জি২০-ভুক্ত দেশগুলির অর্থমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলেন মার্কিন ট্রেজ়ারি সচিব স্কট বেসেন্ট। ফলে আমেরিকা যে কোনও মুহূর্তে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাঙ্ক ত্যাগ করতে পারে বলে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়েছে জল্পনা।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:৩২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজ়েশন বা হু) ও রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদ (ইউনাইটেড নেশন্স হিউম্যান রাইট্স কাউন্সিল বা ইউএনএইচআরসি) থেকে আগেই নাম প্রত্যাহার করেছে আমেরিকা। এ বার কি আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকেও সরে আসবে যুক্তরাষ্ট্র? জি২০-ভুক্ত দেশগুলির অর্থমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকের পর উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন।
০২২০
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজ়ারি সচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন স্কট বেসেন্ট। দক্ষিণ আফ্রিকায় চলা জি২০ বৈঠকে তাঁর যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। এর পরই আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে ওয়াশিংটন সরে আসতে পারে বলে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে।
০৩২০
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাম্প। সূত্রের খবর, ঘনিষ্ঠমহলে তিনি বলেছেন সংশ্লিষ্ট এই দুই প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের কোনও উপকারে লাগছে না। উল্টে এর জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার খরচ হচ্ছে ওয়াশিংটনের। যদিও এই ইস্যুতে প্রকাশ্য কোনও বিবৃতি দেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা তাঁর প্রশাসন।
০৪২০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসতে গত শতাব্দীর ৪০-এর দশকে জন্ম হয় আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের। আধুনিক পৃথিবীর আর্থিক সমীকরণে এই দুই সংগঠনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যখনই কোনও রাষ্ট্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে, তখনই সেখানকার সরকার ছুটে গিয়েছে আইএমএফের কাছে। আর দুনিয়ার নানা প্রান্তে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক।
০৫২০
১৯৪৪ সালের ১ জুলাই শুরু হয় আইএমএফের পথচলা। ওই একই বছর জুলাই মাসে জন্ম হয় বিশ্ব ব্যাঙ্কেরও। দু’টি প্রতিষ্ঠানেরই সদর দফতর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের সদস্যপদ পেয়েছে দুনিয়ার ১৮৯টি দেশ। ২০২৩ সালের ৩ মে থেকে এর প্রেসিডেন্টপদে রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অজয় বাঙ্গা।
০৬২০
বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বহু দেশকে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আইএমএফ। উদাহরণ হিসাবে গ্রিস বা আর্জেন্টিনার কথা বলা যেতে পারে। ১৯৭৬ সালে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় ব্রিটেনও। আর গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটির থেকে ঋণ নিয়েছিল ভারত সরকার।
০৭২০
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, আইএমএফের জন্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ বা অনাহারে মৃত্যুর মতো ঘটনা ঠেকানো গিয়েছে। কারণ, অস্বাভাবিক ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ায় গ্রিসকে টাকা দেওয়ার দুঃসাহস কেউ দেখায়নি। আর আর্জেন্টিনার রয়েছে ঋণখেলাপের বদনাম। অর্থের অভাবে খাদের কিনারা থেকে এই দু’টি দেশকে টেনে তোলার নেপথ্যে যথেষ্ট অবদান রয়েছে আইএমএফের।
০৮২০
বিশ্ব ব্যাঙ্ক আবার পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আর্থিক সাহায্য বা ঋণ দিয়ে থাকে। এশিয়া বা আফ্রিকার বহু জায়গায় রেলপথ স্থাপন ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎপাদনে বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের জন্যই অনেক দেশ ধীরে ধীরে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
০৯২০
দুঁদে অর্থনীতিবিদদের একাংশের দাবি, আইএমএফের জন্য বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশ টিকে রয়েছে। যেমন আর্জেন্টিনার সরকার বেতন দেওয়ার জন্য এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। শ্রীলঙ্কা, সেনেগাল বা পাকিস্তানকে আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বার বার হাত পাততে হয় আইএমএফের সামনে।
১০২০
আইএমএফ নিয়ে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন ইউরোপের অন্যতম বড় সম্পদ ব্যবস্থাপক সংস্থা আমুন্ডির শীর্ষকর্তা ইয়েরলান সিজ়ডিকভ। তাঁর কথায়, ‘‘ঋণে লগ্নিকারীদের ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন ধরেই একটা নোঙর হিসাবে কাজ করছে আইএমএফ। সৌদি আরবের মতো দেশও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের মানদণ্ডকে ব্যবহার করে থাকে। এর সাহায্যেই রিয়াধ বোঝার চেষ্টা করে তাদের দেওয়া তহবিলের সঠিক ব্যবহার করছে কি না সংশ্লিষ্ট দেশ।’’
১১২০
রয়টার্সের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাঙ্ক ত্যাগ করলে, সেটা কোনও ভূমিকম্পের চেয়ে কম হবে না। এতে বিশ্বব্যাপী আর্থিক নীতিতে আসবে বিরাট বদল। রাতারাতি ভেঙে পড়তে পারে বহু দেশের অর্থনীতি। উল্লেখ্য, দু’টি প্রতিষ্ঠানকেই বিপুল আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে আমেরিকা।
১২২০
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আমেরিকার বাজারের ঋণ পোর্টফোলিয়ো সংস্থা নিউবার্গার বারম্যানের পদস্থ কর্তা কান নাজ়লি। তিনি বলেছেন, ‘‘এ ভাবে হঠাৎ করে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে ওয়াশিংটন সরে এলে, ফাঁকা মাঠে গোল করার সুযোগ পাবে চিন। সে ক্ষেত্রে আরও বেশি দেশকে ঋণের জালে জড়িয়ে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে বেজিং। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যথেষ্ট উদ্বেগের হবে।’’
১৩২০
উল্লেখ্য, দীর্ঘ দিন ধরেই বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে চিন। আইএমএফের শেয়ারের পুনর্বিন্যাসের দাবিও করেছে বেজিং। যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে সরে গেলে, চিনের পক্ষে এই সংস্থাটিকে কব্জা করা অনেকটাই সহজ হবে বলে সতর্ক করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
১৪২০
আইএমএফ বা বিশ্ব ব্যাঙ্ক সাধারণত ট্রিপল এ ক্রেডিট রেটিংয়ের উপর দিয়ে থাকে ঋণ। এতে কোনও রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান কম সুদে ঋণ পেয়ে থাকে। এই ব্যবস্থাটিও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। ফলে আমেরিকা দু’টি প্রতিষ্ঠান থেকে নাম প্রত্যাহার করলে নামমাত্র সুদে ঋণ বিলি আইএমএফ বা বিশ্ব ব্যাঙ্কের পক্ষে কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৫২০
ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের উপর একাধিক শর্ত আরোপ করে থাকে আইএমএফ। সেগুলি পূরণ হলে তবেই মেলে টাকা। এ সব কঠোর শর্ত পালন মোটেই সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে কেনিয়ার কথা বলা যেতে পারে। আইএমএফের ঋণ নিতে কর বৃদ্ধি করেছিল আফ্রিকার দেশটির সরকার। ফলে প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়।
১৬২০
১৯৯৭ সালে এশিয়ার আর্থিক সঙ্কটের জন্য আইএমএফকে কিছু ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়। কিউবা, উত্তর কোরিয়া এবং তাইওয়ানের মতো দেশ এই সংগঠনের অংশ নয়। যদিও তার পরেও আন্তর্জাতিক ঋণ প্রদানকারী সংগঠনটির গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।
১৭২০
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অবশ্য বিষয়টিকে এ ভাবে দেখতে নারাজ। তাঁদের দাবি, ভূমি সংস্কারকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলা জি২০ দেশগুলির বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক বয়কট করেছে আমেরিকা। ফলে সেখানে ট্রেজ়ারি সচিবের না যাওয়াটা প্রত্যাশিতই ছিল।
১৮২০
চলতি বছরের ২০-২১ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে চলে জি২০-ভুক্ত দেশগুলির বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক। সেখানে যোগ দিচ্ছেন না বলে আগাম জানিয়ে দেন নতুন মার্কিন বিদেশ সচিব মার্কো রুবিও। এই নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্টও করেন তিনি।
১৯২০
দিন কয়েক আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার ভূমি সংস্কার নীতির কড়া সমালোচনা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও তাতে আমল দেয়নি কেপ টাউন। তাদের যুক্তি ছিল, বর্ণবৈষম্য দূর করতেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০২০
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, জি২০ থেকে সরে দাঁড়াতে পারে আমেরিকা। তবে এখনই আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। বরং চিনকে আর্থিক ভাবে দুর্বল করতে এই দুই সংগঠনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।