছে, সুযোগ পেলেই ঠোঁটে ঠোঁট রাখছে, শরীরে শরীর মিশে যাচ্ছে— ওই স্বর্গীয় অনুভূতি জীবনে এক বারই আসে। সামাজিক বিয়ের সময় থেকেই তাদের জীবনে শুধু অশান্তি। বিয়ে হল শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে শ্রীরূপা এলেন না। বিয়ের পরে দরিয়া শ্বশুরবাড়ি যেতে পারেনি। বিহানকে এক সপ্তাহে তিন জায়গায় থাকতে হয়। মানে বেশি খরচ। দরিয়া কলেজে পড়ার সময় থেকেই টিউশনি করত। কলেজের পাট শেষ হওয়ার পরে সেটা বাড়িয়েছে। বিয়ের পর থেকে সে ফুলটাইম প্রাইভেট টিউটর। বিহানও তার মাইনের একটা অংশ ব্যাঙ্কে রাখছে। অল্প অল্প করে, বিদুরের খুদের মতো সঞ্চয় জমছে যৌথ সেভিংস অ্যাকাউন্টে।
এক ছাদের নীচে থাকতে গেলে সবার আগে একটা ঘর চাই। বিহানের চাহিদা সামান্য। শোওয়ার ঘর, রান্নাঘর আর নিজস্ব বাথরুম। এক ফালি বারান্দা হলে খারাপ হয় না। সেখানে শীতকালে বিহান মরশুমি ফুল ফোটাবে। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, পপি। একটুখানি বাগান পেলে তো কথাই নেই। বিট, গাজর, ওলকপি ফলিয়েই ছাড়বে। ফুলকপি আর বাঁধাকপিও চেষ্টা করে দেখবে। টমেটো, ধনেপাতা আর বেগুন তো এমনিই হয়। বাজার যাবে শুধু আলু, আদা, পেঁয়াজ আর রসুন কিনতে।
বাহারবেড়িয়া জংশনের কাছে একটা বাড়ির সন্ধান পেয়েছে বিহান। আজকালকার ভাষায় ‘ওয়ান বিএইচকে’। একটা বেডরুম, একটা হল, একটা কিচেন। বাথরুম তো থাকবেই। ভাড়া চাইছে মাসে পাঁচ হাজার টাকা। বিহান আর দরিয়া মিলে ঠিক করে রেখেছে, বাচ্চাটা মাস ছয়েক হয়ে গেলেই ফ্ল্যাটে উঠে যাবে। ওখান থেকে বিহান বকুলতলায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করবে। দরিয়াও সকালের ট্রেন ধরে লিলুয়ায় এসে সারা দিন টিউশনি করে আবার ফিরে যাবে। বাচ্চাটা মায়ের সঙ্গেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করবে। করুক। কম বয়স থেকেই শিখুক লড়াই কাকে বলে।
সবচেয়ে বড় কথা, তারা দু’জনে একসঙ্গে রাত কাটাতে পারবে। এত দিন বিয়ে হয়ে গেল। তেমন করে পরস্পরকে চেনাই হল না। সংসার করার মানে এখনও পর্যন্ত জানতেই পারল না বিহান। যাদের টাকা নেই, তাদের কি ভগবান সব দিক দিয়েই মেরে রাখে? কে জানে!
বিহান লাইন কেটে দিতে গিয়েও দিল না। সনৎকে চটানো যাবে না। ফোন ধরে বলল, “বল।”
সনৎ পুরনো প্রশ্নটাই করল, “তুই এখন কোথায়?” বিহান শুনল ও দিক থেকে অনেক মানুষের চিৎকার আর গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। সনৎ কি বকুলতলার মোড়ে রাস্তা অবরোধ করেছে?
সনৎ কোথায় কী করছে না জানলেও চলবে। বিহান বলল, “দরিয়াকে বঙ্গবাসী হাসপাতাল থেকে বেঙ্গল মেডিকাল কলেজে ট্রান্সফার করেছে। আমাকে যেতে হবে। বেঙ্গল মেডিকাল কলেজ এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার। সেকেন্ড ব্রিজ দিয়ে যেতে মিনিট দশেক লাগবে। কিন্তু কী ভাবে যাব বুঝতে পারছি না। রাস্তায় মিলিটারি ঘুরছে। কোনও গাড়ি চলছে না। তোর এ দিকে কোনও চেনাশুনো আছে রে? তুই তো নেতা মানুষ।”
সনৎ চুপ।
বিহান বলল, “আজ সকাল থেকে আমি তোর কাছে একের পর এক ফেভার চাইছি। প্লিজ় রাগ করিস না।”
সনৎ বিহানের কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শুধু বলল, “বঙ্গবাসী হাসপাতালে মন্টু হাইত নামে এক জন ওয়ার্ড বয় আছে। বয়স্ক মানুষ। ওর সঙ্গে যোগাযোগ কর। ওকে আমি ফোন করে দিচ্ছি। কোনও না কোনও গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে।”
“তোকে যে কী বলে ধন্যবাদ...” চুপ করে গেল বিহান। সনৎ ফোন কেটে দিয়েছে।
মন্টুর কাছে যখন সনতের ফোন এল, সে তখন শোকজের চিঠি নিয়ে সুপারের চেম্বার থেকে সদ্য বেরিয়েছে। ফোন ধরতেই সনৎ বলল, “যে লোকটা তোমাকে বাঁশ দিয়েছে, তার জামাইকে তোমার কাছে পাঠিয়েছি। নাম বিহান চ্যাটার্জি। তুমি তাকে বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে পৌঁছে দাও।”
মন্টু বিরক্ত হয়ে বলল, “বলেছি তো, রবিবারের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা তোমার হেস্টিংসের বাড়িতে পৌঁছে দেব। আবার ওই সব কেন? এর কাছেও ক্ষমা চাইতে হবে না কি?”
“যে নকশালটার জন্য শোকজ খেলে তার পোঙায় বাঁশ দিতে ইচ্ছে করছে না?”
“করছে না আবার?” দাঁত কিড়মিড় করছে মন্টুর, “শালাকে জায়গা মতো পেলে আছোলা দিতাম!”
“জায়গা মতো যাতে পাও, তার ব্যবস্থাই করলাম। যা বলছি করো,” ফোন কেটে দিয়েছে সনৎ। ঝোলায় মোবাইল ঢোকাতে গিয়ে মন্টু দেখল, একটা কমবয়সি ছোকরা আর একটা মাঝবয়সি লোক তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
মন্টুর কাছে এসে ছেলেটি বলল, “আপনিই
মন্টু হাইত?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।” কান এঁটো করা হাসি দিল মন্টু, “আপনাদের পরিচয়?”
“আমার নাম বিহান চ্যাটার্জি। ইনি আমার বন্ধু সুদাম মিস্ত্রি। সনৎ কুইলা আপনাকে আমার কথা বলেছে?”
“বলেছে বইকী বাবা! সেই জন্যই তো আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। তা না হলে কখন বাড়ি চলে যেতাম। তবে কি না, আমার সম্বল বলতে একটা ভাঙাচোরা বাইক। তাতেই যেতে হবে। এই অশান্তির দিনে অন্য কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। রাহাখরচ বাবদ আড়াই হাজার টাকা দিয়ে দিও।”
সুদাম বলল, “একটু কমসম করলে হত না? আমরা গরিব মানুষ। অত টাকা কোথায় পাব?”
মন্টু হাতজোড় করে বলল, “আমিও গরিব মানুষ দাদা। তবে কি না, আমার প্রাণের একটা দাম আছে। রাস্তায় মিলিটারির গুলি খেয়ে মরে গেলে বৌ বেধবা হবে, ছেলেমেয়েরা অনাথ। নেহাত সনৎ বলেছে তাই যাচ্ছি।”
বিহান বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা। ওই টাকাই দেব। আমাদের পৌঁছনো নিয়ে কথা।”
হাসপাতালের পিছনে পার্ক করা আছে মন্টুর সাড়ে তিনশো সিসির বাইক। বিহানের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে পকেটে পুরে বাইকের দিকে এগোতে এগোতে মন্টু ভাবল, সনৎ বলেছিল এক জন যাবে। এ তো দেখি দু’জন। কী হবে তা হলে? এখন আর সনৎকে ফোনও করা যাবে না!
যাই হোক। সনৎ যখন বলেছে তখন এদের পৌঁছে দিয়ে আসা যাক!
১৩
অ্যাম্বুলেন্সে উঁকি মেরে সাম্যব্রত দেখলেন, চালকের আসনে রাজু নেই। কোথায় গেল রে বাবা! এই বিপদের দিনে আবার চালাতে হবে ভেবে গাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়নি তো? তা হলে সাম্যব্রত একেবারে জলে পড়বেন। সার্জিকাল ওয়ার্ড থেকে ট্রলিতে করে দরিয়াকে নিয়ে আসছে অন্য এক ওয়ার্ড বয়। একে ‘বয়’ বলা যেতেই পারে। কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy