The history of evidence photography and Amherst street murder which initiated detective department of Calcutta dgtl
Amherst street murder
গ্যাসবাতির টিমটিমে আলোয় মহিলার দেহ, কলকাতার যে ঘটনা বদলে দিয়েছিল দেশের পুলিশি তদন্তের ইতিহাস
ডিটেকটিভ অ্যান্ড রিজ়ার্ভ ফোর্সেসের তদানীন্তন সুপারিন্টেন্ডেন্ট রিচার্ড রিড তাঁর বই ‘এভরি ম্যান হিজ় ওন ডিটেকটিভ’-এ ১৮৮৭ সালে এই ঘটনার সানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে যান।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৪ ১১:৫৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৬
১৮৬৮ সালের ১ এপ্রিল। রাত ২টো নাগাদ এক পুলিশ কনস্টেবল আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে তাঁর প্রথম দফার টহল শেষ করে দ্বিতীয় দফায় বেরিয়েছেন। প্রথম দফার টহলে অস্বাভাবিক কিছু তাঁর নজরে পড়েনি। কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদে দ্বিতীয় টহল দেওয়ার সময় বড় রাস্তার ধারে একটা কাপড়চোপড়ের স্তূপ দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। কলকাতার রাস্তায় তখন সদ্য গ্যাসের বাতি লাগানো হয়েছে। সেই আলোয় ঠাহর করে সেই কনস্টেবল বুঝতে পারেন, যেটিকে তাঁর একটি কাপড়ের স্তূপ বলে মনে হচ্ছল, তা আদতে একটি মৃতদেহ। মহিলার মৃতদেহ।
০২১৬
কনস্টেবল দেহটির কাছে গিয়ে দেখেন, মহিলার গলায় গভীর ক্ষত। সেখান থেকে তখনও রক্তপাত হচ্ছে। আর মহিলার মাথার বাম দিকে পড়ে রয়েছে একটা ধারালো ছুরি। সেই ছুরিটিতেও রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। নিহত মহিলাকে দেখে কনস্টেবল বুঝতে পারেন, ছুরিটি গলায় বসিয়েই হত্যা করা হয়েছে।
০৩১৬
মহিলার দেহটি পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায়, তিনি ‘ইউরেশীয়’ বংশোদ্ভূত। তাঁর পরনে শাড়ি এবং তাতেও রক্তের দাগ। মহিলার পায়ে কোনও জুতো ছিল না। কিন্তু তাঁর পায়ের পাতা দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি জুতো পরতে অভ্যস্ত। মৃতদেহের আশপাশে কোথাও অবশ্য জুতো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ছবি: দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের সৌজন্যে।
০৪১৬
কনস্টেবল বুঝতে পারেন, এই হত্যা রহস্যময়। এবং এর সমাধানের জন্য উপর মহলের কোনও গোয়েন্দার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। অন্য এক কনস্টেবলকে পাহারায় রেখে তিনি আর্মহার্স্ট স্ট্রিট থানায় যান এবং সেখান থেকে জনৈক ইনস্পেক্টরকে নিয়ে ফিরে আসেন। ইনস্পেক্টর মাটিতে রক্তমাখা আঙুলের ছাপ দেখে অনুমান করেন যে, হত্যার সময় আক্রমণকারীর সঙ্গে মহিলার ধস্তাধস্তি হয়েছিল। মহিলার শরীর থেকেই একটি রুমাল উদ্ধার করা হয়। রুমালটির একটি কোণ এমন ভাবে পেঁচানো ছিল যেন তাতে কোনও চাবি বাঁধা ছিল। কিন্তু, মৃতদেহের আশপাশে কোনও চাবি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
০৫১৬
মৃতদেহকে ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায়, তাঁর দু’কানে সোনার দুল এবং আঙুলে বিয়ের আংটি রয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, মহিলা দেশীয় খ্রিস্টান এবং বিবাহিতা। তাঁর গলায় প্রবালের একটি নেকলেসও ছিল। গলায় ছুরি বসানোর সময় সেটি ছিঁড়ে যায়।
০৬১৬
মৃতদেহ আবিষ্কারের প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পরে সকাল ৭টা নাগাদ মৃতদেহটি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চার দিন রাখার পরেও দেহটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে দেহটিতে পচন ধরতে শুরু করায় তা সমাহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
০৭১৬
ডিটেকটিভ অ্যান্ড রিজ়ার্ভ ফোর্সেসের তদানীন্তন সুপারিন্টেন্ডেন্ট রিচার্ড রিড তাঁর বই ‘এভরি ম্যান হিজ় ওন ডিটেকটিভ’-এ ১৮৮৭ সালে এই ঘটনার সানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে যান। ‘আর্মহার্স্ট স্ট্রিট হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত এই ঘটনা ভারতের পুলিশ-প্রশাসনের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হতে শুরু করে। কলকাতা-সহ ভারতের অন্য বড় শহরগুলির সংবাদপত্রে এই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রকাশিত হয়। শুধুমাত্র হত্যারহস্যের কারণে নয়, এই ঘটনা ভারতের তদন্ত প্রক্রিয়ার ইতিহাসেও অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে পরিগণিত। কারণ, এই তদন্তে যে ভাবে মেডিক্যাল এবং ফরেন্সিক পদ্ধতি অনুসৃত হয়, তেমনটি আগে কখনও হয়নি।
ছবি: দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের সৌজন্যে।
০৮১৬
মৃতদেহটি কবর দেওয়ার আগে বেশ কিছু ছবি তোলা হয়। এই কাজটি সম্পন্ন হয় তৎকালীন সিটি করোনার জন ব্লেসিংটন রবার্টসের তত্ত্বাবধানে। ছবিগুলি তোলে মেসার্স স্যাশে অ্যান্ড ওয়েস্টফিল্ড নামে সেই সময়ের এক ফোটোগ্রফিক স্টুডিয়ো। মৃতার পরিচয় জানার জন্য ছবিগুলির প্রতিলিপি শহর এবং মফস্সলের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। উল্লেখ্য, ভারতের অপরাধ তদন্তের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম ‘এভিডেন্স ফোটোগ্রফি’র ব্যবহার।
০৯১৬
রিচার্ড রিডকেই এই হত্যার তদন্তের ভার দেওয়া হয়। তিনি তখন বছর তিরিশেকের যুবক। পুলিশ মহলে এই ঘটনা আত্মহত্যা, না কি খুন— এ নিয়ে খানিক চপানউতর চলছিল। কিন্তু, নিহতের গলার ক্ষতচিহ পরীক্ষা করে রিড নিশ্চিত ভাবে জানান, মহিলাকে হত্যাই করা হয়েছে।
১০১৬
শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে নিহত মহিলার ছবি ছড়িয়ে পড়ার সুফল পাওয়া গেল অচিরেই। মিস্টার হ্যারিস নামে জনৈক ব্যক্তি পুলিশের কাছে গিয়ে জানালেন, নিহত মহিলার নাম রোজ় ব্রাউন। হ্যারিসের বাড়ি ১০০ নং বৈঠকখানা লেনে। সেখানে রোজ় তাঁর ভাড়াটে হিসাবে বাস করতেন। এই সুত্র ধরে তদন্ত এগোতেই জানা গেল, মাধবচন্দ্র দত্ত নামে বৌবাজার নিবাসী এক ব্যবসায়ী রোজ়ের কাছে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। অভিযোগের তির মাধবের দিকেই ইঙ্গিত করায় তাঁকে দ্রুত গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু, এর পরেও বড় চমক অপেক্ষা করেছিল।
১১১৬
প্রয়াত মহিলার জিনিসপত্র অনুসন্ধান করতে গিয়ে কিংসলে নামে এক ব্যক্তির ফোটোগ্রাফ আবিষ্কৃত হয়। এই কিংসলে খুব সুবিধার লোক ছিলেন না। অন্তত পুলিশ সে রকমই মনে করত। জানা যায়, কিংসলের হাওড়ার বাড়িতে রোজ় এক সময় বাস করতেন এবং রোজ়ের সঙ্গে কিংসলের কোনও সম্পর্ক ছিল। তাঁর সঙ্গে বনিবনা না হওয়াতেই রোজ় বৈঠকখানা লেনের বাসায় চলে আসেন এবং কিংসলে তাঁকে হত্যা করতে পারেন, এমন সন্দেহও পোষণ করতে থাকেন। কিংসলের বাড়ি থেকে রোজ় ব্রাউনের বেশ কিছু পোশাক-আশাক উদ্ধার হয়। মাধবচন্দ্রকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু, কিংসলে তত দিনে পলাতক। রিড যখন অবসর নিয়ে তাঁর বইটি লেখেন, তিনি রোজ় ব্রাউনের হত্যকারীর নামটি উহ্য রাখেন। এ-ও এক বড় রহস্য!
১২১৬
শহর কলকাতায় তখন হত্যা, বিশেষ করে নারীহত্যার ঘটনা বিরল কিছু ছিল না। হিন্দু বিধবা মহিলাদের কুপথে নিয়ে যাওয়া এবং হাতুড়ে পদ্ধতিতে গর্ভপাত করতে গিয়ে মৃত্যু তো ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ তাঁর ‘চন্দ্রা’জ় ডেথ’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে ১৮৪৯ সালে বাংলার গ্রামাঞ্চলে সংঘটিত এক গর্ভপাত এবং তা থেকে চন্দ্রা নামে এক যুবতী বিধবার মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেছিলেন। সেখানে গুহ আদালতের একরারনামার কিছু ছিন্নবিচ্ছিন্ন অংশকে তাঁর সূত্র হিসাবে ব্যবহার করেন এবং দেখান, ভারতে সে সময়ে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রশাসন, বা বলা ভাল পুলিশ-প্রশাসন তথা আইনের শাসন সে অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
১৩১৬
কিন্তু, রোজ় ব্রাউন গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন না। আর তত দিনে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। খাস শহর কলকাতার বুকে এক থানার প্রায় দোরগোড়ায় এমন হত্যাকাণ্ড শহরবাসীর মধ্যে বিপুল আলোড়ন ফেলে। সম্প্রতি দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘হ্যারি হবস অফ কলকাতা অ্যান্ড আদার ফরগটেন লাইভস’ গ্রন্থে রিচার্ড রিড সম্পর্কে এক নিবন্ধে দেখিয়েছেন, শুধু রোজ় ব্রাউন হত্যাকাণ্ড নয়, সমসময়ে আরও বেশ কিছু হত্যাকাণ্ড প্রশাসনের টনক নাড়ায়।
১৪১৬
জানা যাচ্ছে, আমহার্স্ট স্ট্রিট হত্যাকাণ্ডের বছরেই কলকাতায় আরও ৫ জন মহিলা নিহত হন। তাঁদের মধ্যে তিন জন যৌনকর্মী। এই হত্যাকাণ্ডগুলি শহরের তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগকে বেকায়দায় ফেলে। হগ অনুভব করেন, নগরায়নের সমান্তরালে জটিল অপরাধও বৃদ্ধি পাবে কলকাতায়। সেই সব অপরাধের সমাধান সাধারণ পুলিশ বিভাগের পক্ষে সব সময়ে সম্ভব না-ও হতে পারে। এই ভাবনা থেকেই হগ ১৮৬৮-এর নভেম্বরে কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট বা গোয়েন্দা বিভাগ তৈরি করেন।
১৫১৬
পরবর্তী কালে রোজ় ব্রাউনের হত্যাকাণ্ড ফরেন্সিক তদন্তের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে ফোটোগ্রাফির ব্যবহারের কারণে। মৃতদেহ পচন ধরে বিকৃত হয়ে যাওয়ার আগেই বিভিন্ন কোণ থেকে তার ছবি তুলে রাখার বিষয়টি ভারতে ফরেন্সিক তদন্তের প্রথম পদক্ষেপ বলেই ধরা হয়।
১৬১৬
এক সময় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে ব্রিটেনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হত। আজও এই বিভাগ বিশেষ ভাবে সক্রিয়। তবে এর সূত্রপাতের নেপথ্যে রোজ় ব্রাউন নাম্নী জনৈকার অস্তিত্ব এখন নেহাতই বিস্মৃতির অতলে। অজানা তাঁর হত্যাকারীর পরিচয়ও।