ছবি: শুভম দে সরকার
পূর্বানুবৃত্তি: দরিয়া বুঝতে পারে কেন বিহান সে দিন সিনেমা দেখতে আসতে পারেনি। ভুল ভাঙে তার। এ দিকে মন্টু ঘুষ নেওয়ায় তাকে শো কজ় করে ডলি ম্যাডাম। সেই ডলিকে বিপদে ফেলার জন্য সনতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সে।
চিৎকার শুনেই বিহান আর সুদাম দৌড় দিয়েছে। দু’জনে চলে এসেছে বঙ্গবাসী হাসপাতালের পিছনের গেটে। এখানে রোগীর বাড়ির লোকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিড়ি বা সিগারেটে টান দিয়ে নিচ্ছে, এক ভাঁড় চা বা একটা কেক খেয়ে নিচ্ছে। বিহান বলল, “এক ভাঁড় চা খাই। এক বার হাসপাতালে ঢুকে গেলে আর বেরোতে পারব না।”
“চলো,” বলল সুদাম। একতারা বাজিয়ে গান ধরল, “বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা...” ঘোর শীতে সুদাম বসন্তের গান গাইছে। বিহানের মুখে তেতো হাসি ফুটে উঠল। তার মনে পড়ে গেল, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় সে আর দরিয়া বাড়িতে গুলতাপ্পি দিয়ে মন্দারমণি বেড়াতে গিয়েছিল। থাকার কোনও সমস্যা নেই। মণিদীপার জ্যাঠার হোটেল আছে সেখানে।
*****
প্ল্যানটা প্রথম আসে বিএস ম্যাডামের মাথায়। “দোলের সময় সবাই মিলে মন্দারমণি গেলে
কেমন হয়?”
“খুব ভাল হয় ম্যাডাম। ওখানে আমার জ্যাঠার হোটেল আছে,” গর্বের সঙ্গে বলেছিল মণিদীপা।
“তা হলে তো আর কোনও কথাই নেই। এই বছর দোল পড়েছে দোসরা এপ্রিল। শুক্রবার। আর হোলি পড়েছে শনিবার। আমরা বৃহস্পতিবার রাতে চলে গেলাম আর রবিবার সকালে চলে এলাম। আইডিয়াটা কেমন?”
সারা ক্লাস আনন্দে হইহই করে উঠেছিল।
প্রিন্সি ম্যাডাম প্রস্তাবটা এক কথায় খারিজ করে দিলেন। বিএস ম্যাডামকে ধমক দিয়ে বললেন, “এতগুলো কমবয়সি মেয়েকে নিয়ে ওই সব জায়গায় রাত কাটানোর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। কিছু একটা হয়ে গেলে চাকরি নিয়ে টানাটানি।”
প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেল, কিন্তু আইডিয়াটা মণিদীপা মারফত পৌঁছে গেল বিহানের কাছে। যে দিন প্রিন্সি ম্যাডাম ফতোয়া জারি করলেন, সেই দিন রাত ন’টার সময়ে দরিয়ার মোবাইলে বিহানের ফোন এল।
রোজ রাত নটায় দরিয়া বসবাস-এর ছাদে চলে যায়। নীচে থাকলেই সীমা হাজারটা প্রশ্ন করেন। “কার ফোন?” “এত রাতে ফোন কেন?” “দিনের বেলা ফোন করা যায় না?” “ছেলে বন্ধু না
মেয়ে বন্ধু?”
