স্বদেশ সেই মহিলাকে তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন ‘মায়াবিনী’ হিসাবে। আত্মকথার ভূমিকার গোড়াতেই তিনি লিখছেন, “মায়াবিনী আমার মস্তিষ্কে তার নখ বসিয়ে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার ঝকঝকে রঙিন জীবন বর্ণহীন আর ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জীবন যেন অ-সুখ আর অ-সুন্দরে ভরে উঠল। আমি আমার নদীকে হারিয়ে ফেললাম। কোথাও, কোনও খানেই কোনও সেতু আর আমার জন্য রইল না।”
কলকাতায় ‘কোর্ট মার্শাল’ নাটকের শো-এর শেষে যে সুন্দরী মহিলা এগিয়ে এসে দীপককে মান্ডু নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন, তিনি নাকি এক প্রথিতযশা চিকিৎসক। সে কথা জানতে পেরে খানিক অপ্রভই হয়ে যান দীপক। তিনি লক্ষ করেন, ভদ্রমহিলাকে প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করলেও তাঁর কিন্তু কোনও ভাবান্তর নেই। তিনি দীপকের সঙ্গে সাবলীল এবং সৌজন্যমূলক ব্যবহারই করে চলেছেন।
এই সময় থেকেই যেন বাস্তব আর অতি-বাস্তবের বোধ লুপ্ত হতে থাকে দীপকের মনোজগতে। মাঝেমাঝেই ‘মায়াবিনী’ হানা দেন তাঁর স্বপ্নে। কখনও একা, কখনও বা তাঁর সঙ্গে থাকে তিনটি শ্বেত চিতাবাঘ। উচ্চকিত হাসিতে দীপককে বিদ্ধ করতে থাকেন ‘মায়াবিনী’। সেই সঙ্গে আশপাশের বাতাসে দীপক যখন-তখন শুনতে পান কাদের যেন কথাবার্তার অস্পষ্ট শব্দ। ঘুম ভেঙে গেলেও রেশ রয়ে যায় ‘মায়াবিনী’র অস্তিত্বের সুবাসের।
এই অবস্থাতেও কিন্তু দীপকের লেখালেখি থেমে থাকেনি। ১৯৯৮-এ প্রকাশিত হয় ‘সবসে উদাস কবিতা’, ১৯৯৯-এ ‘কাল কোঠরি’-র মতো নাটক। ২০০৪ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান তিনি। এক অদ্ভুত সমান্তরাল জীবন যেন বয়ে চলছিলেন দীপক। এক দিকে তাঁর স্বাভাবিক লেখক সত্তা, অন্য দিকে ‘মায়াবিনী’র সঙ্গ আর তাকে ঘিরে বুনে চলা অ-সম্ভবের জগৎ। দীপক মনে করতে শুরু করেন, ‘মায়াবিনী’ যেন কোনও অজানিত রোষ থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে তাঁর উপর।
মান্ডু মধ্যপ্রদেশের এক ঐতিহাসিক শহর। ইনদওর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই শহর অসংখ্য কিংবদন্তিতে মোড়া। সুলতান বাজ বাহাদুর এবং রানি রূপমতির কিংবদন্তি অনুসারে সেই অঞ্চলকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে বিস্তর ভৌতিক কাহিনি। সেই সব গল্প থেকেই জানা যায় বাজ বাহাদুর নাকি দীপক রাগ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গাইতে পারতেন। আর রূপমতি দক্ষ ছিলেন মল্লার রাগের গায়নে। লক্ষণীয়, ‘দীপক’ নামটি। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের বিভিন্ন কিংবদন্তি বলে, দীপক রাগ যথাযথ ভাবে গাইতে পারলে নাকি গায়কের চারপাশে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়। তীব্র দহনে পুড়তে থাকেন গায়ক। তখন বর্ষার রাগ মল্লার গেয়ে সেই দহনজ্বালা প্রশমিত করতে হয়।
স্বদেশ দীপকের ক্রমাগত দেখে চলা দুঃস্বপ্ন, তাঁর বার বার অগ্নিদগ্ধ হওয়া আর মান্ডু শহরের উল্লেখ কি ছিল এক নিষ্ঠুর রূপক? ‘মায়াবিনী’ আসলে কে? এই সব প্রশ্ন বার বার ভাবিয়েছে অতিপ্রাকৃত নিয়ে চর্চারত মানুষদের। দীপকের চিকিৎসকেরা অবশ্য পুরো বিষয়টিকে মনোরোগ হিসাবেই দেখেছেন। তবু কিছু রহস্য থেকেই যায় ‘মাণ্ডু’, ‘দীপক’ আর ‘মায়াবিনী’-কে ঘিরে।
২০০৬ সালের ৭ জুন ভোরবেলায় দীপক প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি। আজ পর্যন্ত তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। উৎকণ্ঠার সঙ্গে কয়েক বছর তাঁর স্ত্রী, সন্তানেরা কাটানোর পর বুঝতে পারেন, তিনি আর ফিরে আসবেন না। সুকান্ত তাঁর লেখাটিতে জানিয়েছেন, দীপকের ফিরে না আসার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পেরে তাঁর পরিবার যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অনুমেয়, কী অপরিসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন তাঁরা।
মানসিক সমস্যার সূত্রপাত থেকে তাঁর জীবন আর অনুভবের কথা দীপককে লিখে রাখতে বলেন মনোচিকিৎসকেরা। দীপক এক আশ্চর্য আত্মকথন লেখেন, যার নাম ‘ম্যায়নে মান্ডু নেহিঁ দেখা’। মুম্বই নিবাসী লেখক, সাংবাদিক জেরি পিন্টো সেই বই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। ‘আই হ্যাভ নট সিন মান্ডু’ নামের সেই বই ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে পাঠকমহলে।
কিন্তু, কী হল দীপকের মতো এক প্রতিভাবান লেখকের? এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। বার বার আত্মহননের চেষ্টায় বিফল হয়ে কি দীপক শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বপ্নে দেখা কুয়াশাময় রেলস্টেশনের দিকেই চলে গেলেন? পৌঁছে গেলেন কি তাঁর কখনও না-দেখা মান্ডুতে? বাজ বাহাদুরের দীপক রাগের সমাপনরেখায় যেখানে মল্লার রাগে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন রানি রূপমতি, যেখানে দীপকের পাশে বসে সেই অতিপ্রাকৃত সঙ্গীতে ডুব দিচ্ছেন তাঁর ‘মায়াবিনী’ও? উত্তর মেলে না এ সব প্রশ্নের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy