পহেলগাঁওয়ের বদলা নিতে পাকিস্তানে ঢুকে বড় আকারের ফৌজি অপারেশন চালাতে পারে ভারত। সে ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভাবে ইসলামাবাদের অনেক কাছে থাকা আমেরিকার অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৩৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার বদলা নিতে ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছে ভারতীয় ফৌজ। সেই লক্ষ্যে লাগাতার মহড়ায় ব্যস্ত রয়েছে জল-স্থল ও বায়ুসেনা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির সৈনিক অভিযানকে কতটা সমর্থন করবে দুনিয়ার অন্যতম ‘সুপার পাওয়ার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? এ ব্যাপারে ‘বন্ধু’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাশে আদৌ কি দাঁড়াবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? উঠছে সেই প্রশ্ন।
০২১৯
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, পহেলগাঁও হামলার পর খোলাখুলি ভাবে নয়াদিল্লির পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানে ঢুকে জঙ্গিনিধনের ব্যাপারে ভারতকে একরকম সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে ট্রাম্প সরকার। গত কয়েক দিন ধরে আমেরিকার একাধিক পদস্থ আধিকারিকের বয়ানে মিলেছে তাঁর ইঙ্গিত।
০৩১৯
এ ব্যাপারে প্রথমেই বলতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গাবার্ডের কথা। পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার খবর মিলতেই এক্স হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট করেন তিনি। সেখানে তুলসী লেখেন, ‘‘ইসলামীয় সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করছি। এই জঘন্য ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বার করে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদীর পাশে আছি।’’
০৪১৯
পাকিস্তানে ঢুকে জঙ্গি নিকেশের ব্যাপারে তুলসীর এই পোস্টকেই ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বলে মনে করছেন দুনিয়ার তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। গত ২৪ এপ্রিল হোয়াইট হাউসে ‘প্রেস ব্রিফিং’-এর সময় এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতে গেলে এক পাক সাংবাদিক মাঝপথেই থামিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ দফতরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস। তাতে ইসলামাবাদের রক্তচাপ কয়েক গুণ বেড়ে গেছিল।
০৫১৯
হোয়াইট হাউসের সাংবাদিক বৈঠকে ব্রুস বলেন, ‘‘আমি এই ব্যাপারে নতুন করে একটা শব্দও খরচ করব না। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কড়া ভাবে সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করি।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং বিদেশ সচিব মার্কো রুবিওর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে। উল্লেখ্য, পহেলগাঁও হামলার পর ফোনে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
০৬১৯
যদিও এত কিছুর পরেও আমেরিকাকে পুরোপুরি ‘বিশ্বাস’ করা বেশ কঠিন বলেই মনে করেন বিশ্লেষকদের অপর অংশ। তাঁদের যুক্তি, পাকিস্তানে ঢুকে ছোট আকারের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালালে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়া যাবে ঠিকই। কিন্তু, সেটা ধীরে ধীরে যুদ্ধে বদলে গেলে চকিতে ‘ইউ টার্ন’ নিতে পারে ওয়াশিংটন। অতীতে যা বহু বার করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা।
০৭১৯
ভারত ও পাকিস্তান দু’টি দেশই পরমাণু শক্তিধর হওয়ায় ঐতিহাসিক ভাবে তারা যুদ্ধে জড়াক এমনটা চায় না যুক্তরাষ্ট্র। বরং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসন অনেক বেশি আগ্রহী। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘আত্মরক্ষায়’ নয়াদিল্লির অবস্থানকে অবশ্যই সমর্থন করবে আমেরিকা, মত বিশ্লেষকদের।
০৮১৯
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি রক্ষায় সব সময় বেশি করে আগ্রহ দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই ধরনের জঙ্গি হামলার পরবর্তী পর্যায়ে নয়াদিল্লির প্রত্যাঘাতের প্রশ্নে ওয়াশিংটনের অবশ্য নির্লিপ্ত থাকার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আত্মঘাতী হামলা চালায় এক জইশ জঙ্গি। তাতে ৪০ জন আধা সেনার মৃত্যু হয়েছিল।
০৯১৯
ওই ঘটনার পর পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার বালাকোটে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শিবিরে ‘এয়ারস্ট্রাইক’ চালায় ভারতীয় বায়ুসেনা। ফলে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সংঘাতের পরিস্থিতি তীব্র হয়। বালাকোট এয়ারস্ট্রাইকে সমর্থন জানালেও দুই দেশের সেনা মুখোমুখি আসুক, তা কখনওই চায়নি আমেরিকা। ফলে তখনও আলোচনার রাস্তা ধরতে নয়াদিল্লি ও ইসালামাবাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল ওয়াশিংটন।
১০১৯
এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত মার্কিন অধ্যাপক মাইকেল কুজেলম্যান। তাঁর কথায়, ‘‘ট্রাম্প প্রশাসনকে নয়াদিল্লি অন্ধের মতো বিশ্বাস করলে ভুল করবে। কারণ, আফগানিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ বা সেখানকার জেহাদিদের নিকেশ করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ (সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি) অনেক বেশি ইসলামাবাদের উপর নির্ভরশীল।’’
১১১৯
গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর আমেরিকার, রাশিয়া, চিন-সহ একাধিক শক্তিশালী দেশের কূটনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সূত্রের খবর, সেখানেই পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে নয়াদিল্লি। পাল্টা একই রকমের বৈঠক করেছে ইসলামাবাদও।
১২১৯
পাশাপাশি, আরব সাগরে বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্তকে মোতায়েন করেছে ভারতীয় নৌসেনা। এ ছাড়া দক্ষিণ পাকিস্তানের নৌঘাঁটি তথা করাচি বন্দরের অদূরে একটি ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে ড্রেস্ট্রয়ার শ্রেণির জাহাজ আইএনএস সুরাট। সূত্রের খবর, পরমাণু শক্তিচালিত জোড়া ডুবোজাহাজ আইএনএস অরিহান্ত এবং আইএনএস অরিঘাটকে আরব সাগরে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নয়াদিল্লি।
১৩১৯
পিছিয়ে নেই ভারতীয় বিমানবাহিনীও। ‘অপারেশন আক্রমণ’ নামের একটি মহড়া শুরু করেছে তাদের বহরে থাকা যাবতীয় যুদ্ধবিমান। রাজস্থানের মরুভূমিতে একই রকমের মহড়া চালাচ্ছে ভারতীয় স্থল সেনার মূল যুদ্ধট্যাঙ্ক।
১৪১৯
তবে পাকিস্তানে ঢুকে বদলা নেওয়ার আগে কূটনৈতিক প্রত্যাঘাত শুরু করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। গত ২৩ এপ্রিল ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে মোদী সরকার। ফলে পাক পঞ্জাব প্রদেশে তীব্র জলসঙ্কটের আশঙ্কায় ভুগছে ইসলামাবাদ। আর তাই নদীর জল বন্ধ হলে তাকে যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে বলে ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে শেহবাজ় শরিফ সরকার।
১৫১৯
এই পরিস্থিতিতে সংঘর্ষবিরতি চুক্তি ভেঙে পাক সেনা নিয়ন্ত্রণরেখায় (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) গুলিবর্ষণ শুরু করায় উত্তেজনার পারদ আরও কয়েক গুণ চড়ছে। সেখানে পাল্টা জবাব দিয়েছে ভারতীয় ফৌজ। ভারতকে প্যাঁচে ফেলতে ১৯৭২ সালে হওয়া সিমলা চুক্তি সাময়িক ভাবে স্থগিত করতে পারে ইসলামাবাদ। তাতে সীমান্তে সংঘাত আরও তীব্র হবে বলেই স্পষ্ট করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
১৬১৯
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, সিন্ধু জল চুক্তিকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে পুরোদস্তর যুদ্ধে জড়াতে পারে পাকিস্তান। রাওয়ালপিন্ডির সেনাশাসকদের শরীরী ভাষায় তার স্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই সীমান্ত লাগোয়া বায়ুসেনা ঘাঁটিগুলিতে আমেরিকার তৈরি এফ-১৬ লড়াকু জেট মোতায়েন করেছেন তাঁরা। এলওসির বাঙ্কারগুলিতে বাড়ানো হয়েছে সৈন্যসংখ্যা।
১৭১৯
তবে উত্তেজনার আবহে ইসলামাবাদ যে গত তিন দশক ধরে জঙ্গিদের সমর্থন এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছে তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাওয়াজা আসিফ। এই ‘নোংরা কাজের’ দায় আমেরিকা এবং পশ্চিমি বিশ্বের উপর চাপিয়েছেন তিনি। তাঁর ওই মন্তব্যকে একেবারেই ভাল চোখে দেখছে না ওয়াশিংটন।
১৮১৯
খাওয়াজা আসিফের বক্তব্যের পর এ ব্যাপারে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ দ্বন্দ্বে মধ্যস্থতার কোনও আকাঙ্ক্ষাই যে তাঁর নেই, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘‘ভারত এবং পাকিস্তান নিজেরাই কোনও না কোনও ভাবে এই সমস্যার সমাধান করবে।’’
১৯১৯
ট্রাম্পের ওই মন্তব্যের পর পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে নয়াদিল্লির কোনও বাধাই থাকছে না বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের একাংশের দাবি, ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ দমনে ভবিষ্যতে আরও কাছাকাছি আসবে ভারত ও আমেরিকা। দুই দেশের সেনাকে যৌথ অভিযানেও অংশ নিতে দেখা যেতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁরা।