কারাগারে ঢোকার পরই বন্দিদের একটি মল নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত ড্রেনের জল খেতে বলা হত। এই জল খেতে অস্বীকার করলে তাঁদের সেখানেই মেরে ফেলা হত।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকতাশেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২২ ০৯:০৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২২
আমরা সকলেই এমন সিনেমা দেখেছি যেখানে জেলের জীবন স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ রকমই কিছু সিনেমা হল ‘কাউন্ট অব মন্টে ক্রিস্টো’, ‘এস্কেপ ফ্রম আলকাতরাজ’, ‘শ্যশাঙ্ক রিডেমপ্শন’, ‘দ্য গ্রিন মাইল’ ইত্যাদি।
০২২২
এই সব সিনেমায় জেলবন্দিদের উপর অত্যাচারের ঘটনা দেখে আপনার মনে হতেই পারে যে বাস্তব জীবনে বন্দিদের সঙ্গে নিশ্চয়ই এতটা অত্যাচার করা হয় না।
০৩২২
তবে বাস্তবে সত্যিই এমন একটি কারাগার রয়েছে, যা কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্য কারাগার হিসাবেই পরিচিত ছিল।
০৪২২
বিশ্বের দরবারে কুখ্যাত তকমা পাওয়া এই কারাগারের নাম তাদমোর। বিখ্যাত বেসরকারি সংস্থা ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর মতে এই কারাগারটিকে নরক বললেও কম বলা হবে। এর কারণ বন্দিদের উপর হওয়া নিয়মিত মারধর এবং নির্যাতন।
০৫২২
তাদমোর কারাগারটি সিরিয়ার পালমিরায়। ফরাসিরা ১৯৩০-এর দশকে আরবের মরুভূমির কেন্দ্রে তৈরি করে এই কারাগারটি। মূলত, এটি সামরিক বাহিনীর সেনাছাউনি হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮০-এর পর এই জায়গার ব্যবহারে বদল আসে।
০৬২২
তাদমোর কারাগারের বন্দিদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার পিছনে যে মানুষের হাত ছিল বলে মনে করা হয়, তিনি সিরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদ।
০৭২২
১৯৮০ সালে আল-আসাদের উপর প্রাণঘাতী আক্রমণ করা হয়। কিন্তু তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আল-আসাদের উপর আক্রমণের দায় বর্তায় ‘দ্য সোসাইটি অব দ্য মুসলিম ব্রাদার্স’-এর উপর।
০৮২২
এর পরই আল-আসাদের ভাই রিফাত গণহত্যার আদেশ দেন। মনে করা হয় এই গোষ্ঠীর প্রায় হাজার সদস্যকে মেরে তাঁদের মৃতদেহ তাদমোর কারাগারের বাইরে কবর দেওয়া হয়।
০৯২২
তাদমোর কারাগারের বন্দিদের বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। এখানে থাকা বন্দিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করা তো দূর অস্ত্, একে অপরের সঙ্গেও দেখা করার সুযোগ দেওয়া হত না। একে অপরের সঙ্গে কথা বললে যে কোনও সময়ে দেওয়া হত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ।
১০২২
তাদমোর কারাগারে বন্দিদের মাথা তোলার, উপরে তাকানোর বা একে অপরের দিকে তাকানোর অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হত না।
১১২২
তাদমোর কারাগারটি বৃত্তাকার। এই কারাগারটি এমন ভাবেই তৈরি করা হয়েছিল, যাতে প্রহরীরা যে কোনও সময়ে সমস্ত বন্দির উপর নজর রাখতে সক্ষম হন।
১২২২
১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে এই কারাগারে বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী।
১৩২২
এক সময়ে তাদমোর কারাগার বন্দিদের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, বন্দিদেরকে পালা করে ঘুমানোর সুযোগ দেওয়া হত। যখন কিছু বন্দি ঘুমোতেন, তখন বাকিদের দাঁড় করিয়ে রাখা হত।
১৪২২
কারারক্ষী ও কারাগার কর্তৃপক্ষ কখনওই কোনও বন্দিদের প্রতি দয়া দেখাতেন না। দয়া দেখানো হয়নি সিরিয়ার কবি ফারাজ বায়রাকদারকেও। তাঁকেও চার বছর এই কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
১৫২২
ফারাজ নিজের লেখা বইয়ে এই কারাগারকে ‘মৃত্যু ও উন্মাদনার রাজ্য’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। ফারাজ ব্যাখ্যা করেন, সমস্ত বন্দিকে সারা দিন অবরুদ্ধ রাখা হত। কোনও বন্দি যদি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে জানাতেন, তা হলে তাঁদের কারাগার চত্বরের উঠোনের চারপাশে দৌড়াতে বলা হত। এর ফলে শ্বাস আটকে মারাও যেতেন অনেকে। কখনও কখনও আবার শুধু পিটিয়ে হত্যা করা হত কারাগারের বন্দিদের।
১৬২২
ফারাজের বইতে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় নির্যাতনের কিছু পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে।
১৭২২
কারাগারে ঢোকার পরপরই বন্দিদের নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত একটি ড্রেনের জল খেতে বলা হত। অন্য এক বন্দি মোস্তফা খলিফার মতে, যাঁরা এই জল খেতে অস্বীকার করতেন, তাঁদের সেখানেই মেরে ফেলা হত।
১৮২২
বইয়ে উল্লেখ রয়েছে যে, এক কারাবন্দিকে এক দল প্রহরী একবার মৃত ইঁদুর গিলে খেতে বাধ্য করে। ওই ব্যক্তি মৃত ইঁদুরটি খেয়ে মারা না গেলেও কিছু মাস পর তিনি পাগল হয়ে যান।
১৯২২
ফারাজের বইটিতে বলা হয়, এক বয়স্ক বন্দিকে এক বার মাটিতে শুইয়ে সারাদিন ধরে এক জন কারা অফিসারের বুট চাটতে বলা হয়েছিল।
২০২২
নিয়মিত বেত্রাঘাত তো ছিলই। পাশাপাশি বন্দিদের একই জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হত যত ক্ষণ না তাঁরা মারা যান।
২১২২
তবে ফারাজের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্মৃতি একজন বন্দিকে ‘মানব ট্রামপোলিন’ হিসাবে ব্যবহার করা। এই প্রক্রিয়ায় বন্দিকে মাটিতে শুইয়ে প্রহরীরা তাঁর উপর দাঁড়িয়ে লাফাতেন। যত ক্ষণ না ওই বন্দি ঘাড় বা মেরুদণ্ড ভেঙে মারা যান, তত ক্ষণ এই প্রক্রিয়া চলতে থাকত।
২২২২
২০১৫ সালে ইসলামিক স্টেট (আইসিস) এই কারাগারটি দখল করে নেয়। এর পর এই কারাগারের ভিতরের ছবি প্রকাশ পায়। অধিগ্রহণের নয় দিন পরে আইসিস এই কারাগার বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়।