সাম্যব্রত মুখে কিছু বলেন না। মেয়ের দিকে এক বার তাকিয়ে চোখ দিয়ে যা বলার বলে দেন। দরিয়া তাই ফোনে প্রেম করার সময়ে ছাদে চলে যায়। এক তলা বাড়ির ছাদে ওঠার জন্য একটা ঘোরানো সিঁড়ি আছে। কয়েকটা টব আর জলের ট্যাঙ্ক ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই।
ফোনালাপের সময় দু’জনে কলকল করে কত যে গল্প করে! সকালে কী খাওয়া হল, কী পরে কলেজ যাওয়া হল, কলেজে কে কার সঙ্গে কী করল, কোন ম্যাডাম বা স্যরের পিছনে লাগা হল... এই সব অর্থহীন বকরবকর। সেগুলো বলতে আর শুনতে যে কী ভাল লাগে! মাঝে মাঝে কথা ফুরিয়ে যায়। তখন দু’জনেই নীরব। বসবাস-এর ছাদে বসে দরিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে, বিহানও নিজের ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দিন শেষ হয়ে গিয়েছে, নেমে এসেছে রাত, পৃথিবী টুক করে সূর্যের চারদিকে আর এক পাক ঘুরে নিচ্ছে। সারা দুনিয়া জুড়ে অনেক শিশুর জন্ম হচ্ছে। মারা যাচ্ছে অনেক লোক। নদী আর সাগরে দূষণ বাড়ছে। ফসিল ফুয়েল আরও একটু কমে এল। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ আর একটু বেড়ে গেল। পৃথিবী আরও একটু কম বসবাসযোগ্য হল। এই অনন্ত এবং নিরবধি কালচক্রের মধ্যে মোবাইলে গাল ঠেকিয়ে বসে রয়েছে দুই যুবক-যুবতী। কেন না তারা একে অপরের প্রেমে পড়েছে। কী আশ্চর্য আর রহস্যময়, কী জটিল আর অলৌকিক এই প্রেম!
আজ প্রথম থেকেই বিহান আক্রমণাত্মক। চোখা প্রশ্ন করছে। স্ট্রেট এবং টু দ্য পয়েন্ট উত্তর চাইছে। “তোমাদের কলেজ থেকে মন্দারমণি যাওয়া ক্যানসেল হয়ে গিয়েছে। সেটা তোমার বাড়ির
লোক জানে?”
“না। কেন?” অবাক দরিয়া।
“গুড। বাড়িতে বলার কোনও দরকার নেই যে বেড়ানো বাতিল। তুমি আর মণিদীপা মন্দারমণিতে যাচ্ছ। উঠছ ওর জ্যাঠার হোটেলে।”
“এটা কখন ঠিক হল?”
“এটা আমি আর মণিদীপা মিলে ঠিক করেছি। মণিদীপার বন্ধু, আমাদের কলেজের সুদীপ্তও যাচ্ছে। আমি আর সুদীপ্ত অনন্যা হোটেলে উঠব। বুকিং-এর দায়িত্ব মণিদীপার। মন্দারমণি পৌঁছে হোটেলে উঠে তোমরা রাত ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে। আর পর দিন ভোরবেলা আমাদের হোটেলে চলে আসবে।”
“অসভ্য কোথাকার!” ঝাঁঝিয়ে উঠেছে দরিয়া, “তোমাদের মাথায় কী ওই সব ছাড়া আর
কিছু নেই?”
“লুকিয়ে লুকিয়ে আর কত দিন চুমু খাব? সিনেমা হলের কোণের সিটে বসতে আর ভাল্লাগে না। এ বার একটা এসপার-ওসপার হয়েই যাক।”
“তুমি কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছ,” হঠাৎ গম্ভীর দরিয়া, “কাদের সঙ্গে মিশছ বলো তো?”
দরিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিহান বলল, “ব্যাগে কী কী নিতে হবে, বাড়িতে কী ঢপ মারতে হবে, সেগুলো মণিদীপা তোমায় বুঝিয়ে দেবে। রাখছি।” তার পর ফোন কেটে দিল।
পর দিন সকালেই মণিদীপা বসবাস-এ এসে এমন নাটক শুরু করল যে লজ্জায় দরিয়ার কান লাল। কলেজ থেকে যাওয়াটা বাতিল হয়ে যাওয়া, প্রিন্সি ম্যাডামের কারণে জ্যাঠার কাছে মণিদীপার সম্মান মাটিতে মিশে যাওয়া, জ্যাঠার মুখরক্ষা করতে দরিয়ার সঙ্গে মন্দারমণি যাওয়ার প্ল্যান, দরিয়ার আপত্তিতে প্ল্যান ঘেঁটে যাওয়া— পুরোটা অভিনয় করে দেখাল। সাম্যব্রত অবাক হয়ে দরিয়াকে বললেন, “ঘুরে আয়। কাছেই তো।”
“সামনে পরীক্ষা বাবা!” লজ্জায় সাম্যব্রতর চোখে চোখ রাখতে পারছে না দরিয়া, “তা ছাড়া খরচও আছে।”
“কিচ্ছু খরচ নেই। বললাম না, ওটা আমার বাবার হোটেল! সরি! জ্যাঠার হোটেল!”
বৃহস্পতিবার দিঘার ট্রেনে উঠে বসল দুই বান্ধবী। বিহান আর সুদীপ্ত কী ভাবে মন্দারমণি পৌঁছবে দরিয়া জানে না। সাম্যব্রত আর মণিদীপার বাবা ছাড়তে এসেছিলেন। তখনই দরিয়া জেনে গেল, মণিদীপার জ্যাঠা সারা সপ্তাহ হাওড়ার বাড়িতে থাকেন। উইকেন্ডে মন্দারমণি গিয়ে ব্যবসা সামলান।
ট্রেন ছেড়ে দিল। দরিয়ার জীবনের এই প্রথমবার বাবা-মা’হীন ট্রেনযাত্রা। ওদের কথা ভাবতে ভাবতে ট্রেনের জানালা দিয়ে চোখ চলে গেল দরিয়ার। তার পাশে বসে মণিদীপা বকবক করে যাচ্ছে।
কাঁথি স্টেশনে নেমে ট্রেকারে চেপে চাউলখোলা হয়ে মন্দারমণি পৌঁছে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় দরিয়ার। এত সুন্দর জায়গা পশ্চিম বাংলায় আছে? বাড়ির এত কাছে? অবিশ্বাস্য! পরের বার অবশ্যই বাবা-মায়ের সঙ্গে আসতে হবে!
হোটেলে চেক-ইন করার পরে রুমেই আড্ডা মারল দু’জনে। রাত ন’টার মধ্যে ভাত আর পমফ্রেট মাছের ঝাল দিয়ে ডিনার করে শুয়ে পড়ল ওরা।
পর দিন সূর্য ওঠার আগে উঠে পড়েছে মণিদীপা। তুলে দিয়েছে দরিয়াকেও। “তাড়াতাড়ি চল! ব্রেকফাস্ট এখানে করব। ওদের জন্যও খাবার নেব। এখন বেরোব, ফিরব সেই লাঞ্চের সময়।”
“ওরা চলে এসেছে?” ভয়ের চোটে বুক ধড়ফড় করছে দরিয়ার।
“কাল আমাদের সঙ্গে এক ট্রেনেই এসেছে।” সমুদ্রে স্নানের পোশাক, তোয়ালে, জল প্রতিরোধক মোবাইল কভার, সানস্ক্রিন লোশন আর রোদচশমা ব্যাগে ভরে রুম থেকে বেরোচ্ছে মণিদীপা। ম্যানেজারকে বলছে, “আমরা কিন্তু সেই লাঞ্চের সময় ফিরব। সারা সকাল চান করব। জোয়ার ক’টার সময়ে আসে?”
মালিকের ভাইঝিকে তোয়াজ করতে ব্যস্ত ম্যানেজার। সে বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না। সঙ্গে ভাল গাইড দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের হোটেলেরই মেয়ে।”
“কাউকে লাগবে না কাকু। আমরা আশেপাশেই থাকব। আপনার নম্বর আমার কাছে আছে। দরকার হলে ফোন করব।”
ম্যানেজার চুপ করে গেল। দু’জনে লুকিয়ে মদ খাবে। সেই জন্য সঙ্গে কাউকে রাখতে চাইছে না।
ছোট্ট দুটো ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছে দুই বান্ধবী। এ দিক-সে দিক ঘোরাঘুরি করে চলে এসেছে বিহানদের হোটেলের সামনে। এখানে একগাদা বাঙালি ট্যুরিস্ট হইচই করছে। কে হোটেলে ঢুকছে, কে বেরোচ্ছে... নজরদারি করার কেউ নেই।
সমুদ্রের ধারে দরিয়া আর বিহানের দেখা হয়ে গেল। নীল শর্টস আর খালি গায়ে বিহানকে খুব সেক্সি লাগছে! অন্য মেয়েরা টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছে বিহানকে। সেটা চোখে পড়ল দরিয়ার।
বিহানের নিজেকে কখনও এত পূর্ণ বলে মনে হয়নি। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আকাশ, ঝিকিয়ে ওঠা রোদের বল্লম, চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ানো শীত, হাসিখুশি মানুষের ঢল, খলবলিয়ে এসে সারা শরীর চাটতে থাকা সমুদ্রের জিভ... এই সবই তার জীবনে প্রথম। পাশে নিজস্ব নারী থাকার ফলে নিজেকে সর্বশক্তিমান বলে মনে হচ্ছে।
সুদীপ্ত আর মণিদীপা হোটেলের ঘরে ঢুকে গিয়েছে। বিহান সেই চেষ্টা করল না। সমুদ্রের জলে গা ভিজিয়ে, বালির উপরে বসে দরিয়াকে জিজ্ঞেস করল, “ভদকা খাবে?”
বিহানের কাঁধে মাথা রেখে দরিয়া আঙুল দিয়ে বালিতে আঁকিবুঁকি কাটছে। ব-এ হ্রস্ব ই, হ-এ আকার, দন্ত্য ন। লেখা শেষ হওয়ার আগেই নোনা জল এসে কখনও ব খেয়ে নিচ্ছে, কখনও দন্ত্য ন, কখনও হ্রস্ব ই। আবার লিখছে দরিয়া। এ এক মজার খেলা। হার নিশ্চিত জেনেও খেলে যেতে হয়। বিহানের প্রশ্ন শুনে সে বলল, “খাব। কিন্তু অন্য জায়গায় চলো। এখানে বড্ড চিৎকার।”
হোটেলের রুমে ঢুকে মদ্যপান না করে বিহান আর দরিয়া চলে গেল মোহনার কাছে। এ দিকে হোটেল কম, ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে। বেলাভূমিতে ছোট্ট ঝুপড়ি বানানো রয়েছে। সেখানে বিয়ার আর মাছভাজা কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। এক প্লেট পমফ্রেটভাজা কিনে ফিরে এল বিহান। ঝাউগাছের ছায়ায় বসে ব্যাকপ্যাক থেকে বার করল ভদকার কোয়ার্টার বোতল, মিনারেল ওয়াটার আর গেলাস। জল ও সুরার মেলামেশা হয়ে গেলে গেলাস হাতে নিয়ে বিহান বলল, “চিয়ার্স!”
“আমি কিন্তু আগে কখনও খাইনি,” লজ্জা পাচ্ছে দরিয়া, “যদি কিছু হয়ে যায়?”
“আজ তুমি এমন অনেক কিছু করবে, যা আগে করোনি। ভদকায় ভয় পেলে চলে?”
“নোংরা! অসভ্য! বাজে একটা লোক!” লজ্জায় লাল হয়ে এক চুমুকে গেলাস শেষ করে দিল দরিয়া। বিহান আঁতকে উঠে বলল, “অত তাড়াতাড়ি নয়! চড়ে যাবে তো! তোমাকে তখন পাঁজাকোলা করে হোটেলে দিয়ে আসতে হবে।”
“হোক শালা! তাই হোক!” গেলাস বাড়িয়ে দিয়েছে দরিয়া।
“হাফ পেগ মাল খেয়ে তোমার নেশা হয়ে গেছে!” ফিকফিক করে হাসছে বিহান।
“তুমি বুধন কাকাকে চেনো?” হুট করে অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে গিয়েছে দরিয়া।
“কে, সে?”
“আমাদের পাড়ায় থাকে। সকালবেলা দুধ আর বিকেলবেলা ফুচকা বিক্রি করে। বুধনকাকার বাংলা আর আমার মায়ের হিন্দি শুনলে তুমি না হেসে থাকতে পারবে না। আমি বলার চেষ্টা করছি। আবার এক চুমুকে মদ শেষ করে পমফ্রেটে কামড় দিয়ে দরিয়া বলল, “এই বিহানোয়া! তুম হমকো ভালবাসতা হ্যায়?”
বিহান জিজ্ঞেস করল, “ইয়ে ভালবাসা হোতা কেয়া হ্যায়?”
“ভালবাসা আর ভূত একই রকম হোতা হ্যায়। কোই নেহি দেখা। কিন্তু সবাই মানতা হ্যায় কে ভূত হ্যায়। তুম বুঝ নহি সকতা?”
বিহান হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, “খুব বুঝ সকতা হ্যায়। আর তোমার প্রশ্নের উত্তরে বলি, ‘হ্যাঁ। হাম তুমকো ভাল বাসতা হ্যায়।’”
“কতটা বাসতা হ্যায়?”
“অনেকটা বাসতা হ্যায়।”
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy