Advertisement
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Letter

শেষ অবধি শিষ্যের ভাগ্যে জুটল গুরুর নীরব উপেক্ষা

কী নিয়ে? তা হলে বলতে হয় সত্যেন্দ্রনাথের কথা। আর এক জনের কথা। তিনি স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। আর একটি চিঠির কথা।

গুরু-শিষ্য: অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

গুরু-শিষ্য: অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। —ফাইল চিত্র।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২৪ ০৯:২৯
Share: Save:

শিষ্য, সত্যেন্দ্রনাথ বসু। লিখেছিলেন একটি চিঠি। তাঁর ‘মাস্টার’কে। এমন চিঠি আর একটিই লেখা হয়েছিল পুব থেকে পশ্চিমে। গণিতজ্ঞ গডফ্রে হার্ডিকে লিখেছিলেন শ্রীনিবাস রামানুজন। হার্ডি সাদরে স্বীকৃতি দেন রামানুজনকে। কিন্তু ‘মাস্টার’-এর একটি ফুটনোটে নস্যাৎ হয় সত্যেন্দ্রনাথের অনুসন্ধান। ‘মাস্টার’, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তাঁকে লেখা শিষ্যের সেই চিঠি শতবর্ষ পূর্ণ করবে আগামী পরশু।

২০০১ সালে ফিজ়িক্সে নোবেল পুরস্কার পান তিন জন। এরিক করনেল, কার্ল ওয়াইমান এবং হোলফগাং কেটারলি। ওই তিন জনের মধ্যে কেটারলিকে কলকাতার সত্যেন্দ্রনাথ ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস’ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। কেটারলি এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে। ২০১১ সালে। এক ফাঁকে সময় করে গিয়েছিলেন ২২ নম্বর ঈশ্বর মিল লেনে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বাসগৃহে। যাবেনই তো, সত্যেন্দ্রনাথের তাত্ত্বিক গবেষণার বাস্তব রূপদানের সূত্রেই তো তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। ১৯৯৫ সালের ১৪ জুলাই ‘সায়েন্স’ জার্নালে কভার স্টোরি প্রকাশ পেতেই যা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে হইচই।

কী নিয়ে? তা হলে বলতে হয় সত্যেন্দ্রনাথের কথা। আর এক জনের কথা। তিনি স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। আর একটি চিঠির কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজ়িক্স ডিপার্টমেন্টের প্যাডের পাতায়, হাতে লেখা সেই চিঠির শুরু এ রকম—

“আপনার মতামতের আশায় সঙ্গের প্রবন্ধটি পাঠালাম। আপনার কেমন লাগল, তা জানতে আগ্রহী। প্রবন্ধটা জার্মানে অনুবাদের মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান আমার নেই। আপনি যদি ওটা প্রকাশযোগ্য ভাবেন, তা হলে ‘ৎজ়াইটশ্রিফট ফুর ফিজ়িক’-এ ছাপানোর ব্যবস্থা করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।...”

বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী পাছে এই অনুরোধকে ধৃষ্টতা জ্ঞান করেন, তাই মহাসিন্ধুপারের একলব্যের স্বীকারোক্তি— “যদিও আমি আপনার কাছে সম্পূর্ণ আগন্তুক, তবুও এমন অনুরোধ পেশ করতে কোনও কুণ্ঠাবোধ করছি না। কারণ আমরা সবাই আপনার ছাত্র। আপনার লেখায় শিক্ষালাভের সুবাদে। আপনার মনে আছে কি না জানি না, কলকাতা থেকে এক জন আপনার অনুমতি চেয়েছিল রিলেটিভিটি-র ইংরেজি অনুবাদের জন্য। আপনি সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েছিলেন। তার পর বইটি প্রকাশিত হয়েছে। জেনারেল রিলেটিভিটি-র সেই অনুবাদক আমিই।”

হাতে লেখা সেই চিঠির তারিখ ৪ জুন ১৯২৪। আগামী পরশু শতবর্ষ পূর্ণ করবে ওই চিঠি। আইনস্টাইনকে চিঠিটি লেখার আগে ‘দ্য ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজ়িন’-এ সত্যেন্দ্রনাথ জমা দিয়েছিলেন ওই প্রবন্ধটি। রেফারিদের মতামত জানার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তিন মাস। রেফারিরা জানিয়েছিলেন, প্রবন্ধটি ভুল, তাই ছাপা যাবে না। তখন অনন্যোপায় সত্যেন্দ্রনাথ প্রবন্ধটি ‘ৎজ়াইটশ্রিফট ফুর ফিজ়িক’-এ ছাপানোর চেষ্টা করেন। তাই আইনস্টাইনকে লেখা ওই চিঠি।

প্রবন্ধটি যে ভুল নয়, চিনলেন আইনস্টাইন। তিনি ওটা পাঠানোর আগে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করলেন, সঙ্গে মন্তব্য— “বোসের গণনা, আমার মতে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এখানে যে পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছে, তার থেকেই যে আদর্শ গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কোয়ান্টাম তত্ত্ব পাওয়া যায়, সেটা আমি অন্যত্র দেখাব।”

‘ৎজ়াইটশ্রিফট ফুর ফিজ়িক’-এর কাছে আইনস্টাইনের সার্টিফিকেট মানে চূড়ান্ত সুপারিশ, তিনি তখন এতটাই বিখ্যাত। দ্রুত প্রকাশিত হয় পেপারটা। ‘প্লাঙ্ক গেসেট্জ উন্ড লিস্ট কোয়ান্টেম হিপোথেসে’ পদার্থবিদ্যার এক নতুন অধ্যায়। উৎফুল্ল আইনস্টাইন বন্ধু পল এরহেনফেস্ট-কে লেখেন, “ভারতীয় বোস প্লাঙ্ক সূত্র উদ্ভাবনের এক চমৎকার গণনা পেশ করেছেন।”

আইনস্টাইনকে লেখা সত্যেন্দ্রনাথের এই চিঠির তুলনা কেবল একটিই। পুব থেকে পশ্চিমের চিঠি। কেমব্রিজের গণিতজ্ঞ গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডিকে পাঠানো শ্রীনিবাস রামানুজনের চিঠি। গণিতের দিকপাল অধ্যাপকের সামনে দীনহীন ভাবে আত্মপরিচয় জ্ঞাপনে যে চিঠিটি রামানুজন লিখেছিলেন ১৯১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি, তার শুরু হচ্ছে এই ভাবে— “আমি মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্ট অফিসের অ্যাকাউন্টস বিভাগের এক সামান্য কেরানি, আপনার কাছে লিখছি।... আমার বয়স ২৩। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পাইনি।... স্কুল ছাড়ার পর হাতের অবসর সময়টুকু অঙ্ক কষে কাটাই।... নিজের জন্য নতুন পথ কেটে চলেছি... আপনাকে অনুরোধ করছি সঙ্গের পেপারগুলো পড়বার। আমি গরিব, তাই পড়ে আপনার ভাল লাগলে প্রতিপাদ্যগুলো ছাপাতে চাই। আমি অনভিজ্ঞ, তাই আপনার উপদেশ আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।”

হার্ডির বন্ধু জন এডেনসর লিটলউড পরামর্শ দিয়েছিলেন অজস্র সমীকরণকে পাত্তা না দিতে। শোনেননি হার্ডি। শোনেননি, কারণ ফর্মুলাগুলোর তাকিয়ে তিনি দেখেছিলেন অন্য কিছু। বুঝেছিলেন, সে সব অক্ষমের আস্ফালন নয়, বরং ওগুলোয় আছে ‘ইউরোপের একত্রিত প্রজ্ঞার সঙ্গে দরিদ্র ও একাকী এক হিন্দুর পাঞ্জা লড়াই’। বন্ধু লিটলউডকে তাই হার্ডি বলেছিলেন, “(সমীকরণগুলোর দিকে) এক বার তাকালে বোঝা যায়, ওগুলো লিখতে পারেন কেবল উঁচু দরের এক জন গণিতজ্ঞই। ওগুলো নির্ভুল হতেই হবে। কারণ, সত্যি না হলে, ওগুলো বানিয়ে লেখার মতো কল্পনাশক্তি কারও নেই।”

গণিতশাস্ত্রে তার শ্রেষ্ঠ অবদান কী জানতে চাইলে, হার্ডি বলতেন সেই ‘অপরিচিত হিন্দু কেরানি’, কিংবা ‘বড়জোর অর্ধশিক্ষিত এক ভারতীয়’-র কথা। বলতেন, ‘রামানুজন ওয়াজ় মাই ডিসকভারি’। পাছে আত্মশ্লাঘা প্রকাশ প্রায় ওই মন্তব্যে, তাই নিজেকে শুধরে নিয়ে বলতেন, “বাট আই ডিড নট ইনভেন্ট হিম। লাইক আদার গ্রেট মেন, হি ইনভেন্টেড হিমসেল্ফ।”

সত্যেন্দ্রনাথও সম্ভবত আইনস্টাইনের আবিষ্কার। রামানুজনের পাঠানো সমীকরণে উচ্ছ্বসিত হার্ডি কেমব্রিজের আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন তাঁকে। ততটা অভিভূত না হলেও, আপেক্ষিকতার প্রবক্তা নিশ্চিত চমৎকৃত হয়েছিলেন ভারতীয় অধ্যাপকের পাঠানো প্রবন্ধে। তাই সেটা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে দিয়েছিলেন নিজেই।

কী সেই হিসাব, যা এত মূল্যবান? কোন সে নতুন আইডিয়া, যা স্বয়ং আইনস্টাইনকে অনুপ্রাণিত করে অন্যত্র পর পর তিনটে প্রবন্ধ লেখায়? বস্তুত, সত্যেন্দ্রনাথের মাত্র চার পৃষ্ঠার প্রবন্ধে আলোচিত পদার্থবিদ্যার এক বড় সমস্যা। কিংবা, বলা ভাল, তার চমৎকার সমাধান। ‘বোস সংখ্যায়ন’। আইনস্টাইনের হাতে কিঞ্চিৎ পরিবর্ধনের ফলে যার নাম এখন ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন’। বিজ্ঞান-লেখক জন গ্রিবিং তাঁর বই ‘শ্রয়েডিঙ্গার’স কিটেনস’-এ সংশ্লিষ্ট অংশটুকুর শিরোনাম দিয়েছেন ‘দ্য ম্যান হু টট আইনস্টাইন টু কাউন্ট ফোটনস’, অর্থাৎ আইনস্টাইনকে ফোটন (আলোর কণা) গুনতে শিখিয়েছিলেন যিনি।

পদার্থের সঙ্গে আলোক বিকিরণের পারস্পরিক ক্রিয়া— যা রীতিমতো ধন্দে ফেলে দিয়েছিল বিজ্ঞানীদের— ব্যাখ্যা করার জন্য জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক আলোককণার ধারণা আমদানি করেছিলেন ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। ওঁর মতে, আলো শোষিত বা বিকিরিত হয় একটানা নয়, খণ্ডে খণ্ডে। খারাপ হয়ে যাওয়া জলের কল বন্ধ করলেও যেমন জল পড়ে ফোঁটায় ফোটায়। আলোর ওই কণারূপ তার তরঙ্গাকারের (যা পরীক্ষিত সত্য) পরিপন্থী। তাই অদ্ভুত কিছু ধর্ম ব্যাখ্যায় সেটা ব্যবহৃত হলেও আলো যে বাস্তবে কণারূপেই বর্তমান, সে কথা বিশ্বাস করতেন না অনেকেই। বস্তুত, আলো তরঙ্গ না কণা, তা বোধহয় স্পষ্ট করে বলাও যায় না। আসল কথা হল, চার দিক ঘেরা তপ্ত বস্তুর শক্তি বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বয়ং প্লাঙ্কও তেমন গুরুত্ব দেননি ওই কণা-চরিত্রকে। ফলে তাঁর হিসাবেও থেকে গিয়েছিল অসঙ্গতি। সেটা দূর করতেই সত্যেন্দ্রনাথের পেপার। আলোকে গ্যাসের মতো পুরোপুরি কণার সমাবেশ হিসেবে তিনি ধরে নেন এবং নতুন সংখ্যাতত্ত্ব প্রয়োগ করেন। ফলে অসঙ্গতি থেকে প্লাঙ্ক-সূত্রের মুক্তি এবং কোয়ান্টাম সংখ্যা তত্ত্বের জন্ম। ব্যাপারটা এতই অভিনব যে, তা এখনও বিজ্ঞানীদের বিস্ময়। সেখানে ফিজ়িক্স-চর্চার পীঠস্থান থেকে বহু দূরে, একাকী এক অধ্যাপক কী ভাবে রীতিমতো মৌলিক এই ধারণার জন্ম দিলেন?— এই প্রশ্ন তাড়িত করেছিল স্বয়ং আইনস্টাইনকেও। সম্ভবত তাই তিনি লিখেছিলেন, “বোসের গণনা চমৎকার। এবং তার প্রতিপাদ্য রহস্যময়।”

সত্যেন্দ্রনাথের বাবা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ, মা আমোদিনী। ঠাকুরদা অম্বিকাচরণ। ভিটে নদিয়া জেলার বড় জাগুলিয়া গ্রামে। ঊনবিংশ শতকে নদিয়া ছিল প্রাচ্যবিদ্যার অন্যতম প্রধান অধ্যয়ন কেন্দ্র। তার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষায় মন দেন বসু-পরিবার। ফল হাতেনাতে। অম্বিকাচরণ চাকরি পান ইংরেজ সরকারি দফতরে। বদলির চাকরি ছিল তাঁর। দেশের নানা জায়গায় বদলি হতে হত। শহরে অ্যাকাউন্ট্যান্ট চাকরিকালীন জীবনাবসান। অম্বিকাচরণ মারা যাওয়ার পর বড় জাগুলিয়া ছেড়ে কলকাতায় চলে আসে বসু-পরিবার। কলকাতাই যে গন্তব্য হবে, বুঝেছিলেন অম্বিকাচরণের বাবা। বাড়িও একটা কিনে রেখেছিলেন হেদুয়ার কাছে ঈশ্বর মিল লেনে। কিন্তু সে বাড়ির ভাড়াটেরা অন্যত্র চলে না যাওয়ায় বসু-পরিবার উঠলেন জোড়াবাগানে ভাড়াবাড়িতে। অম্বিকাচরণের মতো সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজি শিখে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের অ্যাকাউন্ট্যান্ট। অগাধ পড়াশোনা তাঁর। এক দিকে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য দর্শন, অন্য দিকে তেমনই মার্কস-এঙ্গেলস-এর রচনা। সে মানুষটাই আবার ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কার্স-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাতে গড়া বেঙ্গল কেমিক্যাল-এর সমসাময়িক এই কোম্পানি।

আগেই বলেছি, সুরেন্দ্রনাথের বিয়ে হয় ডাকসাইটে উকিল মতিলাল রায়চৌধুরীর মেয়ে আমোদিনীর সঙ্গে। তাঁদের সাত সন্তান। ছ’টি মেয়ে, একটি ছেলে। ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ সকলের বড়। বাবা সুরেন্দ্রনাথ টের পেয়েছিলেন তাঁর প্রথম সন্তান বিশেষ মেধাবী। সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল তো বটেই, গণিতেও। বালকের মধ্যে ওই বিষয়ে ব্যুৎপত্তি দেখে, তা আরও বাড়াতে সুরেন্দ্রনাথ প্রয়াসী হলেন। অফিস বেরোনোর আগে তিনি কঠিন কঠিন অঙ্ক দিয়ে যেতেন সত্যেন্দ্রনাথকে। হোম টাস্ক। বালকের কাজ ছিল দুপুরে সিমেন্টের মেঝেয় চক দিয়ে সেই সব অঙ্ক সমাধান করা। বালকের কাছে খেলা।

পাঁচ বছর বয়স হলে সুরেন্দ্রনাথ ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন নর্মাল স্কুলে। এ সেই শিক্ষায়তন, যেখানে কিছু দিন পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুরেন্দ্রনাথ বাসস্থান বদলালে সেখান থেকে সত্যেন্দ্রনাথ ভর্তি হন নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে। সুরেন্দ্রনাথের মন ভরল না। ছেলে প্রচণ্ড মেধাবী, তার জন্য আরও ভাল স্কুল চাই। অবশেষে হিন্দু স্কুল। ছোটবেলা থেকেই দৃষ্টিশক্তির সমস্যা। সত্যেন্দ্রনাথ তাতে দমে যাওয়ার পাত্র নন। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও পড়ার বিরাম নেই। মেধাবী ছাত্র সব বিষয়ে মাস্টারমশাইদের প্রিয়। তাঁকে সবচেয়ে ভালবাসেন অঙ্কের স্যর উপেন্দ্রনাথ বক্সী। এক বার তো অঙ্ক পরীক্ষায় তিনি ওকে ১০০ নম্বরের মধ্যে ১১০ দিয়ে বসলেন। ব্যাপার কী? হেডমাস্টার রসময় মিত্রের প্রশ্নের উত্তরে উপেন্দ্রনাথ জানালেন, ছাত্রটি ১০০ নম্বরের সব প্রশ্নের সমাধান তো দিয়েছেই, উপরন্তু সব বিকল্প প্রশ্নেরও উত্তর বার করেছে। প্রিয় ছাত্র সম্পর্কে শিক্ষকের ভবিষ্যদ্বাণী— ও এক দিন ফরাসি পিয়ের সিমো লাপ্লা কিংবা অগাস্টিন লুই কাউচির মতো প্রাতঃস্মরণীয়গণিতজ্ঞ হবে!

