Advertisement
E-Paper

রোজাদারদের ইফতার করায় এক হিন্দু পরিবার

প্রায় তিন দশক ধরে এই প্রথা চালিয়ে আসছেন কড়োলা গ্রামের কোলে পরিবার। দাওয়াত থাকে এলাকার সমস্ত মুসলমানদের। রয়েছে নমাজ পড়ার আলাদা ঘরও। ধর্মীয় সম্প্রীতির এ এক বিরল নিদর্শন।

সমন্বয়: ইফতারে আমন্ত্রিতদের সঙ্গে কোলে পরিবারের সদস্যরা।

সমন্বয়: ইফতারে আমন্ত্রিতদের সঙ্গে কোলে পরিবারের সদস্যরা। —ফাইল চিত্র।

নুরুল আবসার

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ০৬:২১
Share
Save

রমজান মাসের সাতাশতম রোজা (উপবাস) মুসলিমদের কাছে খুবই পবিত্র। তাঁরা ওই দিনটিকে বলেন ‘সাতাশে’। বস্তুত পক্ষে ওই দিন থেকেই যেন শুরু হয়ে যায় পবিত্র ইদের উৎসব। হাওড়ার সাঁকরাইলের আলমপুরের কোলে পরিবারও সাতাশে রোজার দিনটির জন্য বছরভর অপেক্ষা করেন। ওই দিন সন্ধ্যায় তাঁরা আয়োজন করেন ইফতারের। এলাকার ধর্মপ্রাণ রোজাদার মুসলিমদের তাঁরা ইফতারে দাওয়াত দেন। তাঁদের জন্য খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করেন। পরিবারের মহিলা সদস্যরা পরিবেশন করেন। পুরুষ সদস্যরা খাবারের উচ্ছিষ্ট নিজের হাতে তুলে ফেলে দিয়ে আসেন। উপবাস ভাঙার পরে যাঁরা মগরিবের নমাজ পড়তে চান, তাঁদের জন্য আলাদা একটা ঘর নির্দিষ্ট করে রাখা আছে। ইফতার শেষে সেখানে নমাজ পড়ে ফিরে যান রোজাদারেরা। গত একত্রিশ বছর ধরে সাতাশে রোজা উপলক্ষে এই আয়োজন চলে আসছে কোলে পরিবারে।

এই পরিবার সূত্রের খবর, সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এখান থেকে কিলোমিটার তিনেক দূরে ডোমজুড়ের কড়োলা গ্রামের বাসিন্দা আবুবকর নামে এক ফেরিওয়ালা গ্রামে গ্রামে ঘুরে রেডিমেড জামাকাপড় বিক্রি করতেন। তাঁর সঙ্গে ছিল কোলে পরিবারের সখ্য। তিনি ফিরি করে ফেরার পথে মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় কোলেদের বাড়িতে রেখে আসতেন কাপড়ের গাঁটরি। রমজান মাসে তিনি যখন কাপড়ের গাঁটরি রাখতে আসতেন, তখন ইফতারের সময় হয়ে যেত। এই পরিবারের তৎকালীন গৃহকর্ত্রী আঙুরবালা কোলে, তাঁকে বাতাসার শরবত ও ছোলাসেদ্ধ দিয়ে ইফতার করাতেন। এই ভাবেই চলেছিল কয়েক বছর ধরে।

পরে আবুবকর মারা যান। আঙুরবালার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে সখ্য ছিল কড়োলা গ্রামেরই শিক্ষক নুর নবী লস্করের। তিনিও রমজান মাসে মাঝে মাঝে এই বাড়িতে এসে ইফতার করতেন।

বিক্ষিপ্ত এই ইফতার আয়োজন সংগঠিত রূপ নেয় ১৯৯৪ সালে। পরিবারের সদস্যরা মিলিত ভাবে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করেন, ‘সাতাশে’ রোজার দিন তাঁরা এলাকার মুসলিমদের ইফতারের দাওয়াত দেবেন। কোলে পরিবারের আশপাশে স্থায়ী মুসলিম বাসিন্দা হাতে গোনা। তাতে কী! এখানে কাজের সূত্রে ভিন রাজ্য বা অন্য জেলার বহু মুসলিম থাকেন। তাঁদের সকলকে ডাকা হয় ইফতারে। প্রথম বছরের ইফতারে যোগ দিয়েছিলেন সাত জন। তাঁদের জন্য ফলমূল-শরবতের আয়োজন করা হয়। সেই শুরু। তার পর থেকে ইফতারে অংশগ্রহণকারীর রোজাদারদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বেড়েছে উদ্যোগের বহরও। গত বছর মোট বাষট্টি জন ইফতারে অংশ নেন।

ইফতারের এক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় কোলে পরিবারে। রোজাদারদের কাছে গিয়ে হাতজোড় করে দাওয়াত দেন পরিবারের সদস্যরা। দু’দিন আগে থেকে ফল কেনেন পরিবারের মহিলা সদস্যরা। তাঁরা ধুলাগড়ি পাইকারি বাজার থেকে কিনে আনেন তরমুজ, খেজুর, আপেল, শসা, পাকা পেঁপে। হাওড়ার নামী দোকান থেকে আনা হয় ফিরনি, কমলাভোগ, সন্দেশ। ইফতারের দিন সকাল থেকে মহিলারা ফল কুটতে থাকেন। বাড়ির উঠোনে বাঁধা হয় প্যান্ডেল। ডেকরেটরের কাছ থেকে আনা হয় চেয়ার টেবিল। লাগানো হয় বিজলি বাতি। অন্যান্য দিন পরিবারের সদস্যদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারতে বেলা দুটো-আড়াইটে বেজে যায়। কিন্তু ইফতারের দিন সকলে খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন বেলা বারোটার মধ্যে।

বিকেল পাঁচটা থেকেই রোজাদাররা আসতে শুরু করেন। তাঁদের আপ্যায়ন করে চেয়ারে বসানো হয়। এই এলাকায় কোনও মসজিদ না থাকলেও পাশাপাশি গ্রাম থেকে শোনা যায় মগরিবের আজানের আওয়াজ। আজান শুনতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরবত পান করে উপবাস ভঙ্গ করেন রোজাদাররা। তার পরে চলে খাওয়াদাওয়া। বাড়ির মহিলারা খাবার পরিবেশন করেন। তত্ত্বাবধান করেন পুরুষ সদস্যরা। ইফতারের পরে নির্দিষ্ট ঘরে নমাজ আদায় করে একে একে বিদায় নেন তৃপ্ত মানুষগুলি। সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে তাঁদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে কোলে পরিবারের সদস্যরা। এ দিন থেকেই উভয় পক্ষই যেন অপেক্ষা করেন পরের বছরের এই মিলনোৎসবের মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য।

এ বছরেও সাতাশে রোজার দিনে কোলে পরিবারে বসবে ইফতারের মজলিশ। তার জন্য ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা। আপাতত চলছে রোজাদারদের দাওয়াত দেওয়ার পালা। ডেকরেটরকে প্যান্ডেলের বরাত দেওয়া হয়ে গিয়েছে। এই পরিবারের সদস্য অলোক কোলে বলেন, “চার দিকে ধর্ম নিয়ে বিবাদ ও অসহিষ্ণুতা যত বাড়ছে, ততই আমরা আমাদের এই পারিবারিক ইফতার মজলিশকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চাইছি। মানুষ সবাই সমান। এই শিক্ষা আমরা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মজ্জায় মজ্জায় গেঁথে দিতে চাই। তাই আমাদের পরিবারের সমস্ত সদস্য ওই দিনটিতে অন্তত নিজেদের মধ্যেকার সব বিবাদ সরিয়ে রেখে ইফতার মজলিশের আয়োজনে সম্মিলিত ভাবে মেতে ওঠেন। আমরা কেউ চাকরি করি। কেউ ব্যবসা করি। ওই দিনে সবাই হাজির থাকি। দিনটি আমাদের পরিবারের কাছে সম্প্রীতির এক মহোৎসব।”

আলমপুরেই পুরনো টায়ার কেনাবেচার দোকান শেখ জাহাঙ্গিরের। তাঁর বাড়ি বিহারের সিওয়ান জেলায়। ব্যবসা সূত্রে বহু বছর ধরে এখানে থাকেন। তিনি প্রতি বছর কোলে পরিবারে ইফতারের দাওয়াত পান। এ বছরও পেয়েছেন। তিনি বলেন, “কোলে পরিবারের ইফতার মজলিশে যোগদান আমার কাছে ইদের তোফা। এই আন্তরিকতা ভোলা যায় না।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Iftar Party EID 2025 eid Hindu-Muslim Relation

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}