বিহারের বসন্তপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটেটি এখন একটি ছোটখাটো মিউজিয়াম। সেই বাড়ির দেওয়ালে তাঁর হাতে লেখা সংখ্যা দেখে অবাক হন পর্যটকেরা। তাঁদের ফিসফিস কথায় একটিই শব্দ ঘুরেফিরে শোনা যায় ‘জিনিয়াস’!
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪ ১৭:১৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৫
নোবেলজয়ী গণিতজ্ঞ জন ন্যাশকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল অস্কারজয়ী ছবি ‘দ্য বিউটিফুল মাইন্ড’। সংখ্যার মায়াজাল বুনে নানা তত্ত্বের ম্যাজিক দেখানো এক প্রতিভাবানের একটু একটু করে বিভ্রমের দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়ার গল্প। ভারতেও ঠিক তেমনই এক ‘জন ন্যাশ’ ছিলেন। নোবেল না জিতলেও গণিতে কৃতিত্বের নানা শিখর-ছোঁয়া সেই ভারতীয় গণিতজ্ঞ হঠাৎই উধাও হয়ে যান একদিন।
০২১৫
নাম বশিষ্ঠ নারায়ণ সিংহ। বিহারের বসন্তপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম। কনস্টেবলের সন্তান। সেই তিনিই চাঁদে নাসার মানুষ পাঠানোর অভিযান অ্যাপোলোর একজন গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী ছিলেন।
০৩১৫
বিহারের বসন্তপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটেটি এখন একটি ছোটখাটো জাদুঘর। সেই বাড়ির দেওয়ালে তাঁর হাতে লেখা সংখ্যা দেখে অবাক হন পর্যটকেরা। তাঁদের ফিসফিস কথায় একটিই শব্দ ঘুরেফিরে শোনা যায়— ‘জিনিয়াস’!
০৪১৫
কখনও-সখনও আগ্রহীদের সেই জিনিয়াসের কাহিনি শোনান বশিষ্ঠের আত্মীয়েরা। সেই গল্পেই জানা যায়, অ্যাপোলো মিশনের রকেট চাঁদে পাড়ি দেওয়ার আগের মুহূর্তে একটি কন্ট্রোলের একটি কম্পিউটার বিকল হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে সেটি সারিয়ে অ্যাপোলো মিশন বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন বশিষ্ঠই।
০৫১৫
তবে অ্যাপোলো অভিযানে তাঁর অবদান শুধু সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। শোনা যায়, অ্যাপোলো চন্দ্রাভিযানে নাসার হয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্কের হিসাবও মিলিয়েছিলেন তিনিই।
০৬১৫
গ্রামের সাধারণ স্কুলেই প্রাথমিকের পড়াশোনা। তবে পরে পরীক্ষা দিয়ে নেতারহাটের স্কুলে পড়ার সুযোগ পান বশিষ্ঠ। রাঁচীর কাছে ওই স্কুল দেশের বহু আমলা, শিক্ষাবিদকে তৈরি করেছে। সেই সময় স্কুলে যাঁরা বশিষ্ঠের থেকে নিচু ক্লাসে পড়তেন, তাঁরা বলছেন, বশিষ্ঠ বরাবরই খেলাধুলায় দুর্বল ছিলেন। বেশির ভাগ সময়েই বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকতেন।
০৭১৫
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে পটনা সায়েন্স কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন বশিষ্ঠ। তাঁর পরিচিতেরা বলছেন, এখানেই তাঁর ভিতরের গণিতজ্ঞ ধীরে ধীরে মাথা তুলতে শুরু করে। গণিতের ক্লাসে অধ্যাপকেরা যে তত্ত্বে অঙ্ক শেখাতেন, বশিষ্ঠ সম্পূর্ণ তার উল্টো ফর্মুলায় সেই অঙ্কের সমাধান করে দেখাতেন।
০৮১৫
বিষয়টি ভাল চোখে দেখতেন না এক অধ্যাপক। এক বার সেই ‘অপরাধে’ই ক্লাস থেকে টেনে তাঁকে প্রিন্সিপালের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য তাতে বশিষ্ঠের ক্ষতি হয়নি। কলেজের অধ্যক্ষ বশিষ্ঠের অঙ্কের দক্ষতায় এতটাই মুগ্ধ হন যে, তিনি বশিষ্ঠকে বিএসসিতে দু’বছরের প্রোমোশন দেন। প্রথম বর্ষের ছাত্র সোজা ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দেন। ভাল নম্বর পেয়ে পাশও করেন।
০৯১৫
সেই বছরই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন এল কেলি দেখা করতে এসেছিলেন পটনা সায়েন্স কলেজের অধ্যক্ষ নরেন্দ্র নাথের সঙ্গে। নরেন্দ্র কথায় কথায় বশিষ্ঠের মেধার কথা জানান জনকে। শোনামাত্রই জন বশিষ্ঠকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন।
১০১৫
এ ভাবেই বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের এক ভোজপুরীভাষী ১৯ বছরের কিশোর বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে অঙ্ক নিয়ে নিজের গবেষণাপত্র জমা দিয়ে পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন।
১১১৫
বার্কলেতে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন বশিষ্ঠ। তাঁর পরিবার বলছে, নাসায় অ্যাপোলো চন্দ্রাভিযানের একজন বিজ্ঞানী ছিলেন বশিষ্ঠ। এমনকি, বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কিছু তত্ত্বের পাল্টা তত্ত্ব দিয়ে কিছু গবেষণাপত্রও লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারেননি।
১২১৫
তাঁর পরিবারের দাবি, বিদেশে থাকাকালীনই বশিষ্ঠ কিছু মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হতে শুরু করেছিলেন। পরে তিনি দেশে চলে আসেন। আইআইটি কানপুরে অধ্যাপনার কাজ নেন। এ ছাড়া কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট এবং মুম্বইয়ের টিআইএফআরেও অধ্যাপনা করেছেন। সেই সময়েই স্কিৎজ়োফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি।
১৩১৫
অঙ্কের মায়াজাল পেরিয়ে বিভ্রমের দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে শুরু করেন বশিষ্ঠ। যার জেরে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। অধ্যাপক হিসাবে তাঁর কর্মজীবনেও প্রভাব পড়ে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল আমেরিকার নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ন্যাশের জীবনে।
১৪১৫
এই সময়েই একটি ট্রেনসফরে বেরিয়ে আচমকা উধাও হয়ে যান বশিষ্ঠ। দীর্ঘ দিন পরে তাঁকে নিজেরই গ্রামের একটি বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায় হতদরিদ্র অবস্থায়। সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেন পরিচিতেরা। সেই সময় অভিনেতা এবং অধুনা বাংলার আসানসোলের সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্হা অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বশিষ্ঠকে। তাঁরই অর্থে বশিষ্ঠের চিকিৎসা হয় দিল্লি এবং বেঙ্গালুরুতে।
১৫১৫
দীর্ঘ চিকিৎসার পরে আবার তাঁর অঙ্কের দুনিয়ায় ফেরেন বশিষ্ঠ। বিহারের মাধেপুরায় ভূপেন্দ্র নারায়ণ মণ্ডল বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ‘দ্য বিউটিফুল মাইন্ড’ ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, বিভ্রমের দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়া বিজ্ঞানী ন্যাশ আবার ফিরে গিয়েছেন তাঁর পুরনো প্রতিষ্ঠানে। তাঁর সামনে নিজেদের কলমগুলি রেখে যাচ্ছেন তাঁর প্রাক্তন ছাত্র, বন্ধু, সহকর্মী, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীরাও। বশিষ্ঠের সেই সৌভাগ্য হয়েছিল কি না জানা নেই। ২০১৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তার পরে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ দিয়ে মরণোত্তর সম্মান দেয় ভারত সরকার।