বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব শুধু স্থলে নয়, পড়ছে জলের উপরেও। দিন দিন আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে সমুদ্র। যা বিপদ ডেকে আনছে প্রাণিজগতে। ব্যাহত হচ্ছে জনজীবনও।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ ১২:০৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
গত ৫০ বছরের উষ্ণতম জুলাই দেখেছে দক্ষিণবঙ্গ। শুধু দক্ষিণ নয়, গোটা বাংলা জুড়েই রীতিমতো ‘তাণ্ডব’ চালিয়েছে গরম। দিনের পর দিন গাঙ্গেয় বঙ্গে তাপমাত্রা থেকেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।
০২২০
জুলাই মাসের অধিকাংশ সময়ই তাপপ্রবাহ চলেছে বাংলায়। বাঁকুড়া থেকে বীরভূম কিংবা কলকাতা থেকে কাঁথি, যেন বাতাসের সঙ্গে বয়েছে আগুনের স্রোত। পশ্চিম মেদিনীপুরের কলাইকুন্ডায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নথিভুক্ত হয়েছে একাধিক বার। পারদ পৌঁছে গিয়েছিল প্রায় ৫০ ডিগ্রির কাছাকাছি।
০৩২০
গরমকালে গরম পড়বেই, তা মেনে নিয়েও বলা যায়, গত কয়েক দশকে এই তীব্র জ্বালাপোড়া গরম দেখেনি বাংলা। শুধু বাংলা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই অপ্রত্যাশিত গরম এ বছর চমকে দিয়েছে সকলকে। জুলাইয়ের ‘ভিলেন’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাপপ্রবাহ।
০৪২০
বিশ্ব উষ্ণায়নই আবহাওয়ার এই চরিত্রবদলের মূল, বলছেন আবহবিদেরা। তবে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব শুধু স্থলে নয়, পড়ছে জলের উপরেও। দিন দিন আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে সমুদ্র। যা বিপদ ডেকে আনছে প্রাণিজগতে।
০৫২০
শুধু স্থলে নয়, তাপপ্রবাহ হচ্ছে জলেও। গত বছর গরমের দিনে সমুদ্রের তাপমাত্রা চোখে পড়ার মতো বেড়ে গিয়েছিল। চলতি বছরে তা আরও বেড়েছে। এই সামুদ্রিক তাপপ্রবাহে প্রমাদ গুনছেন আবহবিদেরা।
০৬২০
উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণ ভারত মহাসাগরীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, উত্তর-পূর্ব অতলান্তিক মহাসাগর, ক্রান্তীয় উত্তর অতলান্তিক মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের জলে গত কয়েক বছর ধরে তাপপ্রবাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
০৭২০
সমুদ্রের মধ্যেকার বাস্তুতন্ত্রকে নিমেষে দুর্বল করে দিতে পারে এই সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ (মেরিন হিটওয়েভ বা এমএইচডব্লিউ)। বহু সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হতে পারে এর প্রভাবে। বদলে যেতে পারে প্রাণীদের বাস এবং অভিবাসনের ধরন। এই ধরনের তাপপ্রবাহে প্রবালও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বছরের পর বছর।
০৮২০
সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের সব থেকে খারাপ এবং ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে আবহাওয়ার উপর। আবহাওয়ার চরিত্রও বদলে যেতে পারে এর ফলে। এই তাপের কারণে স্থলভাগে আছড়ে পড়া সাইক্লোনের প্রাবল্য বেড়ে যায় বলে জানান আবহবিদেরা।
০৯২০
সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ ঠিক কী? কেন এবং কী ভাবে তা সৃষ্টি হয়? আবহবিদেরা জানান, এটি আবহাওয়ার একটি চরম অবস্থা। কোনও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমুদ্রের উপরিভাগের তাপমাত্রা যদি পর পর পাঁচ দিনের জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকে, তবে সেখানে তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
১০২০
আমেরিকার সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) জানিয়েছে, শুধু পাঁচ দিন নয়, এই তাপপ্রবাহ কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত চলতে পারে।
১১২০
স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে তিন থেকে চার ডিগ্রি বৃদ্ধি মানুষের কাছে সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু সামুদ্রিক প্রাণীর ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি অপরিসীম এবং অসহনীয়। তাপপ্রবাহে প্রচুর মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর মৃত্যু হয়। যা ডাঙায় মানুষের জন্যও বিপদ ডেকে আনে।
১২২০
সমুদ্রের উপকূলীয় এলাকায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের অধিকাংশের জীবিকা নির্ভর করে থাকে সামুদ্রিক মাছ এবং অন্যান্য প্রাণীর উপর। তাপে সেই সব প্রাণীর মৃত্যু হলে মৎস্যজীবীদের মাথায় হাত পড়ে। ২০১০-১১ সালে এই তাপপ্রবাহের কারণে বিপুল পরিমাণ মাছের মৃত্যু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল সংলগ্ন এলাকায়। যা সমুদ্রকেন্দ্রিক জীবনে সঙ্কট ডেকে এনেছিল।
১৩২০
নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তর মহাসাগরে ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা সাত বছর তাপপ্রবাহ চলেছে। ২০০৭ থেকে এই তাপপ্রবাহের সংখ্যা অন্তত ১১টি। প্রতি ক্ষেত্রে সমুদ্রের তাপ বৃদ্ধির গড় স্বাভাবিকের চেয়ে ২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
১৪২০
উত্তর মহাসাগরে ২০২০ সালে যে তাপপ্রবাহ হয়েছিল, তা সবচেয়ে ভয়ানক ছিল। টানা ১০৩ দিন ধরে ওই তাপপ্রবাহ স্থায়ী হয়েছিল। জলের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছিল স্বাভাবিকের চেয়ে চার ডিগ্রি। বিশ্ব উষ্ণায়ন ছাড়া এই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে না বলে মত আবহবিদদের।
১৫২০
সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের চলতি বছরের পরিসংখ্যান এখনও হাতে আসেনি। তবে গরম এ বছর অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে সমুদ্রে তাপের দাপটও আগের নজির ভেঙে দেবে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।
১৬২০
ভারতের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের প্রভাব দেখা যায় উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিম আরব সাগরে। আরব সাগরের চেয়ে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা এমনিতেই কিছুটা বেশি। তাই বঙ্গোপসাগরে বছরে বেশ কিছু ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের ফলে আরব সাগরও সেই পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে।
১৭২০
আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, গত কয়েক বছরে আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। বেড়েছে সেই ঝড়ের স্থায়িত্ব এবং প্রাবল্যও।
১৮২০
লক্ষদ্বীপের কাছ থেকে জন্ম নিয়ে ঘূর্ণিঝড় কেরল, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, গোয়ার উপকূল ধরে এগিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে গুজরাতের কাছে। স্থলভাগে আছড়ে পড়ার পর সেই ঘূর্ণিঝড় বৃষ্টি এনে দিচ্ছে দিল্লি এবং নেপাল সংলগ্ন এলাকাগুলিতেও। যা ভারতের পশ্চিম উপকূলে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
১৯২০
সাধারণত সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ দেখা যায় জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। ফলে এটি দেশের নানা প্রান্তে বর্ষার গতিপ্রকৃতিকেও প্রভাবিত করছে। সমুদ্রের জল উষ্ণ থাকলে সেখানে নিম্নচাপ অঞ্চল তৈরি হচ্ছে। ফলে বাতাস স্থলভাগে ঢোকার পরিবর্তে সে দিকেই বইছে। এর ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে বর্ষা।
২০২০
সমুদ্রে তাপপ্রবাহ জলের পরিমাণও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে প্রতি দশকেই ধীরে ধীরে বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর। এর ফলে তাপপ্রবাহের সংখ্যাও বাড়ছে। সামগ্রিক ভাবে যা ব্যাহত করছে জনজীবন। অবিলম্বে বিশ্ব উষ্ণায়নে রাশ টানতে না পারলে আগামী দিনে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ উপকূলীয় এলাকায় আরও বড়সড় সঙ্কট ডেকে আনতে পারে, আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।