সুইস ব্যাঙ্কের জনপ্রিয়তা মূলত তার অর্থ সংরক্ষণের নীতির জন্য। জনপ্রিয়তার এই চাবিকাঠিই আবার সুইৎজ়ারল্যান্ডের ব্যাঙ্কগুলিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৪৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
মধ্য ইউরোপে আল্পস পর্বতের কোল জুড়ে ছোট্ট দেশ সুইৎজ়ারল্যান্ড। ভ্রমণপিপাসুদের বরাবরের আকর্ষণ এই দেশের বরফে ঢাকা মনোরম পরিবেশ। তবে শুধু পর্যটকদের নয়, সুইৎজ়ারল্যান্ড আকর্ষণ করে ব্যবসায়ী, লগ্নিকারীদেরও।
০২২১
সুইৎজ়ারল্যান্ডের যে কোনও ব্যাঙ্ক সুইস ব্যাঙ্ক নামে পরিচিত। এই ব্যাঙ্কই অর্থ সঞ্চয়ের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। বহু মানুষ সুইস ব্যাঙ্কে পরিশ্রমের অর্থ রেখে নিশ্চিন্ত বোধ করেন।
০৩২১
সুইস ব্যাঙ্কের জনপ্রিয়তা মূলত তার অর্থ সংরক্ষণ নীতির জন্য। গ্রাহকের পরিচয় গোপন রাখে সুইস ব্যাঙ্ক। ফলে কে এই ব্যাঙ্কে কত টাকা রাখছেন, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।
০৪২১
জনপ্রিয়তার এই চাবিকাঠিই সুইস ব্যাঙ্ককে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। গ্রাহকের পরিচয় প্রকাশের নিয়ম না থাকায় কালো টাকা রাখার জন্য এই ব্যাঙ্ককেই বেছে নেয় দুষ্কৃতী, অপরাধী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা।
০৫২১
সুইৎজ়ারল্যান্ডে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ইতিহাস অনেক পুরনো। অষ্টাদশ শতক থেকেই এই দেশের ব্যাঙ্কগুলিতে টাকা সঞ্চয়কারীদের জন্য নিয়মাবলি নির্দিষ্ট করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।
০৬২১
১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে জেনেভা কর্তৃপক্ষ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেন। তাতে বলা হয়, ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখা গ্রাহকদের পরিচয় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে সুরক্ষিত রাখবেন।
০৭২১
রাজনৈতিক দিক থেকে সুইৎজ়ারল্যান্ড বরাবরই শান্তিপ্রিয় এবং নিরপেক্ষ। ইউরোপ যখন বিশ্বযুদ্ধের নেশায় উন্মত্ত, তখনও জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ইটালির মধ্যবর্তী এই দেশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছিল। এই দেশেই তাই সম্পদ সংরক্ষণে আগ্রহী হয়েছিলেন ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের উচ্চবিত্ত ধনী সম্প্রদায়।
০৮২১
তার পর থেকে ইউরোপে যত বার ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করা হয়েছে, গ্রাহকদের পরিচয় গোপন, সুরক্ষাই ছিল কর্তৃপক্ষের প্রাধান্য। ১৯৩৪ সালে ব্যাঙ্কিং আইনে আরও কড়াকড়ি করে সুইৎজ়ারল্যান্ড।
০৯২১
১৯৩৪ সালে আইন প্রণয়ন করে বলা হয়, সুইস ব্যাঙ্কে গ্রাহকদের পরিচয় বা সেই সংক্রান্ত অন্য যে কোনও তথ্য বিদেশি সরকারের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া আইনত অপরাধ। বিদেশি সরকার শুধু নয়, কারও কাছেই গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।
১০২১
সুইস ব্যাঙ্কিং অ্যাক্টের ৪৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া তার পরিচয় এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি কারও কাছে প্রকাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি, সুইস সরকার চাইলেও সেই তথ্য জানতে পারবে না। তথ্য প্রকাশ করা হলে অভিযুক্তের পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
১১২১
সুইস ব্যাঙ্কের এই গোপনীয়তার নীতিই তাকে বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। গ্রাহকের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় নেই এখানে। ফলে কর ফাঁকি দেওয়ার সেরা ঠিকানা এই সুইস ব্যাঙ্ক।
১২২১
যাঁরা বিপথে কালো টাকা হস্তগত করেন, কর ফাঁকি দিয়ে যাঁরা কালো টাকার অস্তিত্ব গোপন করতে চান, তাঁরা দলে দলে সুইস ব্যাঙ্ককেই বেছে নেন টাকা রাখার জন্য। সুইস ব্যাঙ্কের প্রচ্ছন্ন মদতে ফুলেফেঁপে ওঠে দুর্নীতি।
১৩২১
শুধু সুইৎজ়ারল্যান্ড নয়, অন্য দেশ থেকেই ধনী ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা সুইস ব্যাঙ্কে টাকা রাখেন। নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশের ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য অবশ্যই কর ফাঁকি।
১৪২১
২০১৪ সালে সুইস ব্যাঙ্কের নীতিতে খানিক পরিবর্তন আসে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সহায়তা বিষয়ক সংগঠনের আওতায় ৫০টির বেশি দেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে করদাতাদের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য আদান প্রদানের বিষয়ে সম্মত হয়।
১৫২১
গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য প্রকাশ করতে সে সময় রাজি হয়েছিল সুইৎজ়ারল্যান্ডও। যে কারণে তাদের ব্যাঙ্কিং নীতিতে পরিবর্তন আসে।
১৬২১
২০২২ সালের শুরুর দিকে সুইৎজ়ারল্যান্ডের ক্রেডিট সুসি ব্যাঙ্ক থেকে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। প্রকাশ্যে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, ওই ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের একাংশ আর্থিক তছরুপ, মাদক পাচারের মতো গুরুতর অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত।
১৭২১
২০১৮ সাল থেকেই ভারত এবং সুইৎজ়ারল্যান্ড সরকারের মধ্যে করদাতাদের তথ্য লেনদেনের প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। সেই প্রক্রিয়ার আওতায় ২০১৯ সালে সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট রয়েছে, এমন ভারতীয়দের যাবতীয় তথ্য ভারতকে দিয়েছিল সুইৎজ়ারল্যান্ড।
১৮২১
কিন্তু মনে করা হয়, সুইৎজ়ারল্যান্ড থেকে গ্রাহকদের যে তথ্য ভারতকে দেওয়া হয়েছিল, তা কেবল তাঁদের আইনসম্মত সম্পত্তি সংক্রান্ত। কালো টাকা নিয়ে কোনও তথ্য আদৌ প্রকাশ করেনি সুইস ব্যাঙ্ক।
১৯২১
ভারতে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম থেকেই কালো টাকা দূর করার বিষয়ে জোর দিয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে কেন্দ্রের অর্থ প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরি লোকসভায় জানান, গত ১০ বছর ধরে সুইস ব্যাঙ্কে কোথায় কত কালো টাকা রাখা হয়েছে সেই সংক্রান্ত কোনও হিসাবই সরকারের কাছে নেই।
২০২১
ভারতের সঙ্গে সুইস ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের তথ্য ভাগ করে নেওয়ার বিরোধিতা করে ইতিমধ্যে ইউরোপীয় দেশটির আদালতে জমা পড়েছে একগুচ্ছ মামলা।
২১২১
তবে এত বিধিনিষেধ এবং বিতর্ক সত্ত্বেও কিন্তু সুইস ব্যাঙ্কের জনপ্রিয়তা কমেনি। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ওই বছর ভারতীয় ব্যক্তি বা সংগঠনের তরফে সুইস ব্যাঙ্কে সঞ্চয়ের পরিমাণ হয়েছিল ১৩ বছরে সর্বোচ্চ।