১৯০৮। সত্যেন্দ্রনাথের এন্ট্রান্স। অর্থাৎ স্কুলের শেষ পরীক্ষা। শুরুর দু’দিন আগে বিপত্তি। বসন্ত রোগ। পরীক্ষায় বসা হল না। বসলেন পরের বছর। হলেন পঞ্চম। সংস্কৃত, ইতিহাস, ভূগোলে নম্বর খুব ভাল, কিন্তু তিনি পড়বেন বিজ্ঞান। ভর্তি হলেন রাস্তার ও পারের কলেজ প্রেসিডেন্সিতে। সহপাঠী কারা? এক-একটি উজ্জ্বল রত্ন। জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নিখিলরঞ্জন সেন, পুলিনবিহারী সরকার, মানিকলাল দে, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ এবং অমরেশ চক্রবর্তী। দু’বছর পরে যোগ দেন আর এক রত্ন। মেঘনাদ সাহা। ১৯০৯-এ যাঁরা প্রেসিডেন্সি কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হলেন, তাঁদের সম্পর্কে কলেজের কেমিস্ট্রির প্রফেসর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, তাঁর ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে পরে লিখেছিলেন, “সেই স্মরণীয় বছরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হইল একঝাঁক মেধাবী ছাত্র, যাঁহারা পরবর্তী কালে গবেষণায় উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছিল।”

১৯০৫। তখন কলকাতা শহর উত্তাল। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা ঘিরে চার দিকে স্বদেশি হাওয়া। ছাত্র, যুবকেরা দলে দলে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। কেউ কেউ পড়াশোনা ছেড়েও। এ দিকে বাবার কড়া নির্দেশ, ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার মাটি করা চলবে না। সত্যেন্দ্রনাথ আন্দোলনে মদত জোগালেন পরোক্ষে। কখনও বিপ্লবীদের গোপন চিঠির কুরিয়ারের কাজ করে, কখনও বা ব্রিটিশ পুলিশ যাঁদের খুঁজছে তাঁদের লুকিয়ে রেখে। পাশাপাশি চলতে লাগল গরিব ছাত্রদের নাইট স্কুলে পড়ানো। কারণ, মনে আছে এক প্রত্যয়। দেশের প্রকৃত নাগরিক তৈরি করতে প্রয়োজন শিক্ষা। ১৯১৩ সালের বি এসসি, ১৯১৫-তে এম এসসি। দু’টি পরীক্ষাতেই সত্যেন্দ্রনাথ ফার্স্ট, মেঘনাদ সেকেন্ড।

তার পর? কাঠবেকার। আর ও দিকে, এম এসসি-র ছাত্রাবস্থাতেই মায়ের কথায় কুড়ি বছর বয়সে উষাবতী ঘোষকে বিয়ে। তিনি নামী ডাক্তার যোগীন্দ্রনাথ ঘোষের একমাত্র মেয়ে। যোগীন্দ্রনাথ জামাইবাবাজিকে সাহায্য করতে চান। সত্যেন্দ্রনাথ অরাজি। অথচ তখন হবু শ্বশুররা বিলেত পাঠাতেন হবু জামাইদের, যাতে তাঁরা দেশে ফিরে আইসিএস হয়ে তাঁদের মেয়েদের বিয়ে করতে পারেন।

সত্যেন্দ্রনাথ আর মেঘনাদ গিয়ে দেখা করলেন স্যর আশুতোষের সঙ্গে। তিনি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর রিলেটিভিটি— যা মাতাচ্ছে পাশ্চাত্য ছাত্রদের— তা মাতাচ্ছে না দেশি ছাত্রদের। সদ্য পাস করা এম এসসি ছাত্ররা ওই দুটো সাবজেক্ট পড়াতে চাইছে। স্যর আশুতোষ রাজি। মেঘনাদ পড়াবেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আর রিলেটিভিটি সত্যেন্দ্রনাথ। মাইনে ১২৫ টাকা। টেক্সট বই কোথায়? কোথায় রিসার্চ জার্নাল? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাজারে ভারতে দুটোই অমিল। কিছুটা হলেও তা পাওয়া গেল শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসর পি জে ব্রুলের কাছে। ভদ্রলোক জার্মানি থেকে ভারতে এসেছিলেন। ছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী। ভারতে গাছগাছড়া নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন। যক্ষ্মা রোগে কাবু হওয়ার পর মাঠে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা বিষয় বদলে ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজ়িক্স-এ চলে আসেন। তাঁর কাছে ছিল ম্যাক্স প্লাঙ্ক, লুটভিক বোল্টনমান, উইলহেলম ভিয়েনের লেখা বই। সে সব পড়ে বোঝার জন্য সত্যেন্দ্রনাথ এবং মেঘনাদ শিখলেন জার্মান ভাষা। ১৯১৯। জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে বিশ্ব জুড়ে হইচই। আইনস্টাইনকে নিয়ে ধন্য ধন্য। সত্যেন্দ্রনাথ আর মেঘনাদ মিলে স্পেশাল এবং জেনারেল রিলেটিভিটির মূল পেপারগুলির একত্র অনুবাদ প্রকাশ করলেন ইংরেজিতে। সেই প্রথম।

১৯২১। তৈরি হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফিজ়িক্সে রিডার পদে চাকরি পেলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ওখানে ছাত্র পড়াতে পড়াতেই আইনস্টাইনকে চিঠি লেখা, যে চিঠির কথা শুরুতে বলেছি।

তড়িঘড়ি সেই চিঠির উত্তর দিলেন আইনস্টাইন। লিখলেন— “আমি আপনার পেপারটি অনুবাদ করে ‘ৎজ়াইটশ্রিফট ফুর ফিজ়িক’-এ ছাপতে পাঠিয়েছি। এটা এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। আমি দারুণ খুশি।”

আর আগেই বলা হয়েছে, ‘ৎজ়াইটশ্রিফট ফুর ফিজ়িক’-এ ছাপা পেপারের সঙ্গে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর মন্তব্য জুড়ে দেন, তা এ রকম— “বোসের উদ্ভাবন আমার মতে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এখানে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে, তা দিয়ে আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম থিয়োরিতে পৌঁছোনো যায়। আমি তা অন্যত্র দেখাব।”

সত্যি সত্যেন্দ্রনাথের পেপার পাওয়ার পর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আইনস্টাইন একটি পেপার লিখলেন প্রুশিয়ান অ্যাকেডেমি অব সায়েন্স-এ, যা সত্যেন্দ্রনাথের পেপারেরই পরবর্তী ধাপ। ওই পেপারের সূত্রেই পরের বছর, ১৯২৫ সালে আরও দু’টি পেপার লিখলেন আইনস্টাইন। যার মধ্যে দ্বিতীয়টিতে এসে গেল ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’-এর আইডিয়া।

সত্যেন্দ্রনাথ প্লাঙ্কের সূত্র উদ্ভাবন করতে গিয়ে নতুন পথ খুঁজেছিলেন। নতুন সংখ্যায়ন প্রয়োগ করেছিলেন। এই সংখ্যায়নের একটা বড় দিক হল, আলোককণা (ফোটন) একটার থেকে আর একটা আলাদা নয়, হুবহু এক। তা এক হলে ওদের গোনার হিসাব পাল্টাতে বাধ্য। এই নতুন হিসাব আইনস্টাইন প্রয়োগ করলেন বস্তুকণার ক্ষেত্রে, যা থেকে বেরিয়ে এল বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স।

অন্য এক রকম স্ট্যাটিসটিক্স-এর প্রবর্তন করেছিলেন এনরিকো ফের্মি এবং মরিস ডিরাক। তার নাম ফের্মি-ডিরাক স্ট্যাটিসটিক্স। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত কণা আছে, তাদের সবই ওই সংখ্যায়নের একটাকে মানতে বাধ্য। দুই সংখ্যায়নের বাইরে কোনও কণা থাকতে পারে না। যে সব কণা ফের্মি-ডিরাক স্ট্যাটিসটিক্স মানে, তাদের বলে ফের্মিয়ন। আর যে সব কণা বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স মেনে চলে, তাদের বলে বোসন। ২০১২ সালে যখন পদার্থের ভর আবিষ্কারকারী কণার সন্ধান পাওয়া যায়, তখন তাকে বলা হয় বোসন কণা। এ জন্য স্যর পিটার হিগস এবং ফ্রাঁসোয়া এংলার্ট ২০১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। আশ্চর্য ঘটনা, আইনস্টাইন, ফের্মি এবং ডিরাক নোবেল পুরস্কার পেলেও সত্যেন্দ্রনাথের ভাগ্যে জোটে না ওই পুরস্কার।

কোন পরীক্ষায় সফল হলেন করনেল, ওয়াইমান এবং কেটারলিরা? সোজা কোথায়, ওঁরা তৈরি করলেন পদার্থের পঞ্চম অবস্থা। জানা ছিল, পদার্থের চার অবস্থা হয়— কঠিন, তরল, গ্যাস ও প্লাজ়মা। কঠিন, তরল বা গ্যাস আমরা সবাই জানি। প্লাজ়মা হল সেই অবস্থা, যেখানে প্রচণ্ড তাপে কণার ইলেকট্রনগুলো খসে গিয়ে নিস্তড়িৎ কণার বদলে পড়ে থাকে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক তড়িৎযুক্ত অংশবিশেষ। ওটাই প্লাজ়মা। গ্যাসের পরের অবস্থা। উল্টো দিকে কম তাপে আর এক অবস্থা। তখন পরমাণুর টুকরো ভাসমান নয়, বরং নিতান্ত কম তাপে অনেকগুলো পরমাণু যেন মন্ত্রবলে একটাই মাত্র জায়গা। অর্থাৎ, সবাই মিলে তখন একটাই পরমাণু। সুপার অ্যাটম। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট।

সবচেয়ে কম ঠান্ডা কোন তাপমাত্রা? না কি কম উষ্ণতার কোনও শেষ নেই, কোনও কিছুকে চাইলে যত খুশি ঠান্ডা করা যায়? না। তা যায় না। ঠান্ডার একটা সীমারেখা আছে, আর সেটা হল মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি। কোনও কিছুকে ওই মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম ঠান্ডা করা যায় না। হাজার চেষ্টা করলেও নয়। সে কারণে ওই মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে বলা হয় চরম শূন্য উষ্ণতা। এখন, উষ্ণতা মানে অণু-পরমাণুর ছোটাছুটি। যত বেশি তাপমাত্রা, তত বেশি দৌড়োদৌড়ি। চরম শূন্য উষ্ণতায় নিয়ে যেতে পারলে পদার্থের অণু-পরমাণু স্ট্যাচু। নট নড়নচড়ন। একেবারে চরম উষ্ণতায় কোনও পদার্থকে নিয়ে যাওয়া যায় না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও চরম শূন্য উষ্ণতার খুব কাছে— খু-উ-ব কাছে। তার পর আর নয়। কত কাছে? এক সেলসিয়াসের ১,০০০,০০০,০০০ ভাগ কাছে। চরম শূন্য উষ্ণতার অত কাছে নিয়ে যেতে পারলে কোনও পদার্থের অণু-পরমাণু ওই পঞ্চম দশা প্রাপ্ত হয়। পঞ্চম দশায় পদার্থ পাত্রের গা বেয়ে উঠে পাত্রের বাইরে চলকে পড়তে পারে। তড়িৎ পরিবহণে সব পদার্থই কমবেশি বাধা দেয়। পদার্থের ওই পঞ্চম দশায় তা প্রায় বিনা বাধায় বিদ্যুৎ পরিবহণ করে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, পঞ্চম দশায় পদার্থের অনেক পরমাণু একাকার হয়ে সুপার অ্যাটম-এ পরিণত হয়। সুপার অ্যাটম মানে অনেক পরমাণু, কিন্তু তারা একই জায়গা দখল করে থাকে।

২০১১ সালে সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ জীবিত। তিনি কেটারলিকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। ২২ নম্বর ঈশ্বর মিল লেন বাড়িতে ঢুকে অনেক ক্ষণ চেয়ে রইলেন সত্যেন্দ্রনাথের ছবিটার দিকে। কেটারলি জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর সঙ্গে আইনস্টাইনের কোনও ফোটো আছে কি না। ওঁকে জানানো হল, তা নেই।

ডিড দ্য মাস্টার লেট হিম ডাউন?

এই প্রশ্নটা বার বার উঠেছে। চিঠিপত্রে সত্যেন্দ্রনাথ আইনস্টাইনকে বার বার ‘মাস্টার’ বলে সম্বোধন করতেন। ১৯২৪-এর অক্টোবরে দু’বছরের স্টাডি লিভে ইউরোপে গিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাঁর ইচ্ছে ছিল আইনস্টাইনের অধীনে গবেষণা করার। হায়! যিনি কখনও কোনও পিএইচ ডি ছাত্র নেননি, তাঁর অধীনে গবেষণা! প্যারিসে কয়েক জনের ল্যাবরেটরিতে কাজ করে আর বার্লিনে কয়েক জনের সুখ্যাতি পেয়েই ফিরতে হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথকে।

সত্যেন্দ্রনাথের একমাত্র জীবিত ছাত্র, বিজ্ঞানী পার্থ ঘোষ এ ব্যাপারে বলেছেন, “আইনস্টাইন এমন পদক্ষেপ করেছিলেন, যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে নজিরবিহীন। সত্যেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পেপারে আইনস্টাইন (যা তিনি জার্মানে অনুবাদ করে ছাপান) জুড়ে দেন এক ফুটনোট। সত্যেন্দ্রনাথকে না জানিয়েই। ওই ফুটনোটে আইনস্টাইন লেখেন, বোসের নতুন সম্ভাব্যতা সূত্র (যা বসু সংখ্যায়ন থেকে আলাদা) ভুল! ওই ফুটনোট সহযোগেই ছাপা হয় পেপার। ওই মন্তব্য প্রায় পেপারটিকে হত্যা করার শামিল।”

এই প্রসঙ্গে নিজের এক অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন পার্থ। বললেন, “এক দিন স্যরের বাড়ি গিয়েছি। তিনি আমাকে বললেন এক গোপন কথা শোনাবেন। কী? আমি উৎসুক। স্যর বন্ধ করলেন দরজা-জানলা। তার পর আমাকে ফিসফিস করে বললেন, ‘আজ তোকে যা বলছি, তা আর কাউকে বলিস না।’ কথা দিলাম যে, আমি আর কাউকে তা বলব না। কিন্তু কী ব্যাপার? স্যরের আবিষ্কৃত সংখ্যায়নে একটা সংখ্যা চার (৪) এসেছিল, সেটা হবে আট (৮)। কেন হবে, তার ব্যাখ্যাও স্যর দিয়েছিলেন। হবে এই কারণে যে, আলোককণার স্পিন (ঘূর্ণনের মতো একটা ব্যাপার) আছে। এখন, আলোককণা ঘুরতে পারে দু’ভাবে। এক, আলোককণা যে দিকে ছুটছে, সে দিকেই ঘোরা। দুই, যে দিকে ছুটছে তার উল্টো দিকে ঘোরা। তাই চার-এর বদলে আট (৪ গুণ দুই)। স্যরের বিখ্যাত পেপারটি দেখার পর আইনস্টাইন তা কেটে দেন। স্যর আমাকে বললেন, ‘বুড়ো ওটা কেটে দিলে।’ পরে আলোককণার স্পিন পরীক্ষায় ধরা পড়ে। আমি স্যরকে বললাম, আলোককণার স্পিন ধরা পড়ার পর কেন আপনি আইনস্টাইনকে বললেন না, আপনিই ঠিক? তা হলে তো আলোককণার স্পিনের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য আপনার কৃতিত্ব স্বীকৃত হত। স্যর উত্তরে বললেন, ‘কে বার করেছে, তাতে কী যায়-আসে রে? বেরিয়েছে তো!’ এই হলেন সত্যেন্দ্রনাথ।”

পার্থ যোগ করেন, “অনেকেই ভাবতে পারেন, এ সব কথা বলে আমি স্যরকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভেঙেছি। তা হয়তো ভেঙেছি। তবে প্রতিজ্ঞাভঙ্গের কারণও আছে। পরে দেখেছি, স্যর তাঁর যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং আমার প্রতিজ্ঞা অর্থহীন। স্যর আমাকে দিয়ে যে দিন প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, তার অনেক দিন পরে আমি কাল্টিভেশন অব সায়েন্সেস-এর লাইব্রেরিতে বসে জার্নাল ঘাঁটছিলাম। হঠাৎ আমার হাতে এল ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজ়িক্স’-এ সি ভি রমন এবং এস ভাগবন্তম-এর লেখা একটা পেপার। ওই জুটি ব্যাখ্যা করেছেন আলোককণার স্পিনের পরীক্ষামূলক প্রমাণ। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, এ পেপার কি স্যর দেখেননি? এ পেপার প্রকাশিত হওয়ার পরও তো স্যর আইনস্টাইনকে বলতে পারতেন যে, আইনস্টাইন নন, তিনিই ঠিক। আসলে কী জানেন, স্যর প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন আইনস্টাইনকে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Letter Albert Einstein Satyendra Nath Bose
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE