পাকিস্তানে কৃষক বিদ্রোহ! নেপথ্যে গম আমদানি দুর্নীতি? সত্যি আড়াল করতে তদন্ত করছে না সরকার?
ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের কৃষক সংগঠন ‘কিসান ইত্তেহাদ পাকিস্তান’ গম নিয়ে তৈরি হওয়া সঙ্কটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় নেমেছে। দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন পাকিস্তানের হাজার হাজার কৃষক।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২৪ ০৮:৩৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আবার জেরবার পাকিস্তান। ভারতের প্রতিবেশী দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থার আবারও অবনতি শুরু হয়েছে। আকাশ ছুঁয়েছে জিনিসপত্রের দাম। সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। তার মধ্যেই সে দেশে গম আমদানি সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
০২২০
ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের কৃষক সংগঠন ‘কিসান ইত্তেহাদ পাকিস্তান’ গম নিয়ে তৈরি হওয়া সঙ্কটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় নেমেছে। দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন পাকিস্তানের হাজার হাজার কৃষক। শুক্রবার মুলতান থেকে মিছিল শুরু করে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। কিন্তু কেন এই প্রতিবাদ? কেন এত মিছিল?
০৩২০
পাকিস্তানের বাজারে গমের দাম কমেছে। বর্তমানে সে দেশে ৪০ কেজি গমের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ৩৯০০ টাকা (পাকিস্তানি মুদ্রা)। ভারতীয় মুদ্রায় ১,১৭২ টাকা। কিন্তু পাকিস্তানের বাজারে গমের দাম এতটাই কমেছে যে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকেও কমে গম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন গমচাষিরা। আর তা নিয়েই এত হইচই।
০৪২০
কৃষকদের দাবি, গমের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না তাঁরা। আর সেই কারণেই গত এক মাস ধরে সরব পাকিস্তানের কৃষক সম্প্রদায়। লাহোর-সহ বহু শহরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তাঁরা। কৃষকদের বিক্ষোভকে প্রশমিত করতে ইতিমধ্যে উঠেপড়ে লেগেছে পাক সরকার। বেশ কয়েক জন কৃষককে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ।
০৫২০
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের এ হেন পরিস্থিতির নেপথ্যে রয়েছে গম আমদানি কেলেঙ্কারি। অন্তত তেমনটাই অভিযোগ করছেন বিরোধীরা। বিরোধীদের অভিযোগ, এই ‘দুর্নীতি’ হয়েছে পাকিস্তানের পূর্বতন তদারকি সরকারের আমলে।
০৬২০
কিন্তু কী এই গম আমদানি দুর্নীতি? ২০২৩ সালে পাকিস্তানের তদারকি সরকার বেসরকারি ব্যবসায়িক সংস্থাগুলিকে গম আমদানি শুরু করার অনুমতি দিয়েছিল। অভিযোগ, দেশের অভ্যন্তরে কতটা গম উৎপাদন হচ্ছে তা বিবেচনা না করেই সেই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
০৭২০
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, পাকিস্তানের তদারকি সরকার ২০২৩ সালের অগস্ট থেকে ২০২৪ সালের মার্চ অবধি বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ৩,৩০,০০০ কোটি পাকিস্তানি টাকার গম আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। পাকিস্তানের তদারকি সরকার বেসরকারি সংস্থাগুলিকে যখন এই অনুমতি দিয়েছিল, তখন ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম পড়তে শুরু করেছে।
০৮২০
পাকিস্তান পরিসংখ্যান ব্যুরো (পিবিএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ’২৪ সালের মার্চের মধ্যে আনুমানিক ২,৮২,৯৭৫ কোটি পাকিস্তানি টাকা (প্রায় ১০০.৫ কোটি ডলার) খরচ করে ৩৪.৪০ লক্ষ টন গম আমদানি হয়েছে সে দেশে।
০৯২০
২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানে গম আমদানি অব্যাহত ছিল। পাক সরকার তখন জানিয়েছিল, বিদেশ থেকে গমভর্তি আরও জাহাজ পাকিস্তানে আসা বাকি। তবে এপ্রিলে কত পরিমাণ গম আমদানি করা হয়েছে তা চূড়ান্ত পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠে।
১০২০
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরে ইদের দিনে ছ’টি জাহাজে করে বিদেশি গম পৌঁছেছিল পাকিস্তানে। এর পর দেখা যায়, পাকিস্তানের আমদানি করা মোট গমের পরিমাণ প্রায় ৪০ লক্ষ টনের কাছাকাছি পৌঁছেছে। যা অর্থনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে লড়তে থাকা পাকিস্তানের কোষাগার এবং দেশের বিদেশি মুদ্রার তহবিলের উপর চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১১২০
বিরোধীদের অভিযোগ, পাকিস্তানের বিদেশি মুদ্রার তহবিলের অবস্থা শোচনীয় হওয়া সত্ত্বেও সরকার গম আমদানি অব্যাহত রেখেছিল।
১২২০
শুধু তা-ই নয়, বেসরকারি সংস্থাগুলিকে আরও গম আমদানি করার অনুমতি দেওয়ার কারণে সে দেশের গমচাষিদের উপর ‘মিডলম্যান’ বা ফড়েদের অত্যাচার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও অভিযোগ।
১৩২০
এ-ও অভিযোগ উঠেছে, পাকিস্তান বিদেশ থেকে যে গম আমদানি করেছে, তা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং ব্যবহারের অনুপোযোগী। ফলে অত্যন্ত কম দামে সেই পণ্য আমদানি করে বেসরকারি সংস্থাগুলি প্রচুর মুনাফা কামিয়েছে বলেও অভিযোগ।
১৪২০
অন্য দিকে, এ বছর পাকিস্তানে গমের ফলন ভাল হয়েছে। কিন্তু বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ গম আমদানির কারণে দেশের কৃষকদের থেকে গম কেনার পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়েছে সরকার। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা।
১৫২০
অভিযোগ, পাকিস্তানের বাজারে অতিরিক্ত পরিমাণ বিদেশি গম আসার কারণে গমের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও পাচ্ছেন না কৃষকেরা। পাক সংবাদমাধ্যম ডনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪০ কেজি গমের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ৩৯০০ টাকা (পাকিস্তানি মুদ্রা) হওয়া সত্ত্বেও কৃষকেরা ২,৮০০-৩,০০০ টাকা (পাকিস্তানি মুদ্রা)-য় ৪০ কেজি গম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, কৃষকদের দামের সঙ্গে টক্কর দিতে বেসরকারি সংস্থাগুলিও গমের দাম উল্লেখযোগ্য ভাবে কমিয়ে দিয়েছে। ফলে আরও দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা।
১৬২০
পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে যে, কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জন্ম নিয়েছে। প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (পিটিআই)-ও গম আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য তৎকালীন তদারকি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তদন্তের দাবি তুলেছে।
১৭২০
যদিও প্রাক্তন তদারকি সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনওয়ার-উল-হক কাকর সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, তদন্তের মুখোমুখি হতে রাজি তিনি। ‘জিয়ো নিউজ়’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রবিবার স্থানীয় সাংবাদিকদের কাকর বলেছেন, ‘‘যদি আমাকে তলব করা হয়, তা হলে আমি গম আমদানি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির সামনে হাজিরা দেব।’’
১৮২০
কাকরের দাবি, তাঁর শাসনকালে গম আমদানির জন্য কোন নতুন আইন প্রবর্তন করা হয়নি। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ফসল আমদানি করতে ‘উৎসাহিত’ করেছিল শুধুমাত্র।
১৯২০
তবে পাকিস্তানের শাহবাজ শরিফের সরকার এখনই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার পক্ষপাতী নয় বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। যদিও পিএমএল-এন সূত্র সংবাদমাধ্যম ‘ডন’কে জানিয়েছে যে, দলের সুপ্রিমো নওয়াজ শরিফ ভাই শাহবাজকে বিষয়টি নিয়ে ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত’ করার কথা জানিয়েছেন। যদিও সরকার এখনও পর্যন্ত বিশেষ কোনও তৎপরতা দেখায়নি। কোন সত্যি আড়াল করতে তদন্ত করা হচ্ছে না? প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা।
২০২০
গত রবিবার বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছিল মন্ত্রি পরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন একটি তদন্ত কমিটি। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার জানিয়েছেন, দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য এবং নথি যাচাই করা হচ্ছে।