Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
I Have Not Seen Mandu

‘মায়াবিনী’র ডাকে ধ্বস্ত জীবন, নিখোঁজ হন এক দিন! রহস্য গল্পকেও হার মানায় বিখ্যাত লেখকের জীবন

‘মায়াবিনী’ যেন স্বদেশ দীপকের শয়নে-স্বপনে-জাগরণে হানা দিতে থাকে। দীপক আক্ষরিক অর্থেই তাঁর ‘স্বাভাবিক জীবন’ থেকে বিচ্যুত হন।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৪ ০৮:০৩
Share: Save:
০১ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

১৯৯১ সাল। ‘কোর্ট মার্শাল’ নামে একটি নাটক সারা দেশেই আলোড়ন ফেলে দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক আধিকারিকের বিরুদ্ধে এক সহকর্মীকে হত্যার অভিযোগ এবং তার কোর্ট মার্শাল নিয়ে রুদ্ধশ্বাস এই নাটক পরে চলচ্চিত্রায়িতও হয়। নাট্যকার স্বদেশ দীপকও শিরোনামে উঠে আসেন।

০২ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

স্বদেশ দীপক (জন্ম ১৯৪৩) কিন্তু তত দিনে হিন্দি সাহিত্য জগতে বেশ পরিচিত নাম। নাটকের সমান্তরালে লিখে চলেছেন ছোটগল্প, উপন্যাসও। যুক্তিনিষ্ঠ মানুষ হিসাবে সুনামও সে সময় তাঁর যথেষ্ট। কিন্তু ওই ১৯৯১ সালেই স্বদেশ দীপকের জীবন আমূল বদলে যায় এক আশ্চর্য ঘটনায়।

০৩ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

সেই ঘটনার কথা স্বদেশ সবিস্তার লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথা ‘ম্যায়নে মান্ডু নেহিঁ দেখা’-তে। তাঁর স্মৃতিকথার একেবারে গোড়াতেই স্বদেশ লিখেছেন, কলকাতায় ‘কোর্ট মার্শাল’-এর প্রথম অভিনয়ের দিনে তাঁর সঙ্গে এক সুন্দরী মহিলা আলাপ করেন। তিনি স্বদেশকে বলেন, তিনি কখনও মান্ডু যাননি। স্বদেশ কি তাঁর সঙ্গে মান্ডু যাবেন?

০৪ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

ঘটনার আকস্মিকতায় স্বদেশ প্রথমে হকচকিয়ে যান। কোনও ভদ্রমহিলা একজন পুরুষকে প্রথম আলাপেই এমন প্রস্তাব দিতে পারেন, তা তাঁর কল্পনার বাইরে। মহিলার এ হেন প্রস্তাবে রেগে গিয়ে তাঁকে ভর্ৎসনা করেন স্বদেশ। কিন্তু, ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি।

০৫ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

স্বদেশ সেই মহিলাকে তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন ‘মায়াবিনী’ হিসাবে। আত্মকথার ভূমিকার গোড়াতেই তিনি লিখছেন, “মায়াবিনী আমার মস্তিষ্কে তার নখ বসিয়ে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার ঝকঝকে রঙিন জীবন বর্ণহীন আর ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জীবন যেন অ-সুখ আর অ-সুন্দরে ভরে উঠল। আমি আমার নদীকে হারিয়ে ফেললাম। কোথাও, কোনও খানেই কোনও সেতু আর আমার জন্য রইল না।”

০৬ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

সেই শুরু। তার পর থেকে এই ‘মায়াবিনী’ যেন স্বদেশ দীপকের শয়নে-স্বপনে-জাগরণে হানা দিতে থাকে। দীপক আক্ষরিক অর্থেই তাঁর ‘স্বাভাবিক জীবন’ থেকে বিচ্যুত হন।

০৭ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

সেই সময় দীপক এমন এক মানসিক অবস্থার মধ্যে চলে যান যে, কিছুই আর তাঁর বশে ছিল না। এই পর্যায়েই তিনি প্রথম আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। দীপক পরে লিখেছিলেন, মনের ভিতর থেকে অবরোধ জারি হলে আগুনের আঁচও টের পাওয়া যায় না। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং তিনি সেই সময় থেকেই তাঁর স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেন।

০৮ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

কলকাতায় ‘কোর্ট মার্শাল’ নাটকের শো-এর শেষে যে সুন্দরী মহিলা এগিয়ে এসে দীপককে মান্ডু নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন, তিনি নাকি এক প্রথিতযশা চিকিৎসক। সে কথা জানতে পেরে খানিক অপ্রভই হয়ে যান দীপক। তিনি লক্ষ করেন, ভদ্রমহিলাকে প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করলেও তাঁর কিন্তু কোনও ভাবান্তর নেই। তিনি দীপকের সঙ্গে সাবলীল এবং সৌজন্যমূলক ব্যবহারই করে চলেছেন।

০৯ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

ভদ্রমহিলার মধুর ব্যবহার দীপককে যেন ক্রমশ গ্রাস করে নিতে শুরু করে। তিনি মহিলাকে ‘মায়াবিনী’ নামেই উল্লেখ করেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। দীপক যেন ক্রমশ ডুবে যেতে থাকেন সেই মহিলার কুহকময় আচরণে। দীপক নিজেই বুঝতে পারেন, ‘স্বাভাবিক’-এর পৃথিবী থেকে ক্রমেই তিনি বিচ্যুত হচ্ছেন।

১০ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

এই সময় থেকেই যেন বাস্তব আর অতি-বাস্তবের বোধ লুপ্ত হতে থাকে দীপকের মনোজগতে। মাঝেমাঝেই ‘মায়াবিনী’ হানা দেন তাঁর স্বপ্নে। কখনও একা, কখনও বা তাঁর সঙ্গে থাকে তিনটি শ্বেত চিতাবাঘ। উচ্চকিত হাসিতে দীপককে বিদ্ধ করতে থাকেন ‘মায়াবিনী’। সেই সঙ্গে আশপাশের বাতাসে দীপক যখন-তখন শুনতে পান কাদের যেন কথাবার্তার অস্পষ্ট শব্দ। ঘুম ভেঙে গেলেও রেশ রয়ে যায় ‘মায়াবিনী’র অস্তিত্বের সুবাসের।

১১ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে বহন করে চলা এক সময় অসম্ভব বলে মনে হতে থাকে। গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন দীপক। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বেঁচে যান দীপক। পরে আবার আত্মহননের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে বারও নিজেকে শেষ করতে পারেননি তিনি।

১২ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

এই অবস্থাতেও কিন্তু দীপকের লেখালেখি থেমে থাকেনি। ১৯৯৮-এ প্রকাশিত হয় ‘সবসে উদাস কবিতা’, ১৯৯৯-এ ‘কাল কোঠরি’-র মতো নাটক। ২০০৪ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান তিনি। এক অদ্ভুত সমান্তরাল জীবন যেন বয়ে চলছিলেন দীপক। এক দিকে তাঁর স্বাভাবিক লেখক সত্তা, অন্য দিকে ‘মায়াবিনী’র সঙ্গ আর তাকে ঘিরে বুনে চলা অ-সম্ভবের জগৎ। দীপক মনে করতে শুরু করেন, ‘মায়াবিনী’ যেন কোনও অজানিত রোষ থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে তাঁর উপর।

১৩ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

মনোচিকিৎসকেরা দীপকের এই অবস্থাকে ‘বাইপোলার ডিজ়অর্ডার’ হিসাবে চিহ্নিত করেন। মাঝেমাঝেই দীপক হিংস্র হয়ে উঠতেন। আক্রমণ করে বসতেন কাছের মানুষদেরও। দীপকের ছেলে সুকান্ত পরে এক স্মৃতিচারণে জানান, মাঝরাতে তাঁর বাবা তাঁকে আক্রমণ করতে পারেন, এই ভেবে বালিশের তলায় একটি লোহার রড রেখে ঘুমোতেন।

১৪ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

পরিবারের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছিলেন দীপক। তাঁর ছেলে সুকান্ত পরে ‘পাপা, এল্‌সহোয়্যার’ নামে এক রচনায় সে সব ভয়ঙ্কর দিনগুলির কথা লিখেছেন। সুকান্তের লেখাটি থেকে জানা যায়, তাঁর মা এবং বোন সর্বদা সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাতেন। দীপক কখন কী করে বসেন, তা নিয়ে আতঙ্কে থাকতেন।

১৫ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

হাসপাতালে থাকাকালীন দীপক তাঁর চিকিৎসকদের জানিয়েছিলেন, তিনি ক্রমাগত দুঃস্বপ্ন দেখে চলেছেন। স্বপ্নে দীপক দেখতেন এক লম্বা ট্রেনযাত্রায় রয়েছেন তিনি। কুয়াশাময় এক অজ্ঞাত স্টেশনে তাঁকে নামতে হচ্ছে। ‘মায়াবিনী’র প্রভাবেই যেন এই সমস্ত কিছু হচ্ছে। ‘মান্ডু’ যেন তাঁকে সর্বদা তাড়া করে ফিরছে।

১৬ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

মান্ডু মধ্যপ্রদেশের এক ঐতিহাসিক শহর। ইনদওর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই শহর অসংখ্য কিংবদন্তিতে মোড়া। সুলতান বাজ বাহাদুর এবং রানি রূপমতির কিংবদন্তি অনুসারে সেই অঞ্চলকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে বিস্তর ভৌতিক কাহিনি। সেই সব গল্প থেকেই জানা যায় বাজ বাহাদুর নাকি দীপক রাগ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গাইতে পারতেন। আর রূপমতি দক্ষ ছিলেন মল্লার রাগের গায়নে। লক্ষণীয়, ‘দীপক’ নামটি। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের বিভিন্ন কিংবদন্তি বলে, দীপক রাগ যথাযথ ভাবে গাইতে পারলে নাকি গায়কের চারপাশে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়। তীব্র দহনে পুড়তে থাকেন গায়ক। তখন বর্ষার রাগ মল্লার গেয়ে সেই দহনজ্বালা প্রশমিত করতে হয়।

১৭ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

স্বদেশ দীপকের ক্রমাগত দেখে চলা দুঃস্বপ্ন, তাঁর বার বার অগ্নিদগ্ধ হওয়া আর মান্ডু শহরের উল্লেখ কি ছিল এক নিষ্ঠুর রূপক? ‘মায়াবিনী’ আসলে কে? এই সব প্রশ্ন বার বার ভাবিয়েছে অতিপ্রাকৃত নিয়ে চর্চারত মানুষদের। দীপকের চিকিৎসকেরা অবশ্য পুরো বিষয়টিকে মনোরোগ হিসাবেই দেখেছেন। তবু কিছু রহস্য থেকেই যায় ‘মাণ্ডু’, ‘দীপক’ আর ‘মায়াবিনী’-কে ঘিরে।

১৮ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

২০০৬ সালের ৭ জুন ভোরবেলায় দীপক প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি। আজ পর্যন্ত তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। উৎকণ্ঠার সঙ্গে কয়েক বছর তাঁর স্ত্রী, সন্তানেরা কাটানোর পর বুঝতে পারেন, তিনি আর ফিরে আসবেন না। সুকান্ত তাঁর লেখাটিতে জানিয়েছেন, দীপকের ফিরে না আসার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পেরে তাঁর পরিবার যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অনুমেয়, কী অপরিসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন তাঁরা।

১৯ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

মানসিক সমস্যার সূত্রপাত থেকে তাঁর জীবন আর অনুভবের কথা দীপককে লিখে রাখতে বলেন মনোচিকিৎসকেরা। দীপক এক আশ্চর্য আত্মকথন লেখেন, যার নাম ‘ম্যায়নে মান্ডু নেহিঁ দেখা’। মুম্বই নিবাসী লেখক, সাংবাদিক জেরি পিন্টো সেই বই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। ‘আই হ্যাভ নট সিন মান্ডু’ নামের সেই বই ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে পাঠকমহলে।

২০ ২০
The mysterious life of Indian playwright and novelist Swadesh Deepak

কিন্তু, কী হল দীপকের মতো এক প্রতিভাবান লেখকের? এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। বার বার আত্মহননের চেষ্টায় বিফল হয়ে কি দীপক শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বপ্নে দেখা কুয়াশাময় রেলস্টেশনের দিকেই চলে গেলেন? পৌঁছে গেলেন কি তাঁর কখনও না-দেখা মান্ডুতে? বাজ বাহাদুরের দীপক রাগের সমাপনরেখায় যেখানে মল্লার রাগে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন রানি রূপমতি, যেখানে দীপকের পাশে বসে সেই অতিপ্রাকৃত সঙ্গীতে ডুব দিচ্ছেন তাঁর ‘মায়াবিনী’ও? উত্তর মেলে না এ সব প্রশ্নের।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE