Ukraine President Volodymyr Zelenskyy’s historic mistakes during arguments with US President Donald Trump dgtl
Trump Zelenskyy Row
মুখে মুখে তর্ক, কোমর বেঁধে ঝগড়া! পূর্বসূরিদের দেখানো পথে হাঁটলে কপাল পুড়ত না জ়েলেনস্কির?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে একাধিক ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। গোটা ঘটনা বিশ্লেষণ করে এমনটাই বলছেন কূটনীতিকদের একাংশ।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৫ ১০:২১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
‘সুপার পাওয়ার’ দেশের প্রেসিডেন্টের দফতরে বসে তাঁর সঙ্গেই তর্কাতর্কি! কিংবা কথা বলতে বলতে গলা চড়িয়ে ফেলা! শান্তি সমঝোতার বৈঠকে একগুচ্ছ ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করেছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি? কিভকে এর জন্য দিতে হবে চরম মূল্য? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর বৈঠক ভেস্তে যেতেই এই সব প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণে মেতেছে বিশ্ব।
০২১৯
প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণের পর থেকেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে উদ্যোগী হন ট্রাম্প। সেই লক্ষ্যে জ়েলেনস্কিকে শান্তি সমঝোতার জন্য ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানান তিনি। ট্রাম্পের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর ওভাল অফিসে পৌঁছন জ়েলেনস্কি। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সেখানে মুখোমুখি বসেন দুই রাষ্ট্রনেতা। বৈঠকে হাজির ছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সও।
০৩১৯
প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চলে ট্রাম্প-জ়েলেনস্কির বৈঠক। সেখানে একরাশ সংবাদমাধ্যমের সামনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদে জড়ান ইউক্রেনের রাষ্ট্রনেতা। একেই ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে উল্লেখ করেছেন দুনিয়ার তাবড় কূটনীতিকেরা। ট্রাম্পকে চটানো জ়েলেনস্কির ‘নিজের পায়ে কুড়ুল মারার’ সামিল, বলছেন তাঁরা।
০৪১৯
বৈঠকের শুরুটা অবশ্য ভাল ভাবেই হয়েছিল। একেবারে গোড়ার দিকে জ়েলেনস্কিকে ‘দুর্দান্ত ব্যক্তি’ বলে সম্বোধন করেন ট্রাম্প। কিন্তু, কিছু ক্ষণের মধ্যেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের সামনেই জেডি ভান্সের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গলা চড়ান তিনি। ঠিক তখনই বদলে যায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের শরীরী ভাষা।
০৫১৯
বিশ্বের তাবড় কূটনীতিকেরা এর জন্য জ়েলেনস্কির প্রবল সমালোচনা করেছেন। তাঁদের যুক্তি হল, এ ভাবে প্রকাশ্যে ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ করতে যাওয়া মূর্খামি। বৈঠক রুদ্ধদ্বার হলে সেটা করতে পারতেন জ়েলেনস্কি। এখন তাঁর গায়ে খুব সহজেই ‘অহঙ্কারী যুদ্ধবাজ’ এবং ‘উদ্ধত’ তকমা সেঁটে দিতে পারবে আমেরিকা।
০৬১৯
এ ব্যাপারে জর্ডনের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লার উদাহরণ দিয়েছেন দুঁদে কূটনীতিকেরা। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমেরিকা সফর করেন তিনি। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজ়া পুনর্নির্মাণের কথা শোনেন তিনি। ট্রাম্প ওই সময়ে প্যালেস্তিনীয়দের গাজ়া ছেড়ে জর্ডন এবং মিশরে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
০৭১৯
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই পরিকল্পনা একেবারেই পছন্দ হয়নি জর্ডনের রাজার। কিন্তু সেই সময়ে প্রকাশ্যে কিছুই বলেননি তিনি। ওয়াশিংটন থেকে দেশে ফিরে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) বিষয়টি নিয়ে একটি পোস্ট করেন তিনি। সেখানে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেন আরব মুলুকটির রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লা।
০৮১৯
দ্বিতীয়ত, আমেরিকাকে ফের এক বার মহান দেশে পরিণত (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন বা মেগা) করার স্বপ্ন দেখিয়ে ফের ক্ষমতায় ফিরেছেন ট্রাম্প। এই অবস্থায় মার্কিন আমজনতার সামনে তিনি যে ‘শক্তি প্রদর্শন’ করবেন, তা বলাই বাহুল্য। বিষয়টি আগাম আঁচ করে জ়েলেনস্কির তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসা উচিত ছিল বলে মনে করেন দুঁদে কূটনীতিকেরা।
০৯১৯
তৃতীয়ত, ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের ‘হোমওয়ার্ক’-এর অভাবের দিকেও আঙুল তুলেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের কথায়, ট্রাম্পের মুখোমুখি বসার আগে রাষ্ট্রদূত বা পদস্থ আধিকারিকদের পাঠিয়ে কূটনৈতিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারতেন জ়েলেনস্কি। সে ক্ষেত্রে এক তরফা ভাবে শান্তি সমঝোতা না করে কিছু শর্ত আরোপের জন্য চাপ তৈরি করার সুযোগ পেতেন তিনি।
১০১৯
বৈঠকের শুরুর দিকে বক্তব্য রাখেন ভান্স। সেখানে কূটনীতিকে হাতিয়ার করার কথা বলতে শোনা যায় তাঁকে। আচমকা সবাইকে চমকে দিয়ে তাঁর কথার মধ্যেই নিজের মতামত তুলে ধরেন জ়েলেনস্কি। তিনি বলেন, ‘‘রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আমাদের দেশ আক্রমণ করলেন। বড় অংশ দখল করে নিলেন। ২০১৪ সাল থেকে এটা চলছে।’’
১১১৯
এর পরই নাম করে একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিশানা করেন জ়েলেনস্কি। তাঁর কথায়, ‘‘ওবামা ছিলেন। তার পর ট্রাম্প ছিলেন, বাইডেন ছিলেন, এখন আবার ট্রাম্প এসেছেন। ২০১৪ সালে কিন্তু কেউ পুতিনকে আটকাননি। উনি বিনা বাধায় আমাদের দেশ দখল করেছেন। মানুষ মেরেছেন।’’ তাঁর এ হেন মন্তব্যকে ‘অসৌজন্যতা’ বলে উল্লেখ করেছেন অধিকাংশ বিশ্লেষক।
১২১৯
বৈঠকে দ্বিতীয় তরজার বিষয়টি ছিল কৃতজ্ঞতা স্বীকার। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্সের বক্তব্য ছিল, ইউক্রেনকে যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে আর্থিক এবং সামরিক ভাবে সাহায্য দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, বিনিময়ে শুকনো ধন্যবাদটুকুও জানাননি জ়েলেনস্কি। যদিও এই অভিযোগ মানতে চাননি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ওভাল অফিসের ঘরে বসেই চোয়াল শক্ত করে তিনি বলে ওঠেন, ‘‘অনেক বারই আপনাদের ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে।’’
১৩১৯
আলোচনার পরবর্তী পর্যায়ে জ়েলেনস্কিকে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘‘লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে আপনি ছিনিমিনি খেলছেন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন। আমেরিকাকে অপমান করছেন।’’ এই হুমকি উপেক্ষা করে পাল্টা তর্ক চালিয়ে যান ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ে যথেষ্ট উত্তেজিত ছিলেন তিনিও।
১৪১৯
বৈঠকের শেষের দিকে ট্রাম্প বলেন, ‘‘আপনারা এই যুদ্ধে জিততে পারবেন না। আমাদের সাহায্যে আপনি এর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। আমাদের অস্ত্র না-পেলে দু’সপ্তাহও টিকত না এই যুদ্ধ।’’ সঙ্গে সঙ্গেই জ়েলেনস্কি বলে ওঠেন, ‘‘আমি পুতিনের কাছ থেকেও একই কথা শুনেছিলাম। উনিও বলেছিলেন, যুদ্ধ তিন দিন টিকবে না।’’
১৫১৯
বিষয়টি যে এ দিকে গড়াতে পারে তা আগাম আঁচ করে ইউক্রেন প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করেন মার্কিন রাজনীতিবিদ লিন্ডসে গ্রাহাম। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দক্ষিণ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান নেতা তথা সেনেটর (আমেরিকার পার্লামেন্ট কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষের সদস্য) বলেছেন, ‘‘জ়েলেনস্কিকে নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে তর্ক করতে বারণ করি। কিন্তু আমার পরামর্শ না শুনে বিপর্যয় ডেকে এনেছেন তিনি।’’
১৬১৯
ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক ভেস্তে যাওয়ায় ইউক্রেনের লোকসানের খতিয়ানও দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের অনুমান, অচিরেই কিভে বন্ধ হবে মার্কিন হাতিয়ারের সরবরাহ। এর ফলে রুশ আগ্রাসন ঠেকানো বেশ কঠিন হবে জ়েলেনস্কির পক্ষে।
১৭১৯
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর উপগ্রহ মারফৎ বিভিন্ন তথ্য এত দিন পাচ্ছিল ইউক্রেনের বাহিনী। ফলে রুশ ফৌজের অবস্থান বুঝে নিয়ে ঝটিতি আক্রমণের পরিকল্পনা করতে পারছিলেন কিভের জেনারেলরা। সেই সাহায্যেও পুরোপুরি বন্ধ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৮১৯
অন্য দিকে রাশিয়াকে নিয়ে বড় পদক্ষেপ করতে পারেন ইউক্রেনের উপর অসন্তুষ্ট ট্রাম্প। যুদ্ধের গোড়া থেকেই মস্কোর উপর বিপুল নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় ওয়াশিংটন। এ বার সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের রাস্তায় হাঁটতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এতে আরও আগ্রাসী হওয়ার সুযোগ পাবে ক্রেমলিন।
১৯১৯
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ইতিমধ্যেই প্রতিবেশী দেশটির ২০ শতাংশের বেশি জমি কব্জা করেছে তাঁর বাহিনী। কিভের উপর থেকে আমেরিকা হাত সরিয়ে নিলে ইউক্রেনের আরও বেশি ভূভাগ মস্কোর দখলে যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।