সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের পরে সমাজমাধ্যম জুড়ে ভাইরাল হয়েছে একটি ট্রেন্ড— ‘ক্লিনচিট টু আদানি’। অর্থাৎ আদানিকে ক্লিনচিট। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট কি সত্যিই ক্লিনচিট দিল ‘মোদী ঘনিষ্ঠ’ ব্যবসায়ীকে?
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৪
পতনের পর কি আবার স্বপ্নের উত্থানের পথে আদানি গোষ্ঠী? দেশের শিল্পপতি এবং ধনকুবের গৌতম আদানিকে নিয়ে বুধবার থেকেই শুরু হয়েছে এই জল্পনা। কারণ বুধবার আদানির সমস্ত সংস্থার শেয়ারের দামই অনেকটা বেড়েছে।
০২২৪
কেন হঠাৎ দাম বাড়ল আদানির শেয়ারের? এর নেপথ্যে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় রয়েছে বলে মনে করছেন শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞরা। বস্তুত সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় আদানির পক্ষে গিয়েছে বলেও মত অনেকের।
০৩২৪
বুধবার সুপ্রিম কোর্টে রায় ঘোষণা করা হয় আদানি সংক্রান্ত হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট মামলার। ওই মামলায় আদানির বিরুদ্ধে ওই রিপোর্টের তদন্তে বিশেষ তদন্ত দল বা সিট গঠনের আর্জি জানানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে এই তদন্তের ভার সিবিআইকে দেওয়া উচিত কি না সে ব্যাপারেও আবেদন জানানো হয় আদালতের কাছে।
০৪২৪
আদালত সেই আবেদনে মান্যতা দেয়নি। বরং বলেছে, যে সেবির বিধিভঙ্গের অভিযোগ উঠেছিল আদানির বিরুদ্ধে, সেই সেবিই এ ব্যাপারে আইনানুগ তদন্ত করবে। উল্লেখ্য, সেবি ইতিমধ্যেই মামলাটির তদন্ত করছিল এবং তাদের তদন্তে সন্দেহ প্রকাশ করেই পাল্টা মামলা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে।
০৫২৪
বুধবার সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, যে রিপোর্টের ভিত্তিতে এই আবেদন করা হচ্ছে, সেই রিপোর্ট এতটাও গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, তার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবির তদন্ত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যায়।
০৬২৪
শুধু তা-ই নয়, সুপ্রিম কোর্ট পাল্টা সরকারকে বলেছে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টেই কোনও আইন ভাঙা হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে।
০৭২৪
সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের পরে সমাজমাধ্যম জুড়ে ভাইরাল হয়েছে একটি ট্রেন্ড— ‘ক্লিনচিট টু আদানি’। অর্থাৎ আদানিকে ক্লিনচিট। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট কি সত্যিই ক্লিনচিট দিল ‘মোদী-ঘনিষ্ঠ’ ব্যবসায়ীকে? তাতে কি বড় লাভের মুখ দেখতে চলেছেন আদানির সংস্থার শেয়ারের ক্রেতারা?
০৮২৪
আদানিকে নিয়ে এই সে দিনেও লোকসভা এবং রাজ্যসভা উত্তাল করেছেন বিরোধীরা। কেন্দ্রীয় সরকার কী ভাবে আদানির স্বার্থ রক্ষা করেছে, তা নিয়েও হয়েছে আলোচনা। তবে কি আদানি সত্যিই দোষমুক্ত হলেন? ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি গায়ে লাগা কলঙ্ক কি ২০২৪-এর ৩ জানুয়ারি ঘুচল?
০৯২৪
এক বছর আগে এই জানুয়ারিতেই প্রকাশ্যে আসে বিতর্কিত হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট। যার জেরে ধস নেমেছিল আদানিদের শেয়ার দরে। ক্ষতি হয়েছিল দেড় লক্ষ কোটি টাকার। বিশ্বের ধনী তালিকায় প্রথম তিনে নাম থাকা আদানি রাতারাতি তালিকা থেকেই উধাও হয়ে গিয়েছিলেন এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর।
১০২৪
কারণ আমেরিকার শেয়ার বিশ্লেষক সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ জানিয়েছিল, আদানি গোষ্ঠী তাদের শেয়ারের দামে কারচুপি করেছে। শুধু তা-ই নয়, ওই রিপোর্টে আরও কিছু অভিযোগ আনা হয়েছিল আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
১১২৪
রিপোর্টটির শিরোনাম ছিল, ‘আদানি গোষ্ঠী: কী ভাবে বিশ্বের তৃতীয় ধনীতম ব্যক্তি কর্পোরেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রতারণাচক্রটি চালিয়ে যাচ্ছেন’।
১২২৪
রিপোর্টে মূলত পাঁচটি বড় অভিযোগ আনা হয় আদানিদের নামে। যার প্রথম এবং সবচেয়ে বড় অভিযোগটির কথা আগেই বলা হয়েছে। হিন্ডেনবার্গ লিখেছিল, আদানী গ্রুপের অধীনে থাকা সংস্থাগুলি তাদের শেয়ারের দাম বেআইনি ভাবে এবং প্রভাব খাটিয়ে বাড়িয়ে নিয়েছে।
১৩২৪
অভিযোগ ছিল, অর্থ তছরুপ এবং হিসাব প্রতারণারও। এর প্রমাণ হিসাবে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, আট বছরে পাঁচ বার নিজেদের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার বদলেছে আদানিরা।
১৪২৪
তৃতীয় অভিযোগ— আদানি গোষ্ঠীর অধীনে থাকা সাতটি সংস্থার শেয়ারের দাম ৮৫ শতাংশ বাড়িয়ে রেখেছে আদানিরা। অর্থাৎ শেয়ারের আসল মূল্য যা, তার থেকে অনেক বেশি মূ্ল্যায়ন করা হয়েছে। শেয়ার বাজারের ভাষায় এই ধরনের মূল্যায়নকে বলে স্কাই রকেট ভ্যালুয়েশন।
১৫২৪
হিন্ডেনবার্গ এ-ও বলেছিল যে, আদানি গোষ্ঠীর ঋণের বোঝা তাদের ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি। আদানি গোষ্টীর কাঁধে ২ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণের ভার রয়েছে বলে জানিয়েছিল হিন্ডেনবার্গ। যা জেনে বিপন্ন বোধ করেছিলেন আদানির সংস্থায় বিনিয়োগকারীরা।
১৬২৪
হিন্ডেনবার্গ জানিয়েছিল, মরিশাস এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশের সংস্থায় আদানির অর্থ যায়। এই সব সংস্থাই আদানির সংস্থার শেয়ার কিনে তার শেয়ারের দাম কৃত্রিম ভাবে বাড়িয়ে দেয়।
১৭২৪
এই রিপোর্টের কুপ্রভাব পড়ে আদানির শেয়ারহোল্ডারদের উপর। তাঁরা যে মুহূর্তে জানতে পারেন, আদানির শেয়ার ৮৫ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে কিনেছেন তাঁরা, সেই মুহূর্তেই তাঁরা ক্ষতি বাঁচাতে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন। এতে এক ধাক্কায় আদানিদের শেয়ার দর ৩০০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় নেমে আসে।
১৮২৪
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের কারণ ছিল এই সংস্থার দীর্ঘ লব্ধ সুনাম। বিদেশে সর্বত্রই হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টকে গুরত্ব দেওয়া হয়। কারণ এই সংস্থা কোনও রকম ভুল করে না বলেই বিশ্বাস। স্বাভাবিক ভাবেই হিন্ডেনবার্গের কথার প্রভাব পড়ে শেয়ার বাজারে। এমনকি, ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও।
১৯২৪
এই রিপোর্ট আদানিদের শেষ করে দিতে পারত। কিন্তু আদানি গোষ্ঠী জানিয়ে দেয়, এই রিপোর্ট সর্বৈব মিথ্যে। শুরু হয় আদানি বনাম হিন্ডেনবার্গের যুদ্ধ। যে যুদ্ধে সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের জন্য ডাকা হয় ভারতের শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবিকে। সেবি এর আগে শেয়ার বাজারে হওয়া বহু দুর্নীতি এবং অনিয়মকে প্রকাশ্যে এনেছে। এমনকি, সহারার শেয়ার দুর্নীতিও প্রকাশ্যে এনেছিল তারাই।
২০২৪
কিন্তু তার পরও বিরোধীরা আদানি সংক্রান্ত হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট নিয়ে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দেশ জুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি হয় আদানিদের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে কেন্দ্রীয় সংস্থা সেবির তদন্ত নিয়েও।
২১২৪
এই পরিস্থিতিতে মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে আদানিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য। ১০ মে তারা সুপ্রিম কোর্টে এ ব্যাপারে রিপোর্ট পেশ করে। সেই রিপোর্টে বলা হয়, আদানিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তাতে সেবির কোনও ভুল ছিল, তা বলা যাবে না। সেবিকে এর পর তাঁদের আর্জি মেনেই তদন্ত শেষ করার ১৪ অগস্ট পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়।
২২২৪
কিন্তু নির্ধারিত তারিখ পেরিয়ে গেলেও সেবি রিপোর্ট পেশ করতে পারেনি। তারা আদানি-হিন্ডেনবার্গ সংক্রান্ত ২৪টি মামলায় তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে আরও ১৫ দিন সময় চায়। পরে সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ২৫ অগস্ট তারা আদানি সংক্রান্ত ২২টি মামলার রিপোর্ট জমা দেয়। বাকি দু’টি মামলার জন্য আরও সময় চায় সুপ্রিম কোর্টের কাছে।
২৩২৪
২৪ নভেম্বর এই সংক্রান্ত মামলার রায় সংরক্ষণ করে সুপ্রিম কোর্ট। বুধবার, ৩ জানুয়ারি সেই রায় ঘোষণা করে শীর্ষ আদালত। রায়ে আদালত যা বলেছে, তাকে ক্লিনচিট বলেই দাবি করছে সরকারপন্থীরা। কারণ আদালত সেবির তদন্তেই ভরসা রেখেছে। রায় ঘোষণার পর নিজের এক্স হ্যান্ডলে আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানি লেখেন, ‘সত্যমেব জয়তে’।
২৪২৪
তবে সেবি কখনওই বলেনি আদানিরা অপরাধী বা তারা কোনও ভুল করেছে। ফলে সুপ্রিম কোর্ট সেবিকে সমর্থন করায় বলা যেতে পারে দেশের শীর্ষ আদালতের রায় গেল আদানিদেরই পক্ষে।