Unique names and nomenclature history of various trains of Indian Railways dgtl
Indian Railways
অহিংসা, লস্কর থেকে পরশুরাম! ভারতে চলে অদ্ভুত সব নামের ট্রেন, আরও অদ্ভুত এদের নামকাহিনি
কখনও কোনও স্থানের নামে, কখনও বা বিশেষ কোনও ঐতিহাসিক সৌধের নামে, কখনও বা সাহিত্য থেকে ভারতীয় রেলের বিভিন্ন বিভাগের ট্রেনগুলির নামকরণ হয়েছে।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:৩১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
ভারতীয় রেল। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রেল-নেটওয়ার্ক। দেশ জুড়ে ১২৮,৩০৫ কিলোমিটার বিস্তৃত রেলপথ। প্রতি দিন ১ কোটি ৮০ লক্ষেরও বেশি যাত্রী যাতায়াত করেন রেলপথে। লোকাল, মেল, এক্সপ্রেস ট্রেন মিলিয়ে এ দেশে ট্রেনের সংখ্যাও কিছু কম নয়। ভারতীয় রেলের বিবিধ বিষয় কৌতূহল উদ্রেককারী। এই বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল বিভিন্ন ট্রেনের নাম।
০২১৯
কখনও কোনও স্থানের নামে, কখনও বা বিশেষ কোনও ঐতিহাসিক সৌধের নামে, কখনও বা সাহিত্য থেকে ভারতীয় রেলের বিভিন্ন বিভাগের ট্রেনগুলির নামকরণ হয়েছে। এখানে তেমনই কিছু কৌতূহলোদ্দীপক ট্রেন-নামের কথা বলা হল। সেই সঙ্গে রইল নামকরণের প্রেক্ষিত বা সেই সব নামের নেপথ্যে থাকা গল্পগুলিও।
০৩১৯
অহিংসা এক্সপ্রেস— গুজরাতের আমদাবাদ থেকে মহারাষ্ট্রের পুণের মধ্যে চলাচল করে এই ট্রেন। এই ট্রেনের এমন নামকরণের নেপথ্যে রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর জীবনব্রতে জড়িয়ে থাকা ‘অহিংসা’র প্রসঙ্গ। আমদাবাদেই গান্ধীজি তাঁর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সূত্রেই এই ট্রেনের নামকরণ।
০৪১৯
আম্রপালি এক্সপ্রেস— বিহারের কাটিহার থেকে পঞ্জাবের অমৃতসর পর্যন্ত চলাচল করে এই ট্রেন। এই ট্রেনের নামকরণের নেপথ্যে রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের বৈশালী জনপদের নগরবধূ আম্রপালির নাম। আম্রপালির জন্ম হয়েছিল বৈশালীর এক আম্রকাননে। তিনি বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে আম্রপালির বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। জানা যায়, অসামান্যা সুন্দরী এই নারী বুদ্ধদেবকে তাঁর আম্রকানন দান করেন। তিনিও নগরবধূর জীবন ত্যাগ করে বুদ্ধ, ধম্ম ও সংঘের শরণ নেন। আজকের মানচিত্র দেখলে বোঝা যায়, আম্রপালি বিহারেরই ভূমিকন্যা ছিলেন। তাঁর নামানুসারেই এই ট্রেনের নামকরণ।
০৫১৯
অনন্যা এক্সপ্রেস— পাশ্চিমবঙ্গের শিয়ালদহ থেকে রাজস্থানের উদয়পুর সিটির মধ্যে চলাচল এই ট্রেনের। ‘অনন্যা’ শব্দটির অর্থ— ‘উপমাহীনা’ বা ‘অতুলনীয়া’। এই শব্দের কিছু আধ্যাত্মিক তাৎপর্যও রয়েছে। একেশ্বরবাদের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এই শব্দটি। কিন্তু ঠিক কেন যে এই ট্রেনটির নামে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা জানা যায় না।
০৬১৯
চেতক এক্সপ্রেস— দিল্লির সরাই রোহিল্লা স্টেশন থেকে রাজস্থানের উদয়পুরের মধ্যে চলাচল করা এই ট্রেনের নামের নেপথ্যে কোনও স্থান বা মানুষ নয়, রয়েছে একটি ঘোড়া। চেতক বা চৈতক রাজপুত বীর রানাপ্রতাপ সিংহের ঘোড়া। ১৫৭৬ সালের হলদিঘাটের যুদ্ধে চেতক গুরুতর আহত হয়। সেই অবস্থাতেই সে তার প্রভু রানাপ্রতাপকে রণক্ষেত্র থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। তার পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সেই বীর ঘোড়া। তার নামেই নামকরণ হয়েছে রাজস্থানগামী এই ট্রেনের।
০৭১৯
সম্পর্ক ক্রান্তি এক্সপ্রেস— রাজধানীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তকে যুক্ত করতে ২০০৪-’০৫ সালের বাজেটে তৎকালীন রেলমন্ত্রী নীতীশ কুমার এই সুপারফাস্ট ট্রেনগুলি চালু করার কথা বলেন। দু’টি সংস্কৃত শব্দ— ‘সম্পর্ক’ এবং ‘ক্রান্তি’-কে যুক্ত করে এই ট্রেনগুলির নামকরণ হয়েছে। রাজধানীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অংশের সম্পর্কবন্ধনকে বৈপ্লবিক রূপ দান করতেই যেন এই নামকরণ।
০৮১৯
দীক্ষাভূমি এক্সপ্রেস— আগে নাগপুর থেকে গয়া পর্যন্ত চলাচল করত এই ট্রেন। এখন এটি চলাচল করে ধানবাদ থেকে কোলহাপুরের মধ্যে। ভায়া নাগপুর এর যাত্রাপথ। ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর ভারতীয় সংবিধানের রূপকার বাবাসাহেব অম্বেডকর নাগপুরে কয়েক হাজার অনুগামী-সহ বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। সেই দীক্ষার ঘটনাকে স্মরণে রেখেই এই ট্রেনের নামকরণ।
০৯১৯
ফলকনুমা এক্সপ্রেস— হাওড়া ও সেকেনদরাবাদের মধ্যে চলাচল করে এই ট্রেন। হায়দরাবাদের বিখ্যাত ফলকনুমা প্রাসাদের নামেই এর নামকরণ। ফলকনুমা প্রাসাদ হায়দরাবাদের চারমিনার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৮৮৪-১৮৮৯ সালের মধ্যে নবাব ভিকর-উল-উমরা এই প্রাসাদ নির্মাণ করান। ‘ফলকনুমা’ একটি উর্দু শব্দ। এর অর্থ, ‘স্বর্গের নক্ষত্র’।
১০১৯
কাইফিয়ত এক্সপ্রেস— ভারতীয় রেলে খুব কম ট্রেনের নামই কোনও ব্যক্তির নামানুসারে হয়েছে। আজ়মগড় ও দিল্লির মধ্যে চলাচলরত এই ট্রেনটির নামের নেপথ্যে রয়েছে উর্দু ভাষার কবি কাইফি আজ়মির নাম। ১৯১৯ সালে আজ়মগড় জেলার মেজ়ওয়ান নামের এক গ্রামে তাঁর জন্ম। শুধু কবিতা নয়, হিন্দি ছবির গানের বাণী রচনাতেও কাইফি তাঁর দক্ষতার পরিচয় রেখেছিলেন। ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মশ্রী সম্মান ছাড়াও কাইফি সাহিত্য অকাদেমি, উর্দু অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০২ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর সারা জীবনের কবিকৃতির সংকলন গ্রন্থটিরও নাম ‘কাইফিয়ত’।
১১১৯
কান্ডারি এক্সপ্রেস— হাওড়া থেকে সৈকত শহর দিঘার মধ্যে যাতায়াত করে এই ট্রেন। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতা থেকেই এই ট্রেনের নামকরণ।
১২১৯
লস্কর এক্সপ্রেস— ‘লস্কর’ শব্দটির অর্থ সেনা। বর্তমানে মুম্বইয়ের লোকমান্য তিলক টার্মিনাস থেকে আগরা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে যাতায়াত করলেও আগে ট্রেনটি গোয়ালিয়র পর্যন্ত যেত। গোয়ালিয়র ছিল মহারাষ্ট্রের শিণ্ডে সামন্তশক্তির অন্যতম প্রধান সামরিক ঘাঁটি। সেই কারণেই ট্রেনটির এমন নামকরণ।
১৩১৯
আন্দামান এক্সপ্রেস— দ্বীপভূমি আন্দামান স্থলপথ বা রেলপথে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে জম্মু তাওয়াই পর্যন্ত চলাচলকারী এই ট্রেনটির নাম সত্যিই আন্দামান এক্সপ্রেস। এক সময়ে রেল মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, দেশের সব ক’টি অঙ্গরাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নামে কোনও না কোনও ট্রেনের নামকরণ হবে। কিন্তু আন্দামানে রেলপথ বিস্তার প্রায় অসম্ভব। তাই আন্দামান যাত্রার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র চেন্নাই ও দেশের অপর প্রান্তবর্তী জম্মু তাওয়াইয়ের সংযোগ সাধনকারী ট্রেনটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে নামকরণের জন্য।
১৪১৯
মৎস্যগন্ধা এক্সপ্রেস— মুম্বইয়ের লোকমান্য তিলক টার্মিনাস থেকে কর্নাটকের মেঙ্গালুরু পর্যন্ত যাতায়াত করে এই ট্রেন। পশ্চিম ভারতের আরব সাগরের মৎস্যজীবী অধ্যুষিত উপকূলের মধ্যে বিস্তৃত কোঙ্কন রেলপথ দিয়ে এর গমনাগমন বলে এর এমন নামকরণ। ‘মহাভারত’-এর মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর সঙ্গে এই নামকরণের কোনও যোগ নেই বলেই জানা যায়।
১৫১৯
বিভিন্ন সাহিত্যিকের বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের নামে বেশ কিছু ট্রেনের নামকরণ হয়েছে। এগুলির মধ্যে অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস (কাজী নজরুলের কাব্যগ্রন্থ), হাটে বাজারে এক্সপ্রেস (বনফুলের উপন্যাস), গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস (রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ), গোদান এক্সপ্রেস (মুন্সী প্রেমচন্দের উপন্যাস), আরণ্যক এক্সপ্রেস (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস), রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস (জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ) এবং পদাতিক এক্সপ্রেস (সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ) উল্লেখযোগ্য।
১৬১৯
পরশুরাম এক্সপ্রেস— কখনও কখনও আবার পৌরাণিক চরিত্রের নামও উঠে এসেছে এ দেশের ট্রেনের নামকরণে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই ট্রেনটি। পরশুরাম বিষ্ণুর দশাবতারের অন্যতম। কুঠারধারী এই বীর ব্রাহ্মণের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’-এও। পুরাণ অনুসারে পরশুরাম তাঁর অস্ত্র কুঠার প্রয়োগ করে কোঙ্কন ও মালাবার অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূভাগকে সমুদ্রের গ্রাস থেকে রক্ষা করেন, এই অঞ্চলটি ‘পরশুরাম ক্ষেত্র’ নামেও পরিচিত। কেরলের তিরুঅনন্তপুরম থেকে মেঙ্গালুরু পর্যন্ত চলাচলকারী এই ট্রেন সেই সুপ্রচীন ভূখণ্ডকে অতিক্রম করে বলেই তার নামকরণে প্রবেশ করে পুরাণপুরুষের অনুষঙ্গ।
১৭১৯
পুষ্পক এক্সপ্রেস— লখনউ জংশন থেকে মুম্বই সিএসটি পর্যন্ত যাতায়াতকারী এই ট্রেনটির নাম রাখা হয়েছে ভারতীয় পুরাণে উল্লিখিত পুষ্পক রথের নামনুসারে। লঙ্কেশ্বর রাবণ নাকি এই দ্রুতগতিসম্পন্ন উড়ন্ত রথটি ব্যবহার করতেন। রাবণের মৃত্যুর পর রাম রথটিকে তার আসল মালিক কুবেরকে ফিরিয়ে দেন। দ্রুতগামিতার কারণেই পৌরাণিক বিমানের নামে এই ট্রেনের নামকরণ।
১৮১৯
সপ্ত ক্রান্তি এক্সপ্রেস— বিহারের মুজ়ফফরপুর ও নয়াদিল্লির আনন্দ বিহার টার্মিনাসের মধ্যে চলাচলকারী এই ট্রেনটির নামের বঙ্গার্থ হল, ‘সাতটি বিপ্লব’। স্বাধীনতা সংগ্রামী রামমনোহর লোহিয়া বিংশ শতককে সাতটি বিপ্লবের সংঘটনের কাল হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর মতে এই ‘বিপ্লব’গুলি হল— ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে আনা, জাতীয় স্তরে শ্রমমূল্যের মধ্যে সমতা বিধান, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানূষের উপর উচ্চবর্ণের অত্যচারের নিরসন, পুরুষ এবং নারীর অধিকারের সমতা বিধান, বর্ণবৈষম্যের অবসান, পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে রাজনৈতিক দল এবং সরকারের হস্তক্ষেপের অবসান। লোহিয়ার এই বিপ্লবের তত্ত্বকে স্মরণীয় করে রাখতেই এই ট্রেনের নামকরণ।
১৯১৯
জ়িয়ারত এক্সপ্রেস— পটনার রাজেন্দ্রনগর টার্মিনাস থেকে রাজস্থানের অজমেঢ় পর্যন্ত যায় এই ট্রেন। আরবি ভাষায় ‘জ়িয়ারত’ শব্দের অর্থ হল পয়গম্বর হজরত মহম্মদের স্মৃতিযুক্ত কোনও স্থানে তীর্থযাত্রা। ভারতে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান তীর্থ ক্ষেত্র অজমেঢ় শরিফের অনুষঙ্গেই এই ট্রেনের নামকরণ হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন।