অতীত: আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতার খবর। ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৫
জানুয়ারি ২৭, ১৯৬৫। তৎকালীন মাদ্রাজের (বর্তমানে চেন্নাই) শহরতলি ভিরিয়াম্বকমে বাড়ির উঠোনে বসে কাঁদছিলেন মল্লিকা। সদ্য স্বামীহারা মল্লিকা, প্রতিবেশীরা চিন্তিত তাঁর তিন নাবালক সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
জানা গিয়েছিল, রাত তিনটেয় ঘুম থেকে উঠে কাছের পেট্রল পাম্প থেকে পেট্রল কিনে নিজের গায়ে ছড়িয়ে, আগুন ধরিয়েছিলেন মল্লিকার স্বামী রঙ্গনাথন। পারিবারিক অশান্তির জেরে নয়, তামিলদের উপর ভারত সরকারের হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদেই তাঁর আত্মাহুতি। বেছে নিয়েছিলেন প্রজাতন্ত্র দিবসের পরের দিনটিকে। সেই বছর প্রজাতন্ত্র দিবসে হিন্দিকে প্রধান সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হয়।
১৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ কেন্দ্রের সমস্ত অফিসে জানিয়েছিলেন, ২৬ জানুয়ারি থেকে হিন্দিই হবে কেন্দ্রের সরকারি ভাষা, ইংরেজি অতিরিক্ত সরকারি ভাষা। কেন্দ্র ও হিন্দিভাষী রাজ্য— উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার ও মধ্যপ্রদেশ এবং দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিল্লি ও হিমাচল প্রদেশে চিঠি লেখা হবে হিন্দিতে। অন্য রাজ্যগুলি লিখবে ইংরেজিতে। দিল্লি থেকে পাঠানো চিঠিপত্রের সঙ্গে একটি হিন্দি অনুবাদও জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। কেন্দ্রীয় কর্মচারীরা হয় হিন্দি নয় ইংরেজিতে নোট লিখতে পারবেন। তবে অ-হিন্দিভাষী কর্মচারীদের সুবিধার জন্য প্রতি দফতরে অনুবাদ শাখা থাকবে। হিন্দি জানা সমস্ত কর্মচারীকে সরকারি সভায় ও আলোচনায় হিন্দিতে বক্তৃতা দিতেও বলা হয়। সংবিধানের ৩৪৮ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের ভাষা ইংরেজি থাকবে। পরে সুবিধা মতো তা হিন্দি করে নিলেই চলবে।
আত্মহত্যার আগে ডাক বিভাগের কর্মী রঙ্গনাথন চিঠি লিখে যান তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি কামরাজ, মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী ভক্তবৎসলম, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজাগাম দলের সাধারণ সম্পাদক সি এন আন্নাদুরাই এবং মাদ্রাজ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ইজিয়ানকে। সব চিঠিতেই ছিল হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
১৯৬৫ সালে মাতৃভাষার জন্য যে আগুন তামিলনাড়ুতে জ্বলে উঠেছিল তা নিভতে সময় নিয়েছিল মাসাধিক। ২৫ জানুয়ারি মাদ্রাজে গুলজারিলাল নন্দকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, হিন্দি ভাষা নিয়ে বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হবে কি না। তিনি জানিয়েছিলেন, পুনর্বিবেচনার কোনও প্রয়োজন নেই। তাতেই আগুনে ঘি পড়ে। পুলিশ গ্রেফতার করে ডিএমকে দলের সাধারণ সম্পাদক সি এন আন্নাদুরাই-সহ ছয়শো সদস্যকে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রজাতন্ত্র দিবসকে কেন্দ্রের সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দি প্রবর্তনের বিরোধী দিবস হিসেবে পালন করবেন।
রঙ্গনাথনের মতো ডিএমকে দলের সক্রিয় সদস্য বছর বাইশের এম শিবলিঙ্গমও গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। সরকারি মতে এই হিন্দি বিরোধী ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল পঞ্চাশেরও বেশি মানুষ। জখম শতাধিক। গ্রেফতার হয়েছেন হাজার-হাজার, অধিকাংশই স্কুল-কলেজের ছাত্র। ছিলেন বহু রাজনৈতিক নেতা, বিধায়ক এবং সাংসদও! এর ফলও হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। ’৬৭-তে মাদ্রাজ বিধানসভা ও লোকসভা ভোটে ভরাডুবি হয় কংগ্রেসের। বিপুল আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজাগাম। মুখ্যমন্ত্রী হন কে এন আন্নাদুরাই। যাঁকে এক সময় হিন্দি বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার পর থেকে তামিলভূমে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি কংগ্রেস। এমনকি ২০১৯-এ বিপুল আসন পেয়ে জিতে আসা ফিরে আসা বিজেপিও পারেনি।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীও। তামিলনাড়ু হিন্দি বিরোধী সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘এটা খুবই আশ্চর্যের, যে সরকার বিচ্ছেদপ্রবণতা রোধের জন্য আইন রচনা করে, সেই সরকারই আবার নিজের কাজের মাধ্যমে দেশকে দুটো ব্লকে ভাগ করে দিচ্ছে।’’ দিল্লির নেতারা অবশ্য তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি। বরং মাদ্রাজে অশান্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ডিএমকে দলকে দায়ী করে তিরস্কার করেন। আশ্বাস দেন, হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে চালু করতে কেন্দ্র ধীরে চলা নীতি নেবে। জওহরলাল নেহরু হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি ব্যবহারের যে আশ্বাস দিয়েছিলেন তা মানা হবে। এমনকি, ১৯৬৭-র ৭ ফেব্রুয়ারি ত্রিভাষা নীতি কার্যকর করতে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিকে অনুরোধ করা হয়। পড়ুয়াদের একটি করে দক্ষিণী ভাষা শেখানোর কথা বলা হয়। কিন্তু তাতেও ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি।
সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন ছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। মাদ্রাজ রাজ্যের তিন শহরে পুলিশের গুলিতে মারা যায় এক বালক-সহ ২৩ জন। পরের দিন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী নামানো হয়। মাদ্রাজের মুখ্যসচিব সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন। ঠিক হয়, অবস্থার অবনতি হলে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার ভার সেনার হাতে তুলে দেওয়া হবে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে ১৯৬৫-৬৬-র বাজেটে রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ উদ্বোধনী ভাষণ দেন ইংরেজিতে। প্রতিবাদে জনসঙ্ঘ ও সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট দলের সাংসদেরা সংসদের যুক্ত অধিবেশন বয়কট করে।
হিন্দি বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহীশূরে। ইস্তফা দেন কেন্দ্রের খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী সি সুব্রহ্মণ্যম ও পেট্রোলিয়াম ও রাসায়নিক দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভি আলাগেসান। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি মাদ্রাজে পৌঁছে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। ভাষা প্রসঙ্গে পুনর্বিচারের আশ্বাস দিলে ১২ ফেব্রুয়ারি হিন্দি বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাময়িক ভাবে স্থগিত হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী সদ্য-সমাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে বিবৃতি দেন, হিন্দিই ভারতের সরকারি ভাষা। ইংরেজি চালু থাকবে সহযোগী ভাষা হিসেবে; ভাষা প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করবেন। তিনি আরও বলেন, জওহরলাল নেহরুর দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য ভাষা আইনের কী সংশোধন দরকার, সরকার তা আলোচনা করবে। সর্বভারতীয় চাকরিতে বিভিন্ন রাজ্যের বরাদ্দের প্রশ্নও বিবেচনা করা হবে।
বিপুল আসন নিয়ে কেন্দ্রে ফিরে আসা বিজেপি যে হিন্দির দিকেই ঝুঁকবে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তারা হয়তো অনুমান করতে পারেনি, ৫০ বছর পরও সেই একই রকম বিদ্রোহ আসবে দক্ষিণ থেকে।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy