US failed repeatedly in peace deal, raised question on ceasefire effort on Russia Ukraine war dgtl
Russia Ukraine Peace Deal
বিশ্বযুদ্ধ থেকে তালিবান... শান্তি চুক্তি করতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ, আমেরিকা লেজেগোবরে হবে ইউক্রেনেও?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে সৌদি আরবের জেড্ডায় মস্কোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বার বার বৈঠক করছে আমেরিকা। তবে ঐতিহাসিক ভাবে এই ধরনের শান্তি চুক্তির উদ্যোগে বার বার ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫ ১৪:৫৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে মরিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই লক্ষ্যে মস্কোর সঙ্গে ক্রমাগত আলোচনা চালাচ্ছে তাঁর প্রশাসন। কিন্তু এই শান্তিপ্রক্রিয়ায় কিভকে ব্রাত্য রেখেছে ওয়াশিংটন। ফলে আদৌ পূর্ব ইউরোপের সংঘাতে আমেরিকা দাঁড়ি টানতে পারবে কি না, তাতে রয়েছে বড় আকারের প্রশ্ন।
০২২০
নিন্দকেরা বলেন, অন্যের ব্যাপারে ‘নাক গলানো’র স্বভাব যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দিনের। গত ১০০ বছরে একগুচ্ছ শান্তিচুক্তি হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে আমেরিকা। যদিও এর বেশির ভাগই কয়েক বছরের মধ্যে ব্যর্থ হয়। উল্টে ওয়াশিংটনের ‘চাপে’ হওয়া শান্তি সমঝোতাগুলি দুনিয়া জুড়ে ভূরি ভূরি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের জন্ম দিয়েছে।
০৩২০
উদাহরণ হিসাবে প্রথমেই আসবে ভার্সাই চুক্তির কথা। ১৯১৯ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে হওয়া এই চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে শেষ হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এতে বড় ভূমিকা নেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন। ইতিহাসবিদদের কথায়, পর্দার আড়ালে থেকে এই চুক্তির শর্তগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তিনি।
০৪২০
ভার্সাই চুক্তিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যাবতীয় দায় জার্মানির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, বিপুল আর্থিক জরিমানার মুখে পড়ে বার্লিন। পাশাপাশি, মধ্য ইউরোপের দেশটির সামরিক এবং আর্থিক ব্যবস্থাকে কঠোর বিধিনিষেধে বেঁধে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। এর ফলে ঘটে হিতে বিপরীত।
০৫২০
দুনিয়ার তাবড় ইতিহাসবিদেরা বিশ্বাস করেন, ভার্সাই চুক্তির জন্যই জার্মানিতে উত্থান হয় অ্যাডল্ফ হিটলারের। মাত্র ২০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ডেকে আনেন তিনি। অর্থাৎ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার স্বপ্ন এই সমঝোতা একেবারেই পূরণ করতে পারেনি।
০৬২০
ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘লিগ অফ নেশন্স’ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখেন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর উচ্চকক্ষ বা সেনেটের সম্মতি দেয়নি। ফলে লিগ তৈরি হলেও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি থেকে দূরে ছিল ওয়াশিংটন।
০৭২০
এক দশকের বেশি সময় ধরে ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে থাকার পর ১৯৭৩ সালে প্যারিসের শান্তিচুক্তি করে আমেরিকা। এতে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। দু’বছরের মধ্যেই সমঝোতা ভেঙে দেয় উত্তর ভিয়েতনাম। ১৯৭৫ সালে তীব্র আক্রমণ শুরু করে তারা। ফলে ওই বছরই সায়গনের পতন ঘটে।
০৮২০
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, ১৯৭৩ সালের শান্তিচুক্তি টিকিয়ে রাখার কোনও গরজ দেখায়নি যুক্তরাষ্ট্র। দু’বছরের মাথায় কমিউনিস্ট শাসিত উত্তর ভিয়েতনাম দেশের দক্ষিণ অংশে আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়ালে সামরিক সাহায্য করতে অস্বীকার করে ওয়াশিংটন। ফলে ব্যর্থ হয় এই সমঝোতা।
০৯২০
২০২০ সালে দোহা চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা করে আমেরিকা। এই সমঝোতার কিছু দিনের মধ্যেই হিন্দুকুশের কোলের দেশটির ক্ষমতা দখল করেন তালিবান নেতৃত্ব। দোহা চুক্তি করার সময় কাবুলের তৎকালীন সরকারের সঙ্গে কোনও রকমের আলোচনা করা হয়নি বলেও অভিযোগ ওঠে।
১০২০
ফলে দোহা চুক্তি-পরবর্তী সময়ে আমু দরিয়ার তীর থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে রীতিমতো হিমসিম খেতে হয় ওয়াশিংটনকে। আফগানিস্তান জুড়ে সৃষ্টি হয় চরম বিশৃঙ্খলা। তালিবান নেতৃত্ব কাবুল দখল করলেও তাঁদের রাজপাট অস্বীকার করে কুখ্যাত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট খোরাসান’। সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ যোগ দেন তাজিক নেতা আহমেদ মাসুদের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘ন্যাশনাল রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট অফ আফগানিস্তান’-এ।
১১২০
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, দোহা চুক্তি করে আফগানিস্তানকে বারুদের স্তূপে ঠেলে দিয়েছে আমেরিকা। কারণ, এই সমঝোতাকে আফগান স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করেন সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশ। ফলে যে কোনও মুহূর্তে হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে নতুন করে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
১২২০
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে পশ্চিম এশিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে অসলো চুক্তি সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একে ‘শতাব্দীর সেরা সমঝোতা’ বলেও উল্লেখ করেন। কিন্তু, শান্তি প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, ইহুদিভূমিকে কেন্দ্র করে বার বার যুদ্ধে জড়িয়েছে পশ্চিম এশিয়া।
১৩২০
একই ভাবে এ বারও ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সৌদি আরবকে বেছে নিয়েছে আমেরিকা। সম্প্রতি এ ব্যাপারে সমাধানসূত্র পেতে আরব মুলুকটির জেড্ডা শহরে রুশ বিদেশমমন্ত্রী সের্গেই লেভরভের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন মার্কিন বিদেশ সচিব মার্কো রুবিয়ো। দ্রুত ইউক্রেনে ৩০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতি করতে চাইছে ওয়াশিংটন।
১৪২০
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, এ ভাবে ‘চাপ’ দিয়ে এই মুহূর্তে কিভকে সমঝোতায় বাধ্য করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। শান্তিচুক্তিতে বার বার আমেরিকার ব্যর্থতার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন তাঁরা। ইউক্রেনেও সেগুলি স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে বলে ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
১৫২০
শান্তিপ্রক্রিয়ায় মার্কিন ব্যর্থতার প্রথম কারণ হল, সব পক্ষের সঙ্গে কথা না বলে জোর করে সমঝোতা চাপিয়ে দেওয়া। জার্মানি, ভিয়েতনাম এবং ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রে এটাই করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে কোথাও শান্তিপ্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। উল্টে আরও ভয়ঙ্কর ভাবে বিবদমান দু’পক্ষকে যুদ্ধে জড়াতে দেখা গিয়েছে।
১৬২০
দ্বিতীয়ত, শান্তিচুক্তি করার ক্ষেত্রে সব সময় তাৎক্ষণিক লাভকে গুরুত্ব দিয়েছে আমেরিকা। এ ক্ষেত্রে আর্থিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থের কথা সব সময় মাথায় রেখেছে ওয়াশিংটন। চুক্তি টেকানোর পন্থা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের কোনও মাথাব্যথা থাকে না। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে প্রায় প্রতিটি সমঝোতা।
১৭২০
রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে কিভের সঙ্গে কোনও রকমের আলোচনায় নারাজ ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে জেড্ডার সমঝোতা কত দিন স্থায়ী হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এ ব্যাপারে ইউরোপের ‘বন্ধু’ দেশগুলিকেও পাত্তা দিচ্ছে না আমেরিকা। ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত ‘বুমেরাং’ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৮২০
‘আগ্রাসী’ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইউক্রেনকে এখনও অর্থ ও হাতিয়ার জুগিয়ে চলেছে জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন। শান্তিচুক্তি হয়ে গেলে সেই সাহায্য বন্ধ হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। অন্য দিকে, সমঝোতার পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গোটা ইউক্রেন ‘গিলে খেতে’ চাইবেন কি না, তা-ও পরিষ্কার হয়নি।
১৯২০
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি কারণেই ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে চাইছেন। পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে রুশ আক্রমণ বন্ধ হলে সেখানকার বিরল খনিগুলির দখল নিতে পারবে আমেরিকা। সেই সংক্রান্ত একটি চুক্তি কিভের সঙ্গে প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে ওয়াশিংটন। এতে ৫০ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ হাতের মুঠোয় নিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র।
২০২০
অন্য দিকে চুক্তি হলে ইউক্রেনের বিশাল পরিমাণ জমি নিজেদের দখলে রাখবে রাশিয়া। পাশাপাশি, যুদ্ধকে কেন্দ্র করে চলা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকেও বেরিয়ে আসবে মস্কো। বলা বাহুল্য, তার পর নতুন করে ক্রেমলিন আগ্রাসী হলে ফের রক্তে ভিজবে পূর্ব ইউরোপের মাটি।